নিবিড় সংশোধনে মমতা ব্যানার্জির এত আড়ষ্টতা, পাঁকে পড়ার দশা কেন?
মমতা ব্যানার্জি যে ন্যারেটিভ তৈরি করছেন তা শুধুমাত্র তার রাজনৈতিক চাল নয়। তা হিন্দু, জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে প্রকৃত বাঙ্গালি এবং বৃহত্তর আঙ্গিকে অতি অবশ্যই ভারতের সুরক্ষার সঙ্গে তঞ্চকতা।
ড. রাজলক্ষ্মী বসু
-মাসিমা মালপো খামু।
-ফুফা গোস্ত করছ আজ? প্রথমটা বাংলাভাষা (পূর্ববঙ্গীয় ডায়ালেক্ট বা উপভাষা)। দ্বিতীয়টা বাংলাদেশি ভাষা যা আরব সাম্রাজ্যবাদ-জারিত খাঁটি মোল্লাবাদের ফসল। একই ভাষার ভিন্ন কথনশৈলী ও শব্দচয়নে বাঙ্গালি আর বাংলাদেশি মোল্লাবাদীরা (কমিউনিস্টদের দাবি অনুযায়ী তারাও নাকি ‘বাঙ্গালি’) একে অপরের থেকে অনেক অনেক ক্রোশ দূরের। সেই দূরত্ব যতক্ষণ না নিবিড় নিবিষ্টতায় দেখা বা পর্যালোচনা করা হবে ততক্ষণ অনুপ্রবেশ এই গতিতেই চলবে।
‘পোয়েটিক জাস্টিস’ বলে ইংরেজিতে একটি ইডিয়মের প্রচলন রয়েছে। এই বান্ধারা বা শব্দবন্ধের অর্থ হলো ‘উপযুক্ত পুরস্কার’ বা ‘উপযুক্ত শাস্তি’। সেই পোয়েটিক জাস্টিস-টা এবার তো পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূলনেত্রী মমতা ব্যানার্জিকে অনুভব করতেই হবে। ভোটে তার ফলাফল কতদূর, কী হবে তা যদিও সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রসঙ্গ। এই বছরের মার্চ মাসেই পশ্চিমবঙ্গের ভোটার তালিকায় ভুতুড়ে ভোটারদের উপস্থিতির একাধিক উদাহরণ তুলে ধরে স্তূপীকৃত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটায় রাজ্যের শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেস। তৃণমূলনেত্রী দাবি করেন, ‘নির্বাচন কমিশন ঘুমোচ্ছে, আর সেই সুযোগে নীচের তলায় ভোটার তালিকা তৈরিতে অনিয়মের বন্যা বইছে। বারবার বলা হলেও কোনো উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে না।’ তার অভিযোগ ছিল যে, ভিন রাজ্যের এপিক
নম্বর এবং পশ্চিমবঙ্গের এপিক নম্বর ম্যাচ করছে। তার দল দাবি করে ভূতুড়ে ভোটারদের রাজ্যের ভোটার তালিকা থেকে বাদ দিক কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশন। মার্চ মাসেই তৃণমূল জানায় যে, ভোটার তালিকা তৈরি তাদের কাজ নয়। তৃণমূল কংগ্রেস সক্রিয় হওয়ার কারণে সেই যাত্রায়
৭,৮০০ ভূতুড়ে ভোটারের নাম রাজ্যের ভোটার তালিকা থেকে বাদ যায়, যদিও কাজটি করেছিল নির্বাচন কমিশন। অতএব মমতা ব্যানার্জিই মাস ছয় আগে প্রমাণ করলেন যে ভুতুড়ে ভোটার হয়। খুব ভালো অভিযোগ, তার মীমাংসাও হলো। তাহলে আজ যখন কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশন অসংখ্য অভিযোগ, পর্যবেক্ষণ ও তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে ভোটার তালিকা ঝাড়াপোঁছার জন্য বিহারে স্পেশাল ইন্টেন্সিভ রিভিশনের কাজ শুরু করল, তখন কেন প্রমাদ গুনল তৃণমূল কংগ্রেস? ভোটার তালিকা সংশোধনের কাজ শুরু হতেই বিহারে বাদ গেল লক্ষ লক্ষ মৃত, ভুয়ো ও অবৈধ ভোটার। এছাড়াও অনেকেই ছিলেন যারা দীর্ঘ সময় ধরে নির্দিষ্ট কেন্দ্রে ভোট দেন না অথচ ভোটার তালিকায় তাদের নাম থেকে গিয়েছে। ভোটার তালিকায় ‘বিশেষ নিবিড় সংশোধন’-এর কাজ বিহারে শুরু হতেই পাশের রাজ্য পশ্চিমবঙ্গে উদ্দাম রাজনৈতিক নৃত্য শুরু করল তৃণমূল। কারণ বিহারের মতো পশ্চিমবঙ্গেও বিধানসভা নির্বাচন
আসন্ন। বিহারের মতো এখানেও যদি ভোটার তালিকায় ঝাড়াইবাছাইয়ের কাজ শুরু হয় তাহলে তো কেঁচো খুঁড়তে কেউটে বেরোনোর সম্ভাবনা!
