ঋষি উদ্ভাবিত এক অভিনব পন্থা
যোগবিজ্ঞান
অভিজিৎ চট্টোপাধ্যায়
যোগ বা যোগা। আরও কায়দার পশ্চিমি উচ্চারণে ইয়োগা; ইদানীং দেশে-বিদেশে শিক্ষিত-অশিক্ষিত নির্বিশেষে এক অদ্ভুত উন্মাদনায় মানুষের মনে স্থান করে নিয়েছে! সমাজের বেশিরভাগ মানুষের কাছেই তা দেশেই হোক বা বিদেশেই হোক, কিছু নিয়মমাফিক শরীরচর্চা বা ব্যায়ামকেই যোগ বলে ধরে নেওয়া হয়েছে।
যোগাসন আর প্রকৃত যোগ কখনোই এক জিনিস নয়। বিশেষ কিছু আসনের সঙ্গে কিছু শ্বাসপ্রশ্বাস গ্রহণ ও নিঃসরণের কায়দা যে প্রকৃত যোগবিদ্যা নয়, তা আর কেউ না বুঝুন সত্যিকার যোগ
অনিসন্ধিৎসু যাঁরা, তাঁরা কিন্তু ঠিকই বোঝেন! যদিও, এই হটযোগ বা যোগাসন করলে তার সুফল কিন্তু উপলব্ধি করা যাবেই। সনাতন ভারতে হটযোগের স্থান যোগী সমাজে সর্বনিম্নে হলেও প্রকৃত গুরু সান্নিধ্য এই যোগেরও মূল। ভারতবর্ষে সবরকম যোগ পদ্ধতিই তাই পুরোপুরি গুরুমুখী। মানসিক ও আধ্যাত্মিক উত্তরণের পন্থা। তা যে,
লয়যোগ, রাজযোগ, সিদ্ধযোগ, শিবযোগ, বিহঙ্গযোগ, ক্রিয়ায়োগ, উদগীথযোগ যাই হোক না কেন! সবই শেষপর্যন্ত ব্রহ্মস্থিতি লাভের বৈজ্ঞানিক পথ।
সনাতন ঋষিরা যোগকে এককথায়
বলেছেন ‘জীবাত্মা পরমাত্মনোটরকম’, অর্থাৎ জীবাত্মা ও পরমাত্মার ঐক্য বা মিলন! যতক্ষণ না এই মিলন বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে বা গুরু প্রদর্শিত পথে সাধিত হচ্ছে ততক্ষণ যোগসিদ্ধ হওয়া সম্ভব নয়। যোগ বিজ্ঞানের প্রথম ধাপই হলো চঞ্চল চিত্তবৃত্তিগুলিকে নিরোধ করা। তাই যোগবিজ্ঞান হলো এমন এক মিলন বিজ্ঞান যার প্রথম ভাগেই আছে চিত্তবৃত্তি নিরোধ প্রক্রিয়া।
আমাদের মন অর্থাৎ চিত্ত সারাক্ষণই চঞ্চল। সারাক্ষণই সে বিক্ষিপ্ত।
সহস্র সহস্র বাসনা-কামনার জালে আমরা আটকে রয়েছি সর্বদাই। একটি মুহূর্তও আমরা কামনা-বাসনা ও লালসার লালা বিজড়িত জাল থেকে মুক্ত নই। এর ফলেই আমাদের চিত্ত চঞ্চল, বিক্ষিপ্ত। এসব উপলব্ধি করেই ঋষিরা বলেছিলেন, প্রথমেই এই যে
বাসনা নামক রোগের চিকিৎসা শুরু করো! যার একমাত্র উপায় চিত্তবৃত্তি নিরোধ। জড় গবেষণাগারের পরিধির শেষে, নিজের শরীরকে যদি গবেষণাগার বানানো যায়, তবেই একাজ
সম্ভব। আমাদের প্রাচীন ঋষিরা যাঁদের বলা যায় এক কথায় যোগবিজ্ঞানী, তাঁরা বহু অধ্যবসায়, পন্থা উদ্ভাবন করেছেন। এই ভুয়োদর্শনের ফলশ্রুতিই হলো বিশেষ জ্ঞান আর যোগ। তাই বিজ্ঞান যা শুরু হচ্ছে জড়বিজ্ঞানের সীমানর শেষে।
