‘রূপং দেহি জয়ং দেহি যশো দেহি দ্বিষো জহি’
বিমল কৃষ্ণ দাস
শ্রীশ্রীচণ্ডীর প্রারম্ভেই ঋষি মার্কণ্ডেয় কণ্ঠে উচ্চারিত হয়েছে সাতাশটি শ্লোকের অর্গলা স্তোত্র। তিনি বলছেন- শ্রী জগদম্বার প্রীতিসাধনে রচিত এই অর্গলা স্তোত্র পাঠ করার পরেই মহাস্তোত্র (শ্রীশ্রী চণ্ডী) পাঠ করা বিধেয়। চণ্ডীর মূল তিনটি আখ্যায়িকা অংশে আছে মোট ৪৬৪টি শ্লোক- মধুকৈটভ বধ থেকে শুরু করে মহিষাসুর, ধুম্রলোচন, চণ্ডমুণ্ড রক্তবীজ ও নিশুম্ভ শুম্ভ বধ পর্যন্ত। বাকি বিভিন্ন অংশে দেবীস্তব ইত্যাদি মিলিয়ে সাতশোর কিছু বেশি শ্লোক বর্তমান। প্রশ্ন হলো, এই ২৭টি শ্লোকের মধ্যে এমন কী আছে যার জন্য ঋষি মার্কণ্ডেয় মূল চণ্ডীপাঠের আগে এই অংশটি পাঠ করার নির্দেশ দিয়েছেন বা আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। মূল চণ্ডীর বহু কিছু না জানলেও আমাদের মহালয়ায় আকাশবাণীর ‘মহিষাসুর মর্দিনী’ অনুষ্ঠানের সুবাদে বাণীকণ্ঠ বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের সুললিত কণ্ঠে উচ্চারিত চণ্ডী স্তোত্রের শ্লোকগুলির অতিরিক্ত আমরা পঙ্কজ মল্লিকের কণ্ঠে সুরে সুরে অর্গলাস্তোত্র সমূহের সঙ্গে সকলে পরিচিত। সমগ্র অর্থ না বুঝতে পারলেও সুরমাধুর্যে কথাগুলি যেন প্রাণবন্ত হয়ে সকলের মনে এক অন্য অনুভূতির সৃষ্টি করে, হয়ে ওঠে আমাদের কাছে যেন এক জাগরণী গান।
‘ওঁ জয়ত্বং দেবী চামুণ্ডে জয় ভূতাপ হারিণি। জয় সর্বগতে দেবী কালরাত্রি নমোহস্তুতে।। জয়ন্তী মঙ্গলা কালী ভদ্রকালী কপালিনী। দুর্গা শিবা ক্ষমা ধাত্রী স্বাহা স্বধা নমোহস্তুতে।। জয়ন্তী মঙ্গলা কালী ভদ্রকালী কপালিনী। দুর্গা শিবা ক্ষমা ধাত্রী স্বাহা স্বধা নমোহস্তুতে।। মহিষাসুরনির্ণাশি ভক্তানাং সুখদে নমঃ। রূপং দেহি জয়ং দেহি যশো দেহি দ্বিষো জহি।। এর পরে ছাব্বিশতম শ্লোক পর্যন্ত প্রতিটি শ্লোকেই দেবীস্তুতির সঙ্গে যাজ্ঞা করা হচ্ছে- ‘রূপং দেহি… দ্বিষো জহি।’ প্রথম দুটি ও শেষের শ্লোকটি-সহ মোট ৩টি শ্লোক বাদ দিলে বাকি ২৪টি শ্লোকে এই একই প্রার্থনা। তার অর্থ এই চাওয়া বস্তুকয়টির গুরুত্ব নিশ্চয়ই
