২০২৬-এর ভোটে তৃণমূলের বড়ো দুর্বলতা ‘মুক আর মুখ’-এর লড়াই
‘টেক অফ’
নির্মাল্য মুখোপাধ্যায়
আহমেদাবাদের মর্মান্তিক বিমান দুর্ঘটনার বিদেহী আত্মাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এই লেখা। তাই এই রাজনৈতিক লেখায় ইচ্ছাকৃতভাবেই বিমান পরিবহণের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত ‘টেক-অফ’ ও ‘ল্যান্ডিং’ শব্দ দু’টি ব্যবহার করা হয়েছে। প্রশ্ন হলো কোন দলের টেক অফ, আর কারই-বা ল্যান্ডিং? ২০২৬-এর পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার ভোটে তৃণমূলের মুখ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। খানিকটা নিরুপায় হয়েই অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় তা ঘোষণা করেছেন। মমতা স্বাভাবিক মুখ হলে ঘোষণার প্রয়োজন হতো না। অভিষেক যে মুখ হবেন না, নরেন্দ্র মোদী শাসিত ভারতের প্রতিনিধি করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তা বুঝিয়েছেন। প্রতিনিধিদলে থেকে সাংসদ অভিষেক ভারতীয় সেনার ‘অপারেশন সিঁদুর’-এর ভূয়সী প্রশংসা করলেও রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিধানসভার প্রস্তাব থেকে শব্দ দু’টি বাদ দিয়েছেন।
সাংগঠনিক রাশ অভিষেকের হাতে। এবারেও তৃণমূলের তরী পারের দায়িত্ব রয়েছে অভিষেকের আমদানি আইপ্যাক সংস্থার হাতে। তাই তৃণমূলের মুখ মমতা আর দেহ অভিষেক। ২০২১-এর ভোটে তৃণমূলের নতুন বিধায়ক ছিলেন ৬৪ জন। এবারের প্রার্থী তালিকা থেকে তৃণমূল নাকি তাদের ১০০ জন বিধায়ককে বাদ দিতে চলেছে। মুখবদলের এই খেলা প্রমাণ করে যে রাজ্যের শাসক দল তৃণমূল মোটেই স্বস্তিতে নেই। দলের একটা বড়ো অংশের কাছে আইপ্যাকের পেশাদারিত্ব অস্বস্তির। ২০০০ সালে বিদেশি বামেরা বুঝে গিয়েছিল জ্যোতি বসুকে দেখলেই লোকে পালাচ্ছে। তাই মুখ পালটে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে নিয়ে আসা হয়। বসু তার পঞ্চম মুখ্যমন্ত্রিত্বের মেয়াদ শেষ করতে পারেনি। তার আগেই স্বস্তিকা।। ৮ আষাঢ় – ১৪৩২।। ২৩ জুন ২০২৫ ঘাড়ধাক্কা দিয়ে তাকে বের করে দেওয়া হয়। ২০১১ সালে ক্ষমতাসীন হওয়ার ১৫ বছর পর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তেমন দুরবস্থা যদিও নয়। তৃণমূল তার নামেই একটি ছোটো ফ্যান ক্লাব দল। সেখানে ভঙ্গ দেহ তৈরি হলেও মুখ তৈরি হয় না। সেখানে মূক-বধিরের সংখ্যাটাও অধিক। যারা কোনোভাবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বা অভিষেকের বিরুদ্ধাচরণ করে না।
