বাঙ্গালির মহাপূজা
বাঙ্গালির মহাপূজা সমাগত। আর এক পক্ষকাল বিলম্ব রহিয়াছে। আয়োজনের ব্যস্ততাও তুঙ্গে। গ্রাম-শহরের বারোয়ারি ও পারিবারিক
পূজামণ্ডপে প্রতিমা শুধু রঙের প্রলেপের অপেক্ষায়। প্যান্ডেল বাঁধিবার কাজও প্রায় সমাপ্তির মুখে। আপামর মানুষের মনেও যে আনন্দের
হিল্লোল বহিতেছে তাহা স্পষ্ট। গ্রাম-গ্রামান্তর হইতে যে শ্রমজীবী মানুষের দল পাড়ায় পাড়ায় নির্মাণকার্যে ব্যাপৃত রহিয়াছেন, তাহাদের মুখমণ্ডলের
চিত্র তাহারই ইঙ্গিত বহন করিতেছে। একেবারে অজ পাড়াগ্রাম হইতে কলকাতার কুমারটুলির মৃৎশিল্পীদের মুখমণ্ডলেও আনন্দের আভাস। এই
সময়েই তাহাদের ঘরে আসিবে সংবৎসরের সম্বল। বাঙ্গালির মহাপূজা যে রাষ্ট্রপ্রতিমার পূজা! রাষ্ট্রজীবনের প্রতিটি অঙ্গের মানুষের যে তাহাতে
সহভাগিতা। বিশ্বের তাবড় তাবড় অর্থনীতিবিদরাও স্বীকার করিয়াছেন বাঙ্গালির দুর্গাপূজাকে কেন্দ্র করিয়া কী বিশাল অর্থের লেন-দেন হইয়া
থাকে, যাহাতে সমাজের সর্বস্তরের মানুষ কোনো না কোনোভাবে যুক্ত থাকেন। ভারতাত্মার সন্ধান না পাওয়া কমিউনিস্টরা বহু বৎসর প্রচার
করিয়াছে দুর্গাপূজা বন্ধ করিবার। তাহাদের মতে ইহাতে নাকি শুধুমাত্র অর্থের অপচয় হইয়া থাকে। বহু প্রচার করিয়া এবং তিনদশকের অধিক
রাজ্যে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকিয়াও তাহারা বাঙ্গালির মন হইতে বিন্দুমাত্র ধর্মভাব বিলুপ্ত করিতে পারে নাই, বরং তাহারাই শুধু ভারত নহে,
বিশ্বমঞ্চ হইতেও বিলুপ্ত হইতে চলিয়াছে। স্বামী বিবেকানন্দ বহু পূর্বেই বলিয়াছেন, ধর্মে হস্তক্ষেপ করিলে তোমার ধ্বংস অনিবার্য। আশ্চর্যের
বিষয় যে, ভণ্ড কমিউনিস্টরা যত উৎসাহের সহিত দুর্গাপূজার বিরোধিতা করিয়া থাকে, তত উৎসাহেই তাহারা দুর্গাপূজার মণ্ডপে মণ্ডপে কমিউনিস্ট
সাহিত্যের স্টল খুলিয়া বসে। তাহারা দীর্ঘকাল বাঙ্গালিকে বোকা বানাইবার চেষ্টা করিয়াছে, কিন্তু বাঙ্গালি তাহাদের স্তোকবাক্যে বিভ্রান্ত হয় নাই।
দুর্গাপূজা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাইয়াছে আর তাহারা নিশ্চিহ্ন হইতে চলিয়াছে। আসলে মা দুর্গা তো বাঙ্গালির ঘরের কন্যা। কন্যাকে তাহারা পিতৃ-মাতৃগৃহ
হইতে বিচ্ছিন্ন করিবে কী করিয়া! পূজার চারি দিবস তিনি সপরিবারে পিতৃগৃহে আসেন। তিনি যে জগজ্জননী, তাই প্রকৃতিদেবীও তাঁহাকে বরণের