অসীম, নতুবা এতবার কেন এই একই প্রার্থনা! কী আছে এর মধ্যে! আপাত দৃষ্টিতে সবাই বলবেন- কী আর আছে! এতো পরিষ্কার সেই চিরন্তন কথা। সেই অনাদিকাল থেকে মানুষের একই অন্তর-বাসনা। -আমায় সুন্দর রূপ দাও, সর্বত্র জয়ী কর, যশ দাও আর আমার শত্রু বিনাশ কর। একেবারে নিজের একান্ত চাওয়া। এখন বিচারের বিষয় হলো রূপ, সৌন্দর্য সবাই চায়। আমি সুন্দর হই, সকলে আমাকে দেখবে- আমাকেই দেখবে; তাইতো মানুষের এত সাজপোশাক, রূপচর্চার আয়োজন। তবে এই প্রবণতা কিন্তু সমস্ত প্রকৃতির মধ্যেও বর্তমান। কীট-পতঙ্গ, প্রাণী, বৃক্ষলতা সকলেরই নিজের নিজের সৌন্দর্য প্রকাশের অসীম আগ্রহ। নিজের পরিমণ্ডলে পরস্পরের দৃষ্টি আকর্ষণ করার এক গভীর আকাঙ্ক্ষা। সৃষ্টিকর্তা তাই সকলের জন্য নানা ব্যবস্থারও ত্রুটি রাখেননি।
কিন্তু তাঁর এই দান বড়ো ক্ষণস্থায়ী। আজ মুগ্ধ-সৌন্দর্য নিয়ে প্রস্ফুটিত ফুল কাল শুকিয়ে যায়। মানুষের রূপও এক সময় বিবর্ণ হতে থাকে। তাহলে ঋষি মার্কণ্ডেয় কেন এমন তুচ্ছ বস্তুর জন্য বার বার প্রার্থনা করেছেন! যার কোনো স্থায়িত্ব নেই তার জন্য আগ্রহ তিনি নিশ্চয়ই করেননি। প্রকৃতপক্ষে ‘আমায় রূপ প্রদান কর’ এর অর্থ দৈহিক রূপ নয়। আমার আত্মরূপ, আমার সত্তাকে রূপায়িত কর, আমার প্রকৃতি, আমার সামর্থ্যকে জানলেই না আমার কর্মপথ
নির্ধারিত সম্ভব হবে। যদি আমি ক্ষত্রিয়ই হই তবে তো আমার কাজ, আমার কর্তব্য সকলকে রক্ষা করা। যদি আমার মধ্যে শিল্পীসত্তা বর্তমান থাকে তবে আমার কাজ সৃষ্টির সত্যকে নানা রূপে তুলে ধরা- সকলকে আনন্দিত করা। শক্তি এক সত্তা। তাই এত কর্মবৈচিত্র্য, সংসার চক্রে পূর্ণতা আনার প্রয়াস। মহর্ষি দেবীর কাছে আপন অন্তর-রূপ প্রার্থনা করেছেন। ‘চিদানন্দ রূপ শিবোহম্ শিবোহম্’, শুধু কথা নয়, শুধু অনুভূতি নয়। নিরাকার নয়, সাকার চাই। বিমূর্ত নয়, মূর্তরূপে পরিগ্রহ করাও। দেহের নয়, দেহের মাঝে যিনি আছেন- তার রূপ প্রদান কর। রবীন্দ্রনাথের কথায়- ‘তোমারি মিলনশয্যা হে মোর রাজন,/ক্ষুদ্র এ আমার মাঝে অনন্ত আসন/অসীম, বিচিত্র, কান্ত। ওগো বিশ্বভূপ,/দেহে মনে প্রাণে আমি একি অপরূপ।’
জয় দাও- ‘জয়ং দেহি’, জয় দু-রকমের, এক- আমি চাই- তা পাওয়াটা আমার পক্ষে জয়। আবার প্রতিপক্ষকে পর্যুদস্ত করাও জয়লাভ। এই চাওয়ার মধ্যেও কত মানুষের কতরকম জয়লিপ্সা। ধার্মিক যেমন অধার্মিকের উপরে জয় চায়, তেমনি অসৎ, অপরাধীও তো তার কাজে জয়ের আশা রাখে। আবার আমার তারা কোনো ক্ষতি করেনি কিন্তু তাদের ক্ষতিসাধন করে আমার উদ্দেশ্য লাভে বিজয়ী হলাম, – এমন জয়াগ্রহ কেন! এখানে কাজ করছে আমার প্রবৃত্তি, আমার ঈর্ষা, লোভ, বাসনা। প্রকৃতপক্ষে দেবীর কাছে এদের উপরেই জয়লাভের প্রার্থনা করা হয়েছে। আপ্তজনেরা বলে থাকেন- অপরকে জয় করা সহজ। পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন কাজ নিজের উপরে জয়লাভ করা। আর এ কাজ যিনি পারেন সেই পুরুষকে বলা হয় জিতেন্দ্রিয়, আত্মজয়ী, জিতাত্মা। ‘যশো দেহি’- যশ এখানে ‘খ্যাতি’ বলে মনে হয় না। বরং ‘কীর্তি’ শব্দ দিয়ে অনেকটা অর্থের কাছাকাছি আসা যেতে পারে।