সনাতন ভারতবর্ষ বিশ্বাস করে পুনর্জন্মতত্ত্বে। জীব বারবার জন্মগ্রহণ করে এই কামনা-বাসনা চিত্তে সংস্কার রূপে সঞ্চিত থাকার ফলে। ঋষিরা বলেছেন- জন্ম হলে মরণ অবশ্যম্ভাবী। শ্রীমদ্ভগবদ গীতার যে ‘দ্বিতীয় অধ্যায়’ সেই ‘সাংখ্যযোগ’-এ ভগবান নিজ শ্রীমুখে বলেছেন- ‘জাতস্য হি ধ্রুবো মৃত্যুধ্রুবং জন্ম মৃতস্য চ।’ (গীতা ২।২৭) তাই, জন্মালে মরণ, মরলে আবার পুনর্জন্ম। বার বার জন্ম-মৃত্যু মানে বার বার সেই একইভাবে রোগ, শোক, জরা, কামনা, সন্তাপ, অশান্তি ভোগ করা! জীব চায় চিরকার নিরবচ্ছিন্ন আনন্দ, শান্তি, সুখ ভোগ করতে। এ তার অনাদি চাওয়া। দুঃখহীন জীবন পেতে গেলে জন্মান্তরের পারে গিয়ে মুক্তি বা মোক্ষ লাভ অনিবার্য। সেই জন্যই চিত্তবৃত্তি নিরোধের আবশ্যকতা। যা একমাত্র উপলব্ধ হয় কামনা-বাসনার ক্ষয় হলে। আর বাসনা না থাকলেই মুক্তি অবশ্যম্ভাবী। গীতার ‘পঞ্চমঅধ্যায়’ অর্থাৎ ‘কর্মসন্ন্যাস যোগের’ ২১নং শ্লোকে বলা হচ্ছে-
বাহ্যস্পর্শেম্বসক্তাত্মা বিন্দত্যাত্মনি যৎ সুখম্।
স ব্রহ্মযোগযুক্তাত্মা সুখমক্ষয়মম্মুতে।।
অর্থাৎ বাহ্যবিষয়ে অনাসক্ত ও ব্রহ্মভাবে সমাহিত ব্যক্তি আত্মাতে আনন্দলাভ করেন। এই অবস্থায় তিনি অক্ষয় আনন্দ উপভোগ করেন।
এই কারণেই জীবাত্মা-পরমাত্মার মিলন বিজ্ঞানম বা ব্রহ্মভাবে অবস্থিতি লাভের পন্থা উদ্ভাবন করা সনাতন বৈদিক ঋষিদের খুবই ভাবিত করেছিল। তাঁরা বুঝেছিলেন, জীব স্বল্পায়ু। এক জীবনে যদি ব্রহ্মস্থিতি লাভ করতে হয়, তো যেভাবেই হোক আয়ুর বিস্তৃতি প্রয়োজন। তা না হলে চিত্তবৃত্তি রোধ করার মতো সময় একটি মাত্র জীবনেই মানুষ পাবে না। আর একজীবনে তা না পাওয়ার অর্থ পুনর্জন্ম। বার বার পুনর্জন্ম রোধের চিন্তা আর চির সুখসাগরে অবগাহনের প্রয়োজনীয়তার কথা মাথায় রেখে তাঁরা আবিষ্কার করলেন ‘খ্যাদ্যবিজ্ঞানের নিয়ম। যে নিয়ম যোগ সাধনার বিশেষ সহায়ক। তাঁরা দেখেছিলেন চিত্তবৃত্তিকে রোধ করতে গেলে আহার সংযম বিশেষভাবে জরুরি।
আমরা প্রশ্বাস গ্রহণ কালে বাতাসের অক্সিজেন বা অম্লজান গ্রহণ করি। এই
অক্সিজেন বা অম্লজান জারণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আমাদের খাদ্য হজমে, রক্তশোধনে, শরীরে উত্তাপ তৈরিতে অংশগ্রহণ করে। এই জারণক্রিয়ার ফলে উদ্ভূত জীবনীশক্তির এক ক্ষুদ্রাংশ সঞ্চালিত হয় আমাদের মস্তিষ্কের কোষগুলির পুষ্টি ও তাদের মধ্যে পারমাণবিক কম্পন বা cellular vibration ঘটতে এবং যার থেকে উন্মেষ ঘটে ‘চিত্তবৃত্তি’র। আবার এই জারণের ফলেই দেহে উৎপন্ন হয় দ্ব্যম্লাঙ্গার বা অঙ্গারিকাম্ল অর্থাৎ কার্বন-ডাই-অক্সাইডের। যা নিঃশ্বাস রূপে দেহ থেকে বেরিয়ে যায়। এইসব ক্রিয়া-বিক্রিয়ার ফলেই হয় ক্ষুধার উদ্রেক এবং একই সঙ্গে প্রারম্ভ ঘটে ক্ষয়ের। সোজাকথায়, এই নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসই মানুষের চিত্তবৃত্তি ও আয়ুনাশের কারণ।
