ঐতিহ্যবাহী পারিবারিক বুড়িমার পূজা
গীতশ্রী চক্রবর্তী
গ্রামটির নাম ধোড়াদহ। নদীয়া জেলার তেহট্ট মহকুমার অধীন একটি বর্ধিষ্ণু গ্রাম। নদীয়ার প্রাচীন পারিবারিক দুর্গাপূজাগুলির মধ্যে অন্যতম একটি হলো ধোড়াদহ চৌধুরী বাড়ির ‘বুড়িমার পূজা’।
এই পূজার সঙ্গে জড়িত ঐতিহ্যপূর্ণ ইতিহাসের কথা। সময়টা মুঘল আমল। দিল্লির মসনদে তখন বাদশা আকবর। বঙ্গের অন্যসব রাজারা তাঁর বশ্যতা স্বীকার করলেও ব্যতিক্রমী ছিলেন অবিভক্ত বঙ্গের যশোরের বারোভুঁইয়ার অন্যতম প্রতাপাদিত্য। অপমানিত দিল্লির বাদশা তাঁর সেনাপতি মানসিংহকে হুকুম দিয়ে বসলেন যেকোনো উপায়ে প্রতাপাদিত্যকে তাঁর কাছে হাজির করতে হবে। গুপ্তচর মারফত সংবাদটি কর্ণগোচর হতেই তাঁর কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ল। কেননা যুদ্ধ শুরু হলে তাঁর নাবালক দুই শিশু পুত্র উদয়াদিত্য ও সংগ্রামাদিত্যের দায়িত্ব কে নেবে? এহেন সংকটকালে প্রতাপাদিত্যের দেওয়ান দুর্গারাম
মৈত্রগাঁই (পরবর্তীতে যিনি চৌধুরী উপাধি লাভ করেন) তাঁর চিন্তার অবসান ঘটিয়ে নাবালক দুই শিশুপুত্রকে নিয়ে আসেন ধোড়াদহ গ্রামে।
তখন ধোড়াদহ ছিল জঙ্গলে ভরা জনবসতিহীন এলাকা। সেইখানেই দুর্গারাম প্রতাপাদিত্যের দুইপুত্রকে নিয়ে আত্মগোপন করে থাকেন বেশ কিছুদিন। তখনই তিনি মানত করেন যুদ্ধ শেষে তাঁদের অক্ষত অবস্থায় রাজার কাছে ফিরিয়ে দিতে পারলে তিনি এই গ্রামেই মাকে প্রতিষ্ঠা করবেন। যুদ্ধ মিটে গেলে তাঁদের রাজার হাতে তুলে দিলে, প্রতাপাদিত্য খুশি হয়ে দুর্গারামকে পাঁচটি মহল দান করেন যার মধ্যে অন্যতম ধোড়াদহ। ফলস্বরূপ, দেওয়ান দুর্গারাম হয়ে ওঠেন জমিদার দুর্গারাম চৌধুরী। মানত অনুযায়ী দুর্গারাম ধোড়াদহের জঙ্গলে খানিকটা জায়গা সাফ করে ১৬১৪ খ্রিস্টাব্দে খড়ের আটচালায় মাকে প্রতিষ্ঠা করেন।
সেই থেকে আজও তিনি ‘বুড়িমা’ নামে পুজিত হয়ে আসছেন। পরবর্তীকালে ১৭৫৩ খ্রিস্টাব্দে দুর্গারাম সুদৃশ্য খিলান যুক্ত নাটমন্দির ও পৃথক গর্ভগৃহ বিশিষ্ট ঠাকুরদালান তৈরি করেন।
একচালা বিশিষ্ট সাবেকি বুড়িমা’র মূর্তি যাঁর দুটি সম্মুখ বাহু প্রমাণ মাপের, অপরদিকে কাঁধের দুইপাশে চারটি চারটি করে ছোটো ছোটো আটটি বাহু বর্তমান। প্রতিমা শিল্পী গ্রামেরই মালাকার পরিবার, যাঁরা বংশপরম্পরায় এখনো মায়ের প্রতিমা তৈরি করে আসছেন। কালিকাপুরাণ মতে মায়ের পুজা করা হয়। মায়ের বেদিতে পুজার চারদিন রাখা হয় শালগ্রাম