ভারতবাসীর আশা পূরণে বদ্ধপরিকর বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার
সুদীপ্ত গুহ
কোনো একটা দেশে যদি সবাইকে কার্পেন্টার, ফিটার, ইলেক্ট্রিশিয়ান, ইলেকট্রনিক্স মেরামতি, প্লাম্বার, লোহার কাজ, মাটির কাজ থেকে রান্না করা- সব কিছুতে প্রশিক্ষণ নেওয়ার পর বলা হয় তোমরা রান্না করা এবং প্লাম্বারের কাজ ছাড়া আর কিছুই করতে পারবে না। বাকি সব পরিষেবা বা পণ্য নেওয়া হবে পাশের গ্রাম থেকে। এটা কি কোনো সুস্থ আর্থিক ব্যবস্থা? বহু মানুষকে এই প্রশ্ন করা হয়েছে গত এগারো বছরে। সবাই এককথায় বলেছেন অবাস্তব। এরপরে, যদি প্রশ্ন করা হয়, তাহলে ভারতে সরকারি চাকরি এবং সফট্রয়ার ছাড়া অন্য কোনো পেশা প্রায় নেই কেন বা থাকলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে বেতন আজ ১০০ দিনের কাজের সমান কেন? পদার্থবিদ্যা হোক বা সমাজতত্ত্ব, হিসাবশাস্ত্র হোক বা কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার, এমনকী ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার সবাই দৌড়াচ্ছিলেন হয় সরকারি চাকরির জন্য, নইলে সফট্ওয়ার কোম্পানিতে কাজের জন্য। কারও কাছে উত্তর ছিল না।
কিন্তু ২০১৪ সালে ক্ষমতায় এসে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী এক অদ্ভুত ব্যবস্থা লক্ষ্য করলেন। বিশ্লেষণ করে দেখলেন, এই অবস্থার অন্যতম কারণ, ভারত ম্যানুফ্যাকচারিং তথা উৎপাদন প্রায় করতোই না। পুরোটাই বিদেশের উপর নির্ভরশীল। এখন প্রশ্ন, আমেরিকাও তো নির্ভরশীল? তাহলে ভারতের সমস্যা কোথায়? উত্তর হলো, আমেরিকান ডলার হলো আন্তর্জাতিক মুদ্রা। তারা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে শুধু ডলার ছাপিয়ে বাজারে ছেড়ে অন্যের কষ্টার্জিত পণ্য ও পরিষেবা ভোগ করেছে। ভারতের নীতিনির্ধারকরা আমেরিকাকে অন্ধের মতো নকল করতে গিয়ে সেই ফাঁদে পা দিয়ে সম্পূর্ণ পরনির্ভর করে ফেলেছিল দেশকে। ভারতের
টাকা তো আন্তর্জাতিক মুদ্রা নয়। ভারত কি এই বিলাসিতা করতে পারে?
এই অবস্থায় নরেন্দ্র মোদী প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়ে লক্ষ্য করলেন:
(১) শক্তিক্ষেত্রে ভারত মধ্যপ্রাচ্যের উপর নির্ভরশীল। (২) ভোজ্য তেলের জন্য ভারত নির্ভরশীল লাতিন আমেরিকা, পূর্ব এশিয়া এবং রাশিয়া-ইউক্রেনের উপর। (৩) ইলেকট্রিক দ্রব্যের জন্য চীন। (৪) মাইক্রোচিপের জন্য তাইওয়ান, চীন। (৫) এলইডি বাতির জন্য চীন। (৬) ওষুধের পেটেন্টের জন্য আমেরিকা এবং উপাদানের জন্য চীন। (৭) ইউরেনিয়ামের জন্য রাশিয়া। বিভিন্ন খনিজের জন্য অস্ট্রেলিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও লাতিন আমেরিকা। (৮) যাওয়ার আগে এমন
