বাংলা সাহিত্যের প্রথম শারদীয়া ও বাংলা শারদীয়া সংখ্যার প্রথম বিজ্ঞাপন
সংকর্ষণ মাইতি
জানা যায়, দেড়শো বছর আগে একজন ব্রাহ্মর হাত দিয়ে বাংলা সাহিত্যের প্রথম শারদীয়া পত্রিকা প্রকাশ পেয়েছিল। যাঁর হাত দিয়ে প্রকাশ, তিনি হলেন ব্রাহ্ম সমাজের অন্যতম বিশিষ্ট ব্যক্তি কেশবচন্দ্র সেন। ১৮৫৭ সাল নাগাদ দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরকে তিনি ‘মহর্ষি’ উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর
কেশবচন্দ্র সেনকে ‘ব্রহ্মানন্দ’ উপাধি দিয়েছিলেন।
কেশবচন্দ্র সেনের একটি পত্রিকা ছিল- ‘সুলভ সমাচার’। তখন পত্রিকায় সম্পাদকের নাম প্রকাশ করা চালু হয়নি। বঙ্গদর্শন পত্রিকায় প্রথম সম্পাদকের নাম ছাপা শুরু হয়।
কেশবচন্দ্র সেন পরিচালিত ‘সুলভ সমাচার’-এ বাংলা সাহিত্যে প্রথম শারদীয়া ‘ছুটির সুলভ’ প্রকাশিত হয়েছিল। দিনটি ছিল ১০ আশ্বিন, ১২৮০ বঙ্গাব্দ (ইং ১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দ) বৃহস্পতিবার। ‘ছুটির সুলভ’ শব্দবন্ধ থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়, সে সময়ে দুর্গাপূজার সময় ছুটি দেওয়ার রেওয়াজ ছিল। তবে কেশবচন্দ্র সেনের ‘ছুটির সুলভ’ শারদীয়াতে দুর্গোৎসব বা পূজা শব্দটি ব্যবহার করা হয়নি। কারণ, কেশবচন্দ্র সেন ছিলেন ব্রাহ্ম। প্রতিমা পূজায় বিশ্বাসী ছিলেন
না। তাই শারদীয়ার নামটি ছিল- ‘ছুটির সুলভ।’ এখন যেমন শারদীয়া পত্রিকা প্রকাশের অনেক আগে থেকে কিছু কিছু দৈনিক এমনকী সাপ্তাহিক পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেখা যায়, সে সময়েও সুলভ সমাচার-এ শারদীয়া ‘ছুটির সুলভ’-এর বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছিল। ১২৮০ সালের ১০ আশ্বিন শারদীয়া ‘ছুটির
সুলভ’ প্রকাশ পাবে- এই উদ্দেশ্যে ১ আশ্বিন, ১২৮০ তারিখে সুলভ সমাচার পত্রিকায় একটি বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছিল।
।। ‘ছুটির সুলভ’।। আগামী ছুটি উপলক্ষ্যে সুলভের বিশেষ একখণ্ড বাহির হইবে। উত্তম কাগজ, উত্তম ছাপা। দাম কিন্তু ১ পয়সা।
বিজ্ঞাপনে আবেদনটি ছিল এই রকম:
‘মজা করে পড়িতে পড়িতে ঘরে যাও। একটা পয়সা দিয়ে সকলের কিনিতেই হইবে। দেখ যেন কেউ ফাঁকি পড়ে না।’ উল্লেখ্য, বাংলা সাহিত্যে প্রথম শারদীয়া পত্রিকা ছিল ‘ছুটির সুলভ’। আবার সুলভ সমাচার পত্রিকায় প্রকাশিত এই বিজ্ঞাপনটি হলো বাংলা সাহিত্যের শারদীয়া সংখ্যার প্রথম বিজ্ঞাপন।
