প্রাতিষ্ঠানিক ভিক্ষায় ‘এক লাফে এক লাখ’ মানুষের টাকা খাচ্ছে কাক!
ক্লাব খয়রাতিতেই মুখ্যমন্ত্রীর ভোট ভিক্ষা
নির্মাল্য মুখোপাধ্যায়
ক্ষমতায় আসার পাঁচ বছরের ভিতরেই পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বুঝে গিয়েছিলেন যে, ভাত না ছড়ালে কাক আসবে না। নীতি, আদর্শ ও সততাকে চুল্লিতে পাঠিয়ে সাত বছর আগে দুর্গাপূজায় ভিক্ষা ছড়ানোর কাজটা তিনি শুরু করেছিলেন। চালু হয় ‘পূজায় দক্ষিণা’ দেওয়ার আড়ালে যথেচ্ছ ক্লাব খয়রাতি। ২০১৮ সালে রাজ্যের ২৮,০০০ পূজা কমিটিকে ১০ হাজার টাকা করে সরকারি অনুদান দেওয়ার কথা ঘোষণা করেন তিনি। সেই শুরু। সেদিন তাঁর ঘোষিত ১০ হাজার টাকার দক্ষিণা এখন ১ লক্ষ ১০ হাজারে পৌঁছেছে। এক বশংবদ শিল্পপতির বদান্যতায় বিদ্যুতের বিলে আশি শতাংশ ছাড় দেওয়া হয়েছে। আনুমানিক ২ লক্ষ টাকা উৎসব ফান্ড উৎকোচে মকুব হয়েছে। সবরকম দক্ষিণা ও ছাড় বাবদ রাজ্যের খরচ আনুমানিক ৪৮০ কোটি টাকা। মহামারীও এই উৎকোচ দানের প্রবাহ থামাতে পারেনি। এটা ভোট কেনার দীর্ঘমেয়াদি ঘুষ। নাহলে কেবল ভোট বছরেই তা দেওয়া হতো। প্রতি বছর প্রায়
৪৪ হাজার বারোয়ারি দুর্গাপূজা কমিটির ভিতর মাত্র তিনটি কমিটি এই অনুদানের অর্থ প্রত্যাখ্যান করেছে। অথচ তৃণমূল-বিরোধী বিজেপির ভোট
এই রাজ্যে প্রায় ৪০ শতাংশ। কলকাতার দুর্গাপূজা বিশ্বের দরবারে ঠাঁই পেয়েছে আর কেন্দ্রীয় সরকার বাংলা ভাষাকে ধ্রুপদী ভাষায় মর্যাদা দিয়েছে। এই দুই সম্মানের সঙ্গে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূলনেত্রীর কোনো প্রত্যক্ষ যোগ নেই। অথচ দু’টি বিষয় নিয়েই ভরপুর রাজনীতি করেন তিনি। কিছু মানুষের মাতব্বরি করা স্বভাব। কয়লা বহুবার ধুলেও তার ময়লা যায় না।
সিপিএম ছিল ধর্মবিরোধী। বিদেশি ভাবনায় পরিচালিত দল। সাম্রাজ্যবাদী সাহেব শাসকদের চোখে হিন্দু দেব-দেবীর ভাবনার থেকে সিপিএমের ভাবনা খুব একটা পৃথক নয়। তাই ক্ষমতায় থাকার জন্য সিপিএমের অত্যাচার চরম সীমায় পৌঁছে যায়। ২০১৬ সালের ভোটের পর তৃণমূলনেত্রী বুঝেছিলেন যে, এ রাজ্যে একটা বড়ো অংশের মানুষকে চৌত্রিশ বছরে সিপিএম ভিখারি করে রেখেছে। ভূমি সংস্কারের ধামা বাজিয়ে তাদের দলদাসে পরিণত করেছে সিপিএম। ধ্বংস হওয়ার আগে সিপিএম রাজ্যের ঘাড়ে প্রায় ২ লক্ষ কোটি টাকার দেনা রেখে যায়। এই ১৫ বছরে সেই উচ্ছিষ্টের বোঝা প্রায় ৭ লক্ষ কোটিতে পৌঁছে দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ২০২৬-এর পর তৃণমূল ক্ষমতায় থাকলে রাজ্যটাই হয়তো ভিখারিতে পরিণত হবে। অনেকে সে দাবি করছেন। সিপিএমের ধর্মবিরোধিতার বিরুদ্ধে তৃণমূলনেত্রীর কোনো আন্দোলন নেই। অথচ ৩৪ বছরে তার শরীরে বহু আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। সেই সঙ্গে জুটেছে তার নাটুকেপনা। যেহেতু মুখ্যমন্ত্রীর দেওয়া উৎকোচের বিষয়টি অনেকেই