বঙ্গের বাইরেও মহাসমারোহে বাঙ্গালির দুর্গাপূজা
দুর্গাপদ ঘোষ
কিছু কিছু কথা আছে যা প্রবাদের মতো। যেমন ‘যেখানে বাঙ্গালি থাকবে সেখানেই পূজা।’ হিন্দু বাঙ্গালির ‘পূজা’ মানে শারদীয়া দুর্গাপূজা। পশ্চিমবঙ্গের কথা তো আলাদা করে বলার কিছু নেই। এখানে এই পূজার সংখ্যা অগুনতি। ২০২৪ সালে কেবল নথিভুক্ত বারোয়ারি পূজা হয়েছে প্রায় ৪৩ হাজার। তার মধ্যে কলকাতা ও সংলগ্ন এলাকায় ছিল ১৫ হাজারের মতো। সারা বিশ্বে মোট ২০৬টা দেশ আছে। তার মধ্যে হাতে গোনা কয়েকটা দেশের কথা বাদ দিলে
দুর্গাপূজা নিয়ে হিন্দু বাঙ্গালির আবেগের বহিঃপ্রকাশ দেখা যায় না এমন কোনো দেশ নেই। আমেরিকা থেকে জাপান, আলাস্কা থেকে অস্ট্রেলিয়া, যেখানেই বাঙ্গালি সেখানেই দুর্গাপূজা।
প্রচলিত ইতিহাস অনুযায়ী ইদানীংকালে ১৪৮০ খ্রিস্টাব্দে তাহেরপুরের রাজা কংসনারায়ণ প্রথম দুর্গাপূজা শুরু করেন। তারপর কৃষ্ণনগরের রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের সময় থেকে এই পূজা জনপ্রিয়তা লাভ করতে শুরু করে। কিন্তু ২০২৩ সালের ২৯ অক্টোবর রাষ্ট্রসঙ্ঘের তত্ত্বাবধানে থাকা ইউনেস্কোর প্রকাশিত এক রিপোর্টে বলা হয়েছে যে ৯৯৭ সালে বিষ্ণুপুরে প্রথম পূজা করেন মল্ল রাজবংশের রাজা জগৎ মল্ল। তবে ঐতিহাসিক তথ্য যাই হোক না কেন, দুর্গাপূজার ব্যাপ্তিই এর জনপ্রিয়তার পরিচায়ক। সেই ব্যাপ্তি কেবল ভারত তথা বিশ্বজুড়েই নয়, এর সঙ্গে একাত্ম হয়েছেন অন্যান্য ভাষাভাষীরাও। তাই ‘যেখানে বাঙ্গালি সেখানেই দুর্গাপূজা’ এই অভিধা এখন অনেকটাই বদলে গেছে। তবে বাঙ্গালি থাকবে অথচ দুর্গাপূজা হবে না এটা যেন ভাবাই যায় না। কিন্তু সব জায়গার কথা এক নিবন্ধে তুলে ধরাটা খুব স্বাভাবিক ভাবেই দুরূহ। এখানে বহির্বঙ্গে কেবল যাত্রাপালাও মঞ্চস্থ করে থাকেন। ভারতের সামান্য কয়েকটা জায়গার কথা
অতি সংক্ষিপ্তাকারে তুলে ধরার চেষ্টা করা হলো। যা বিভিন্ন দিক থেকে কিছুটা ভিন্ন ও বৈশিষ্ট্যপূর্ণ।
দিল্লি
দিল্লি ভারতের রাজধানী। সারা বিশ্বের বহু রকমের মানুষ এখানে আসেন ও থাকেন। এরকম একটা অতি গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় ২,৫০০-রও বেশি বারোয়ারি
দুর্গাপূজা হয়ে থাকে। বাঙ্গালিদের সঙ্গে হাতে হাত, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এর আয়োজন করে থাকেন অবাঙ্গালিরাও। কলকাতা থেকে ভারতের রাজধানী দিল্লিতে