কারণ যশ সাধারণত অহঙ্কারের জন্মদাতা। সেই যশ দেবকুল প্রার্থনা করবেন! তাঁরা আসলে সৎকর্মে, কতর্ব্যকর্মে নিয়োজিত কর্মে কীর্তিমান হওয়ার প্রার্থনা করেছেন। গীতায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বিষাদগ্রস্ত অর্জুনকে খুব স্পষ্টভাবে জানিয়েছেন, ‘তুমি যদি ধর্মযুদ্ধ না কর তবে স্বধর্ম ও কীর্তি হারিয়ে তুমি পাপগ্রস্ত হবে, লোকে চিরকাল তোমার অপযশ করবে, সম্মানিত ব্যক্তির কাছে অপযশ মৃত্যুর চাইতে বেশি।’ -তাই কর্তব্য কর্মে কীর্তি স্থাপনই প্রকৃত যশ। অন্যদিকে বৈষ্ণব সাধনায় ‘যশ’কে বলা হয়েছে সাধনপথের অন্তরায়। কারণ যশ অহঙ্কারেরই নামান্তর। তর্কে বিজয়ী শ্রীজীবের প্রতি রূপ সনাতনের উক্তি ছিল- ‘যশ প্রতিষ্ঠা শূকরী বিষ্ঠা মেখে এলে সারা গায়!’ তাদের যশ বৈরাগ্য ও ত্যাগে। এটি একরকম পরোক্ষ যশ। যাকে বলা যায় একপ্রকার সুকৃতির স্বীকৃতি। অহঙ্কার বর্জিত সুকৃতির যশই অর্গলাস্তোত্রে দেবীর কাছে প্রার্থনা করা হয়েছে।
দ্বিষো জহি- আমার শত্রুনাশ কর। এর অর্থ এই নয় যে আমি যাদের শত্রু ভাবি তাদের সব ধ্বংস করো। স্বার্থের টানাপোড়েনে শত্রুর পরিবর্তন হতে থাকে। হ্রাস বৃদ্ধি হয়, সবাইকে নাশ করলে একসময় তো কেউ থাকবো না। আসলে যদি এই বাইরের শত্রু নাই থাকে তবে তো ধ্বংসের প্রয়োজন নেই। প্রকৃতপক্ষে বাইরের শত্রু তখন সৃষ্টি হবে না। যদি আমার ভেতরের শত্রু সক্রিয় সজীব না থাকে। ভেতরে শান্তি বিরাজ করলে জগৎও শান্তিময় হয়ে উঠবে।
আমার ভেতরে যে লোভ, লালসা, ঈর্ষা, হিংসা- যারা নিরন্তর বাইরের শত্রু সৃষ্টি করছে, তাদের বিনাশ হলে তো আর সংঘাতের কোনো প্রয়োজন হবে না! ঋষি মার্কণ্ডেয় দেবীর কাছে এই শত্রু বিনাশেরই আর্তি জানিয়েছেন। মহাশক্তি সাধনার আগে এ হলো পাত্রটি প্রস্তুত করা। আপন স্বরূপকে চিনতে শেখাও, আমার প্রবৃত্তিকে জয়লাভের শক্তি দাও, কর্মচেতনা জাগ্রত করে কীর্তিমান কর, আর অন্তরে ঠাঁই পাওয়া ষড়রিপুর বিনাশ কর। পরিচ্ছন্ন উপযুক্ত পাত্র না
হলে কি মূল্যবান পবিত্র সামগ্রী রাখা যায়। শ্রীশ্রীচণ্ডীতে তার জন্যই এই অর্গলাস্তোত্রের অবতারণা।