এ রাজ্যে অনুমেয় জালি ভোটারের সংখ্যা তো লক্ষ ছাড়িয়ে কোটিতে। আসলে তা কত লক্ষ বা কত কোটি সেই সম্পর্কে মমতা ব্যানার্জি নিজেই
নিশ্চিত নন। সেই সংখ্যাটা এত বড়ো যে, তা হলো তার ভোটব্যাংক নামক সম্পদ। ভোট মেশিনারিরও সম্পদ। পশ্চিমবঙ্গের এই অবৈধ
ভোটারদের অধিকাংশ হলো অনুপ্রবেশকারী বাংলাদেশি ও রোহিঙ্গা মুসলমান। সীমান্ত পেরিয়ে তারা পশ্চিমবঙ্গে ঢুকে রাজ্যের শাসক দলের
মদতে, অবৈধ উপায়ে ভোটার কার্ড, আধার কার্ড, রেশন কার্ড ইত্যাদি পরিচয়পত্রগুলি সংগ্রহ করে। তাদের আবার একটা বড়ো অংশ হলো
পরিযায়ী শ্রমিক। অর্থনীতির দুর্দশার কারণে এই রাজ্যে কাজের বড়ো অভাব। তাই পশ্চিমবঙ্গে আস্তানা গেড়ে, এখান থেকে পরিচয়পত্র বানিয়ে নিয়ে তারা ভারতের নানা রাজ্যে ছড়িয়ে পড়ে। তাই এই মূহূর্তে তৃণমূলনেত্রীর সবচেয়ে বড়ো অস্বস্তির বিষয় হলো এইসব ‘বাংলাভাষী’ পরিযায়ী শ্রমিক। এই অনুপ্রবেশকারীরাই এখন দেশজুড়ে যাবতীয় বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু। এরা বাংলায় মা বলুক বা আম্মি, তাদের অনেকেই ভিন রাজ্যে হাতুড়ি-করাত-পাইপ-সিমেন্টের কাজে ব্যস্ত। পেশাগত পরিচয়ের আড়ালে অনেকে বিভিন্ন জেহাদি সংগঠনের স্লিপার সেলের সদস্য এবং ভারতবিরোধী নানা কার্যকলাপে যুক্ত। এই প্রেক্ষিতে উঠে আসতে পারে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। পশ্চিমবঙ্গ থেকে বিভিন্ন রাজ্যে যাওয়া পরিযায়ী শ্রমিকের সংখ্যা কত? পরিযায়ী শ্রমিকদের ঘরে ফেরার
সেই ছবিটা ভয়ানক ঠেকেছিল কোভিড আবহে লকডাউনে। রাজ্যে যে কাজ নেই, এখানে অর্থনীতির যে বেহাল দশা তা প্রকাশ্যে চলে আসায় ঈশান কোণে কালো মেঘ দেখেছিল তৃণমূল। ২০২৩-এ কলকাতা হাইকোর্ট রাজ্যের কাছে হলফনামা চেয়ে জানতে চায় যে, তৃণমূল কংগ্রেস সরকার ক্ষমতায় আসার পর পরিযায়ী শ্রমিকের সংখ্যায় কত দাঁড়িয়েছে। ২০১১ সাল থেকেই বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে এই প্রশ্ন করা হচ্ছিল, কিন্তু ২০২৩-এও সে উত্তর দিতে পারেনি রাজ্য সরকার। এমনকী পৃথকভাবে পরিযায়ী শ্রমিকদের চিহ্নিত পর্যন্ত করেনি এই সরকার। লকডাউনকালে যখন দলে দলে পরিযায়ী শ্রমিক