মহামায়া : অধ্যাত্ম ও বিজ্ঞান
লক্ষ্মণ চন্দ্র মাইতি
পরমা প্রকৃতি আদ্যা দুর্গা সুরেশ্বরী
মহামায়া মহাকালী তুমি মহামারী।
ত্রিগুণা পরমেশ্বরী তুমি মহালক্ষ্মী
মহাবিদ্যা সরস্বতী তোমারে প্রণমি।।
আধুনিক বিজ্ঞান প্রকৃতির তত্ত্ব বিজ্ঞান। বৈজ্ঞানিকরা প্রকৃতিকে তন্ন তন্ন করে অনুসন্ধান করে, প্রাকৃত বস্তুকে বীক্ষণাগারে বিশ্লেষণ করে প্রকৃতির তত্ত্ব ও সৃষ্টির রহস্যকে আবিষ্কার করেছেন এবং মানব কল্যাণে ব্যবহার করেছেন। জড় বিজ্ঞানের জয়যাত্রার হাজার হাজার বছর আগে মুনি, ঋষি, বেদান্তবিদ, অধ্যাত্ম-বিজ্ঞানীরা ধ্যানের মাধ্যমে সৃষ্টির তত্ত্ব ও রহস্য উদ্ঘাটন করেছেন এবং মানব জাতি ও সমস্ত জীব জগতের কল্যাণে নিঃস্বার্থভাবে দান করেছেন, উভয়ের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বিশ্বের কল্যাণ ও সত্যের অনুসন্ধান। অধ্যাত্ম-বিজ্ঞান ও আধুনিক জড়-বিজ্ঞান আলোকে মহামায়া চণ্ডীতত্ত্বের বিশ্লেষণের লক্ষ্যে এই প্রবন্ধের অবতারণা।
মহালয়ার ঊষালগ্নে আমরা মহামায়া চণ্ডীর যে স্তব-গান, বন্দনাগীতি নিবিষ্ট চিত্তে শ্রবণ, মনন ও উচ্চারণ করি, সেগুলি বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতে বিশ্লেষণ করলে দেখতে পাব, এই স্তোত্রগুলি জীবন বিজ্ঞান, প্রকৃতি বিজ্ঞানের তত্ত্বগুলিকে বিজ্ঞানের আবিষ্কারের বহু আগে প্রকাশ করেছে।
প্রতি বছর সাড়ম্বরে দেবী দুর্গার বোধন হয়ে থাকে। এই দেবী, শাক্তদের কাছে আদ্যাশক্তি মহামায়া, শৈব্যদের কাছে শিবশক্তি, বৈষ্ণবরা যাঁকে বলেছেন- বিষ্ণুমায়া বা যোগমায়া, আবার সাংখ্যদর্শনে যিনি প্রকৃতি স্বরূপা, দেবী ভাগবতে যাঁকে- নির্গুণা যা সদা নিত্যা ব্যাপিকা হবিকৃতা শিবা। যোগগম্যাহখিলাধারা তুরিয়া যা চ সংস্থিতা।।
তস্যাস্ত সাত্ত্বিকী শক্তি রাজসী তামসী তথা। মহালক্ষ্মী মহাসরস্বতী মহাকালীতি তাঃ স্ত্রিয়ঃ।। (১/২) দেবী যিনি সদা নির্গুণা, নিত্যা, ব্যাপিকা, অবিকৃতা ও শিবা, যাঁকে যোগ-ধ্যানে লাভ করা যায়, যিনি বিশ্বধারা ও তুরীয়া রূপে সংস্থিতা এবং যিনি সাত্ত্বিকী শক্তিতে জ্ঞানরূপা মহাসরস্বতী, রাজসী শক্তিতে
ক্রিয়ারূপা মহালক্ষ্মী এবং তামসী শক্তিতে ইচ্ছা-স্বরূপা মহাকালী। এক মহামায়া পরমেশ্বরী পরমা প্রকৃতি ত্রিগুণা রূপে ত্রিবিধাঃ- মহাসরস্বতী, মহাকালী, মহালক্ষ্মী-ইচ্ছা ক্রিয়ার সমন্বিত রূপে মহামায়ার এই ত্রিগুণের ধারায় প্রতিনিয়ত সংঘটিত হয়ে চলেছে বিশ্বের বিকাশ-সৃষ্টি-স্থিতি-লয় এবং মহাসম্প্রসারণ ও
মহাসংকোচন।
