প্রত্যেক হিন্দুর করণীয় বিধি পিতৃপক্ষে পিতৃতর্পণ
গোপাল চক্রবর্তী
আশ্বিন মাসের কৃষ্ণপক্ষের প্রতিপদ থেকে অমাবস্যা পর্যন্ত পক্ষটি পিতৃপক্ষ নামে পরিচিত। অবশ্য এই পক্ষকে অপরপক্ষ, প্রেতপক্ষও বলা হয়। এই দিনে পিতৃপুরুষের উদ্দেশ্যে তর্পণ ও পার্বণ শ্রাদ্ধের রীতি আছে। কেউ কেউ পিতৃপক্ষের প্রতিদিনই তর্পণ করেন। পিতৃপক্ষ মহালয় নামে প্রসিদ্ধ ছিল। এই মহালয় শব্দ থেকে মহালয়া নামের উৎপত্তি হয়েছে। এই পিতৃপক্ষে যমলোক থেকে পূর্বপুরুষদের আত্মা মর্ত্যে আগমন করেন জল পিণ্ডের আশায়। পিতৃপক্ষ পিতৃপুরুষদের উৎসবের আধার। গঙ্গা বা অন্যান্য স্রোতস্বিনী অথবা জলাশয়ে তর্পণ করা হয়। পুত্র-পৌত্রাদির হাতে জল, পিণ্ড লাভের পর পরিতৃপ্ত
পূর্বপুরুষদের আত্মা আবার যমলোকে প্রত্যাবর্তন করেন। তাঁদের এই যমলোকযাত্রা যাতে সুগম হয় তার জন্য উল্কা বা আকাশ প্রদীপ জ্বালানোর ব্যবস্থা ভারতবর্ষে অনন্তকাল ধরে চলে আসছে। এখনো অনেক বনেদি বাড়িতে পুরো কার্তিকমাস আকাশ প্রদীপ জ্বালানোর ব্যবস্থা আছে।
পূর্বপুরুষদের মধ্যে ঊর্ধ্বতন সপ্তম পুরুষ পর্যন্ত জল দানের শাস্ত্রীয় বিধান আছে। তবে বর্তমানে পিতা থেকে বৃদ্ধ প্রপিতামহ পর্যন্ত পঞ্চম পুরুষের ষের উদ্দেশে তর্পণ করা হয়। পিতৃপক্ষে তর্পণ যে শুধু পিতৃপুরুষদের উদ্দেশ্যে করা হয় তা নয়, তর্পণের সূচনা হয় ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও রুদ্র ও প্রজাপতিকে জল দানের মাধ্যমে। প্রাচীন ভারতীয় ঋষিরা যে কতটা উদার ছিলেন তা তর্পণের এই বিশেষ মন্ত্রটির মাধ্যমে অনুধাবন করা যায়।
‘ওঁ দেবা যক্ষাস্তথা নাগা গন্ধর্বাপরসোহসুরাঃ। ক্রুরাঃ সর্পাঃ সুপর্ণাশ্চ তরবো জিক্ষপা খগাঃ।। বিদ্যাধরা জলাধারাস্তথৈ বা কাশ গামিনঃ। নিরাহারাশ্চ যে জীবঃ পাপে ধর্মে রতাশ্চ যে।। তেষামাপ্যায় নায়ৈ তদু দীয়তে সলিলং ময়াঃ।। সনাতন ভারতবর্ষ যুগ যুগ ধরে পিতৃপক্ষে পিতৃপুরুষদের সঙ্গে দেবতা, যক্ষ, নাগ, গন্ধর্ব, অপ্সরা, অসুর, সর্প, বৃক্ষলতা, বিদ্যাধর, জলধারা, অভুক্ত জীব, এমনকী যে পাপে অথবা অধর্মে নিরত, বিধিমতে তাদের উদ্দেশ্যেও তর্পণ করা হয়, জল প্রদান করা হয়। তর্পণের সময় হিন্দুরা মরীচি, অত্রী, অঙ্গিরা, পুলস্ত্য, পুলহ, ক্রতু, প্রচেতা, বশিষ্ট, ভৃগু, নারদ প্রমুখ ঋষিকেও জল প্রদান করেন। দেবতা ও ঋষিদের সঙ্গে যম, বৈবস্বত মনু, চিত্রগুপ্ত, বৃকোদর ভীম এঁদেরকেও বিধি মতে জল প্রদান করা হয়।
মহান উদার ঋষিরা তর্পণের মধ্য দিয়ে দেবর্ষি, পিতৃকুল, মনুষ্য, সপ্তদ্বীপ নিবাসী, এমনকী ত্রিভুবনের সমস্ত অতৃপ্ত আত্মার তৃপ্তির কথা বলেছেন। ‘ওঁ আব্রহ্মা স্তম্বপর্যন্তং জগৎ তৃপ্যন্তু।’ তর্পণ ক্রিয়ার সর্বোৎকৃষ্ট সংযোজন উপরোক্ত মন্ত্রটি। এখানে বলা হয়েছে তপর্ণকারীর প্রদত্ত জলে ব্রহ্ম থেকে ‘স্তম্ব’ অর্থাৎ তৃণগুচ্ছ পর্যন্ত জগতের প্রতিটি বস্তুর তৃপ্তি হোক।
