সন্ত্রাসবাদ কী করে ধ্বংস করতে হয় তা দেখিয়ে দিয়েছে ভারত
সন্ত্রাসবাদ হলো মানবিকতার একটি পাপ। শহিদ হওয়ার বিপ্লব। কিছুটা হিংসার রোমান্টিক প্রলেপ দিয়ে হত্যার দর্শন। এগুলি পাপের বাহ্যিক আবরণ মাত্র। চালু কথাটা বেশ কায়দা করে বলা হয়। একজনের কাছে যে সন্ত্রাসী অন্যজনের কাছে সেই স্বাধীনতা সংগ্রামী। এটি একটি বিপজ্জনক অর্থহীন কথা, কোনো সত্যিকারের স্বাধীনতা কখনোই আতঙ্ক ও রক্ত উৎসবের দ্বারা অর্জিত হয় না।
সন্ত্রাসবাদকে চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার পুঁজি হচ্ছে আতঙ্ক তৈরি করা। কিন্তু এই আতঙ্ক বিতরণের মাধ্যমেও সন্ত্রাসীরা আক্রান্তের ওপর কোনো নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে না। ভারতের সাম্প্রতিক পহেলগাঁও পরবর্তী ঘটনাক্রম তাই প্রমাণ করে। এই সন্ত্রাসের ধারাবাহিকতায় ২৬/১১ বা ২০০১-এর সংসদ আক্রমণ বা একেবারে সাম্প্রতিক পহেলগাঁওয়ে নৃশংসতা ভারতকে এর মোকাবিলায় আরও শক্তিমান, দীর্ঘকায় ও প্রতিজ্ঞাবদ্ধ করে তুলেছে, যা হয়তো অতীতে অতটা প্রতীয়মান হয়নি। সমস্ত শান্তিকামী জাতির একজোট হয়ে এই রোগের নিরাময়ে হাত লাগানো দরকার।
এখানেই ভারতের বিশেষতা যে পথপ্রদর্শকের কাজ করছে। কয়েক যুগ ধরে আমরা পাকিস্তান মদতপুষ্ট সন্ত্রাসবাদের শিকার হয়ে থেকেছি। পাকিস্তান অন্ধসেজে থেকেছে। পহেলগাঁওয়ের সদ্য আক্রমণটি একটি ব্যর্থ, মানবিক অ্যাডভেঞ্চার ছিল যা ভারতের একতাকে ধ্বংস করার লক্ষ্যে পরিচালিত হয়েছিল। সন্ত্রাসবাদীরা যেভাবে নিহতদের প্রত্যেকের ধর্ম নিয়ে নির্দিষ্ট প্রশ্ন করেছিল তা নির্দ্বিধায় এই সত্যই উন্মোচিত
করে। মনে রাখতে হবে, ড্রোন দিয়ে ভারতের বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী মানুষদের উপাসনালয়গুলির ওপর আক্রমণও একই উদ্দেশ্যে অনুযায়ী। কোনো ধর্মই এমন পাশবিক ক্রিয়াকর্ম অনুমোদন করে না। সন্ত্রাসবাদীরা ঘৃণ্যভাবে মজহবকে তাদের বর্বরতার সমর্থনে প্রয়োগ করেছিল। মজহবের এই ধরনের অপব্যবহার কখনোই আবেগপ্রসূত নয়। এটি অতি যত্ন সহকারে চিন্তাপ্রসূত কৌশলে নৃশংতাকে মান্যতা দেওয়ার অপচেষ্টা।
এক্ষেত্রে ভারত কিন্তু পরিষ্কার করে দিয়েছে যে সন্ত্রাসবাদের ক্ষেত্রে আমাদের নীতি ‘শূন্য’ সহনশীলতার। শান্তি আলোচনা আর সন্ত্রাসবাদ হাত ধরাধরি করে চলতে পারে না। ভবিষ্যতে পাকিস্তানের সঙ্গে কোনো আলোচনা কেবলমাত্র সন্ত্রাসবাদ এবং পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীর নিয়েই চলতে পারে। এ বিষয়ে পাকিস্তান যদি সত্যিই ইচ্ছুক থাকে তাহলে ইউএন-এর দ্বারা ঘোষিত সন্ত্রাসী হাফিজ সঈদ আর মাসুদ আজহারকে ভারতের হাতে তুলে দিক। এ প্রসঙ্গে বলা যায় অতীতে আমাদের সেনাবাহিনীকে কেবলমাত্র প্রতিরক্ষামূলক কাজ করার অনুমতি দেওয়া হতো। কিন্তু ২০১৬-র সার্জিক্যাল স্ট্রাইক, ২০১৯-এর বালাকোট ধ্বংস আর এবারের অপারেশন সিঁদুর
পাকিস্তানি মদতপ্রাপ্ত সন্ত্রাসবাদী আক্রমণের ক্ষেত্রে ভারতের মূলগত নীতিকেই আগাপাশতলা পালটে দিয়েছে। সামরিক নীতিতে ঘষামাজা করেছে।
এখন আমাদের নীতি হলো, সক্রিয়ভাবে যেখানেই সন্ত্রাসবাদীর হদিশ পাওয়া যাবে সেখানেই আমরা তাদের বিনাশ করব। আজ যে কোনো সন্ত্রাসমূলক কাজকেই দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ বলে ধরা হবে। এর উত্তরেও কোনোভাবে বেসরকারি সন্ত্রাসবাদী বা সরকার-পোষিত সন্ত্রাসী বলে আলাদা করা হবে না। হ্যাঁ, যদি পাকিস্তান তার মাটি থেকে তার সন্ত্রাসবাদীদের নিয়ন্ত্রণ না করতে পারে তাহলে তার মূল্য তাদেরই চোকাতেই হবে।