ব্রহ্মের সৃষ্টি শক্তি ব্রহ্মা, স্থিতি শক্তি বিষ্ণু এবং সংহার শক্তি বা লয় শক্তি শিব। তাই দেব-দেবী কোনো মূর্তি নয়, এক একটি শক্তির নাম। বেদান্তে, তন্ত্রে, সেই শক্তি পূজার কথা বলা হয়েছে, মূর্তি পূজার কথা নয়। সাধক রামপ্রসাদের সংগীতে সেই সত্যের প্রসাদ আস্বাদনীয়-
‘মাটির প্রতিমা পূজিস রে তোরা
মাকে তো তোরা পূজিসনে।’
‘শ্রীশ্রীচণ্ডী’তে দেবগণ মহামায়াকে ‘প্রকৃতি দেবী’-রূপে প্রণাম জানিয়েছেন- নমঃ প্রকৃত্যৈ ভদ্রায়ৈ নিয়তাঃ প্রণতাঃ স্ম তাম্।। (৫/৯) বিশ্ব প্রকৃতির মধ্যে বিরাজিত সর্বব্যাপী শক্তিকে ঋষিরা যোগধ্যানের মাধ্যমে লাভ করেছেন; মনের নিয়ন্ত্রণ তথা মনঃসংযোগ দ্বারা। আধুনিক বৈজ্ঞানিকরা প্রতি বস্তুর অতি ক্ষুদ্র পরমাণুর মধ্যে যে শক্তি নিহিত তার পরিমাপ করেছেন এই সমীকরণের মাধ্যমে- E (শক্তি) = M (বস্তুর ভর) x C² (আলোর গতিবেগের বর্গ)। বিশ্বজতের প্রতিটি পদার্থের মধ্যে যে শক্তি নিত্য বর্তমান তা চণ্ডীতত্ত্বের মধ্যেও পাই- যা দেবী সর্বভূতেষু শক্তিরূপেণ সংস্থিতা। (৫/৩৪) দেবী, যিনি সর্বভূতে (সমস্ত জড় ও জীবে) শক্তি রূপে বিরাজমান।
বিজ্ঞানীগণ পরমাণুকে বিশ্লেষণ করে দেখালেন নিউট্রন, প্রোটন ও ইলেকট্রন কণার গতি ও শক্তি বিন্যাস। আবিষ্কৃত হলো পরমাণু বোমা, যা সমগ্র পৃথিবীকে ধ্বংস করে দিতে পারে। পরমাণুর অভ্যন্তরে ইলেকট্রন, প্রোটন, নিউট্রন তথা ফোটন কণার গতিপথে কণাগুলির মধ্যে সংঘাত ঘটালে বেরিয়ে আসে বিশাল ভয়ংকর অতি উচ্চ তাপমাত্রার তাপশক্তি, যে তাপে কঠিন পদার্থ তরলে, তরল পদার্থ বাষ্পীয় পদার্থে নিমেষে রূপান্তরিত হয়। জাপানের হিরোশিমা ও
নাগাসাকিতে সেই অ্যাটম বোমার ধ্বংসাত্মক ক্রিয়া আমরা প্রত্যক্ষ করেছি।
শ্রীশ্রীচণ্ডীতে আরো বলা হয়েছে- যা দেবী সর্বভূতেষু মাতৃরূপেণ সংস্থিতা (৫/৭৩) দেবী, যিনি সর্বভূতে (জীবে ও জড়ে) মাতৃশক্তি রূপে অবস্থিতা। মাতৃশক্তি হলো প্রজনন শক্তি। জনক বা জননী যিনি জনন করেন। এই জননী শুধু গর্ভধারিণী নয়- তিনি পালন করেন, স্নেহ মায়া মমতা প্রেম দিয়ে সন্তানকে রক্ষা করেন, জগজ্জননী মা মহাপ্রকৃতি ও আমাদের তাঁর অনন্ত স্তনধারা- আলো, জল, বাতাস, তাপ, ফুল, ফল, ফসল, ওষধি দিয়ে পুষ্ট করেন। রক্ষা করেন। আবার মহাকাশের অন্ধকার মহাযোনিতে মুহূর্তে কোটি কোটি গ্রহ নক্ষত্র সৃষ্টি হচ্ছে, স্থিতি লাভ করছে, আবার লয় হচ্ছে।