যোগবিজ্ঞানী ঋষিরা এই শ্বাস-প্রশ্বাস নামক ক্রিয়াটিকে নিরুদ্ধ করেই প্রাপ্ত হন চিত্তবৃত্তি নিরোধক অবস্থা বা যোগাবস্থা। যোগাবস্থায় কোনোরকম ক্ষয়ক্রিয়া হয় না বলেই, পক্ষান্তরে আয়ুরও বৃদ্ধি ঘটে। যোগবিজ্ঞানীরা যে পদ্ধতিতে এই শ্বাস-প্রশ্বাস নিয়ন্ত্রণ করেন, তাই হলো প্রাণায়াম। যম, নিয়ম, আসন, প্রাণায়াম। প্রত্যাহার, ধ্যান, ধারণা ও সমাধি- এ সবই হলো অষ্টাঙ্গ যোগের বিভিন্ন অবস্থার ভেদ বা সহায়ক। প্রাণায়ামের পরিণামে যোগবিজ্ঞানী প্রাপ্ত হন সমাধি। সমাধি অর্থ সমভাবে অধিষ্ঠান করা। এই অবস্থায় চিত্তবৃত্তি নিরোধ ও ক্ষয় শূন্যতা একই সঙ্গে চলতে থাকায় ঘটতে থাকে আয়ু বৃদ্ধি।
ঋষিরা অনুভব করেছিলেন খাদ্য হজম করতে যতটুকু অক্সিজেন প্রয়োজন, ঠিক যদি ততটুকুই গ্রহণ করা যায়, তবে দেহের ক্ষয় ও চিত্তবৃত্তি নিরোধ খুব একটা অসম্ভব কিছু নয়। শুধু তাই নয়, এর ফলে রেহাই পাওয়া যাবে জরা-ব্যাধির হাত থেকেও।
বেদজ্ঞানী ঋষিরা তাঁদের জীবনের সব কিছুই গ্রহণ করতেন প্রকৃতি মায়ের কাছ থেকে। তাঁদের তপোবন, সাধনা, জীবনধারণ সবকিছুতেই ছিল প্রকৃতির সান্নিধ্য। সুতরাং প্রকৃতি ও পরিবেশের মধ্যেই তাঁরা শুরু করেছিলেন পুঙ্খানুপুঙ্খ সত্যানুসন্ধান। শুরু হলো সেইসব প্রাণীদের খোঁজ যারা স্বভাব-সমাধিবান। তাঁরা দেখলেন এবং সাহায্য নিলেন প্রকৃতির সব বস্তু ও প্রাণীর। যেমন স্বভাব-সমাধিবান প্রাণী হিসেবে তাঁরা পর্যবেক্ষণ করলেন, সাপ, ব্যাঙ, কচ্ছপ প্রভৃতিকে। এরা শীতঘুম দেয় নাতিশীতোষ্ণ পরিমণ্ডলে এবং সেই সময় তারা জিভকে উলটো করে তালুগহ্বরে ঢুকিয়ে দেয়। এসময় কোনোরকম জৈবিক ক্রিয়া তাদের থাকে না। সম্পূর্ণ বৃত্তি নিরোধক উপায়ে তারা দীর্ঘজীবন লাভ করে, যেমন- কচ্ছপ। তাঁরা গোমুখাসন, পদ্মভঙ্গিমায় পদ্মাসন, শবাসন, সিদ্ধাসন, হংসের ভঙ্গিমায় হংসাসন; বিড়ালের থেকে মার্জারাসন, উটের থেকে উষ্ট্রাসন, মাছের থেকে মৎস্যাসন, ঈগলের ভঙ্গিমা থেকে গরুড়াসন, কচ্ছপ থেকে কুর্মাসন আবিষ্কার করলেন। উদ্ভাসিত হলো খেচরীমুদ্রা।
