তারাচাঁদ দত্ত স্ট্রীটে আঢ্যিবাড়ির ঐতিহ্যপূর্ণ ‘শিবদুর্গা পূজা
সপ্তর্ষি ঘোষ
মধ্য কলকাতায় চিত্তরঞ্জন এভিনিউয়ে মহম্মদ আলি পার্কের বিপরীতে রবীন্দ্র সরণি পর্যন্ত বিস্তৃত তারাচাঁদ দত্ত স্ট্রিট কলকাতার এক অন্যতম ব্যস্ততম বাণিজ্যকেন্দ্র। মূলত পরিবহণ ব্যবসার গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র এই অঞ্চল। ৩৭/বি তারাচাঁদ দত্ত স্ট্রিটে আঢ্যি পরিবারের বসবাস আনুমানিক দুইশো বছর ধরে। হাওড়ার জগৎবল্লভপুরে এদের জমিদারি এবং প্রচুর সম্পত্তি ছিল এক সময়। পরবর্তীকালে আঢ্যি পরিবার কলকাতায় চলে আসেন এবং বর্তমান
ঠিকানায় বাস করতে শুরু করেন।
পরিবারের আদিপুরুষ ঈশ্বর আঢ্যি ছিলেন একজন নিষ্ঠাবান ও ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি। এক রাতে তিনি স্বপ্নে সপরিবারে শিবঅঙ্গে মাতৃরূপিণী মাতৃরূপিণী দুর্গার এক নয়নাভিরাম রূপ দর্শন করেন। আনন্দে আপ্লুত হয়ে স্বপ্নকে রূপ দেন মৃন্ময়ীমূর্তিতে। ১৮৪৯ সালে শুরু হয় আঢ্যিবাড়ির ‘শিবদুর্গা’ পূজা। এবার এদের পূজা ১৭৭তম বর্ষে পদার্পণ করলো। কলকাতার প্রাচীন ও ঐতিহ্যমণ্ডিত বনেদি পরিবারের দুর্গাপূজার মধ্যে তারাচাঁদ দত্ত স্ট্রিটের আঢ্যিবাড়ির ‘শিবদুর্গা’ পূজা অন্যতম। পাঁচ খিলান বিশিষ্ট সুদৃশ্য চলোন ঠাকুরদালান। প্রথমাবধি এই ঠাকুরদালানেই পূজা অনুষ্ঠিত হচ্ছে।
শিবের কোলে বসে আছেন মা দুর্গা, মায়ের মূর্তি শান্তভাবের। ডান হাতে বরাভয় দান করছেন। দেবীর ডান পাশে উপরে লক্ষ্মী ও নীচে গণেশ, বামপাশে সরস্বতী ও নীচে কার্তিক। ডাকের সাজে সজ্জিতা দেবী দুর্গার শান্ত, স্নিগ্ধ, প্রসন্নময়ী রূপ দর্শনে ভক্ত হৃদয় বিগলিত হয়ে যায়। জন্মাষ্টমীতে প্রতিমার কাঠামো পূজার পর ঠাকুরদালানেই প্রতিমা তৈরি হয়। একই মৃৎশিল্পী পরিবার পুরুষানুক্রমে প্রতিমার রূপদান করছেন।
মহালয়ার পরদিন প্রতিপদ তিথি থেকে পূজা, চণ্ডীপাঠ, আরতি শুরু হয়ে যায়। ষষ্ঠীর সন্ধ্যায় দেবীর আমন্ত্রণ ও অধিবাস। সপ্তমীর সকালে ‘নবপত্রিকা’ স্নানে যান জগন্নাথ ঘাটে। ফিরে এসে পুজা ও আরতির পরে গণেশের দক্ষিণপার্শ্বে নবপত্রিকা স্থাপন করা হয়। এরপর সংকল্প, দেবীর প্রাণপ্রতিষ্ঠা, চক্ষুদান করে পূজার আনুষ্ঠানিক সূচনা হয়। সংকল্প হয় ‘আঢ্যি পরিবার’-এর নামে।
সপ্তমী, অষ্টমী ও নবমীতে যথাক্রমে ১৫ থালা, ১৭ থালা ও ১৯ থালা নৈবেদ্য দেবীকে নিবেদন করা হয়। সন্ধিপূজায় একমণ চাল এবং একমণ কাশীর বাটা চিনি নৈবেদ্য দেওয়ার রীতি আজও অটুট রয়েছে। অন্নভোগ না থাকায় লুচি, ভাজা-সহ ব্যঞ্জনের সঙ্গে দেবীর ভোগে থাকে নানারকম মিষ্টি।
আঢ্যিবাড়িতে পূজা হয় বৈষ্ণব মতে। তাই এখানে পশুবলির প্রথা নেই। সপ্তমী, অষ্টমী, সন্ধিপূজা ও নবমীতে মহিলারা ধুনো পোড়ান। এই অনুষ্ঠান একান্তভাবে বিবাহিতা মহিলাদের জন্যে। পরিবারের মঙ্গল কামনায় এই মাঙ্গলিক অনুষ্ঠানে মহিলারা অংশগ্রহণ তারাচাঁদ দত্ত স্ট্রিটে আঢ্যিবাড়ির করেন। সন্ধিপুজায় ১০৮ প্রদীপ জ্বালানো হয় প্রতিমার সামনে। নবমীর সকালে যথাবিহিত পূজা, পুষ্পাঞ্জলি ও হোমের পর ‘দক্ষিণান্ত’। পুরোহিতকে দক্ষিণা প্রদান করে দুর্গাপূজার সমাপন।
দক্ষিণান্তের পর হয় কুমারীপূজা। অনূর্ধ্বা নবম বর্ষীয়া ব্রাহ্মণ কন্যাকে মালা পরিয়ে, কপালে চন্দনের ফোঁটা দিয়ে, পায়ে আলতা পরিয়ে দেবীজ্ঞানে পূজা করা হয়।
১৮৪৯ সাল থেকে দুর্গাপুজায় যে নিয়ম আচার শুরু হয়েছিল, ঈশ্বর আঢ্যির উত্তরসূরিরা নিষ্ঠার সঙ্গে তা অব্যাহত রেখেছেন।এমনকী পুরোহিত এবং ঢাকিরা বংশপরম্পরায় আঢ্যিবাড়ির পূজার সঙ্গে যুক্ত।
দশমীতে বরণ ও সিঁদুর খেলার পর নিরঞ্জনের উদ্দেশ্যে মাতৃমূর্তি কাঁধে করে নিয়ে যাওয়া হয় মতি শীল ঘাটে। ফিরে এসে পরিবারের সকলে কলাপাতায় দুর্গা নাম লেখেন। এরপর শান্তিজল গ্রহণ, বিজয়ার শুভেচ্ছা বিনিময় এবং মিষ্টিমুখ করে দুর্গোৎসব সম্পন্ন হয়। প্রতিবেদককে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেছেন আঢ্যি পরিবারের সদস্য দীপক আঢ্য।