আমেরিকা হলো একটি অত্যন্ত লোভী দেশ, যা আধুনিক কালের ‘রাবণ’ হিসেবে ক্রিয়াশীল। প্রশ্ন হলো ভারত কি আমেরিকা নামক
দশাননের অন্যতম একটি মস্তকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হবে, নাকি বিভীষণ বা শ্রীরামচন্দ্রের ভূমিকা গ্রহণ করবে?
ড. শেখর প্যাটেল
নিজের ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ বাঁকে এসে আজ উপনীত হয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ইতিহাসের এই মোড়ে এসে দাঁড়িয়ে দেশটি এই মুহূর্তে নানা চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। এই সমস্যাগুলি বর্তমানে আমেরিকার অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাকে প্রায় বিপন্ন করে তুলেছে।
আমেরিকার আর্থিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, দেশটির ঋণের পরিমাণ সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছে। অর্থনৈতিক পূর্বাভাস অনুযায়ী, আগামী এক দশকে আরও কয়েক ট্রিলিয়ন (লক্ষ কোটি) ডলার ঋণবৃদ্ধির সম্ভাবনা রয়েছে। বর্তমানে ঋণভারে বিপর্যস্ত আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র। সেই ঋণের সুদ দেশটির প্রতিরক্ষা বাজেটের চেয়ে বেশি। মুদ্রাস্ফীতি যদি অব্যাহত থাকে, তবে খুব শীঘ্রই আমেরিকাকে মৌলিক চাহিদা মেটানোর লড়াইয়ে শামিল হতে
হবে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, ডলার হলো ‘গ্লোবাল রিজার্ভ কারেন্সি’, অর্থাৎ বিভিন্ন দেশের বৈদেশিক মুদ্রা ভাণ্ডারের ক্ষেত্রে ডলার সঞ্চয়ের বিষয়টি
আন্তর্জাতিক স্তরে স্বীকৃত। বিশ্বব্যাপী রিজার্ভ মুদ্রা হিসেবে ডলারের অবস্থান বা এই মুদ্রাটির মূল্যমানের ওপর আন্তর্জাতিক বাণিজ্য নির্ভরশীল। ডলারের মূল্যের হ্রাস-বৃদ্ধি, অর্থাৎ মূল্য পরিবর্তন বাণিজ্য ঘাটতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাণিজ্য ঘাটতির কারণে আমেরিকার আর্থিক পরিস্থিতির অবনতি বিশেষ লক্ষণীয়।
ট্রাম্প প্রশাসনের খামখেয়ালি নেতৃত্বে উপেক্ষা করা হচ্ছে ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট, বর্তমান বাস্তবতা। তাদের প্রতিটি পদক্ষেপের ভবিষ্যৎ পরিণতি কী দাঁড়াবে সেই বিষয়েও উদাসীন ট্রাম্প প্রশাসন। এই সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলিকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে শুল্ক আরোপকে একটি চটজলদি ‘সমাধান’ হিসেবে
বেছে নেওয়া হয়েছে। এই পদক্ষেপগুলির পরিণামস্বরূপ আমেরিকায় দেখা দিতে পারে মুদ্রাস্ফীতি। এর ফলে বাড়তে পারে গ্লোবাল জিডিপি ও মার্কিন জিডিপি (আমেরিকার মোট আভ্যন্তরীণ উৎপাদন) হ্রাসের ঝুঁকি। শুল্কবৃদ্ধির ফলে আর্থিক বোঝা কেবল রপ্তানিকারক দেশ এবং মার্কিন ব্যবসা-বাণিজ্যের ওপরেই চাপবে না। শেষ পর্যন্ত মার্কিন নাগরিকদের ওপরেও আর্থিক চাপ বাড়বে যারা ইতিমধ্যেই অর্থনৈতিক বৈষম্যের ভারে জর্জরিত।