‘ছুটির সুলভ’ শারদীয়া পত্রিকাতে কী কী ছবি, মজার মজার বিষয়, কাগজ কী রকম, ছাপা কেমন- এই নিয়ে ৮ আশ্বিন, ১২৮০ (বঙ্গাব্দ) মঙ্গলবার সুলভ সমাচার-এ আরও একটি বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হয়েছিল।
বিজ্ঞাপনটি এই রকম: ‘আগামী বৃহস্পতিবার ‘ছুটির সুলভ’ বাহির হইবে। কেমন সুন্দর কাগজ, কেমন পরিষ্কার ছাপা, কেমন মজার ছবি, অথচ কেমন সস্তা দাম! ছেলেবুড়ো সকলেই মজা করিয়া ‘ছুটির সুলভ’ পড়ো। দেখ যেন কেউ ফাঁকি পড়ো না।… কত মজার মজার কথা!’ বিজ্ঞাপনে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘ছুটির সুলভ’ পড়লেই ছেলেবুড়ো সকলে মজা পাবেন। কীরকম মজা? উল্লেখ্য- ওই সংখ্যায় কোনো লেখকের নাম ছিল না। সংখ্যাটি হলো প্রথম
শারদীয়া ‘ছুটির সুলভ’।
‘সত্যগল্প’ এই শিরোনামের গল্পটিতে একটি বিয়ের গল্প রয়েছে। ছেলের বিয়ে দিতে বাবা বরযাত্রী-সহ মহাসমারোহে বাড়ি থেকে সাত ক্রোশ দূরে, কনের বাড়ির উদ্দেশে যাত্রা করেন। অনেকেই মদ্যাসক্ত। কনের বাড়ি অনেক দূরে, কাজেই প্রত্যুষেই যাত্রা।
কন্যাকর্তাটি আবার ইয়ং বেঙ্গল দলের লোক। তাঁর নাকি দিশিতে মানায় না, বিলিতি না হলে তাঁর রঙ্গ হয় না। কনের মামা অবশ্য নিরামিষাশী। বরকর্তা ও কন্যাকর্তা দুজনেরই মিল সুরাসক্তিতে।
বিয়ের যাত্রাপথে বরের অভিজ্ঞতা হয়েছিল। যাত্রাপথে বিশ্রাম। বিশ্রামে পানাহার। বাজনদার, নাপিত, পুরোহিত, পালকির বেহারা, মায় বরকর্তা পানাহারে ভোঁ। বরবাবাজি পালকিতে। ভাবছেন, বিয়েটা হবে তো?
সন্ধ্যের সময় সবাই কনের বাড়িতে। সেখানেও একই দৃশ্য। বরবাবাজির মনে জিজ্ঞাসা- কখন ছাদনাতলায় ডাক আসবে? কনের মামা বিয়ের লগ্ন ধরে ভাগ্নির বিয়ে সম্পন্ন করেন। পরের দিন কনের শ্বশুরবাড়িতে গমন। বরকর্তার ছেলে ও বউমাকে নিয়ে বাড়ি ফেরার তোড়জোড়।
ছেলের বাবা বউমাকে দেখতে চাইলে, ছেলে তাঁর স্ত্রীকে দেখাতে রাজি হননি। বাবার প্রতি ক্ষুব্ধ, দারুণ ক্ষুব্ধ। কনের বাড়িতে আসা ইস্তক, কনের বিয়ে পর্যন্ত ইয়ারদের নিয়ে শুধুই পানাহার। বাবা তথা বরকর্তার মানসম্মান বলে কিছুই থাকল না। ছেলের ব্যবহারে বাবাও ক্ষুব্ধ। বাবার কথার অমান্যি করলে!