খেচরী মুদ্রা অনুশীলনে তাঁরা সিদ্ধান্তে এলেন জিহ্বাকে যদি উলটো করে তালুদেশে প্রবেশ করানো যায়, তাহলে তালুনিঃসৃত একরকম রসের প্রভাবে, ক্ষুধা, ক্ষয়, রোগ-ব্যাধি, জরা-সবই জয় করা যায়। উপরন্তু চিত্তবৃত্তি নিরোধ হেতু দেহ-মন আনন্দে ভরে যায়! শুধু তাই নয়, আয়ুবৃদ্ধি হেতু বহুদিন সুস্থভাবে বাঁচার উপায় থাকবে। ভারতের আধ্যাত্ম ইতিহাসে বহুবর্ষজীবী যোগীরা এই পন্থাই অবলম্বন করেন। এর ভুরি ভুরি প্রমাণ আছে। যেমন: ‘তৈলঙ্গ স্বামী (২৮০ বছর)’, ‘ভাস্করানন্দজী’, ‘লোকনাথবাবা’ (১৬০ বছর), ‘দাদাজী বরফানী বাবা’ (প্রায় ৩০০ বছর), কাশীর কামরূপ মঠের’ অচ্যুতানন্দজী’ (১০৭বছর) আর কাশীর শিবানন্দজী তো এই সেদিন ১২৯ বছর বয়সে দেহ রাখলেন!
এদেশের গিরিকন্দরে আজও বহু যোগী সাধক রয়েছেন যাঁরা দীর্ঘজীবন লাভ করে রত আছেন মানব কল্যাণে। এর পিছনে যোগবিজ্ঞানের ভূমিকা কী? তাই যদি প্রশ্ন হয় তবে বলি, ঋষিদের অনুপুঙ্খ পর্যবেক্ষণের ফলে জানা গেছে যে স্বাভাবিক অবস্থায় মানুষ ২৪ ঘণ্টায় ২১৬০০ বার প্রশ্বাস গ্রহণ এবং নিঃশ্বাস ত্যাগ করে। এটা ধ্রুব সত্য। এই শ্বাসপ্রশ্বাসের সংখ্যা বা হার যোগবিজ্ঞানের প্রকরণগুলির সাহায্যে প্রশমন বা হ্রাস করেই যোগীরা লাভ করেন দীর্ঘজীবন। ঋষিবাক্য অনুসারে জীব একটি নির্দিষ্ট শ্বাসসংখ্যা নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। যতদিন না এই শ্বাসসংখ্যা তার পূর্ণ হচ্ছে, স্বয়ং কালও তাকে ছুঁতে পারে
না।
যোগবিজ্ঞানী ঋষিরা প্রমাণ করেছেন যা আধুনিক বিজ্ঞানের দ্বারাও সমর্থিত, তাহলো প্রাণীদের মধ্যে কচ্ছপই সবচেয়ে বেশিদিন বাঁচে। ঋষিদের নিরলস পর্যবেক্ষণে তাঁরা দেখেছিলেন, মানুষ মিনিটে প্রায় ১৫ বার, কুকুর প্রায় ২৮ বার, বানর ৩৪ বার, বিড়াল ২৪ বার, ঘোড়া ১৬ বার ও কচ্ছপ মাত্র ৩ বার শ্বাস গ্রহণ করে। এটাই তাদের সম্পূর্ণ স্বাভাবিক অবস্থায় শ্বাসগ্রহণ। যেহেতু, কার্বন-ডাই-অক্সাইড নিঃসরণের পরিমাণের সঙ্গে অক্সিজেন গ্রহণের পরিমাণ সমানুপাতিক, তাই যত কম শ্বাসগ্রহণ তত বেশি আয়ু। সেজন্যই কচ্ছপের শারীরিক ক্ষয় কম ও দীর্ঘজীবী।
অতএব, শ্বাস-প্রশ্বাসের মাত্রা যত কমবে-তত কমে যাবে শারীরিক ক্ষয়। আবার শ্বাস-প্রশ্বাসের হার যত কম হবে, তত কমে যাবে শ্বাস-প্রশ্বাসের দৈর্ঘ্য।
নাসাগ্র থেকে নিঃশ্বাসের স্পর্শ যতদূর অনুভব করা যায়, তাই হলো শ্বাস-প্রশ্বাসের দৈর্ঘ্য। এই দৈর্ঘ্য কমার সঙ্গে সঙ্গে কমে যাবে
