ভোটার তালিকার বিশেষ সংশোধনীর বিরুদ্ধে শাসকদলের বিরোধিতা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত
আনন্দ মোহন দাস
প্রসঙ্গত, ১৯৬০ সালের জনপ্রতিনিধিত্ব আইন ও ভারতীয় সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩২৬ অনুসারে নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব হলো, প্রকৃত ভারতীয় নাগরিকদের ভোটের মাধ্যমে জনপ্রতিনিধি নির্বাচন করা এবং সুনিশ্চিত করা যাতে কোনো অবৈধ ভোটারের নাম তালিকাভুক্ত না হয়। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছ ভোটার তালিকার মাধ্যমে অবাধ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন করানো নির্বাচন কমিশনের মৌলিক ও সাংবিধানিক কর্তব্য। ভারতীয় জনপ্রতিনিধিত্ব আইন, ১৯৫০ অনুযায়ী নিম্নলিখিত তিনটি শর্ত পূরণ করলে তবেই ভোটাধিকার প্রাপ্ত করা যায়।
(১) ভারতীয় নাগরিক হতে হবে, (২) বয়স ১৮ বছর বা তদূর্ধ্ব হতে হবে, (৩) কোনো স্থানে ন্যূনতম ৬ মাস বা তার অধিক সময়ের জন্য অধিবাসী হতে হবে।
দেশের নাগরিকত্ব আইন, ১৯৫৫ ও ভারতীয় সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৫ থেকে ১১ (পার্ট ২) অনুযায়ী ভারতীয় নাগরিকত্ব আইন পরিচালিত হয়। কেন্দ্রের বিজেপি সরকার ২০১৯ সালে ১৯৫৫ সালের নাগরিকত্ব আইনে একটি সংশোধনী এনেছে। এই সংশোধনীতে বলা হয়েছে যে ২০১৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর অবধি পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও আফগানিস্তান থেকে যে সমস্ত সংখ্যালঘু হিন্দু, খ্রিস্টান, জৈন, শিখ, বৌদ্ধ ও পার্শি ধর্মীয় অত্যাচারের কারণে ভারতে আসতে বাধ্য হয়েছেন, তারা এই দেশের নাগরিকত্ব পাবেন। এই সংশোধনীটি বহুল প্রচারিত সিএএ (নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন) নামে পরিচিত। সুতরাং হিন্দুরা কোনোভাবেই অনুপ্রবেশকারী নয়। তাঁরা হলেন শরণার্থী।
স্বাভাবিকভাবেই বৈধ নাগরিক ছাড়া ভোটার তালিকায় কোনোরকম বিদেশি, মুসলমান অনুপ্রবেশকারী ও রোহিঙ্গাদের নাম থাকা দেশের সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তার ক্ষেত্রে ক্ষতিকারক ও বিপজ্জনক। এছাড়াও দেশের সরকার গঠনের ক্ষেত্রে বিদেশি অনুপ্রবেশকারী এবং অবৈধ ভোটারদের কোনোরকম ভূমিকা থাকা বাঞ্ছনীয় নয়। ২০০৫ সালে সুপ্রিম কোর্টের রায়েও বেআইনি অনুপ্রবেশকারীদের অসাংবিধানিক আখ্যা দেওয়া হয়েছে। তাই স্বচ্ছ নির্বাচনের স্বার্থে সময়ে সময়ে ভোটার তালিকা বিশেষভাবে নিবিড় সংশোধন (SIR) করা অত্যন্ত আবশ্যক। সম্প্রতি বিহারে ভোটার তালিকার SIR সম্পন্ন হয়ে গেল। এনডিএ
জোট ছাড়া ইন্ডি জোটের বেশিরভাগ দলগুলি এসআইআর-এর তীব্র বিরেধিতা করে আলোচনার দাবিতে সংসদ অচল করে রেখেছিল। কয়েকটি বিরোধী দলের নেতা এবং বিদেশি মদতপুষ্ট কিছু এনজিও মিলে সুপ্রিম কোর্টে নির্বাচন কমিশন দ্বারা ভোটার তালিকার বিশেষ নিবিড় সংশোধনীর বিরুদ্ধে মামলা করেছেন। এমনকী আদালতে তারা বিহারে ভোটার তালিকার এসআইআর বন্ধ রাখার আবেদন করেছিলেন। কিন্তু সর্বোচ্চ আদালত সঙ্গত কারণেই নির্বাচন কমিশনের এই বিশেষ সংশোধনীর বিরুদ্ধে কোনো রকম স্থগিতাদেশ দেয়নি।