স্থানান্তরিত হয় ১৯১১ সালে। তার প্রায় ২৯ বছর আগে ১৮৮২ সালে যমুনা নদীর ধারে কাগাজি মহল্লায় প্রথম দুর্গাপূজা হয়। উদ্যোক্তা-আয়োজনকারীরা সকলেই ছিলেন অবাঙ্গালি। দেশের রাজধানী হবার পর বাঙ্গালিরা দিল্লিতে প্রথম পূজা করেন ১৯২২ সালে। ওই বারোয়ারি পূজার উদ্যোক্তা ছিলেন পরমেশ্বর বিশ্বাস। তবে পূজার জায়গা ঠিক করে দিয়েছিলেন অবাঙ্গালিরা। বিল্লিসারণে এক ধর্মশালার পরিসরে। প্রতিমা নিয়ে যাওয়া হয়েছিল কাশী থেকে। উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, ওই ধর্মশালায় প্রতি বছর যাতে পূজা হয় সেজন্য ধর্মশালার মালিক লালানাদ নারায়ণ উইল করে গেছেন। আর একটা বিষয় হলো, তিন
দশক আগেও কলকাতায় অনেক মণ্ডপে সারারাত ব্যাপী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হতো। গান-বাজনা, কৌতুকাভিনয় ইত্যাদি হতো। মুম্বই থেকেও নামকরা শিল্পীরা আসতেন। এখন আর তেমন দেখা যায় না। কিন্তু দিল্লিতে হয়ে থাকে। কলকাতা থেকে অনেক শিল্পী যান। কোনো কোনো পূজায় স্থানীয়রা অনেক দিন ধরে মহড়া দিয়ে নাটক,
তুরা
‘মায়াময় মেঘালয়’-এর গারো হিল্স-এর সদর হলো তুরা। গুয়াহাটি থেকে ২০০ কিলোমিটার মতো দূরে বর্ষারণ্য বেষ্টিত ছোটো শহর। নগর সভ্যতার দৃষ্টিতে প্রায় প্রত্যন্ত অঞ্চল বলা যেতে পারে। হিন্দু বাঙ্গালির সংখ্যাও তেমন বেশি নয়। তবুও প্রতি বছর তুরাতে ২৫টার মতো দুর্গাপূজা হয়ে থাকে। পুরো গারো
পাহাড় এলাকায় শতাধিক পূজা হয়ে থাকে। বাঙ্গালিদের সঙ্গে একাত্ম হয়ে অনেক পূজা করেন স্থানীয় নেপালি এবং কোচ ও হাজং জনজাতির লোকেরাও। বাদ যায় না বিহারী, মাড়োয়ারীরাও। উল্লেখ করার মতো বিষয় হলো, বাঙ্গালিরা নয়, ১৮৮৫ সালে তুরাতে প্রথম দুর্গাপূজা শুরু করেন গোর্খা রেজিমেন্টের জওয়ানরা। মুখ্যত নেপালিদের দ্বারা শুরু হওয়া সেই পূজা হয়েছিল তুরার প্যারেড গ্রাউন্ড সংলগ্ন ‘মেঘালয় ট্রান্সপোর্ট কর্পোরেশন’-এর প্রাঙ্গণে। সেই থেকে ১৪০ বছর ধরে এখনোও মহা ধুমধামে তা চলে আসছে। এই পূজা বিশেষভাবে ‘নেপালি দুর্গাপূজা’ নামে পরিচিতি লাভ করেছে। বাঙ্গালিদের দ্বারা উদ্যাপিত প্রথম এবং অন্যতম প্রধান পূজা হয় সেখানকার বাবুপাড়ায়। প্রায় ১০০ বছর আগে এই পূজা শুরু হয়েছিল। আড়ম্বর দেখলে মনে হয় যে পশ্চিমবঙ্গের
কোথাও হচ্ছে। সমগ্র গারো পাহাড়ে সব দুর্গাপূজা যাতে উৎসাহ-উদ্দীপনার সঙ্গে সঙ্গে সুস্থ ও সুন্দরভাবে উদ্যাপিত সম্পন্ন হয় সেজন্য ২৬ বছর আগে ‘সেন্ট্রাল পূজা কমিটি’ তৈরি হয়েছে। প্রায় প্রশাসনিক ব্যবস্থার মতো সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করে এই সমিতি। দশমীর দিন তুরার সব প্রতিমা একত্রিত হয় সেখানকার প্যারেড গ্রাউন্ডে।
