চিত্তরঞ্জন পার্কের দুর্গাপূজা বাঙ্গালিয়ানায় ভরপুর
অত্রি মল্লিক
‘আশ্বিনের শারদপ্রাতে বেজে উঠেছে আলোক মঞ্জীর;ধরণীর বহিরাকাশে অন্তরিত
মেঘমালা; প্রকৃতির অন্তরাকাশে জাগরিত জ্যোতির্ময়ী জগন্মতার আগমন বার্তা…’ বঙ্গপ্রদেশের ভৌগোলিক সীমা অতিক্রমে করে বাঙ্গালির সার্বজনীন
দুর্গাপূজা ভারতবর্ষের ভিন্ন ভিন্ন প্রান্ত তথা এক-দুমাস ধরে অনুশীলন চলে চিত্তরঞ্জন পার্কেও সারা বছর মনুষ্য মনের মণিকোঠায় চক্রাকারে একটা পরিকল্পনা
আবর্তিত হয়, এই দুর্গাপূজা উৎসব ও তার উদ্যাপনকে ভিত্তি করেই। খুঁটি পূজা, পূজা খাদ্যান্বেষণ, নতুন পোশাক, শুভেচ্ছা বিনিময়, আলোর রোশনাই- আক্ষরিক অর্থেই এ যেন সামাজিক আনন্দপূর্তি।
সম্ভবত ১৯৭০ সালে চিত্তরঞ্জন পার্কের ১ নম্বর মার্কেটের উলটো দিকের খোলা জায়গায় প্রথম দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। দুর্গাপূজা চলাকালীন সাংস্কৃতিক
অনুষ্ঠানের আয়োজনও সেই হেতু পার্কের পরিবারগুলিতে। দুর্গাপূজাতে মিহির ঘটক চৌধুরী ও প্রভাত ঘোষ অভিনীত যাত্রা ‘রাজা দেবীদাস’ জনমানসে
সাড়া ফেলেছিল। পাড়ার বন্ধুদের সঙ্গে মণ্ডপ সজ্জার কাজ করার জন্য চিত্তরঞ্জন পার্কের রাস্তায় বাসিন্দাদের আনাগোনায় উৎসব অন্য মাত্রা পায়। ক্রমান্বয়ে সমগ্র দিল্লি জুড়ে বাঙ্গালির সংখ্যাধিক্যের কারণেই বর্তমানে শুধু দিল্লিতেই কম-বেশি দুশো পঞ্চাশের বেশি সংখ্যক দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। কেবল বারোয়ারি পূজা অথবা মন্দির প্রাঙ্গণের দীর্ঘ সময়ের পূজাই নয়, পারিবারিক স্তরেও নতুন দিল্লিতে বেশ অনেকগুলি দুর্গাপূজা হয় যার মধ্যে চিত্তরঞ্জন পার্কও
ব্যতিক্রম নয়। কলকাতা থেকে দিল্লিতে রাজধানী স্থানান্তরিত হওয়া, মহাযুদ্ধ, মন্বন্তর এবং আরও সামাজিক অবস্থার কারণে অনেক বাঙ্গালি দলে দলে আশ্রয় নিয়েছিলেন নতুন ও পুরনো দিল্লিতে। কর্মসূত্রে দিল্লিতে স্থানান্তরিত হয়েছে এমন বাঙ্গালির সংখ্যাও এখন বেশ বেড়েছে। ফলে দুর্গাপূজার সংখ্যাও বেড়েছে অনেক বেশি।
দিল্লির বাঙ্গালি পরিমণ্ডলে ধর্মীয় ও সামাজিক সংগঠনগুলির মধ্যে অন্যতম হলো চিত্তরঞ্জন পার্ক কালী মন্দির সোসাইটি বা সংক্ষেপে কেএমএস অথবা
শিবমন্দির। চিত্তরঞ্জন পার্ক কালী মন্দিরের দুর্গাপূজা এই নিরিখে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য। এই মন্দির চিত্তরঞ্জন পার্কের অধিবাসীদের প্রাণকেন্দ্র বলা চলে। এই