ত্রিবঙ্গে (উত্তর, মধ্য ও দক্ষিণ) ত্রিফলা আক্রমণ শানানোর জন্য বিজেপি-র মুঠোয় একাধিক মুখ রয়েছে। তাঁরা দলীয় স্তর ও ভোটার- উভয়ের কাছেই বেশ জনপ্রিয়। ২০২৪ সালের আগে পরে ৬টি রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনে সংশ্লিষ্ট রাজ্যগুলিতে কাউকে মুখ না করেই বিজেপি বিপুল ভোটে জেতে। পশ্চিমবঙ্গ তাই ব্যতিক্রম নাও হতে পারে। এই মুহূর্তে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মুখ শিক্ষিত শ্রেণীর কাছে মিম ও হাস্যকৌতুকের পরিবেশন। সাধারণ মানুষের কাছে তা একটি বিশেষ সম্প্রদায় তোষণকারী ও চরম দুর্নীতিগ্রস্ত। ‘ম’-এর লক্ষ্মণরেখায় এবার যুক্ত হয়েছে ‘মহেশতলা’।
রাজ্যের গ্রাম আর জেলাগুলি মিলিয়ে প্রায় ৪০ শতাংশ মানুষ ভোট দিতে আসেন না। হয়তো জোর করে তাঁদের আটকে দেওয়া হয়। কলকাতার ১১টি আসনে ৫০ থেকে ৫৫ শতাংশ মানুষ ভোট দেন না। তারা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘মিম’ উপভোগ করেন, আর টেবিলে বসে বা চায়ের দোকানে মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সমালোচনা করেন, কিন্তু তার বিরুদ্ধে ভোট দেন না। অনেকেরই ধারণা ৫টি মেয়াদের পর জ্যোতিবাবুকে দেখে যেমন লোক পালাচ্ছিল, ভোটের সময় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সে দশা হবে। আর সেটা বুঝে অভিষেক আগেভাগেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে তৃণমূলের মুখ হিসেবে ঘোষণা করে দিয়েছে। রাজ্য বিজেপি-র এখন টেক অফের সময় এসেছে। বিরোধীদের বোঝা দরকার তৃণমূলের ভিতর আর বাইরের দু’টো ইঞ্জিন দুর্বল হয়ে পড়েছে। এরপরও তৃণমূল উড়তে পারে যদি তাদের বিরুদ্ধে শক্তিশালী আন্দোলন না গড়ে ওঠে, এবং রাজ্যের প্রধান বিরোধী দল বিজেপি-র বুথভিত্তিক সংগঠন মজবুত না হয়।
২০২১-এর পর তিনটে (পুরসভা, পঞ্চায়েত ও লোকসভা) ভোটে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারকে পালটানোর সুযোগ ছিল না। তাই ২০২৬-এ বিজেপিকে টেক অফের পরীক্ষায় পাশ করতেই হবে। প্রায় তিন দশক পর বিজেপি দিল্লি ও ওড়িশা দখল করেছে। সংসদে নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকারের যখন নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল, তখনও রাজধানী দিল্লি বিজেপির হাতের বাইরে ছিল। ২০২৬ সালে বিজেপি সঠিকভাবে টেক অফ করলে তবেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ক্র্যাশ ল্যান্ডিং হবে। আর তা না হলে বিজেপিকে কেঁচে গণ্ডুষ করতে হবে। ২০২৬ সালে পশ্চিমবঙ্গ সমেত চার রাজ্য- অসম, কেরালা, তামিলনাড়ু ও কেন্দ্রশাসিত পুদুচেরিতে ভোেট। আসাম ছাড়া তিনটি বড়ো রাজ্যেই অ-বিজেপি সরকার রয়েছে। বিজেপি-র কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের কাছে তামিলনাড়ুর পাশাপাশি পশ্চিমবঙ্গেও বড়ো লড়াই। ভারতের উত্তর, মধ্য, পশ্চিম, পূর্ব প্রান্তের বিভিন্ন রাজ্যে শক্তিশালী সংগঠন থাকলেও বিজেপি এককভাবে কখনো বিহার জেতেনি। আগামী নভেম্বরে সেখানে ভোট। সেই ভোেট খানিকটা বলে দেবে ২০১১-তে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে বিমান উড়িয়েছিলেন, ২০২৬-এ বিজেপি তার ক্র্যাশ ল্যান্ডিং ঘটাতে পারবে কিনা।