বাঁকুড়া শহরে গোপীনাথপুর দত্ত বাড়ির প্রাচীন দুর্গাপূজা
রবীন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়
প্রাচীন দুর্গাপূজাগুলির মধ্যে বাঁকুড়া শহরের গোপীনাথপুরে দত্ত বাড়ির দুর্গাপূজা অন্যতম। প্রথমে দত্ত বাড়ির পারিবারিক পূজাটি বাঁকুড়া জেলার মানকানালী গ্রামে আরম্ভ হয়। মানকানালী গ্রামের পাশ দিয়ে গন্ধেশ্বরী নদী প্রবাহিত। কথিত, এই গন্ধেশ্বরী নদীতে দত্ত বংশেরই জনৈক স্নান করতে গিয়ে একটি খড়া পান। সেই রাতেই তিনি স্বপ্নাদিষ্ট হন যে, ‘আমি তোর বাড়িতে গন্ধেশ্বরী রূপে এসেছি। তোরা আমার পূজা-অর্চনা কর।’ এই সূত্র থেকেই মানকানালী গ্রামে দত্ত বংশে দুর্গাপূজা শুরু হয়।
বাংলা ১১৭৬ সাল, ইংরেজি ১৭৭০ খ্রিস্টাব্দ, ভয়াবহ মন্বন্তরের সময় দত্ত বংশের স্বপ্নাদিষ্ট পারিবারিক পূজাটি গুরুর নির্দেশে বাঁকুড়া জেলার বিষ্ণুপুর থানার অন্তর্গত দ্বারকা গ্রামে স্থানান্তরিত হয়। দ্বারকা গ্রামে বেশ কিছু বছর দেবী পূজিত হন। পরে পরিস্থিতি ফিরে এলে পুনরায় মানকানালীতে পূর্বস্থানে পূজিত হন। এরপর ঊনবিংশ শতাব্দীতে মানকানালী গ্রাম থেকে সম্পূর্ণ দত্ত পরিবার বাঁকুড়া শহরের গোপীনাথপুরে চলে আসায় পূজা গোপীনাথপুরে শুরু হয়।গোপীনাথপুরে সেই পূজা ওই বংশের দামোদর দত্ত শুরু করেন। দামোদর দত্তের পুত্র বৃন্দাবন দত্ত এই পূজা পারিবারিক ধারা অনুসারে চালিয়ে যান। পরে
তাঁর পুত্র বৃন্দাবন দত্ত এবং তাঁর উত্তরাধিকারী ভবতারণ দত্ত ও মন্মথ দত্ত পূজাটি নির্দিষ্ট ধারা অনুসারে চালিয়ে যান। তাদের উত্তরপুরুষ একই ধারায় আজও এই পূজা চালিয়ে যাচ্ছেন। এই পূজায় কোনো মৃন্ময়ী প্রতিমা হয় না, কাপড়ের ওপর দেবীমূর্তি অঙ্কিত হয়ে শিবদুর্গার পূজা হয়। পর্দায় পারিবারিক শিব-দুর্গা, লক্ষ্মী- সরস্বতী এবং কার্তিক-গণেশের পূজা পরিলক্ষিত হয়। এই বংশের যিনি দেবীর খঙ্গ স্নান করতে গিয়ে পেয়েছিলেন, সেই খড়া দিয়েই বলিকার্য হয়। সপ্তমী-অষ্টমী ও নবমীতে বলিদান হয়। তবে পশুবলি হয় না। শুধুমাত্র আখ ও শসা বলি দেওয়া হয়। উল্লেখ্য, ওই খাঁড়াটিতে কোনো শান (ধার) দেওয়া হয় না। পুকুরের পাঁক ও বস্তা দিয়ে ঘষামাজা করলে পূর্বরূপ ফিরে আসে।
পরিবারের সদস্যরা দেবী-গন্ধেশ্বরীর প্রতি শ্রদ্ধা এবং গভীর অনুরাগ পোষণ করেন। একমাস যাবৎ বিভিন্ন প্রস্তুতি এবং ষষ্ঠীর রাত্রি যে পুত্তলিকাবুদ্ধি থাকে, কলাবধূ স্নান করানোর পর মন্ত্রপূত করে প্রতিমার পাশে অবস্থানের সঙ্গে প্রতিমা বুদ্ধি থাকে না। বিজয়াদশমী পর্যন্ত এক অদ্ভুত ভাবান্তর পরিলক্ষিত
হয়। তিনদিনের নিরবচ্ছিন্ন দেবীর পূজায়, তাঁর আবাহন দেবীজ্ঞানে মানুষের মতো পদ্য-অর্ঘ্য-বস্ত্র-ফলমূল, ধূপ-দীপ ইত্যাদির মধ্য দিয়ে দেবীর-অর্চনা হয়।
পরিবারের বালক-বালিকা, তরুণ-তরুণী অন্য পরিবার থেকে আগত গৃহবধূ এক অনন্য ভাবের অনুভব করে বা করেন। প্রকৃতপক্ষে আমরা যা দেখি বা শুনি এবং ইন্দ্রিয়ের দ্বারা যা গ্রহণ করি তার অতীতে যে বস্তু তার অনুভবেই ধর্ম সাধনের বনিয়াদ। এই পরিবারটি যেমন অনুভব করে সঙ্গে প্রতিবেশী এবং শহরের মানুষও দীর্ঘ প্রাচীন পূজাটির গৌরবগাথার মধ্য দিয়ে প্রীতি লাভ করে। পূজার রীতি, আঙ্গিক সবই পূজাপদ্ধতি অনুসারে হয়। পূজার মধ্যে বাহ্যিক ভাবনা অতিক্রম করে এর রসাস্বাদন এক অনির্বচনীয় ভাবের ও শক্তির প্রেরণা লাভ করে। এটাই পারিবারিক সূত্র থেকে উঠে এসেছে।
দেবীর রূপবর্ণনায় বলা হয়েছে- ‘চিন্তয়েৎ সততং দেবীং ধর্মকামার্থ মোক্ষদাম্’ সর্বদাই ধর্ম-অর্থ-কাম-মোক্ষ- এই চতুর্বর্গ প্রদায়িণী দেবীকে চিন্তা করবে। পুরাণ ভেদে পাঠান্তর দেখা যায়: ‘চিন্তয়েজ্জগতাং ধাত্রীং ধর্মকামার্থ মোক্ষদান’। কালিকাপুরাণে ‘সতত’ শব্দটির প্রয়োগই বুঝিয়ে দেয়, দেবী-ধ্যান, দেবী-চিন্তন, দেবী মনন আসলে শুধু পূজাকালীন কৃত্য নয়। দেবী-অনুক্ষণ-চিন্তনীয়া। দুর্গার চিন্তন শক্তিকেই দুর্গা করে তোলে। সাধক সাধ্যা মিলেমিশে একাকার হয়ে যান। সেটিই শক্তি সাধনার মূল লক্ষ্য।