মা আসছেন
বৈশাখী কুণ্ডু
আগমন উপলক্ষ্যে প্রকৃতি যেন নবরূপে সজ্জিত হয়। নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলা, হাওয়ায় দোলা কাশবন, শিউলি ফুলের সুমিষ্ট গন্ধ, ঘাসের ডগায়
শিশিরের বিন্দুতে ভোরের আলো, যেন এক অপরূপ সৌন্দর্য তৈরি হয়। গ্রীষ্মকালের দাবদাহনের পর বর্ষা স্বস্তির বার্তা নিয়ে আসে। রুক্ষ শুষ্ক মাটির উপর
বৃষ্টির জল পড়ে। তারপর শরৎ ঋতুতে সেই মাটিতে আমন ধানের দোলা লাগে। রবি ঠাকুর এই শরৎ ঋতুকে নিজের মনের মাধুরী মিশিয়ে প্রকৃতির অপরূপ বর্ণনা করেছেন-
‘শরৎ তোমার অরুণ আলোর অঞ্জলি শিউলিবনের বুক যে ওঠে আন্দোলি’- প্রকৃতির প্রতিটি বর্ণনা কবির কলমে প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছে। আবারও ‘এসেছে শরৎ হিমের পরশ লেগেছে হওয়ার পরে’- শরৎ কালের আমেজ কবিতাটির পরতে পরতে লেগে রয়েছে। কবিগুরু শান্তিনিকেতনে শারদোৎসবের আয়োজন করেছিলেন। উদ্দেশ্য ছিল প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য নিজে উপভোগ করবেন এবং ছাত্রদের মধ্যে জাগরিত করাবেন। শারদোৎসব মূলত কবির লেখা
একই অঙ্গে মাতা, জায়া, কন্যা, জননী, ভগ্নী। প্রতিটি সম্পর্কের বাঁধন যত দৃঢ় হয় সম্পর্ক তত মধুর হয়। সামাজিক সম্পর্কের নিবিড় স্নেহ ভালোবাসার বন্ধনে মানুষ চিরকালই আবদ্ধ। সেই বন্ধনে স্বর্গের দেব-দেবীরাও আবদ্ধ। দেবী মহামায়াকে কন্যা এবং পরম শিবকে জামাতা রূপে কল্পনা বাঙ্গালিজাতির এক অভিনব বৈশিষ্ট্য। তাইতো প্রতি বছর আশ্বিনের মাঝামাঝি মা মেনকার ঘরে মা মহামায়ার কন্যা রূপে আগমন ঘটে। সোহাগে-বিরাগে, হাসি-কান্নায় পরিপূর্ণ
হয়ে আবালবৃদ্ধবনিতা আগমনী গানে মেতে ওঠে।
শরৎকালে দেবী দুর্গার পিত্রালয়ে আগমনকে কেন্দ্র করে জনমানসে আনন্দ ও ভক্তিরসের উন্মাদনা জাগে। তখন তো তিনি দেবী নন, তিনি আপামর বাঙ্গালির ঘরের মেয়ে উমা। সে মেয়ে সপরিবারে শ্বশুরবাড়ি থেকে বাপের বাড়িতে আসছে। উল্লেখ্য, সঙ্গে শুধু চার সন্তানই নয়, সন্তানদের বাহনরাও থাকে। এছাড়া অশুভ শক্তির প্রতীক মহিষাসুরকেও পরিবারের সদস্য রূপে স্থান দিয়েছেন। এই পরিবারের মধ্য দিয়ে মা মহামায়া আমাদের এই বার্তাই দেন যে, শুধু মানুষ নয়, প্রাণী ও বৃক্ষদেরও সমান যত্ন নিতে হয়।
পৌরাণিক ব্যাখ্যায় দেখা যায় দেবীর আগমন বা গমন কখনো হাতি, কখনো পালকি, নৌকা বা ঘোড়ায় চড়ে। এই প্রতিটি বাহনে চড়ে আগমন বা গমনের
ভিন্ন ব্যাখ্যা আছে। যেমন- রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতা, দুর্যোগ, খরা, ভূমিকম্প, শস্যশ্যামলা ভূমি ইত্যাদি পৃথিবীর বুকে হবে এমন ভাবনা বিরাজ
করে। এমনকী সারা বছর কেমন যাবে তাও নির্ভর করে। এগুলির সবই পৌরাণিক ব্যাখ্যা আছে কি? ওই প্রতিটি বাহনে চড়ে স্থান থেকে স্থানান্তরে গেলে
শরীরে ভিন্ন অনুভূতি জাগে তার প্রভাবে ধারণাগুলির উন্মেষ ঘটতে পারে। দেবী দুর্গার কন্যা রূপে পৃথিবীতে
একটি নাটক। যার বিষয়বস্তুতে রয়েছে প্রকৃতিকে উজাড় করে ভালোবাসা। শিউলি ফুলের গন্ধ, কাশফুলের বাহার, নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলা ইত্যাদির সঙ্গে ঢাকির ধুমুল মনে করিয়ে দিচ্ছে মায়ের পিত্রালয়ে আগমনের বার্তা। আগমনী গানে শরতের আকাশ বাতাস মুখরিত হয়ে ওঠে। বিদ্রোহী কবি নজরুলের সৃষ্টিতে মা দুর্গার বিভিন্ন দিক বিশেষ ভাবে ফুটে উঠেছে। কোথাও দেখা গেছে রণরঙ্গিনী রূপ, কোথাও ঘরের মেয়ে, আবার কোথাও ভক্তের হৃদয় বিগলিত আনন্দ। ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ কবিতাটি প্রকাশের ফলে রাজদ্রোহিতার অপরাধে কারাগার বন্দি হতে হয়। কবিতাটির প্রথম দুটি পঙ্ক্তি:
‘আর কতকাল থাকবি বেটি মাটির ঢেলা মূর্তি-আড়াল?/স্বর্গ যে আজ জয় করেছে অত্যাচারী শক্তি চাঁড়াল।’ অষ্টাদশ শতাব্দীতে এবং তার পরব্তীকালে শাক্ত
পদালবী বাংলা সাহিত্যের এক মূল্যবান সম্পদ। মূলত উমা, পার্বতী, চণ্ডী ও কালিকাকে কেন্দ্র করে শাক্ত পদাবলীর বিকাশ। একাধারে মেনকার সঙ্গে উমার পিত্রালয়ে মিলন, অপরদিকে বাঙ্গালির জীবনের নানা দিক ফুটে ওঠে এই আগামনী গানগুলিতে। মা মেনকার মধ্য দিয়ে সাধারণ বাঙ্গালি ঘরের মায়েদের
মনের কথা ব্যক্ত হয়েছে। সপ্তমী, অষ্টমী ও নবমী পর্যন্ত মা ও মেয়ে একসঙ্গে থেকে নিজেদের সুখ দুঃখ ভাগ করে নেবার পর নবমীর রাতেই বিষাদের সুর বেজে ওঠে। কারণ পরদিন সকালে তো উমার পিত্রালয় ছেড়ে কৈলাশে প্রত্যাবর্তনের সময় উপস্থিত হয়। গিরিরাজকে মেনকা বলে, ‘আমার গৌরী রে লয়ে যায় হর আসিয়ে/কি কবা হে গিরিবর রঙ্গ দেখ বসিয়ে।’
এইভাবে বিভিন্ন আঙ্গিকে দেবী মহামায়ার কন্যা রূপে মা মেনকার গৃহে আগমনের উৎসবে মর্ত্যবাসী মিলনোৎসবে মেতে ওঠে।