কসবা ল’ কলেজের গণধর্ষণের ঘটনা বাঙ্গালির কলঙ্ক
আনন্দ মোহন দাস
দেখা গেছে সমাজে যখন মাতৃজাতির উপর অত্যাচার ও অনাচার বাড়তে থাকে তখনই তার পতন ঘটে। মহাভারত ও রামায়ণের যুগেও দ্রৌপদী ও সীতার অপমানের পরিণামের কথা সকলেরই জানা আছে। এর ফলে রাবণবংশ ও কৌরবকুল ধ্বংস হয়েছিল। সেই দিকেই কি পশ্চিমবঙ্গ এগিয়ে চলেছে? রাজ্যে একের পর এক ধর্ষণের ঘটনা ঘটে চলেছে। কারণ রাজ্যে লাগামছাড়া প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলার অবনতির জন্য অপরাধীরা নারীধর্ষণ ও যৌন নির্যাতনের মতো জঘন্য ও নারকীয় ঘটনা ঘটাবার সাহস করছে। সম্প্রতি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কসবা ‘ল’ কলেজ ক্যাম্পাসে শাসকদলের মদতপুষ্ট ছাত্র নেতাদের দ্বারা ছাত্রীকে গণধর্ষণ বাঙ্গালি সমাজের কলঙ্ক। এমনকী ধর্ষিতাকে ব্ল্যাকমেল করার জন্য একজন অভিযুক্ত ধর্ষণের ভিডিয়ো পর্যন্ত করেছে। কত বড়ো দুঃসাহস থাকলে এই ধরনের নোংরা কাজ এরা করতে পারে! অভিযুক্ত ছাত্র নাকি বলছিল, ইউনিয়নের পদ পেতে গেলে কম্প্রোমাইজ করতে হবে, তার প্রতি লয়্যাল থাকতে হবে। কলেজের সম্পাদক পদের জন্য যদি ধর্ষণের শিকার হতে হয়, তাহলে নারী সম্মান কোথায় নেমেছে এই রাজ্যে? কলেজে ছাত্রীদের নিরাপত্তা কোথায়? মুখ্যমন্ত্রী নিজে একজন নারী ও পুলিশ মন্ত্রী হয়ে নারী সুরক্ষার জন্য দায়ী নয় কি? নারী শিক্ষা ও সুরক্ষা সরকারের মৌলিক কর্তব্য নয় কি? দশমাস আগেও এই রাজ্যে আরজি কর মেডিক্যাল কলেজের ছাত্রীকে ধর্ষণ করে খুন করার ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটেছে, যা সারা বিশ্বে লজ্জায় বাঙ্গালির মাথা হেঁটে হয়েছে। তারপরও খোদ রাজধানী কলকাতা শহরের বুকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আবার গণধর্ষণের ঘটনা ঘটে গেল।
কসবা ল’ কলেজের ঘটনায় অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে শাসকদলের সঙ্গে যোগ থাকার কথাও সংবাদপত্রে এসেছে। এর ফলে কলেজে এদের দাদাগিরি চলতো। ইতিপূর্বে অভিযুক্ত মনোজিৎ মিশ্রের নামে বিভিন্ন থানায় মোট ১১টি ফৌজদারি মামলা রয়েছে এবং এর মধ্যে ৪টি শ্লীলতাহানির মামলাও রয়েছে। মামলাগুলির নিষ্পত্তি হলো কিনা বা শাস্তি হলো কিনা সবকিছুই অজানা। কিন্তু ভাবতে আশ্চর্য লাগে, যার বিরুদ্ধে এতো ফৌজদারি মামলা, দল তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়নি কেন?
এমনকী মনোজিতের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে, পিকনিকে গিয়ে কলেজের ছাত্রীদের শ্লীলতাহানি করাও তার অভ্যাসে ছিল। এই মনোজিৎ মিশ্র গ্যাঙের ভয়ে ছাত্রীরা সর্বদা আতঙ্কে থাকতো। প্রশ্ন ওঠে, এত অভিযোগের পরেও সে কীভাবে এই কলেজে চাকরি পায়। তাহলে কি শাসকদলের কৃপাদৃষ্টি রয়েছে?