মাথায় রাখেন, তাই এইসব সামাজিক প্রকল্পের মুখোশে রেউড়ি রাজনীতি করেন তৃণমূলনেত্রী। অবশ্য দেশের কোনো সিউডো-সেকুলার, পরিবারতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল তাতে পিছিয়ে নেই। তবে তুল্যমূল্য বিচারে তৃণমূলনেত্রী প্রথম। তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ দেশে সরকারি খাতে সংগ্রহ করা জনগণের টাকা কীভাবে এবং কেন কোনো পূজা-পার্বণ বা উৎসবে ব্যবহৃত হয়, তা যদিও
বোধগম্য নয়। এ বিষয়ে সুপ্রিম আদালত কোনো নির্দেশ জারি করেনি। কলকাতা হাইকোর্টে এই সংক্রান্ত মামলা দায়ের হয়। সরকারি সার্কুলারের ওপর হাইকোর্টের সিঙ্গল বেঞ্চ স্থগিতাদেশ দিলেও সেই নির্দেশ খারিজের জন্য ডিভিশন বেঞ্চের দ্বারস্থ হয় রাজ্য। এই মামলার পরিণতি যদিও জানা যায়নি।
এ রাজ্যের একটি শিশুও জানে পশ্চিমবঙ্গে কীভাবে সরকারি অর্থের অপব্যয় হয়। করদাতাদের টাকার যথেচ্ছ ব্যবহার বা অপচয়ের আড়ালে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার যে রাজনৈতিক ভয় তাকে তাড়া করে বেড়ায়, তার থেকে অব্যাহতি পেতে এই সমস্ত সহজ উপায় বের করেন মুখ্যমন্ত্রী। তাই হিন্দুধর্মের নিন্দা করে, শ্রীজগন্নাথ ও মা দুর্গাকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিকভাবে ভেসে থাকতে সচেষ্ট হন। তৃণমূলনেত্রী বিশ্বাস করেন যে, আদর্শ বা নীতির জোরে ভোট ভিক্ষা পাওয়া
যায় না বা ভোটে জেতা যায় না। তাই বামফ্রন্ট জমানার ফেলে দেওয়া উচ্ছিষ্টকে পরমান্ন হিসেবে বিতরণ করে তাকে একটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেন। বন্ধু বামেরা তাকে ‘খেলা মেলা’র মুখ্যমন্ত্রী বলে ডাকেন। কথাটা আংশিক সত্য বটে। বাকি সত্যিটা হলো রাজ্যে বামেরা ক্ষয়িষ্ণু হলেও তাদের বর্তমান রাজনৈতিক শক্তি তৃণমূলনেত্রীকে হারানোর কাজে ব্যবহৃত হয় না। তাকে রাজ্যের শাসন ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখার খেলায় বামেরাও শামিল। তৃণমূল-বিরোধী ভোট কেটে তারা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কেই জেতায়। রাজ্যে বিজেপির উত্থান রুখতে তৃণমূলনেত্রীই হলেন তাদের শেষ পারানির কড়ি। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যেভাবে ‘ভাত’ ছড়িয়ে ভোটারদের মন জয় করার চেষ্টা করেন, আজ পর্যন্ত সিপিএম দল তার বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট বিরোধিতার কোনো চিহ্ন রাখেনি। এই রাজ্যে একটা ধারণা রয়েছে যে, ‘ভাত’ ছড়ানোর রাজনীতি বন্ধ করা যায় না। তাই কোনো জোরদার প্রতিবাদ না থাকার সুযোগ নিয়েই রাজ্যের
মানুষের নজর ঘুরিয়ে রাখছেন তৃণমূলনেত্রী। ২০২৪-এর আগস্ট মাসে অভয়া কাণ্ডের মতো নারকীয় ঘটনার পরেও এ রাজ্যের বেশিরভাগ দুর্গাপূজা কমিটি মুখ্যমন্ত্রীর ছড়ানো ‘ভাত’ খেয়েছে। সে লজ্জা বাঙ্গালি আর কতদিন লুকিয়ে রাখবে?