আমেরিকার প্রেক্ষাপটে, মার্কিন জনতার শ্বেতাঙ্গ অংশটির সামাজিক অবস্থান এই মুহূর্তে বিশেষ সুবিধাজনক নয়। সমাজের সর্বোচ্চ স্থানে একদা আসীন এই লোকজন তাদের সেই অবস্থান থেকে প্রায় বিচ্যুত। এমতাবস্থায় অ-শ্বেতাঙ্গ জনগোষ্ঠীর রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতাশালী হয়ে ওঠার প্রভূত সম্ভাবনা। অ-শ্বেতাঙ্গ জনগোষ্ঠীর এই রাজনৈতিক উত্থানের ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ‘অভিবাসন’ একটি বিতর্কিত বিষয় হয়ে উঠেছে। আর্থিক বৃদ্ধির পক্ষে সহায়ক হিসেবে একদা
পরিগণিত হলেও নানা নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে অভিবাসন রোধ করা মার্কিন প্রশাসনের পক্ষে সম্ভবপর হয়েছে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে অনুপ্রবেশকারীদের বহিষ্কার এবং সীমান্তরক্ষার প্রতি কড়া নজরদারিতে জোর দেওয়া হচ্ছে। জাতিবিদ্বেষজনিত উত্তেজনা, প্রবল রাজনৈতিক মতপার্থক্য, স্বাস্থ্যপরিষেবার শোচনীয় পরিস্থিতি
এবং ক্রমবর্ধমান আর্থিক বৈষম্যের মতো জটিল পরিস্থিতিকে জটিলতর করে তুলেছে বৃহৎ মার্কিন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান বা কর্পোরেশনগুলি। আন্তর্জাতিক স্তরে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে এই কর্পোরেশনগুলি নানা ব্যবসাবাণিজ্যে লিপ্ত। আমেরিকা অন্য দেশের ওপর শুল্কের বোঝা চাপানোর ফলে প্রকারান্তরে তাদের এই শুল্কের বোঝার বিরুদ্ধে লড়তে হচ্ছে। মার্কিন শুল্কনীতি তাদের মুনাফা হ্রাসের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আমেরিকার যাবতীয় সমস্যার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে বিগত কয়েক দশকের অনিয়ন্ত্রিত ভোগবাদ। আমেরিকায় অনেক রকম রাজনৈতিক বিতর্ক হলেও ‘বর্জ্য’-এর বিষয়টির ওপরে এই দেশে কোনো আলোচনা হয় না। বর্জ্যের পরিমাণ হ্রাসের ক্ষেত্রে গুরুত্ব দেয় না আমেরিকা। প্রয়োজনীয় হলেও অনেক উৎপাদিত পণ্য অপচয় করে থাকে আমেরিকাবাসী। তাদের দ্বারা দরকারি হলেও ফেলে দেওয়া পণ্যের মোট পরিমাণ রীতিমতো বিস্ময়কর! এই ব্যাপক ও
লাগামছাড়া ভোগবাদ পরিবেশের ক্ষতি, প্রাকৃতিক সম্পদহানি এবং গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনের কারণ হয়েছে। আমেরিকার জনসংখ্যা বিশ্বের জনসংখ্যার মাত্র ৪ শতাংশ হলেও তারা বিশ্বব্যাপী উত্তোলিত প্রাথমিক শক্তিসম্পদ বা গ্লোবাল প্রাইমারি এনার্জি (উদাহরণ- কয়লা, খনিজ তেল, প্রাকৃতিক গ্যাস, ইউরেনিয়াম
ইত্যাদি)-র ১৬ শতাংশ ব্যবহার করে। তাদের এহেন কার্যকলাপ প্রকৃতি-পরিবেশের ক্ষয়ক্ষতি, বিশ্ব পরিবেশ দূষণ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলে। উন্নয়ন ও আর্থিক বৃদ্ধিকেও যে সুষম, সুসংহত ও সীমাবদ্ধ রাখা প্রয়োজন- আমেরিকায় সেই সংক্রান্ত সামাজিক বিতর্ক, মতবিনিময় ও পর্যালোচনার নিতান্ত অভাব।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী পরিস্থিতিতে অপরিসীম শক্তিসম্পন্ন হয়ে ওঠে মার্কিন যুক্তিরাষ্ট্র। বিশ্বের মধ্যে চূড়ান্ত ক্ষমতাধর এই দেশটির সমকক্ষ কেউ হয়ে উঠতে পারেনি।