কার্বন-ডাই-অক্সাইড নিঃসরণের মাত্রা ও অক্সিজেন গ্রহণ। ধীরে ধীরে যোগী প্রাপ্ত হবেন চিত্তবৃত্তি নিরোধক অবস্থা। আর, সেই অক্ষণবেধী উপায়কে তরান্বিত করতে যোগীরা একাগ্রতা, নাসাগ্রে দৃষ্টিপাত, ত্রাটক, কুম্ভক, রেচক, পুরক প্রভৃতির আশ্রয় নেন। তাঁরা চান যে কোনো উত্তেজনা থেকে দূরে থাকতে। অধিকাংশ যোগী লোকসমাজ থেকে দূরে শান্তিপূর্ণ নাতিশীতোষ্ণ পরিমণ্ডল বেছে নেন। কারণ, তারা জানেন বিভিন্ন অবস্থায়, বিভিন্ন কার্যকলাপের ফলে এ শ্বাস-প্রশ্বাসের দৈর্ঘ্যের হ্রাস বৃদ্ধি ঘটে।
স্বরোদয় যোগ শাস্ত্র প্রাচীন ভারতীয় একটি তন্ত্রশাস্ত্র। যা শ্বাসপ্রশ্বাস এবং শরীরের বিভিন্ন অবস্থার মধ্যে সম্পর্ক স্থাপন করে। সেই স্বরোদয় শাস্ত্রে শিব-পার্বতীর কথোপকথনের ছলে ঋষিরা বলে গেছেন যে, স্বাভাবিক অবস্থায় মানুষের প্রাণের বা শ্বাস-প্রশ্বাসের দৈর্ঘ্য ১২ আঙুল। প্রতিটি আঙুলের প্রন্থ হিসেবে য়া মোটামুটি ০.৭৮ ইঞ্চি। সুতরাং ১২ আঙুল মানে মোটামুটি ৯.৩৬ ইঞ্চি। যা আধুনিক বিজ্ঞানও স্বীকার করে নিয়েছে। হাজার হাজার বছর আগেই এদেশের যোগবিজ্ঞানীরা বলে গেছেন স্বাভাবিক অবস্থা ছাড়া অন্যান্য অবস্থা বা কার্যকলাপের সময় এই দৈর্ঘ্যের হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটে। যেমন, খাবার সময়, দৌড়াবার সময়, মৈথুনকালে, নিদ্রার সময়; এক-এক অবস্থায় হবে এক-এক রকম। অর্থাৎ প্রতিটি কর্মের ফলশ্রুতি হিসেবে এই স্বাভাবিক সাম্যাবস্থার হেরফের ঘটে।
প্রাচীন যোগবিজ্ঞানী ঋষিদের দ্বারা এটাও পরীক্ষিত হয়েছে যে, এই
শ্বাস-প্রশ্বাসের দৈর্ঘ্য কমার সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের ‘বিভূতি’ স্বতঃস্ফূর্তভাবে অর্জন করা যায়। শ্বাস-প্রশ্বাসের দৈর্ঘ্য ৮.২৫ ইঞ্চিতে নামলে যোগী হন জিতেন্দ্রিয়। ৭.৫ ইঞ্চিতে আনন্দলাভ, ৩.৭৫ ইঞ্চিতে লেখনী শক্তি, ৬ ইঞ্চিতে নামলে জানা যায় ভবিষ্যৎ, ৫.২৫ ইঞ্চিতে সূক্ষ্মদৃষ্টি লাভ হয়, ৪.২৫ ইঞ্চিতে মাধ্যাকর্ষণকে জয় করা যায়, ৩.৭৫ ইঞ্চিতে দূরের জিনিস বা স্থানে ঘটা বিষয় দর্শিত হয়, ৩ ইঞ্চিতে অনিমাদি শক্তি লাভ, ১.৫ ইঞ্চিতে সূক্ষ্ম শরীরে যায় বিচরণ করা, ০.৭৫ ইঞ্চিতে হয় ব্রহ্মানুভূতি আর এই শ্বাস-প্রশ্বাস যখন একেবারেই বাইরে আসে না, ভিতর ভিতর চলতে থাকে, তখনই হয় নির্বাণ লাভ।