ইতিমধ্যে জানা গেছে বিহারে ভোটার তালিকার বিশেষ নিবিড় সংশোধনীর (SIR) মাধ্যমে ৬৫ লক্ষ ভোটারের নাম বাদ গেছে। এর মধ্যে ২২ লক্ষ ভোটারের মৃত্যু হয়েছে, ৩৫ লক্ষ ভোটার স্থায়ীভাবে অন্যত্র চলে গেছেন, ৭ লক্ষ ভোটারের নাম একাধিক স্থানে রয়েছে এবং ১ লক্ষ ভোটারের কোনো অস্তিত্ব নেই। বিরোধীদের কাছে প্রশ্ন এই বিরাট সংখ্যক অবৈধ ভোটারের নাম কি তালিকায় থাকা উচিত? তাদের আন্দোলনের উদ্দেশ্য কী? তাদের ভোটব্যাংক কি অবৈধ বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী ও রোহিঙ্গা? তাঁদের ভোট ব্যাংক কি ভূতুড়ে ও মৃত ভোটার? ভারতীয় গণতন্ত্রে বিরোধী দলগুলির এই ধরনের দেউলিয়াপনা ও দায়িত্বজ্ঞানহীন ভূমিকা লজ্জাজনক।
বলাবাহুল্য, এই ধরনের ভোটার তালিকার বিশেষ নিবিড় সংশোধনীর কাজ নতুন কিছু নয়। এর আগেও বিহারে ২০০৩ সালে এবং পশ্চিমবঙ্গে ২০০২ সালে ভোটার তালিকার বিশেষ নিবিড় সংশোধনী হয়েছে।
ভারতবর্ষে বিভিন্ন রাজ্যে ইতিপূর্বে ভোটার তালিকার ১৩টি বিশেষ নিবিড় সংশোধনী (Special Intensive Revision) হয়েছে। সুতরাং বর্তমান নির্বাচন কমিশনের এটি কোনো মনগড়া বা বেআইনি সিদ্ধান্ত নয়। এই বিশেষ সংশোধনীর কাজে বিএলও (বুথ লেভেল অফিসার) ও সমস্ত স্বীকৃত রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি (বিএলএ) বা বুথ লেভেল এজেন্ট হিসেবে থাকেন। সুতরাং কোনো পক্ষের এককভাবে কোনো অন্যায় সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ থাকে না এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত ছাড়া কিছু নয়। দেশের স্বার্থে ভোটার তালিকায় ভূতুড়ে, মৃত ও অবৈধ বাংলাদেশি মুসলমান অনুপ্রবেশকারী ও রোহিঙ্গাদের নাম থাকা একেবারেই বাঞ্ছনীয় নয়।
এই বিশেষ সংশোধনীতে মোটের ওপর পাঁচটি বিষয়ের উপর নজর দেওয়া হয়।
(১) মৃত ভোটার, (২) স্থায়ীভাবে স্থান ত্যাগ করা ভোটার, (৩) একাধিক স্থানে ভোটার তালিকায় নাম থাকা, (৪) অস্তিত্বহীন ভোটার, (৫) অবৈধ বাংলাদেশি মুসলমান অনুপ্রবেশকারী ও রোহিঙ্গা ভোটার। এই সমস্ত অবৈধ ভোটারদের নাম স্বাভাবিকভাবেই ভোটার তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়ে থাকে। এরপর খসড়া ভোটার তালিকা প্রকাশের পর এক মাসের মধ্যে ERO (Electoral Registration Officer) এর কাছে অভিযোগ জানাবার সুযোগ থাকে। তারপরও সন্তুষ্ট না হলে DRO (District Returning Officer, i.e. DM) অভিযোগের নিষ্পত্তি করতে পারেন এবং সবশেষে মুখ্য নির্বাচনী আধিকারিকের কাছেও অভিযোগ জানাবার সুযোগ থাকে। সুতরাং নির্বাচন কমিশনের এটি একটি ন্যায়সঙ্গত পক্ষপাতহীন প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে অবৈধ ভোটারের নাম বাদ দেওয়া হয়ে থাকে। সুতরাং শাসক তৃণমূলের অপপ্রচারে জনগণের বিভ্রান্ত বা আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। যদিও পরিচ্ছন্ন ভোটার তালিকা তৈরি করতে সমস্ত রাজনৈতিক দলেরই নির্বাচন কমিশনকে সর্বতোভাবে সাহায্য করা উচিত।