একই জনন ক্রিয়া, সৃষ্টিক্রিয়া চলছে প্রতিটি মৌল, যৌগ ও পরমাণুর মধ্যে। হাইড্রোজেন, অক্সিজেন পরমাণুর মিলন ক্রিয়ার সৃষ্টি হচ্ছে জল; এভাবে মৌলে যৌগে, রাসায়নিক মিলন ক্রিয়ায় সৃষ্টির অনন্ত কোটি বিকাশ ও প্রকাশ। পরমাণুর গভীরে ইলেকট্রনে ইলেকট্রনে, প্রোটনে প্রোটনে চলছে সৃষ্টির প্রজনন ক্রিয়া।
সোডিয়ামের ইলেকট্রনের সঙ্গে ক্লোরিনের ইলেকট্রনের তড়িৎযোজী বন্ধনে সৃষ্টি হচ্ছে খাদ্যলবণ। বেদান্ত বলছে ‘সর্ব্বং খল্বিদং ব্রহ্ম’,- সব কিছু চৈতন্যময়, প্রাণময়। সবই চৈতন্যের সৃজন লীলা-সৃষ্টির আনন্দ নিকেতনে।
মা যেমন স্নেহ মায়ার আকর্ষণে আমাদের ধরে রাখেন, তেমনই মহামায়ায় আকর্ষণে এই জগৎ সংসার বাঁধা। বিজ্ঞান যাকে বলছে মহাকর্ষ, অধ্যাত্ম-বিজ্ঞানে তাকে বলা হয়েছে মহামায়ার আকর্ষণ- প্রতিটি বস্তুতে প্রাণ আছে, চৈতন্য আছে, বলেই এই মায়ার আকর্ষণ। আমাদের চতুর্দশ ইন্দ্রিয়ের প্রত্যেকটিতে এক একটি দেবতা বা শক্তি নিহিত রয়েছে- যার দ্বারা ইন্দ্রিয়গুলি ক্রিয়াশীল। দেবী চণ্ডীর বন্দনা-গীতে আমরা তা পাই। সর্বোপরি, অধ্যাত্ম-বিজ্ঞান বলে বিশ্বের
সবকিছু চিৎশক্তি দ্বারা পরিচালিত। যার ধারে কাছে জড় বিজ্ঞানের গবেষণা আজও পৌঁছতে পারেনি। তবে আশার আলো-বৈজ্ঞানিক ফ্রিটজফ কাপরা তাঁর The Tao of Physics গ্রন্থে লিখেছেন, ‘Finally both (Metaphysical and scientific) approaches recognise that consciousness may be an essential aspect of the universe that will have to be included in a future theory of the Physical Phenomena.’ ‘পরিশেষে (অধ্যাত্ম-বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানে) উভয় পক্ষই মান্যতা দিচ্ছে- চৈতন্য বা চেতনাকে মহাবিশ্বের অত্যাবশ্যক বিষয় হিসেবে অদূর ভবিষ্যতে পদার্থ বিজ্ঞানের গবেষণায় প্রকৃতি তত্ত্বের উদ্ঘাটনে স্থান দিতে হতে পারে।’
বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে বিশ্ব আছে, আছে তার ক্ষেত্র এবং ক্ষেত্র নিহিত শক্তি। চৈতন্যকে স্বীকৃতি দেওয়ার তত্ত্বে এখনো বিজ্ঞান পৌঁছতে পারেনি। কিন্তু গীতা ও চণ্ডীতে- ক্ষেত্র আছে, আছে সমগ্র ক্ষেত্র জুড়ে শক্তি এবং ক্ষেত্রজ্ঞ চৈতন্য। চণ্ডীতে মহামায়ার বন্দনা মন্ত্রে-
‘চিতিরূপেণ যা কৃৎস্নমেতদ্ ব্যাপ্যা স্থিতা জগৎ। নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমোেনমঃ।’ মহামায়া যিনি চিৎশক্তি রূপে সমগ্র বিশ্ব ব্যাপী অবস্থিতা। তাঁকে
নমস্কার, তাঁকে নমস্কার, তাঁকে নমস্কার। মানবজাতি এগিয়ে চলুক ধ্যান ও জ্ঞানের পথে; বিজ্ঞানের পথে। অদূর ভবিষ্যতে বিজ্ঞানের বীক্ষণাগারে চৈতন্যের আলোর দরজা উন্মোচিত হবেই হবে।