অঞ্চলের মানুষের মধ্যে একটা চোখে পড়ার মতো বিষয় হলো ধর্মভাব ও সংস্কৃতি চর্চার প্রতি গভীর অনুরাগ। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষাংশ থেকেই ক্রমশ
বিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগ পর্যন্ত দিল্লিতে বসবাসকারী বাঙ্গালির সংখ্যা ধীরে ধীরে বেড়ে চলেছিল। দেশভাগের দুর্ভাগ্যজনক পরিণতির ফলস্বরূপ এই ধীরগতির
ক্রমবর্ধমান সংখ্যা হঠাৎ বেশ অনেকটা বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হলো।
চিত্তরঞ্জন পার্কের দুর্গাপূজা উপলক্ষ্যে অন্তত এক মাস আগে থেকেই মন্দির প্রাঙ্গণে মণ্ডপ সজ্জা তৈরি হয়ে যায়, হইহই করে শুরু হয় নানা ধরনের
প্রতিযোগিতামূলক অনুষ্ঠানের। অবাক হতে হয়, বাঙ্গালি ও ওই অঞ্চলের বসবাসকারী অবাঙ্গালি মানুষও অফুরান উৎসাহে অংশ নেন এই অপূর্ব উদ্যাপনে।
রবীন্দ্রনাথের গান, নজরুলগীতি, বাংলা আধুনিক গান, রজনীকান্ত ও দ্বিজেন্দ্রগীতি, কবিতা পাঠ, আবৃত্তি, নৃত্য প্রতিযোগিতা, ক্যুইজ এবং আরও রকমারি প্রতিযোগিতা ও পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয় প্রায় প্রত্যেকটি সন্ধ্যেতে এই মাসাবধি সময়কালে।
অস্থায়ী স্টলগুলোতে তখন থেকেই শুরু হয়ে যায় অবশ্যম্ভাবী কেনা-বেচার তথা হরেকরকম বাঙ্গালি খাবারের নিত্য সান্ধ্যকালীন আনাগোনা। আর এসব
কিছুকে কেন্দ্র করে একটা অবিস্মরণীয় উদ্দীপনা দেখতে পাওয়া যায় চিত্তরঞ্জন পার্কের আনাচে কানাচে। সমকালীন সময়ের নিত্যনতুন সব ডিজিটাল ব্যাকড্রপ ও চিত্রকলায় সেজে ওঠে এই পূজা প্রাঙ্গণের সবটুকু। সঙ্গে থাকে কিছু সক্রিয় অংশগ্রহণ এক অন্যরকম সার্বিক আনন্দের পরিবেশ সৃষ্টি করে।
আকাশে-বাতাসে তখন শরতের আলো ও গন্ধ, আর তৎসংলগ্ন মানুষের মানসচক্ষে উৎসবের অনাবিল আবেশ- এ যেন প্রকৃতি ও তার সন্তানদের অটুট বন্ধনের বাস্তবিক চিত্রায়ণ।
চিত্তরঞ্জন পার্কের অন্যান্য পূজাগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো বি ব্লক ও কোঅপারেটিভের বা কে ব্লকের পূজা। এ বছর এই দুটি পূজা মণ্ডপই সারা রাত