তারপর বিশাল শোভাযাত্রা সহকারে একে একে বিসর্জন দেওয়া হয় বাবুপাড়া বিসর্জন ঘাটে। এই শোভাযাত্রা বিশেষ আকর্ষণীয় এবং দুচোখ ভরে দেখার মতো। বারোয়ারি পূজাকে ‘সর্বজনীন’ বলা হয়ে থাকে। গারো হিল্স-এর সদরে আয়োজিত দুর্গাপূজা প্রায় আক্ষরিক অর্থেই তাই।
অসম
দশম-একাদশ শতকে রচিত ‘কালিকাপুরাণ’ থেকে জানা যায় যে তারও আগে থেকে অসমের তাম্রেশ্বরী মন্দিরে দুর্গাপূজা হতো। তবে তা তেমন জনপ্রিয়
হয়নি। ১৬২০ সালে অহোম রাজা স্বর্গদেব রুদ্রপ্রতাপ সিংহ গারগাঁওয়ে পূজা করেন। পরে ওই পূজা জোরহাটে বুড়ি গোঁহাই দেবালয়ে স্থানান্তরিত হয়। এটাকেই বেশিরভাগ মানুষ অসমে প্রথম দুর্গাপূজা বলে মনে করেন। আবার ভিন্নমতে গৌরীপুর রাজবাড়িতে প্রথম পূজা করেন রাজা কবিশেখর। আর গুয়াহাটিতে দুর্গাপূজার প্রচলন হয় উনিশ শতকের শেষের দিকে। অহোম রাজবংশের রাজা কন্দর্পেশ্বর সিংহের হাতে। উল্লেখিত সব পূজা এখনো বহাল রয়েছে। অসমে বারোয়ারি দুর্গাপূজার প্রচলনও শুরু হয় সেই সময় থেকে। গুয়াহাটিতে এখন ঠিক কতগুলো দুর্গাপূজা হয় তার তথ্য সংগ্রহ করা দুরূহ ব্যাপার। পাড়ায় পাড়ায় হিন্দু বাঙ্গালি, পাড়ায় পাড়ায় দুর্গাপূজা।
গুয়াহাটির পূজার একটা উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো বিসর্জন শোভাযাত্রা। শহরের প্রধান রাস্তাগুলোর দুই ধারে হাত জোড় করে দাঁড়িয়ে থেকে মা দুর্গাকে বিদায়
জানান। যতদূর জানা যায়, আগে উদ্যোক্তারা রাস্তার দু’ধারে দাঁড়িয়ে থাকা অতি দরিদ্র মানুষদের আঁচলে কিংবা ধুতির খোঁটে চাল ঢেলে এককথায় ‘অন্নদান’ করতেন। কালক্রমে এখন সেটাই চাল ছড়ানোর প্রথায় এসে দাঁড়িয়েছে। এখন ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে এই চাল কুড়িয়ে বাড়িতে নিয়ে গিয়ে ঠাকুরের সিংহাসনে কিংবা কুলুঙ্গিতে রাখেন।
অসমকে মুখ্যত দু’ভাগে ভাগ করা হয়ে থাকে। নামনি অসম বা ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা। আর উজানি অসম বা বরাক উপত্যকা। গুয়াহাটি নামনি বা নিম্ন অসমে। দুই ক্ষেত্রেই দুর্গাপূজার সংখ্যা প্রচুর বেড়েছে। উপেন্দ্রচন্দ্র গুহ’র ‘কাছাড়ের ‘ইতিবৃত্ত’ গ্রন্থ থেকে জানা যায় যে বরাক উপত্যকায় ২৪৪
বছর আগে কাছাড়ের জমিদার বাড়িগুলোতে পাল্লা দিয়ে দুর্গাপূজা হতো। বিশেষ করে এখনকার হাইলাকান্দিতে। হাইলাকান্দি তখন কাছাড়ের অন্তর্ভুক্ত ছিল।