যোগীরা লক্ষ্য করেছেন, কোনো মানুষ যদি একই সময়ে প্রতিদিন একই নিয়মে এই অভ্যাস চালিয়ে যায় তাহলে কিছু বছর পর ঠিক ওই সময়ে তার শ্বাস-প্রশ্বাসের হার কমে যাবে। এমনকী কিছু বছর পর ঠিক ওই সময় যদি সে সাধনায় বসার সময় নাও পায়, তাহলেও অন্তত কিছুদিন এই সময় তার শ্বাসসংখ্যার হেরফের হবে না। যে কারণে নিষ্ঠাবান লোকেদেরও নির্দিষ্টক্ষণে সন্ধ্যা করার নিয়ম প্রচলিত। ব্রাহ্মমুহূর্তে বা উষাকালে, সন্ধ্যায় এবং গভীর রাত- এই সময়গুলিই সাধনার সময়, কারণ তখন প্রকৃতি থাকে শান্ত ও শীতল।
ঋষিরা তাই বলেছেন দিনের নির্দিষ্ট সময়, নির্দিষ্ট জায়গা বা আসনে বসে সাধনা করতে হয়। যোগবিজ্ঞানের পন্থাগুলি ঋষিদের এমনই এক অভিনব উদ্ভাবন যার মধ্যে লুক্কায়িত আছে মানব জীবনের ধ্রুব ও অনাদি সত্যগুলি। তাই সামগ্রিকভাবে যোগবিজ্ঞান এক পূর্ণাঙ্গ বিজ্ঞানভিত্তিক পথ যা মানবকে দেবত্বে উন্নীত করে, এনে দেয় নির্বাণরূপ মোক্ষ এবং অবশেষে শিবত্ব।
সুস্থ শরীর-মনের জন্য যোগাভ্যাস জরুরি
প্রদীপ মারিক
যোগব্যায়াম ও ধ্যান জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। শ্রীমদ্ভগবত গীতায় যে আঠারোটি অধ্যায় আছে প্রথমটি অর্জুন বিষাদযোগ এবং শেষটি মোক্ষ সন্ন্যাসযোগ। সবকটি অধ্যায় যোগের ওপর দাঁড়িয়ে। বর্তমান দিনে মানসিক শান্তি পাওয়া খুব কঠিন। এই মন ও শরীরের জন্য প্রয়োজন যোগাসন। বর্তমান দিনে মনের এই অশান্তি কীভাবে দূর করা যায় তার পথ মানুষ খুঁজে বেড়াচ্ছে। যোগব্যায়ামের মাধ্যমে শরীর-মন ভালো হয়। একটা শান্তির সকাল এসে পড়ে। যোগবিশেষজ্ঞরা বিভিন্নভাবে যোগের উপযোগিতার কথা বলেছেন। তারা বোঝাতে চেয়েছেন যোগ কেন দরকার? চিকিৎসকরাও রোগ নিরাময়ে যোগের কথা বলেন।
যোগ একটি প্রাচীন শারীরিক, মানসিক ও আধ্যাত্মিক অনুশীলন যা ভারতে উদ্ভূত হয়েছে। ‘যোগ’ শব্দটি সংস্কৃত থেকে এসেছে। এর অর্থ মিলন, সংযোগ বা একত্রিত হওয়া। আন্তর্জাতিক যোগদিবস লোগোতে দুই হাত ভাঁজ করা যোজনকে প্রতীকীকরণ করে। যা সর্বজনীন চেতনা, মন শরীর এবং মানুষ ও প্রকৃতির মধ্যে নিখুঁত সাদৃশ্যর সঙ্গে স্বতন্ত্র সচেতনতার মিলনকে প্রতিফলিত করে। এতে বাদামিপাতা পৃথিবীর উপাদান। সবুজপাতা প্রকৃতির প্রতীক। নীল রং উজ্জ্বলতার প্রতীক। লোগোটি মানবতার জন্য সম্প্রীতি ও শান্তি নির্দেশিত করে, যা যোগের সারমর্ম।