সম্প্রতি দিল্লিতে অনুষ্ঠিত ‘No money for terror’ বিষয়ক মন্ত্রী পর্যায়ের এক Counter terrorism নিয়ে আলোচনায় প্রধানমন্ত্রী দ্ব্যর্থহীন ভাষায় জানিয়েছেন আমরা মনে করি কেবল একটিমাত্র আক্রমণই পর্যাপ্ত বলে গণ্য হবে এবং এই সূত্রে একটি জীবন নষ্ট হলেও তাকে ব্যাপক সংখ্যক মৃত্যু বলেই গণ্য করা হবে। তাই সন্ত্রাসবাদ সমাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত আমরা থামব না’। ভারত সরকার ও সামরিক বাহিনী অপারেশন সিঁদুরকে সফল করে বিশ্বের কাছে প্রমাণ রেখেছে যে সন্ত্রাসবাদ ধ্বংস করতে আমরা দায়বদ্ধ। এই সূত্রে একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্যে,
পাকিস্তান সন্ত্রাসবাদকে অভিষ্ট সাধনের একটি অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে ঠিক সেই কারণেই ভারত কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক কৌশলেই পাকিস্তানকে কোণঠাসা করে ফেলেছে।
সুনিয়ন্ত্রিত পদ্ধতিতে কোনো বাড়াবাড়ি ছাড়াই আমাদের আক্রমণ ছিল পাকিস্তানের মাটিতে সন্ত্রাসবাদীদের যে ঘাঁটিগুলি লালিত পালিত হচ্ছে তার নিকেশ করা। অবশ্যই পিওকে (পাক-অধিকৃত কাশ্মীর)-সহ।
আমরা জানি সন্ত্রাসবাদীদের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান প্রয়োজন কিন্তু তা যথেষ্ট নয়। সন্ত্রাসবাদীদের ভিত্তিভূমি তাদের আঁতুড়ঘরকেই ধ্বংস করে ফেলতে হবে। যেহেতু পাকিস্তান সন্ত্রাসবাদকে অভীষ্ট সাধনের একটি অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে ঠিক সেই কারণেই ভারত কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক কৌশলেই পাকিস্তানকে কোণঠাসা করে ফেলেছে। বিশ্বের অন্যান্য দেশ থেকে তাকে অনেকটাই বিচ্ছিন্ন করেছে। সকলেই জানেন, আমরা সিন্ধু জল চুক্তিকে সাময়িকভাবে বাতিল করেছি যতক্ষণ না পাকিস্তান সীমান্ত পারের সন্ত্রাসবাদকে ঘোষিতভাবে ও কাজে থামিয়ে না দেয়।
জল বন্ধের এই সিদ্ধান্ত পাকিস্তানের ওপর গভীর রেখাপাত করবে। সিন্ধুনদের জলের ওপর পাকিস্তানের ১ কোটি ৬০ লক্ষ হেক্টর চাষজমির ৮০ শতাংশ এবং সামগ্রিক জল প্রয়োজনের ৯৩ শতাংশ নির্ভরশীল। এই জলের অভাবে দেশের ২৩ কোটি ৭০ লক্ষ মানুষ এবং কৃষিজ উৎপাদন যা জিডিপি-র এক চতুর্থাংশ তা ব্যাহত হবে। মনে রাখা দরকার, সন্ত্রাসবাদ শুধু ভারতের সমস্যা নয় এটি বিশ্বজনীন সমস্যা। যে কারণে সন্ত্রাসবাদকে সমূলে নির্মূল করতে হলে টুকরো টুকরো করে অ্যাকশন নিলে হবে না। এর জন্য পাঁচটি বিন্দু রয়েছে:
(১) প্রথমত, সন্ত্রাসবাদ কী, এখন পর্যন্ত সঠিকভাবে তার সর্বসম্মত সংজ্ঞা নির্ধারিত হয়নি। সবচেয়ে কাছাকাছি আমরা যে জায়গায় পৌঁছেছি সেটি হলো রাষ্ট্রসঙ্ঘে Comprehensive Con-vention against International Terrorism যে প্রসঙ্গটি ভারতই উত্থাপন করেছিল। কোনো জাতিগত সমস্যা সন্ত্রাসবাদের শিকড় হয়ে যেন সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াইকে সংকুচিত না করে দেয়। সেই কারণে সন্ত্রাসবাদীদের চিহ্নিত করণ ও তাদের বিরুদ্ধে কড়া আইনি পদক্ষেপ এবং তাদের সূত্রে সন্ত্রাসবাদীদের সর্বদেশগ্রাহ্য একটি সংজ্ঞা অবশ্যই প্রয়োজনীয়। একই সঙ্গে যাতে বিদেশ থেকে সন্ত্রাসবাদীদের বিশ্বব্যাপী সরবরাহ বন্ধ হয় সেটা দেখাও জরুরি।