ওইসব পূজায় তখন ঢাকের বাদ্যের বাজানো হতো বড়ো বড়ো কাঁসর-ঘণ্টা। শিলচর শহরের পত্তন হয় ১৮৩০ সালে। ১৮৫৩ সালে ব্রিটিশ শাসন চালু হবার পর শ্রীহট্ট থেকে প্রচুর বাঙ্গালি শিলচরে আসতে থাকেন। সেই সময় শহরের মারুয়াগঞ্জে একজন বাঙ্গালি আড়তদার বটুবাবু দুর্গাপূজা শুরু করেন। সে পূজা এখনও চলছে। বটুবাবুর আগে শিলচরে দুর্গাপূজা শুরু করে গোর্খা রেজিমেন্ট। সেই প্রাচীন পূজায় মোষ বলি দেওয়া হতো। গুয়াহাটির সংখ্যা পাওয়া
না গেলেও শিলচরে এখন ১০০-র বেশি পূজা হয়ে থাকে। সরকারি তথ্য অনুসারে ২০২৪ সালে ২২টা জেলা সমন্বিত অসমে নথিভুক্ত বারোয়ারি দুর্গাপূজা হয়েছিল ৪ হাজার ৮০৪টি।
মুম্বাই
দেবী চণ্ডীর অন্য এক রূপ মুম্বাদেবীর নামানুসারে বর্তমান মুম্বাই মহানগরীর নামকরণ হয়েছে পূর্বতন নাম বোম্বাই থেকে। এখানকার বিভিন্ন স্থানে খুব ধুমধাম
ও আড়ম্বরের সঙ্গে দুর্গাপূজা হয়ে থাকে। দাদার এলাকায় শিবাজী পার্কের পূজা দেখলে মনে হবে যেন কলকাতার সন্তোষ মিত্র স্কোয়ারের মতো কোনো জমকালো পূজা দেখছি। শিবাজী পার্কে ‘বেঙ্গল ক্লাব’ ১৯২২ সালে এই পূজা শুরু করে। এখন প্রতি বছর প্রায় ২ লক্ষের মতো ভক্ত ও দর্শনার্থীর সমাগম হয়। প্রায় একই রকম পূজা হয় প্যারেলেও। যতদূর জানা যায় ভারতের এই বাণিজ্যিক রাজধানীতে প্রথম দুর্গাপূজা করেন রাজা প্রতাপ সিংহ সপ্তদশ
শতাব্দীর মাঝামাঝি। বাঙ্গালি জলুরিরা (সোনারুপোর অলঙ্কারের কারিগর) বেশ ভালো সংখ্যায় মুম্বাইয়ে আসার পর কলবাদেবী এলাকায় ১৮৮০ সালে তাঁরা
চাঁদা তুলে বেশ বড়ো করে পূজা করেন। সেটাই ছিল মুম্বাইয়ে প্রথম বারোয়ারি দুর্গাপূজা। এখন এই এলাকাতে বেশ কয়েকখানা বড়ো পূজা হয়ে থাকে। শিবাজী পার্কের দুর্গাপূজার প্রচুর নামডাক থাকলেও এক সময় মুম্বাইয়ের শ্রেষ্ঠ পূজা ছিল পূর্ব প্যারেলে। এখনো এখানকার পূজায় মায়েদের সিঁদুরখেলা অত্যন্ত গরিমাময়। দশমীর দিন মহানগরের অনেক দূর দূর থেকে মায়েদের আগমন ঘটে থাকে এখানকার নারে পার্কের পূজায়। মুম্বাইয়ে বসবাসকারী অভিজাত বাঙ্গালি ব্যবসায়ী এবং উচ্চপদস্থ চাকরিজীবীরা একটু পারিবারিক ঢঙে কিন্তু বিপুল আয়োজনে পূজা করেন পেডার রোডে অবস্থিত তেজপাল হলে। ‘বম্বে দুর্গাবাড়ি সমিতি’ এই পূজার আয়োজন করে থাকে। দুর্গাপূজার সংখ্যা বাড়ছে নবী মুম্বাইয়েও। এখন বৃহত্তর মুম্বাইয়ে ১৫০টারও বেশি বারোয়ারি পূজা
হচ্ছে।
মুম্বাইয়ে দুর্গাপূজার একটা লক্ষণীয় বিষয় হলো, চলচ্চিত্র জগতের বহু খ্যাতনামা অভিনেতা ও সংগীত শিল্পীদের আগমন ও আত্মনিয়োগ। চলচ্চিত্র প্রযোজক
