সোনামুখী পালবাড়ির দুর্গাপূজা
বিজয় ঘোষাল
শরতের মেঘমুক্ত আকাশ আর কাশফুলের মাথা দোলানো দেখলেই মানুষের মন স্মৃতিমেদুর হয়ে পড়ে। বাঙ্গালির শ্রেষ্ঠ পর্ব শারদীয়া দুর্গাপূজা এখন শহর ছাড়িয়ে গ্রামেগঞ্জের পাড়ায় পাড়ায় হয়ে চলেছে। কিন্তু একসময় দুর্গাপূজা হতো বাড়িতে। বিশেষ করে শহর থেকে নগর সবখানেই জমিদারবাড়ি ও
বড়োবাড়িতে এই পূজার চল ছিল। প্রাচীনকালের সেই পূজাগুলির মধ্যে অনেক পূজা এখনো হয়ে আসছে। সময় পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হয়েছে, ভেঙে গেছে বড়বাড়ির একান্নবর্তী সংসার। তবু অনেক ক্ষেত্রেই সেইসব বাড়িতে বংশপরম্পরায় বাড়ির আদিপুরুষ প্রবর্তিত পূজা হয়ে চলেছে।
বাঁকুড়া জেলার সোনামুখী শহরের পালপাড়ার পালবাড়ির পূজা বর্তমান পুরুষদের হিসেব অনুযায়ী প্রায় ৫০০ বছরের প্রাচীন। সেই সময় পূজায় আধুনিকতার ছোঁয়া ছিল লক্ষ যোজন দূরে। পালবাড়ির পুজাকে ঘিরে বহু অলৌকিক লোককথা আজও পরিবারের সদস্যদের মুখে মুখে ফেরে। পাল বংশের প্রবীণ সদস্য
গনু পাল শোনালেন সেইসব প্রাচীন কাহিনি।
আজ থেকে প্রায় পাঁচশো বছর আগে এই পূজার প্রচলন করেন বংশের কোনো আদিপুরুষ। সেটাও শুরু করা হয়েছিল কোনো দুরারোগ্য ব্যাধি থেকে আরোগ্য লাভের আশায়। প্রচলিত প্রবাদ, ওই সময় বংশের অন্যতম এক সদস্যের দুরারোগ্য ব্যাধি হয়। সেই সময় কোনো পাশ করা ডাক্তার ছিল না। তাই রোগ সারাতে ভরসা করতে হতো কবিরাজ বা বৈদ্যর উপরে। সোনামুখীর নামকরা এক কবিরাজকে এনে চিকিৎসা শুরু করানো হয়। কিন্তু বহুদিন ধরে বহু চিকিৎসার পরেও সেই রোগ নিরাময়ের কোনো লক্ষণ দেখা যায়নি। এক সময় সেই কবিরাজ নাকি হাল ছেড়ে দিয়ে বলেছিলেন, আমার চিকিৎসার রোগী কোনো সাড়া দিচ্ছে না। তাই তাঁকে বাঁচানোর জন্য এখন ভগবানই ভরসা। এই কথা বলে কবিরাজ পালবাড়ি থেকে বিদায় নেন। তখন বাড়ির লোকেরা পড়ে যান ভীষণ চিন্তায়। তারা ভাবতে থাকেন কোন উপায়ে এই রোগ সারানো যায়। তখনই মা দুর্গাকে স্মরণ করে বাড়ির সদস্যরা বাড়ির উঠোনে শামিয়ানা টাঙিয়ে মা দুর্গার আরাধনা শুরু করেন।
বর্তমানে পূজায় যেমন আলোর বাহার জাঁকজমক থাকে, তখন কিন্তু তেমন কিছুই ছিল না। তবে এই পূজায় নিষ্ঠা ছিল ষোলোআনা। যা এখনো রয়েছে। ওই পূজা করার পরেই নাকি পালবাড়ির সেই সদস্য ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে ওঠেন। এটাই ছিল পাল বাড়ির পুজার আদিকথা। তারপর থেকে প্রতিবারই বাড়িতে দুর্গাপূজা হয়ে চলেছে। শামিয়ানা