উন্মুক্ত থাকবে দর্শনার্থীদের জন্য। এই দুটি পূজাই প্রায় ৫০ বছর পূর্তির দোরগোড়ায় নতুনত্বের ছোঁয়া। প্রত্যেক বছরেই প্রতিমা দাঁড়িয়ে। চিত্তরঞ্জন পার্ক কালী মন্দিরের আনয়ন থেকে মূর্তি বিসর্জন পর্যন্ত সবেতেই থাকে ভরপুর বাঙ্গালিয়ানার স্পষ্ট ছাপ। পুজার চারটে দিন আজকাল লক্ষাধিক মানুষের ঢল নামে একদা কিঞ্চিৎ অপরিচিত তথা নতুন দিল্লিস্থিত এই বাঙ্গালি পাড়ায়। চিত্তরঞ্জন পার্কের পূজা প্যান্ডেলগুলির মতো কালীমন্দিরেও প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ ভোগ ও অন্নপ্রসাদ গ্রহণ করেন। নরনারায়ণ সেবায় নিযুক্ত হন সমাজের সুধীজন। পূজার জোগাড়, আনুষঙ্গিক ব্যবস্থা দেখভাল, ভোগ বিতরণ, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান- সব কিছুতেই পুরুষদের মতো এই অঞ্চলস্থিত মাতৃশক্তিও সামনে থেকে নেতৃত্ব দান ও মতো এখানেও প্রাকপূজা প্রতিযোগিতা সমূহ তথা আনন্দমেলা অনুষ্ঠিত হয় মূল পূজার নির্ঘণ্ট আগমনের পূর্বলগ্নেই। মা সারদা পার্কের বেদীতে বি ব্লকের এই দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। বাহারি সব স্টলে রকমারি আয়োজনে জমজমাট হয়ে থাকে আনন্দ-প্রাঙ্গণ। দৈনিক ভোগ বিতরণ, বিশেষ প্রসাদের ব্যবস্থা, পুষ্পাঞ্জলি, দধিকর্মা বিতরণ- এ সব কিছুই খুব যত্ন করে ব্যবস্থা করা হয় উদ্যোক্তাদের পক্ষ থেকে। এছাড়াও চিত্তরঞ্জন পার্কের মেলা গ্রাউন্ডে, ডি-ব্লকে, ই-ব্লকে, মিলন সমিতিতে আরও কিছু বারোয়ারি পূজা অনুষ্ঠিত হয় প্রত্যেক বছর।
চিত্তরঞ্জন পার্ক সংলগ্ন আরও একটি পূজার কথা উল্লেখ না করলেই নয়। সেটি হলো এই অঞ্চলের একেবারে নিকটস্থ ‘অলকানন্দা’ নামক এক উচ্চ-মধ্যবিত্ত বাঙ্গালি পাড়ায় দুর্গাপূজার আয়োজন। এই বছর অলকানন্দা পূজা সমিতির দুর্গাপূজার ৫০ বছর পূর্তি হতে চলেছে। বঙ্গ সংস্কৃতির প্রচার ও প্রসারের তাগিদেই সর্বমোট প্রায় ১৫০টিরও বেশি পরিবার ঘরোয়া পরিমণ্ডলে এই দুর্গাপূজা করে আসছে বিগত চার দশক যাবৎ। পাঁচ থেকে পঁচাশি বছর বয়সের মানুষ এই পূজায় সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। দৈনিক ছয়-সাত পদ বিশিষ্ট ভোগ বিতরণ করা হয় আনুমানিক ৬০০-৭০০ মানুষের মধ্যে। আর প্রতিদিন অন্তত ১০০০০-১৫০০০ দর্শনার্থীদের ঢল নামে এই পূজা মণ্ডপে। চিত্তরঞ্জন পার্কে বেশ কিছু পরিবার তাঁদের বাড়িতেও সংক্ষিপ্ত পরিসরে দুর্গাপূজার আয়োজন করে থাকেন।সব মিলিয়ে বাঙ্গালির শ্রেষ্ঠ উৎসব চিত্তরঞ্জন পার্কেও ধরা দেয় এক অন্য রূপে, অন্য পটে সার্বিক আনন্দঘন পরিবেশ ও উৎসবময়তার এক সুন্দরতম মিশেলে। পূজার কদিন দিল্লির চিত্তরঞ্জন পার্ক যেন কলকাতায় রূপান্তরিত হয়ে যায়।