ডালি সাজাইয়া তৈরি থাকেন। বঙ্গের কবি, সাহিত্যিকগণ সেই আয়োজনের বর্ণনা তাঁহাদের গানে-কবিতায়-সাহিত্যে তুলিয়া ধরিয়াছেন।
বাঙ্গালির এই মহাপূজা আজ শুধু বঙ্গভূমিতেই সীমাবদ্ধ নহে। যেখানে বাঙ্গালি, সেখানেই তাহারা মাতৃমূর্তিকে প্রতিষ্ঠা করিয়াছে। বঙ্গভূমির
বাহিরে যেখানে বাঙ্গালি রহিয়াছেন, পূজার কয়েকটি দিন তাহাও ক্ষুদ্র বঙ্গভূমিতে রূপান্তরিত হইয়া যায়। তাহা বিহার প্রদেশের পাটনা অথবা
দিল্লির চিত্তরঞ্জন পার্ক, মুম্বাইয়ের শিবাজী পার্ক কিংবা বারাণসীর বাঙ্গালি গলি হউক না কেন। ওড়িশা-সহ দক্ষিণ ভারতের চারটি রাজ্যেও
বাঙ্গালিরা মহাপূজায় মাতিয়া থাকেন। এই কথা বলিবার অবকাশ নাই যে, দুর্গাপূজার আজ বিশ্বায়ন ঘটিয়াছে। ভারতীয় উপমহাদেশের বাহিরেও
মহাধুমধাম সহকারে দুর্গাপূজা পালিত হইতেছে। ব্রিটেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুর তো বটেই, এককালের কমিউনিস্ট দেশ
রাশিয়া এবং বর্তমান কমিউনিস্ট দেশ চীনেও বেশ উৎসাহ সহকারে দুর্গাপূজা আরম্ভ হইয়াছে। সেখানে বসবাসকারী বাঙ্গালিদের সহিত সেই
দেশের অধিবাসীরাও সমান উৎসাহে, সমান ভক্তি-শ্রদ্ধায় পূজায় অংশগ্রহণ করিতেছেন। ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘ, রামকৃষ্ণ মিশনের শাখাগুলিও
ভিন রাজ্যে বা বিদেশে দুর্গাপূজায় বড়ো ভূমিকা পালন করিতেছে। গর্বের বিষয় যে, ইউনেস্কো ২০২১ সাল হইতে দুর্গাপূজাকে সাংস্কৃতিক
ঐতিহ্যের তালিকাভুক্ত করিয়াছে। তাহা সত্ত্বেও কোথাও কোথাও দুর্গাপূজার উপর বিঘ্ন ঘটানো হইতেছে। প্রতিবেশী দেশ একদা এই বঙ্গভূমিরই
অঙ্গ বাংলাদেশে নিয়ম করিয়া প্রতি বৎসর দুর্গাপূজায় আক্রমণ হইয়া থাকে। পশ্চিমবঙ্গও ইহার ব্যতিক্রম নহে। এই রাজ্যেও বিশেষ একটি
শ্রেণীকে খুশি করিবার জন্য শাসকদলের বা স্পষ্ট করিয়া বলিতে গেলে রাজ্য প্রশাসনের পক্ষ হইতে পূজার অনুমতি অথবা ঠিক সময়ে প্রতিমা
নিরঞ্জনের অনুমতি পাওয়া কঠিন হইয়া পড়ে। কোথাও কোথাও বিধর্মীদের আক্রমণে পূজায় বিঘ্নও ঘটিতেছে। তাহা সত্ত্বেও বাঙ্গালি বিশ্বাস করে,
জগজ্জননীর কৃপায় একদিন নিশ্চয় এই অসুরকুলের পরাজয় ঘটিয়া এই দুর্দিন ও ভয়াবহ মানসিকতার অবসান হইবে- এই অভয়বাণী মা স্বয়ং
শ্রীশ্রী চণ্ডীতে দান করিয়াছেন।