জানা গেছে, কলেজে বছরে ১০-১৫টি আসনে ভর্তির জন্য নাকি অভিযুক্ত মনোজিৎ মিশ্রের কোটা রয়েছে এবং পিছনের দরজা দিয়ে ভর্তির জন্য মাথাপিছু ৫০ হাজার থেকে ৩ লক্ষ টাকা পর্যন্ত নতুন ছাত্র-ছাত্রীদের কাছ থেকে সে নিত। এর ফলে সে বছরে সর্বনিম্ন ৭.৫০ লক্ষ টাকা এবং সর্বোচ্চ ৪৫ লক্ষ টাকা পর্যন্ত আয় করতো। এই অর্থবলই নাকি তার পাশবিক শক্তির আস্ফালনের রসদ।
সাধারণত আইন কলেজে ভর্তির জন্য পরীক্ষায় ৫০০-এর মধ্যে র্যাঙ্ক করলেও মনোজিৎ মিশ্রের মাধ্যমে টাকার বিনিময়ে ভর্তি হওয়া সম্ভব হতো। শাসকদলের মদত ছাড়া সে এই ধরনের বেআইনি কাজ করার ছাড়পত্র পায় কী করে? শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গত কয়েক মাসের ব্যবধানে দুটি নারী ধর্ষণের ঘটনা ঘটে গেল। এছাড়াও রাজ্যের বিভিন্ন দিকে নারী ধর্ষণের ঘটনা ক্রমাগত বেড়ে চলেছে। অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হলে এবং শাসকদলের সঙ্গে যোগ থাকলে দুষ্কৃতকারীরা বহাল তবিয়তে ঘুরতে থাকে। এদের সাহস ক্রমশ বাড়তে থাকে এবং পুলিশ তাদের অঙ্গুলিহেলনে চলবে এই বিশ্বাস জন্মাতে থাকে।
রাজ্যে দীর্ঘদিন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে নির্বাচন হয়নি। এখানে শেষ নির্বাচন হয়েছিল ২০১৭ সালে। কাগজে কলমে ইউনিয়ন না থাকলেও পিছনের দরজা দিয়ে শাসকদলের মদতপুষ্ট ছাত্রনেতারা বকলমে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে ইউনিয়নের ক্ষমতা অবৈধভাবে দখল করে রেখেছে। এমনকী প্রাক্তন ছাত্ররাও কলেজে শাসকের মদতে দাদাগিরি বজায় রেখেছে। কসবা কলেজে অভিযুক্ত মনোজিৎ মিশ্র ২০২২ সালে পাশ করে গেছে। এর পরেও কলেজে তার মাতব্বরি বজায় রেখেছে। তার ফলে কলেজ প্রশাসন স্বাধীনভাবে কলেজ চালাতে পারেন না এবং বিনা বাধায় ক্যাম্পাসের মধ্যে অবৈধ কাজকর্মের রমরমা চলে। শাসকদলের হুমকিতে অন্যান্য ছাত্র ইউনিয়নগুলির কলেজে সংগঠন করার অধিকার না থাকায় শাসকদলের ছাত্র ইউনিয়নের একচেটিয়া আধিপত্য বজায় থাকে। এর ফলে ছাত্রীদের নিরাপত্তা ও সম্ভ্রম নিয়ে এরা ছেলেখেলা করে। রাজ্যের কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে নারী সুরক্ষা প্রায় নেই বললেই চলে। কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে অসামাজিক কাজের আখড়া করে রেখেছে। সেজন্য প্রায়শঃ অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নারী লাঞ্ছনা, যৌন নির্যাতন ও শ্লীলতাহানির ঘটনা ঘটতে থাকে। অনেক জায়গায় এই ধরনের যৌন নির্যাতন ও ধর্ষণের ঘটনা ঘটলেও তা প্রকাশ্যে আসে না। এর আগেও নাকি এই কলেজে শারীরিক শোষণ হয়েছে। অনেক মেয়েরা লোকলজ্জায় সামনে আসতে পারেন না। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ও এই ধরনের অপসংস্কৃতির কবলে পড়েছে।
যে পশ্চিমবঙ্গ শিক্ষায় দেশকে পথ দেখাত, তার আজ এই অবস্থা। যে বঙ্গে এক সময় শিক্ষা, সংস্কৃতি ও নারী প্রগতিতে দেশকে এগিয়ে রাখত, সেখানে আজ আরজি কর ও কসবার কলেজের মতো ঘটনা ঘটছে। শাসকদলের ভয়েই কি বাঙ্গালি বিদ্বৎ সমাজ আজ প্রতিবাদ বিমুখ হয়েছে? কিন্তু ভাবতে
অবাক লাগে, শাসকদলের সঙ্গে এরাই উন্নাও, হাথরসের ঘটনার প্রতিবাদে রাস্তায় নেমেছে। তাহলে এ ক্ষেত্রে চুপ কেন?