(২) এই সূত্রে শুধুমাত্র সন্ত্রাসবাদীদের সংগঠনকে অর্থনৈতিক মদত বন্ধ করলেই হবে না, মদতদাতা দেশগুলি ওপরও এই অর্থনৈতিক নিষেধজ্ঞাকে বলবৎ করতে হবে। বিশ্বের বহু ধরনের সংগঠন ও অর্থপ্রদানকারী দেশগুলিকে এটা মনে রাখতে হবে যে পাকিস্তানের ইতিহাসে এই ধরনের অনুদানের অপপ্রয়োগ বিস্তর। তারা অন্য কোনো ঋণ থেকে বেরিয়ে আসার জন্য পাওয়া বিদেশি অর্থকে ঘুরপথে সীমান্ত পারে সন্ত্রাসবাদ ছড়িয়ে দেওয়ার কু-পথ অবলম্বন করে। সেই কারণে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে পাকিস্তানকে FATF দ্বারা আবার কালো তালিকাভুক্ত করতে হবে, সমস্ত টাকা দেওয়া সম্পূর্ণ বন্ধ করতে হবে যতক্ষণ না পর্যন্ত ইসলামাবাদ বিশ্বাসযোগ্যভাবে এবং অলঙ্ঙ্খভাবে তাদের সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ বন্ধ করার অঙ্গীকার না করে।
(৩) আর একটা জিনিস যা দীর্ঘদিন ধরেই বিশ্বের দেশগুলির ধারণা ছিল যে, সরকারি প্রশ্রয়ের সন্ত্রাসবাদ এবং কোনো সন্ত্রাসী সংগঠনের নিজস্ব পরিচালনার সন্ত্রাসী আক্রমণ দু’টিই একই মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ। হ্যাঁ, এটি একেবারে প্রকাশ্যে এসে পড়ল যখন চিহ্নিত জেহাদি সন্ত্রাসবাদী নিহত হওয়ায় সসম্মানে বিদায় জানানো হলো। শুধু তাই নয়, যেখানে সামরিক অফিসাররা ফুল ইউনিফর্মে তাকে পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দিলেন। পাকিস্তানে একটা ভয় সবসময় কাজ করে যে পারমাণবিক অস্ত্রসম্ভার না সন্ত্রাসবাদীদের হাতে চলে গিয়ে প্রলয় ঘটিয়ে দেয়। আন্তর্জাতিক সমর বিশারদরা এই বিষয়টি যত্নসহকারে অনুধাবন করে পাকিস্তানের মারণাস্ত্রগুলিকে Inter-national Atomic Energy Agency-র কড়া নিরীক্ষণে রাখুন।
(৪) সেই সমস্ত দেশকে চিহ্নিত করা দরকার যারা তাদের প্রতিবেশী দেশগুলিকে অস্থিরতার মধ্যে ঠেলে দিতে সন্ত্রাসবাদকে গোপনে লালন করে। তাদের কড়াভাবে বোঝানো যে, সন্ত্রাসবাদী হামলার কতটা কড়া প্রতিরোধ করা হবে, তা কখন কোথায় ঘটেছে বা আক্রান্তের প্রকৃতি কী ছিল তার ওপর নির্ভর করে না।
(৫) সন্ত্রাসবাদীদের নিরাপদ আশ্রয়স্থল পাকিস্তানের ছত্রছায়ায় তারা এআই (কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা), নিজস্ব ইলেকট্রনিক সিস্টেম, বায়োটেকনলজি ও ন্যানোটেকনলজি ব্যবহারের নিরাপদ সুবিধে পায়। এই কারণেই সারা বিশ্বের সহযোগিতাই এই ধরনের সর্বব্যাপী সন্ত্রাসবাদের প্রসারকে রুখতে একমাত্র পথ। সময় এসে গেছে-সমস্ত দেশগুলির একত্রিত হয়ে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলা এবং ‘Comprehensive Convention against International Terrorism’কে বাস্তবায়িত করা। এই ধরনের চুক্তি স্বাক্ষরের জন্য তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ী ৯/১১-র জঙ্গি আক্রমণের পর রাষ্ট্রসঙ্ঘের সাধারণ সভায় বলেছেন, ‘আমাদের যে কোনো সন্ত্রাসবাদকেই কোনো রকমের আদর্শবাদ, রাজনীতি বা মজহবি অজুহাতকে উপেক্ষা করে কড়া হাতে শিক্ষা দিতে সঙ্ঘবদ্ধ হতে হবে’। ভারত এখন সন্ত্রাসবাদ নির্মূল করতে সর্বান্তঃকরণে তাই দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ও বদ্ধপরিকর।
”