শিলা, বাণেশ্বর শিব ও মা মঙ্গলচণ্ডী। আগে মায়ের বোধন হতো মহালয়ার দিন কিন্তু বর্তমানে ষষ্ঠীর দিন মায়ের বোধন ও অধিবাস সমাপন হয়। পঞ্জিকা অনুসারে নির্ধারিত সময়েই ওইদিন মাকে বেদিতে স্থাপন করা হয়। মহাসপ্তমীর সকালে কলাবউ স্নান, ঘট স্থাপন, প্রাণ প্রতিষ্ঠা ও মহাস্নানের মধ্য দিয়ে পূজার শুভারম্ভ হয়। মহাসপ্তমী থেকে জলপানি (ফল, লুচি ও মিষ্টান্ন) ভোগ ও অন্ন ভোগ-সহ রকমারি
ব্যঞ্জন, পরমান্ন মাকে নিবেদন করা হয়ে থাকে। মহাষ্টমীতে খিচুড়ি, আট রকম ভাজা ও পরমান্ন ভোগ।
মহাসন্ধিতে মায়ের ভোগ হিসেবে নিবেদিত হয় লুচি, পায়েস, ফল ও মণ্ডা-মিঠাই। কথিত, আগে কামান দেগে শুরু হতো সন্ধিপুজা। মহানবমীতে সকালে পুকুর থেকে মাছ তুলে মাকে মাছ ভোগ নিবেদন করা হয়, সঙ্গে খিচুড়ি, পোলাও, নয় রকম ভাজা, চাটনি, পায়েস ইত্যাদি। দশমীতে মায়ের ভোগ একটু ভিন্ন স্বাদের, মাকে নিবেদন করা হয় পান্তাভাত, লেবু-লঙ্কা ও কচুর শাক। এরপর মায়ের ঘটে বিসর্জন, সিঁদুরখেলা ও অপরাজিতা পূজার মাধ্যমে দশমী পূজা সমাপন হয়। পূজার চারটি দিন দূরদূরান্ত থেকে মাকে দর্শনের জন্য অজস্র ভক্তের ঢল নামে। দশমীতে কাঁধে করে মা নিরঞ্জনের উদ্দেশে যাত্রা করেন। গ্রামের খড়েনদীতে মা বিসর্জিত হন। গ্রামে প্রায় ১৩টি পূজা হয় এবং সর্বপ্রথম বুড়িমার বিসর্জনের মধ্য দিয়ে নিরঞ্জন পর্ব শুরু হয়।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, বুড়িমার পূজা শুরুর আনুমানিক পঞ্চাশ বছর পর দুর্গারামের দুই পুত্র রামেশ্বর চৌধুরী ও বীরেশ্বর চৌধুরীর মধ্যে মনোমালিন্যের সৃষ্টি হয়। রামেশ্বর চৌধুরী পৃথকভাবে রাতারাতি প্রতিমা গড়িয়ে বুড়িমার মন্দিরের অনতিদূরে আরেকটি দুর্গাপূজার আয়োজন করেন যা ‘ছোটমা’-র পূজা নামে খ্যাত। বুড়িমার মতোই এই পূজারও নিয়মরীতি একই। সেই থেকে বুড়িমার পাশাপাশি ছোটমার পূজাও ধারাবাহিক ভাবে হয়ে আসছে।
বর্তমান মন্দির সময়ের স্রোতে তার জৌলুস অনেকাংশেই হারিয়েছে। আগে অনেকগুলি খিলান থাকলেও বর্তমানে তা মাত্র ছটিতে এসে দাঁড়িয়েছে। বাড়ির প্রবীণদের মুখে শোনা যায় আগে নাকি জমিদারগিন্নিরা চিকের আড়ালে বসে পূজা দেখতেন, বর্তমানে এসব রীতি কল্পনাতীত। এখন বুড়িমার পূজায় শহরের আর পাঁচটি পূজার মতো আলোর রোশনাই হয়তো নেই ঠিকই কিন্তু নিয়ম, নিষ্ঠা ও ভক্তি অটুট রেখে আজ ৪১১ বর্ষে পদার্পণ করেও সেই সুপ্রাচীন ইতিহাসের সাক্ষী বহন করে চলেছে।