স্বাভাবিকভাবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গণধর্ষণের ফলে অভিভাবকরা নিজেদের মেয়েকে কলেজে পাঠাতে দ্বিধাবোধ করবেন। মেয়েদের নিরাপত্তা ও সুরক্ষা নিয়ে চিন্তিত থাকবেন। তাই সুশীল সমাজকে এই অনাচারের বিরুদ্ধে এগিয়ে আসতে হবে। শাসক দলের মদতপুষ্ট কিছু ছাত্রের কুকাজের বিরুদ্ধে ছাত্র সমাজকে গর্জে উঠতে হবে। নতুবা রাজ্যে নারী শিক্ষা রসাতলে যাবে। এত ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটার পরেও শাসকদলের কিছু নেতা কথাবার্তায় নারী বিদ্বেষী আচরণ করছেন। সুতরাং নারীদের প্রতি কী ধরনের দৃষ্টিভঙ্গী তা শাসকদলের নেতাদের আচরণেই বোঝা যাচ্ছে।
পশ্চিমবঙ্গের নারীরা আজ অসহায়।শাসকদলের মদতপুষ্ট দুষ্কৃতীরা নারীজাতির উপর নিরন্তর অত্যাচার চালিয়ে যাচ্ছে। এরাই নির্বাচনে শাসকদলের পক্ষে ভোট লুঠের কারিগর। সেজন্য এদের অপরাধমূলক কাজের শাস্তি হয় না। অনেক সময় এদের বিরুদ্ধে পুলিশ এফআইআর পর্যন্ত নেওয়ার সাহস করে না। সেই কারণে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছাড়াও রাজ্যে এই ধরনের অবাঞ্ছিত ঘটনা প্রতিনিয়ত ঘটে চলেছে। ইতিমধ্যে সামনে এসেছে সন্দেশখালির শেখ শাজাহানের মতো শাসকদলের নেতারা পিঠে বানাবার নাম করে রাতের বেলায় পার্টি অফিসে মা-বোনেদের তুলে নিয়ে গিয়ে যৌনশোষণ করে। জেলায় জেলায় শাসকদলের অনেক শেখ শাজাহান রয়েছে, যারা এই ধরনের কুকাজে অভ্যস্ত। প্রত্যেকদিন সংবাদপত্রের পাতায় রাজ্যে নারী ধর্ষণ ও নির্যাতনের সংবাদ রয়েছে এবং নারীদের সুরক্ষা তলানিতে ঠেকেছে। এখানেই কামদুনি, পার্ক স্ট্রিট, ক্যানিং, কালিয়াচকের মতো ঘটনা ঘটেছে। বামেদের ৩৪ বছর রাজত্বেও এই ধরনের ঘটনা অনেক ঘটেছে। সিপিএমের আমলে বানতলার মতো জঘন্য নারকীয় ঘটনার উদাহরণ রয়েছে। বামেরা এই রাজ্যে রক্তবীজের চাষ করে গেছে। মমতা ব্যানার্জি তাকে লালনপালন করে বড়ো করে তুলছেন। বাঙ্গালির সম্মানটুকু আজ সারা দেশে ভূলুণ্ঠিত হয়েছে।
ভারতীয় সংস্কৃতিতে নারী সমাজের একটি সম্মানজনক ও মর্যাদাপূর্ণ স্থান রয়েছে। শাস্ত্র বলছে, ‘মাতৃবৎ পরদারেষু’ অর্থাৎ অন্যের স্ত্রীকে আমরা মায়ের মতো দেখি। নারীকে আমরা দেবীরূপে কল্পনা করি। নারীজাতির প্রতি এটাই আমাদের দৃষ্টিভঙ্গী। হিন্দু বিরোধী শক্তি সেই সংস্কৃতিকে ধ্বংস করার চক্রান্ত করে চলেছে। সেই কারণে এই রাজ্যে নারী শক্তির প্রতি পাশবিক অত্যাচার বেড়ে চলেছে। নারীর সম্মান রক্ষা করতে না পারলে সমাজ ধ্বংস হবে এবং দানবীয় শক্তির প্রকোপ বৃদ্ধি পাবে। তাই এই ধরনের নারকীয় ঘটনার বিরুদ্ধে সমস্ত শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের ঐক্যবদ্ধ প্রতিবাদের প্রয়োজন রয়েছে।□

