ইতিমধ্যে পশ্চিমবঙ্গে ভোটার তালিকার প্রস্তাবিত SIR (Special Intensive Revision) বা বিশেষ নিবিড় সংশোধনীর বিরুদ্ধে শাসক তৃণমূল আদাজল খেয়ে মাঠে নেমে পড়েছে। শাসকদল রাজ্যে যেকোনো মূল্যে SIR যাতে চালু না হয় তার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে চলেছে। বিভিন্ন রকম মিথ্যা ন্যারেটিভ ছড়িয়ে সর্বত্র পাহাড় প্রমাণ দুর্নীতি, আইন শৃঙ্খলার অবনতি, বেকার সমস্যা, খুন, নারী ধর্ষণ ও শিক্ষা, শিল্প, স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে ব্যর্থতা ঢাকতে এবং জনগণের দৃষ্টি ঘোরাতে SIR নিয়ে উদ্দেশ্য প্রণোদিত ভাবে বিষোদ্গার করে চলেছে। এই রাজ্যে এখনো পর্যন্ত এসআইআর চালু না হলেও তৃণমূল কংগ্রেসের প্রধান মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রশাসনিক সভায় ডিএমদের মাধ্যমে বুথ লেভেল অফিসারদের (বিএলও) ভোটার তালিকা থেকে কোনো নাম বাদ না দেওয়ার জন্য আগাম হুঁশিয়ারি দিচ্ছেন। মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচন কমিশনকে চ্যালেঞ্জ করছেন এবং কমিশনের কাজে সরাসরি হস্তক্ষেপ করার চেষ্টা করছেন।
এহেন শাসকদলের এসআইআর বিরোধিতার রহস্য উন্মোচন করতে কয়েকটি পরিসংখ্যানের দিকে নজর দেওয়া দরকার।
২০১১ সালের জনগণনায় (২০০১-২০১১) পশ্চিমবঙ্গের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ছিল ১৩.৮৪ শতাংশ, অথচ জাতীয় হার ছিল ৭.৫৪ শতাংশ। ২০২৫ সালে রাজ্যে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার আরও অনেক বেশি হবে বলে অনুমান করা হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জনসংখ্যা বৃদ্ধির জাতীয় হারের চেয়ে রাজ্যের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার বেশি হওয়ার মূল কারণ হলো, রাজ্যে অবৈধ বাংলাদেশি মুসলমান ও মায়ানমারের রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশকারীদের সংখ্যা বৃদ্ধি। সেজন্য এই রাজ্যে মুসলমান জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারও অনেক বেশি। বিশেষ করে মুর্শিদাবাদ, উত্তর ২৪ পরগনা, দক্ষিণ ২৪ পরগনা, নদীয়া, মালদহ-সহ কয়েকটি সীমান্তবর্তী জেলায় ব্যাপক হারে মুসলমান জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, উত্তর ২৪ পরগনার বসিরহাট ২০.৯৪ শতাংশ, হাসনাবাদে ১৭.৪৭ শতাংশ, মুর্শিদাবাদের রঘুনাথপুরে বৃদ্ধি ৩৭.৮২ শতাংশ, সামসেরগঞ্জে ৩৪.০৯ শতাংশ এবং সুতিতে ৩০.৮২ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। তদনুসারে রাজ্যে
অবৈধ ভোটারদের সংখ্যাও বৃদ্ধি পেয়েছে।