টাঙিয়ে পূজা শুরু হলেও পরবর্তীকালে মাটির মন্দির এবং আরও পরে পাকাপাকিভাবে নাটমন্দির গড়ে ওঠে। গনু পালের কথায়, বাড়ির পূজায় এতোটুকু অনাচার করার উপায় নেই। তাতে দেবী রুষ্ট হন। যেমন রুষ্ট হয়েছিলেন এক সময় দেবীর মূর্তি গড়া মৃৎশিল্পীর উপরে। প্রচলিত কাহিনি বলছে, সেই বছর বাড়ির বরাবরের ওই মৃৎশিল্পীর প্রচুর কাজ পড়েছিল। তাই তিনি জানিয়ে দেন দিনেরবেলা দেবীমূর্তি রং করবে না। রাতে দেবীর অঙ্গরাগ করবেন। বাড়ির সদস্যরা তা করতে নিষেধ করা সত্ত্বেও মৃৎশিল্পী নিজের সিদ্ধান্তে অনড় থেকে রাতেই রং করবেন বলে ঠিক করেন। সেইমতো এক রাতে উঁচু টুল নিয়ে তার উপরে উঠে দেবীর গায়ে রঙের প্রলেপ দিতে উদ্যত হন। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় যতবার তিনি রং-তুলি নিয়ে দেবীর গায়ে ছোঁয়ানোর চেষ্টা করেন ততবারই নাকি কেউ ওই টুল ধরে প্রবল ঝাঁকুনি দিতে থাকে। এর সঙ্গেই তিনি নূপুরের শব্দ শুনতে পান। ওই রাতে এত কিছু হলেও মৃৎশিল্পী মন্দিরে দ্বিতীয় কোনো ব্যক্তিকে দেখতে পাননি। এই ঘটনার পর শিল্পী ভীষণ ভয় পেয়ে রাতে রং করার সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসেন।
আরও একটি কাহিনি রয়েছে। তখন পালেদের অবস্থা নিম্নগামী। আয় বলতে কিছুই নেই। বাড়ির লোকেদেরও সামর্থ্য নেই দুর্গাপূজার বিপুল ভার বহন করার। তখন বাড়ির সদস্যরা আলোচনা করে ঠিক করেন দেবীর সোনার গয়না বন্ধক রেখে পূজার আয়োজন করা হবে। সেইমতো স্থানীয় এক মহাজনের কাছে ৫০ টাকার বিনিময়ে গয়নাগুলি বন্ধক রাখেন। কিন্তু সেই রাতে ওই মহাজন বাড়িতে বিভিন্ন রকমের শব্দ, কখনো শঙ্খধ্বনি বা অন্যান্য শব্দ শুনে ভীষণ ভয় পেয়ে যান। তিনি বুঝতে পারেন দেবীর গয়না বন্ধক রেখে তিনি খুব অন্যায় করেছেন। ভীতিকর এইসব শব্দের মধ্যে দিয়েই দেবী যেন নির্দেশ দিচ্ছেন ওই গয়না ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য। তখনই সেই মহাজন কালবিলম্ব না করে পালেদের দেওয়া ৫০ টাকা পূজার জন্য উৎসর্গ করে দেবীর সব গয়না ফিরিয়ে দেন। পালবাড়ির পুজাকে ঘিরে এমনই বহু কাহিনি রয়েছে। বর্তমানে পালেদের পরিবার ভাগ হয়ে গেলেও বাড়ির পূজায় সবাই এক হয়ে যে যার সাধ্যমত অর্থ দিয়ে এই পূজা করছেন। তবে প্রাচীনকালের মতো এখন পালবাড়ির পূজায় কোনো জাঁকজমক নেই। যা রয়েছে তা হলো পূজার উপচার এবং প্রতিটি নির্ঘণ্টও মেনে নিষ্ঠা ভরে পূজা। যে পূজা দেখে নিজের অজান্তেই মানুষের ভক্তি আর বিশ্বাস জাগ্রত হয়ে ওঠে।