দেশ আরও এগিয়ে যাবে। প্রয়োজন বিচারব্যবস্থা, প্রশাসন, পুলিশ এবং রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সংস্কার। আরও বেশি সরকারি বিনিয়োগ প্রয়োজন শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও গবেষণায়। দুর্নীতির বিষয়ে প্রয়োজন আরও কড়া আইন, যাতে ক্ষমতাবান ও প্রভাশালীরা ছাড়া না পেয়ে যান।
জমিনীতি বানিয়ে গেছেন ড. মনমোহন সিংহ, যে ভারতের ব্যবসায়ীরা চীন বা আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে বিনিয়োগ শ্রেয় মনে করেছে। (৯) আয়করের ক্ষেত্রে প্রণববাবুর করে যাওয়া রেট্রোসপেক্টিভ আইন বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কাছে দেশ সম্পর্কের ভীতির সঞ্চার করে গেছে। (১০) শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের গবেষণার সঙ্গে বাস্তবের কোনো যোগ নেই। (১১) দেশের ৪০ শতাংশ মানুষ ব্যাংকিং সিস্টেম এবং সামাজিক সুরক্ষার বাইরে। ছোটো কৃষক থেকে ছোটো ব্যবসায়ী অর্থের জন্য সেই মহাজনের কাছেই যায়। ভারত তখনও যেন সেই ‘দুই বিঘা জমি’র পৃথিবী। (১২) ইন্টারনেট পেমেন্ট ব্যবস্থা চালু হয়েছে, কিন্তু দেশের মানুষকে বহু টাকা কমিশন গুনতে হচ্ছে ভিসা কার্ড, মাস্টার কার্ড বা SWIFT নেটওয়ার্কিং কোম্পানিকে। (১৩) করব্যবস্থা এত জটিল যে মুম্বই থেকে কলকাতা ব্যবসা করার চেয়ে মুম্বই থেকে সিঙ্গাপুর ব্যবসা করা সহজ। দেড় ডজন অদ্ভুত সব অপ্রত্যক্ষ কর। (১৪) পরিকাঠামো অচল। (১৫) অগ্নিমূল্য ইন্টারনেট ডাটা।
এককথায়, প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম, বিমান সরঞ্জাম, গাড়ি, ব্যাটারির জন্য প্রয়োজনীয় রাসায়নিক দ্রব্য, ওষুধ, দূরভাষ যন্ত্র, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ, সৌরশক্তির জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম, ইস্পাত, সিমেন্ট, সার থেকে বেনারসি শাড়ি, পুতুল হয় ভারত তৈরি করত না, নয় দাম এতো বেশি ছিল যে দেশবাসী সেটা কিনতেই পারত না। না ছিল আধুনিক প্রযুক্তি, না ছিল গবেষণার পরিবেশ। ব্যাপারটা অনেকটাই বিদ্যে বোঝাই বাবুমশাই গোছের। পড়াশোনা করেছি, কিন্তু বাড়িতে কাজের লোক না এলে বৃষ্টির দিনে আদা-চা করে খাবারও মুরোদ নেই। মাইনের সব টাকা কাজের লোক, ড্রাইভার থেকে ইলেকট্রিশিয়ানের জন্য খরচ হয়ে যায়।
ভারতও পরিষেবা ক্ষেত্রে (তথ্য প্রযুক্তি, সফট্ওয়ার ইত্যাদি) যা সঞ্চয় করতো, তার একটা বড়ো অংশ চলে যেত বিদেশ থেকে পণ্য ও পরিষেবা কিনতে। এমনকী ভারতের বস্ত্রবাজারেও রাজত্ব করতো বাংলাদেশিরা। ভারতের রিলায়েন্স কোম্পানি যশোর-খুলনায় কাপড় বানিয়ে বেচত কলকাতা থেকে ক্যালিফোর্নিয়ার বাজারে।