শশধর মুখার্জির উদ্যোগে পশ্চিম সান্তাক্রুজে দুর্গাপূজা শুরু হয়। ওই পূজায় চলচ্চিত্র জগতের অনেক রথী-মহারথীদের আগমন ঘটত। জুহু সৈকত সংলগ্ন আন্ধেরি এলাকাটি এখন এককথায় ‘বলিউড’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। এখানে বেশ আড়ম্বরের সঙ্গে কয়েকখানা পূজা হয়ে থাকে। খ্যাতনামা সংগীত শিল্পী জগন্ময় মিত্র এক সময় এখানকার দুর্গাপূজা কমিটিতে পর পর তিন বছর সভাপতি ছিলেন। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, মান্না দে, অভিনেতা ‘দাদামণি’
(অশোক কুমার), প্রদীপ কুমার প্রমুখ এখানকার বিভিন্ন পূজা মণ্ডপে অংশ নিতেন। এখন বেশ কয়েক বছর ধরে খুব ধুমধামের সঙ্গে পূজা হচ্ছে নামকরা সংগীত শিল্পী অভিজিৎ ভট্টাচার্যর বাড়িতে। এবছর জাতীয় পুরস্কার লাভ করা অভিনেত্রী রানি মুখার্জিও প্রতি বছর দুর্গাপূজা করে থাকেন। পূজার কদিন
বলিউড ও টলিউডের বিশিষ্ট শিল্পীদের সমাগম ঘটে এখানকার দুর্গাপূজাগুলোতে।
বারাণসী
এক সময়ের ‘দ্বিতীয় বঙ্গ’ বারাণসীতে এখনো প্রায় তিন লক্ষের মতো বাঙ্গালি রয়েছেন। তাই এখানে ভালো সংখ্যায় দুর্গাপূজা হবে এতে নতুনত্বের কিছু নেই। উপরন্তু এই ‘শিব ঠাকুরের আপন দেশে’ দুর্গাপূজা করলে বেশি পুণ্য হয় এমন প্রবাদ অনেক আগে থেকে চলে আসছে। এই সূত্রে অবিভক্ত বঙ্গ থেকে অনেক সম্পন্ন পরিবার কাশীতে এসে দুর্গাপূজা করতেন। ১৭৭০ সালে শুরু করেছিলেন একজন চৌখিম্বর জমিদার আনন্দমোহন মিত্র। সে পূজা এখনো হচ্ছে। প্রায় এইই সময়ে কেদারঘাটের বাপলি পরিবারও কাশীতে দুর্গাপূজা আরম্ভ করেন।
এই হিসেবে বারাণসীতে আড়াইশো বছরেরও বেশিদিন আগে থেকে এই পূজা হচ্ছে। তবে প্রথম বারোয়ারি পূজা শুরু হয় ১৯২১ সালে। ১০৪ বছর আগে সেই পূজা হয়েছিল নাদেশড়ে মিনিট হাউসে। উদ্যোক্তা ছিলেন রায়বাহাদুর ললিত সেন রায়। জায়গাটা বারাণসীর প্রাণকেন্দ্র গোদৌলিয়া থেকে কিছুটা দূরে বলে পরের বছর পাণ্ডে হাভেলিতে অ্যাংলো-বেঙ্গলি প্রাইমারি স্কুলে বারোয়ারি পূজা শুরু হয়। দু’ বছর পরে ১৯২৩ সালে গঠিত হয় ‘বারাণসী দুর্গোৎসব
সম্মিলনী’। প্রথম তিন বছর পূজা হয়েছিল হ্যাজাগ লাইটের আলোয়। ২০২৪ সালে জেনারেটারের আলোয় মহা আড়ম্বরে পূজা করে এই সম্মিলনী।
এখন বারোয়ারি পূজাগুলোতে অবাঙ্গালিদেরও অংশগ্রহণ উল্লেখ করার মতো। বারাণসীতে অষ্টাদশ শতকে নাটোরের রানি ভবানীর হাতে প্রতিষ্ঠিত দুর্গাকুণ্ড মন্দিরের পূজা ভক্তদের কাছে বিশেষ আকর্ষণের কেন্দ্র। প্রতি বছর বেশ বড়ো এবং রীতিমতো আড়ম্বরের সঙ্গে দুর্গাপূজা হয়ে থাকে কাশী হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় পরিসরের মধ্যেও। প্রতি বছর দুর্গাপূজার সময় বিভিন্ন জায়গা থেকে বারাণসীতে এত বেশি বাঙ্গালির আগমন ঘটে যে পূজার সময় দশাশ্বমেধ ঘাটে বিখ্যাত গঙ্গারতির সময় বাংলা ভাষাতে যাবতীয় ঘোষণা করা হয়ে থাকে।