প্রাণায়াম মূলত শ্বাস-প্রশ্বাসের নিয়ন্ত্রণ। প্রাণের আয়াম অর্থাৎ প্রাণের দীর্ঘতাই প্রাণায়াম। সঠিক নিয়মে শ্বাস গ্রহণ, ধারণ ও ত্যাগ নিয়ন্ত্রণের পদ্ধতিই প্রাণায়াম। যোগশাস্ত্র অনুযায়ী নাকের মাধ্যমে ফুসফুসে বাতাস পুরণ করে ধারণ এবং ফুসফুস থেকে বাতাস বের করে দেওয়ার বিশেষ নিয়মবদ্ধ প্রক্রিয়ার দ্বারা প্রাণায়াম করা হয়। ফুসফুসে ভিতরে বায়ুর প্রবেশ ও নিষ্ক্রমণের প্রক্রিয়ার দ্বারা শরীরে বায়ুর বিস্তার ঘটে। তার নিয়ন্ত্রণ করার প্রক্রিয়াই হলো প্রাণায়াম। এই নিয়ন্ত্রণের প্রক্রিয়া চারটি ধাপে সম্পন্ন হয়। -পূরক, অন্তঃকুম্ভক, ও বাহ্য কুম্ভক রেচক। দেহের প্রাণশক্তি বৃদ্ধি করে জরা, ব্যাধি ও অকালমৃত্যুর হাত থেকে দেহকে রক্ষা করার উদ্দেশ্যে
প্রাণায়াম করা হয়।
ফুসফুসের ব্যায়ামের ক্ষেত্রে প্রাণায়াম অত্যন্ত ফলপ্রসু। প্রাণায়ামের ফলে প্রায় কুড়ি প্রকার কফ থেকে অব্যাহতি পাওয়া যায়। প্রাণায়াম স্নায়ুকে অত্যন্ত সক্রিয় ও সবল করে থাকে। প্রাণায়ামের সঙ্গে খুব সহজ কয়েকটি আসন করালে খুব ফলপ্রসু হয়- (১) প্রথমে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে কিংবা ধ্যান করার মতো করে আসন করে বসতে হবে। (২) ধীরে ধীরে নাক দিয়ে যতটা সম্ভব বুক ভরে শ্বাস গ্রহণ করতে হবে। (৩) যেমন করে ধীরে ধীরে শ্বাস নেওয়া হয়েছে তেমনি ধীরে ধীরে মুখ দিয়ে (হা করে) ছাড়তে হবে। এইভাবে দিনে তিন মিনিট/পাঁচ মিনিটে যতবার ইচ্ছা নিঃশ্বাস নিতে হবে এবং ছাড়তে হবে।
এক্ষেত্রে মনে রাখার মতো বিষয় হলো, নিঃশ্বাস নিতে হবে নাক দিয়ে কিন্তু নিঃশ্বাস ত্যাগ করতে হবে মুখ দিয়ে। যতটা সময় ধরে নিঃশ্বাস নেওয়া হয়েছে ততটা সময় ধরে ছাড়তে হবে। প্রাণায়াম যেহেতু ধ্যানেরই একটি বিশেষ প্রকার, তাই এর নানাবিধ উপকারিতা রয়েছে। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে যোগাসন বা ধ্যানের উপকারিতা সম্পর্কে আমরা কম-বেশি সবাই জানি। কিন্তু প্রাণায়ামের উপকারিতাও অপরিসীম। স্বাভাবিকভাবে আমরা যখন শ্বাস ত্যাগ করার পর শ্বাস গ্রহণ করি, তখন ফুসফুসে যে পরিমাণ বাতাস প্রবেশ করে, তাতে ফুসফুস মাত্র দুই-তৃতীয়াংশ প্রসারিত হয়। কিন্তু প্রাণায়াম করার মাধ্যমে ফুসফুস সম্পূর্ণভাবে প্রসারিত করা যায়। শরীরে প্রচুর পরিমাণ বাতাস প্রবেশের সুযোগ পায়। ফলে শরীর পর্যাপ্ত পরিমাণ অক্সিজেন পায়। শরীরে অক্সিজেন সরবরাহ বৃদ্ধি পেলে রক্ত চলাচল সঠিকভাবে হয়, হৃদযন্ত্র ভালোভাবে কাজ করতে পারে। এক কথায় শরীরের যন্ত্রাংশ যখন ভালোভাবে কাজ করে তখন শরীরের অনেক রোগ, ব্যাধি দূর হয়ে যায়।
কেবলমাত্র একটা দিনের জন্য নয় প্রতিদিন একটা অভ্যেস গড়ে তোলা, যাতে সারা দিনে অন্তত ত্রিশ মিনিট সময় বের করা যায় যোগাভ্যাসের জন্য। সুস্থ জীবনের জন্য যোগাভ্যাস খুব জরুরি।