কিন্তু ভারত কেন পারত না? পারা কি আদৌ সম্ভব, না সম্ভব নয়? কিন্তু পরনির্ভরতা তো কমাতে হবে? নইলে কাল যদি চীন ওষুধের উপাদান পাঠানো বন্ধ করে কিংবা মধ্যপ্রাচ্য তেল, কিংবা ইন্দোনেশিয়া ভোজা তেল, কোথায় যাবে ভারত? হঠাৎ যুদ্ধ লাগলো, আর চীনের কথা শুনে রাশিয়া সাহায্য বন্ধ করে দিল। কী করবে ভারত? আর ঠিক এই কারণেই কিন্তু ভূ-রাজনীতিতে ভারত পিছিয়ে ছিল। ভারতে কেউ বোমা মেরে গেলে, মৌখিক প্রতিবাদটুকু করত অনেক চিন্তা করে। আর এখানেই নরেন্দ্র মোদী আত্মনির্ভর হওয়ার স্বপ্ন দেখাতে শুরু করলেন। কিন্তু আত্মনির্ভরতা ব্যাপারটা কি এতই সহজ? যদি হতো, বাকিরা পারলেন না কেন? সমস্যা কোথায় ছিল? আসলে ভারত একটা দশ অশ্বশক্তির যন্ত্র, যা চলছিল দুই অশ্বশক্তিতে। বস্তাপচা ব্রিটিশ যুগ/সোভিয়েত যুগের আইন, জটিল কর ব্যবস্থা, কোম্পানি আইনের অসম্পূর্ণতা আর কৃষকদের অবস্থা তো জালনিবদ্ধ রোহিত। একজন কৃষক একমাত্র সরকার নির্ধারিত ফড়েদেরই কিংবা সরকারি গুদামেই তাঁর শস্য বেচতে পারতেন।
কীভাবে এই দুই অশ্বশক্তিতে চলা দেশকে নরেন্দ্র মোদী নিজের শক্তিতে চলার জায়গায় আনলেন? (১) দেশের সব মানুষকে জনধন ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলিয়ে দিলেন। (২) দেশের দরিদ্রতম মানুষকে প্রথমবার হাতে ধরালেন জীবন বিমা, দুর্ঘটনা বিমা এবং চিকিৎসা বিমা পলিসি। (৩) প্রতিটি অ্যাকাউন্ট হোল্ডার পেলেন একটি করে রুপে কার্ড, যা বিশ্বব্যাপী রাজত্ব করা ভিসা ও মাস্টার কার্ডের ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেললো। (৪) আন্তর্জাতিক অনলাইন লেন-দেনের মাধ্যমে তথা SWIFT-এর বিকল্প হিসেবে আরও সহজে ব্যবহার করা UPI নামক ইলেক্ট্রনিক মাধ্যম চালু করলেন। (৫) দেশের সব নাগরিককে
বললেন, নিজের আয় ঘোষণা করে কর দিয়ে দিতে। নইলে আগামীদিনে আরও কঠিন পদক্ষেপ নিতে হবে সরকারকে। (৬) এরপর নোটবন্দি ঘোষণা করলেন। দেশের সব ৫০০ ও ১০০০ টাকার নোট বাতিল করলেন। (৭) কিছুদিনের মধ্যে দেশের দেড় ডজন অপ্রত্যক্ষ করের বদলে আনলেন একটা মাত্র কর তথা জিএসটি অর্থাৎ পণ্য ও পরিষেবা কর। (৮) ভারতে ১৯৬৯-তে ব্যাংক জাতীয়করণ হলেও, ব্যাংকের হাতে তার নিজের টাকা আদায়ের ক্ষমতা দেননি ইন্দিরা গান্ধী। দেশের এক দল বড়ো ব্যবসায়ী এই সুযোগে কোটি কোটি টাকা লুট করতেন এবং সরকার টাকা ছাপিয়ে ব্যাংককে বাঁচিয়ে রাখত। আমানতকারীর সরাসরি ক্ষতি না হলেও, মুদ্রাস্ফীতিতে মানুষের প্রকৃত আয় কমে যেত। ২০০২-এ অটলবিহারী বাজপেয়ী সারফায়েসি আইন প্রণয়ন করে ব্যাংককে টাকা আদায়ের আইনি ক্ষমতা দিলেন। কিন্তু ২০০৪ থেকে ২০১৪, সেই আইনও বলবৎ হয়নি। তাছাড়া কোম্পানি বন্ধ করার কোনো আইন ছিল না। নরেন্দ্র মোদী ২০১৬-তেই আনলেন ইনসলভেন্সি অ্যান্ড ব্যাংক্রপসি কোড। এই কোড ব্যাংককে ক্ষমতা প্রদান করে ঋণখেলাপি কোম্পানিকে দেউলিয়া ঘোষণা এবং ওই কোম্পানি বিক্রি করে নিজের টাকা উদ্ধারে। গত আট বছরে এটা অন্যতম বড়ো সংস্কার। (৯) আবাসন ক্ষেত্রে ক্রেতাকে সঠিক অধিকার দিতে আনা হলো RERA। (১০) এরপর আনা হলো তিনটি কৃষি বিল, যা কৃষি বিপণনে বিপ্লব আনতে পারতো। কিন্তু আড়াইটি রাজ্যের প্রতিবাদে পিছিয়ে আসতে