মদনপুরা বাঙ্গালিটোলার পুরনো দুর্গাবাড়ির পূজারকাল আড়াইশো বছরেরও বেশি। কিন্তু এখানকার প্রতিমা বিসর্জন নিয়ে একটা অলৌকিক কাহিনি আছে।’ মাটির প্রতিমা প্রয়োজনে সময়ে সময়ে কলেবর পালটানো হলেও বিগত আড়াইশো বছর ধরে কখনো বিসর্জন দেওয়া হয় না। একটা সরু গলির মধ্যে ১৭৬৭ সালে এই মন্দির বা দুর্গাবাড়ি নির্মাণ করেছিলেন কালীপ্রসন্ন মুখোপাধ্যায়। তিনি ছিলেন মূলত হুগলি জেলার জনাইয়ের বাসিন্দা। বাঙ্গালিটোলার স্থানীয় লোকেদের বক্তব্য অনুযায়ী কালীবাবু ‘পুরানি দুর্গাবাড়ি’-তে পূজা করার পর দশমীর দিন যখন বিসর্জন দেবার চেষ্টা করেন তখন একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটে। লোকজন মিলে শত চেষ্টাতেও মৃন্ময়ী মূর্তিকে ওঠানো তো দূরের কথা, একচুল নড়ানো পর্যন্ত যায়নি। সেদিন রাতে দেবী দুর্গা কালীবাবুকে স্বপ্নে দেখা দিয়ে
বলেন যে তাঁর মূর্তিকে যেন বিসর্জন না দেওয়া হয়। কারণ কাশীবাসীদের কল্যাণের জন্য তিনি যেখানে অধিষ্ঠিত হয়েছেন সেখানেই থেকে যেতে চান।
রাজস্থান
দেবী দুর্গা ঘোটকে আসুন কিংবা গজে অথবা নৌকায়, মরুরাজ্য বলে কথিত রাজস্থানেও বিভিন্ন জায়গায় তাঁর অকাল বোধন ও পূজা হয়ে থাকে। এই মরুরাজ্যে এখন প্রতি বছর ৫০টারও বেশি দুর্গাপূজা হচ্ছে। ঐতিহাসিক শহর যোধপুরে আধ ডজনের মতো পূজা হয়। ২০০০-এর কিছু কিছু বাঙ্গালি এই শহরে থাকেন। এই সূত্রে গঠিত হয়েছে ‘যোধপুর দুর্গাবাড়ি সমিতি।’ তাঁদের আয়োজিত বারোয়ারি পূজাই এখন এখানকার প্রধান দুর্গাপূজা। এ বছর ৮৪ বছরে পড়ল। এত বছর ধরে একটানা চলে আসছে। এমনকী ২০২০-২১ সালে কোভিড অতিমারির সময়ও বন্ধ হয়নি। সে সময় কোভিড প্রটোকল মেনে পূজা করা হয়েছিল বলে জানিয়েছেন সমিতির দীর্ঘদিনের সভাপতি মিলন সেনগুপ্ত।
২০২১ সালে ইউনেস্কো প্রকাশিত ‘দ্য ইনট্যাঞ্জিবল্ কালচারাল হেরিটেজ অফ হিউম্যানিটি’র তালিকায় স্থান করে নিয়েছে ‘কলকাতার দুর্গাপূজা’। ইউনেস্কোর পক্ষ থেকে এই স্বীকৃতি পাওয়ার অনেক আগে থেকেই বাঙ্গালির দুর্গাপূজা হয়ে উঠেছে বিশ্বজনীন। বিশ্বের যে প্রান্তেই বাঙ্গালি পৌঁছেছে, বসতি স্থাপন করেছে এবং নানা কৃতিত্ব অর্জন করেছে, সেখানেই জনপ্রিয় হয়েছে মা দুর্গার আরাধনা। এক কথায় বলা যায় যে, বাঙ্গালি ও দুর্গাপূজা সমার্থক। এক শতক ধরে ঘটে চলেছে দুর্গাপূজার বিশ্বায়ন। ব্যতিক্রম হলো জেহাদি শক্তির কবলে থাকা- বাংলাদেশ।