‘চল্, বাড়ি চল্, দেখাচ্ছি মজা’- মনে রাগটা পুষে রেখেছেন তিনি। শোনা যায়, পরে ছেলেকে ত্যজ্য করেছিলেন তিনি। গল্পের শেষ এখানেই।
আসলে, গল্পটি সত্য কিনা তা বলা মুশকিল। ধরে নেওয়া যায়, প্রকাশিত গল্পটি ছিল ব্যঙ্গাত্মক। সেই সময়কার বাবুকালচারের ছবি তুলে ধরা হয়েছে। সুরাসক্তির পরিণাম কী হতে পারে, তা এই গল্পে তুলে ধরা হয়েছে।
‘ছবি’ শীর্ষক কার্টুনে ছবি সাজিয়ে লেখা হয়েছে- ‘ওরে বাবা, আমি মদকে খাই না, মদ আমাকে খায়। ওই কামড়াতে আসছে, পালা, পালা, পালা, পালা।’ মদ্যপানের বিষময় ফলের কথা লিখে পাঠককে সচেতনও করা হয়েছে-
‘ওরে সুরা, তোর অত্যাচারে বসে বঙ্গমাতা কাঁদে অনিবার নীরবে নির্জনে, ব্যাকুলিত মনে, সে দুখ হেরিলে বিদরে হৃদয়।’ পত্রিকায় মাতাল ও কুকুরকে অগ্রাহ্য করার কথাও বলা হয়েছে-
‘কুকুরের সম্মুখে ভয় প্রকাশ করিলে সে চাপিয়া ধরে। কুকুর ও মাতাল উভয়কে অগ্রাহ্য করাই তাহাদিগের হস্ত হইতে নিষ্কৃতি পাইবার উপায়।’
আমরা দিবানিদ্রায় অভ্যস্ত। সবাই না। দিবানিদ্রার কুফলও ওই ‘ছুটির সুলভ’-এ প্রকাশিত।
‘দিবসে নিদ্রা লেগে পেটের পীড়া হয়, জ্বরজ্বর ভাব হয়, সহজে ক্রোধ জন্মে, রাত্রিতে নিদ্রা হয় না, মুখশ্রী জঘন্য হয় এবং আপনাকে আপনি গালাগালি দিতে ইচ্ছে করে।’
আজকাল টিভির চ্যানেলে ক্যুইজ প্রতিযোগিতায় অনেকে অংশ নেন। সে সময়েও ওই শারদীয়া পত্রিকায় মজার ক্যুইজ ছিল। প্রশ্ন: এমন নিরাকার জিনিস কী আছে যাহাতে আকার দিলে মানুষের টাকা হয়।
উত্তর: টাক।… এমন অনেক ধরনের প্রশ্নোত্তর ওই শারদীয়া পত্রিকাতে ছিল।
***
কথায় আছে- ‘কবেই কেটে গেছে কালিদাসের কাল।’ কবি কালিদাসকে নিয়ে অনেক গল্প-কাহিনি। কালিদাস শুধু প্রাচীন কালের কবি নন, তিনি একটি কাল। কাল অর্থে সময়। তাঁর সময়ের সঙ্গে এখনকার সময় মেলানো যাবে না। সে রকম কেশবচন্দ্র সেনের উদ্যোগে যে বাংলা সাহিত্যের প্রথম শারদীয়া পত্রিকা ‘ছুটির সুলভ’ প্রকাশিত হয়েছিল, তা ছিল সেই সময়কার নিরিখে। বর্তমান সময়ের সঙ্গে মেলানো যাবে না। তবে তিনি যে বাংলা সাহিত্যের
প্রথম শারদীয়া পত্রিকার পথিকৃৎ, এটা মানতেই হয়।
আমরা সামনের দিকে এগিয়ে চলেছি। এগিয়ে চলাই সভ্যতার ধর্ম। তার মানে এই নয় যে, অতীতকে ভুলে যাওয়া। ইতিহাস
আমাদের শিক্ষা দেয়। ‘History educates us।’ সে-রকম ‘Looking back moving ahead।’ সামনের দিকে এগোতে গেলে পেছনের দিকটা দেখে নিতে হয়। কারণ, অনেক কিছুর সুচনা অতীতে। অতীতকে ঘেঁটে নিজেকে জানতে হয়। জানার মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাওয়া।
আজ যেটা ঘটে
কাল সেটা পুরনো,
পুরনোকে ঘেঁটে
নিজেকে জানো।
আজকে শারদীয়া পত্রিকার রমরমা। দিশারি কেশবচন্দ্র সেন।
কলিকাতা, মঙ্গলবার, ২১ পৌষ ১২৮২ সাল/৪ জানুয়ারি, ১৮৭৬ (২৭৪ সংখ্যা)।
সূত্র:
• বাংলা সাহিত্যের প্রথম শারদীয়া ‘ছুটির সুলভ’। অভিজিৎ লাহিড়ী/২৬ সেপ্টেম্বর ২০০৯। বর্তমান।
• শত ধারায় বিকশিত একটি এলাকার ইতিবৃত্ত। সংকর্ষণ মাইতি। মহিষাদল বইমেলা স্মরণিকা/২০২৩।