হয় কেন্দ্র সরকারকে। তবে এই বিল দেশের কৃষকদের জন্য নতুন সুযোগ এনে দেবে এবং সরকার আলোচনার মাধ্যমে ভবিষ্যতে আবার এই বিল আনবে। (১১) দুশো শ্রমিক আইনের বদলে আনলেন চারটি লেবার কোড। শ্রমিকদের মাইনে অনলাইন করা আগেই বাধ্যতামূলক করেছিলেন। (১২) মুদ্রা যোজনা, যেখানে ছোটো ব্যবসায়ীর জন্য আরও কিছু সংস্কার আগামীদিনে আসতে চলেছে। ব্যাংকিং, পুলিশ ও বিচারব্যবস্থায় বড়ো সংস্কার আগামীদিনে আসছে। কারণ দেশের পুলিশ ও বিচারব্যবস্থা সঠিক না হলে কেউ দেশে
বিনিয়োগ করবে না।
মূল সংস্কার ছাড়াও, বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিভিন্ন আলাদা নীতি তৈরি করেছে ভারত সরকার। যেমন, মাইক্রোচিপ, উৎপাদন ক্ষেত্র, গ্রিন (প্রাকৃতিক) হাইড্রোজেন, ইলেকট্রিক ব্যাটারি, ইলেকট্রিক গাড়ি, সার, ওষুধ, আন্তর্জাতিক খনিজ সম্পদের মালিকানা, পরিকাঠামো, ভোজ্যতেল, শিক্ষা ও বিজ্ঞান-প্রযুক্তি গবেষণা বিশেষত প্রতিরক্ষা, চিকিৎসাক্ষেত্র এবং কৃত্রিম মেধা এই প্রত্যেক ক্ষেত্রে সরকার আলাদা নীতি বানিয়েছে।
শিক্ষাবিস্তারে প্রতিটি রাজ্যে খোলা হয়েছে নতুন IIT, IIM, AIIMS, IIIT, সুপার স্পেশালিটি হাসপাতাল, জাতীয় আইন কলেজ। প্রশিক্ষণের জন্য শুরু হলো স্কিল ইন্ডিয়া প্রকল্প।
এতোসব সংস্কার যজ্ঞের ফল গত অর্থবর্ষে দেশবাসী দেখতে পেয়েছে। তার কিছু এখানে উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক হবে- (১) জিডিপি বৃদ্ধির হার উন্নত দেশগুলির চেয়ে বেশি এবং কয়েকদিন আগে ভারত জাপানকে জিডিপিতে ছাড়িয়ে গিয়ে এখন বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম অর্থনীতি। (২) রপ্তানিতে ভারত এই বছর রেকর্ড করেছে। বর্তমানে ভারতের রপ্তানি দাঁড়িয়েছে ৭৫০ বিলিয়ন ডলার। (৩) ফোরেক্স রিজার্ভে ভারত সর্বকালীন রেকর্ড ৬০০ বিলিয়ন ডলারের মাত্রা অতিক্রম করেছে। (৪) দেশের সবক’টি ব্যাংকের লাভপ্রথমবার ছাড়িয়েছে এক লক্ষ কোটি টাকা। (৫) এই আট বছরে সড়কপথ হয়েছে দ্বিগুণ। (৬) বিমান নেটওয়ার্ক তিনগুণ হয়েছে। (৭) ব্যাংক অ্যাকাউন্ট বেড়েছে তিনগুণ। (৮) ইন্টারনেট ডাটা ব্যবহার বেড়েছে ৫৪ গুণ। (৯) প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ বেড়েছে আড়াই গুণ। (১০) ভারতীয় মুদ্রার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি মিলেছে।
দেশ আরও এগিয়ে যাবে। প্রয়োজন বিচারব্যবস্থা, প্রশাসন, পুলিশ এবং রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সংস্কার। আরও বেশি সরকারি বিনিয়োগ প্রয়োজন শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও গবেষণায়। দুর্নীতির বিষয়ে প্রয়োজন আরও কড়া আইন, যাতে ক্ষমতাবান ও প্রভাশালীরা ছাড়া না পেয়ে যান। দরকার Enforcement of Contract নিশ্চিত করা। ভারতবাসীর আশা, ভারত সরকার এই লক্ষ্য পূরণ করতে বদ্ধপরিকর।