সেই সুদূর অতীতে ভারতীয় শাস্ত্রকাররা ছিলেন উন্নত ও উদার মানসিকতা অধিকারী। তর্পণ বিধির বিভিন্ন মন্ত্রে তাঁদের উদার মানসিকতা এবং সাম্যের প্রতিফলন দেখতে পাওয়া যায়। যেমন- ‘ওঁ যে অবান্ধবা বান্ধবা বা সেন্যজন্মনিবারবাঃ। তে তৃপ্তিমখিলাং যান্ত্ব যে চাস্মাৎ তোয়কাঙ্ক্ষিণ।। আবার তাদের উদ্দেশ্যেও তর্পণ করা হয়, অগ্নিদগ্ধ হয়ে যে সকল জীব নিহত হয়েছে কিংবা তর্পণকারীর নিজ কুলে যিনি অগ্নিদগ্ধ হয়েছেন, মন্ত্রপুত তর্পণের জলে যেন সবার তৃপ্তি হয়। পিতৃপক্ষে জাতিধর্ম নির্বিশেষে প্রত্যেক গৃহস্থের অপুত্রক ভীষ্ম তর্পণের বিধান আছে।
ওঁ বৈয়াঘ্র পদ্য গোত্রায় সাস্কৃতি প্রবরায় চ।
অপুত্রায় দদাম্যেতৎ সলিলং ভীষ্মবৰ্ম্মণে।।
ঋগ্বেদে যে পঞ্চ মহাযজ্ঞের বিধান রয়েছে এই তর্পণ তারই অঙ্গ। তর্পণ পঞ্চ মহাযজ্ঞের অন্তর্গত পিতৃযজ্ঞ। পিতৃপক্ষে কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারিকা পর্যন্ত হিন্দুরা একই মন্ত্রে একই পদ্ধতিতে তর্পণ করেন। শুধু ভারতবর্ষ নয়, পৃথিবীর সর্বত্র যেখানে হিন্দুরা রয়েছেন সর্বত্রই পিতৃপক্ষে পিতৃপুরুষের উদ্দেশে তর্পণ করেন। আমাদের শাস্ত্র পিতাকে দেবতাদের অগ্রে স্থান দিয়েছে। পিতৃস্তুতিতে বলা হয়েছে- ওঁ পিতাস্বর্গঃ পিতাধর্মঃ পিতাহি পরমং তপঃ। পিতরি প্রীতিমাপন্নে প্রীয়ন্তে সর্বদেবতাঃ।। তর্পণান্তে পিতৃপ্রণামে পিতাকে সর্বোচ্চ সম্মান দেওয়া হয়েছে। যেমন-
ওঁ পিতৃন্ নমস্যে দিবি যে চ মূৰ্ত্তাঃ
সধাভুজঃ কাম্য ফলাভিসন্ধৌ।
প্রদানশক্তাঃ সকলেপ্সিতানাং
বিমুক্তিদা যেহনাভিসংহিতেষু।।
পিতৃন্ বন্দে সদা ভক্ত্যা সর্ব্বদেব ময়ানবরান্।
ভুক্তিদান্ মুক্তিদান্ সৌম্যান্ সৰ্ব্বাভীষ্ট ফলপ্রদান।।
পিতরং জন্মদাতারং ভুক্তিদং মুক্তিদং প্রভুম্।
বাৎসল্য-করুণাপূর্ণং প্রণমাম পুনঃ পুনঃ।।
শাস্ত্রকাররা মাতৃপ্রণামের যে অনবদ্য মন্ত্র লিপিবদ্ধ করে গেছেন
পৃথিবীর কোনো দেশে তার নজির পাওয়া যাবে না।
সর্ব্বদুঃখনিহন্ত্রী ত্বং ভুক্তি মুক্তি প্রদায়িনী।
বিশ্বেশ্বরী জগদ্ধাত্রী মাতৃদেবী নমোস্তুতে।।
সর্ব্বমঙ্গলদাতৃকে সর্ব্বশোকহরাত্মিকে।
করুণাস্নেহ সম্পন্নে মাতৃদেবি নমোস্তুতে।।
বৎসরান্তে পিতৃপক্ষ আসে, ভারতবাসী পিতৃপুরুষের আত্মার সঙ্গে সঙ্গে দেবতা, ঋষি এবং যাদের জল পিণ্ড দেবার কেউ নেই, তর্পণের মাধ্যমে জল দিয়ে তাঁদের আত্মাকেও তৃপ্ত করেন। পিতৃপক্ষ পূর্বপুরুষদের শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করার এক প্রকৃষ্ট সময়। পিতৃপক্ষের অবসানে দেবীপক্ষের শুরু। বাঙ্গালি হিন্দুর মহাপর্ব দুর্গাপূজার সূচনা।