পশ্চিমবঙ্গে ২০০৬ সালে মোট ভোটার ছিল ৫ কোটি ৯ লক্ষ। ২০১১ সালে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরকারে আসার সময় পশ্চিমবঙ্গের মোট ভোটার ছিল ৫ কোটি ৬০ লক্ষ।
সুতরাং ২০০৬ থেকে ২০১১ সাল অবধি বিগত পাঁচ বছরে ভোটার বেড়েছে ৫১ লক্ষ। অর্থাৎ ওই সময় রাজ্যে বছরে গড়ে ১০ লক্ষের অধিক ভোটার বৃদ্ধি পেয়েছে। এই অনুসারে রাজ্যে ২০২৫ সালে পশ্চিমবঙ্গে মোট ভোটারের সংখ্যা হয়েছে ৭ কোটির মতো। কিন্তু কোন জাদুবলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজত্বে ২০২৫ সালে পশ্চিমবঙ্গে মোট ভোটারের সংখ্যা হয়েছে ৭ কোটি ৯৬ লক্ষ। সুতরাং রাজ্যের ভোটার তালিকায় কমপক্ষে ৯০ থেকে ৯৬ লক্ষের বেশি অবৈধ ভোটার থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। এখানে মুখ্য বিরোধী দলের দাবি, অবৈধ ভোটারের সংখ্যাটি এক কোটি ছাড়িয়ে গেলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই। বিগত
১৪ বছর ক্ষমতায় থাকার সুবাদে শাসক তৃণমূলের বদান্যতায় বাংলাদেশি মুসলমান অনুপ্রবেশকারী ও রোহিঙ্গারা সকলেই আধার, ভোটার ও রেশন
কার্ড বানিয়ে নিয়েছে। সেজন্য তৃণমূল এসআইআর করার জন্য ডকুমেন্ট হিসেবে আধার, ভোটার ও রেশন কার্ড রাখার জোরালো দাবি তুলেছে। কারণ তারা বিলক্ষণ জানে, এই সমস্ত ভুয়ো ও অবৈধ ভোটারদের নাম কমিশন নির্ধারিত ডকুমেন্টের অভাবে তালিকা থেকে বাদ গেলে আগামী বিধানসভা নির্বাচনে শাসকদলের ভরাডুবি অনিবার্য। তাই শাসক তৃণমূল শিবির গেল গেল রব তুলে সাংবিধানিক সংস্থা নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে বিষোদ্গার করে চলেছে।
একথা সত্য, একসময় এই অবৈধ ভোটাররা রাজ্যে বামফ্রন্টের ভোটব্যাংক ছিল। সেই সময় বিরোধী দলে থাকাকালীন এই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রাজ্যের ভোটার তালিকায় বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীদের নাম বাদ দেওয়ার দাবিতে লোকসভায় প্রতিবাদস্বরূপ তদানীন্তন ডেপুটি স্পিকারের টেবিলে কাগজ ছুঁড়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু আজ তিনিই এই সমস্ত অবৈধ বাংলাদেশি মুসলমান অনুপ্রবেশকারী ও রোহিঙ্গাদের নাম ভোটার তালিকা থেকে বাদ না দেওয়ার জন্য সবচেয়ে বেশি সোচ্চার হয়েছেন। কারণ এরাই তাঁর ভোটব্যাংক এবং নির্বাচনী সাফল্যের চাবিকাঠি। তাই পশ্চিমবঙ্গে ২০২৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নির্বাচন কমিশন দ্বারা ভোটার তালিকার বিশেষ নিবিড় সংশোধনীকে যেকোনো মূল্যে রুখে দেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করে চলেছে। সেজন্য এই রাজ্যে ভোটার তালিকা শুদ্ধীকরণের কাজ নির্বাচন কমিশনের সামনে বড়ো চ্যালেঞ্জ হিসেবে রয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ ও দেশের স্বার্থে পরিচ্ছন্ন ভোটার তালিকা নির্মাণের জন্য অবৈধ বাংলাদেশি মুসলমান অনুপ্রবেশকারী ও রোহিঙ্গাদের নাম ভোটার তালিকা থেকে বাদ দিতে অবিলম্বে বিশেষ নিবিড় সংশোধনী বা SIR দরকার।