এ রাজ্যে ফিরছে, তখন গোটা রাজ্যের চোখ সত্যিই কপালে ওঠার উপক্রম হয়। এটাই হলো বুদ্ধিজীবী-সমাজ সংস্কারক-চিন্তাশীল-শিক্ষিত বাঙ্গালির পশ্চিমবঙ্গ! যাঁরা দেশকে বিচার-বুদ্ধি- শিক্ষা-সংস্কৃতির উদাত্ত আলো দিত, তাঁদের রাজ্য থেকে পরিযায়ী শ্রমিকরা আজ গোটা দেশে যাচ্ছে বা যেতে বাধ্য হচ্ছে। আরও পরিতাপের বিষয় হলো, তাদের অনেকের বাংলাভাষার কথনশৈলী, উচ্চারণের প্রকৃতি থেকে অনেকের মনে নানা সন্দেহ দানা বাঁধছে। প্রশ্ন উঠছে, কেমন বাংলাভাষী এরা? পশ্চিমবঙ্গ থেকে বানানো ভোটার কার্ড বা আধার কার্ড হাতে থাকলেই যে সে জন্মসূত্রে পশ্চিমবঙ্গের বাসিন্দা বা ভারতের নাগরিক, নাকি অনুপ্রবেশকারী বাংলাদেশি বা রোহিঙ্গা মুসলমান- এই জিজ্ঞাসা, সন্দেহ আপামর বাঙ্গালির জন্য নিশ্চিতভাবে অস্বস্তির। কিন্তু এই প্রশ্ন বা সন্দেহ না করলে আগামীদিনের ভারতের কপালে ‘স্বস্তি’ নাও লেখা থাকতে পারে। এইসব মুসলমান পরিযায়ী শ্রমিকদের ক্ষেত্রে মমতা ব্যানার্জি অন্ধ। ২০২২-২৩-এ
পশ্চিমবঙ্গে ১৭১টি কারখানা বন্ধ হয়। ২০২৩-২৪-এ বন্ধ হয় ১৬৯টি কারখানা। ২০২৪-এ বিধানসভায় দাঁড়িয়ে রাজ্যের শ্রমমন্ত্রী মলয় ঘটক একবার বলেন যে, এ রাজ্যের পরিযায়ী শ্রমিকের সংখ্যা ২১ লক্ষ ৫৯ হাজার ৭৩৭ জন। স্বাভাবিক বুদ্ধি বলে, এটা হয়তো নিবন্ধিত সংখ্যা। বাস্তবে এর অন্তত কয়েক গুণ পরিযায়ী শ্রমিক রয়েছে যারা রাজ্যের শ্রম দপ্তরে নিবন্ধিত না হওয়ার কারণে ‘পরিযায়ী’ তালিকাভুক্ত নয়। এই ক্ষেত্রে নিবন্ধীকরণ যদিও আবশ্যক নয়। এছাড়াও, এরকম নিবন্ধীকরণের নিয়ম যে রয়েছে তাই-ই জানে না অধিকাংশ পরিযায়ী শ্রমিক। আরও একটি ইচ্ছাকৃত ফাঁকিবাজির কারণেও অসংখ্য
‘বাংলাভাষী’ পরিযায়ীরা নিবন্ধিত নয়। এই সমস্ত বাংলাভাষীরা তো ভারতীয় ছদ্মবেশধারী, তথাকথিত বাঙ্গালি, পরিযায়ী শ্রমিক। কাঁটাতার না থাকায় পূর্বসীমান্তের একটা বড়ো অংশ অরক্ষিত। রাজ্যের শাসক দলের মদতে চলে অবাধ অনুপ্রবেশ। এই অনুপ্রবেশকারীদের অনেকের হাতেই রয়েছে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত সংলগ্ন ঠিকানার ভুয়ো ভোটার কার্ড। রাজ্যের শাসকদল এবং স্থানীয় প্রশাসনের ঢালাও মদতে তৈরি হয়েছে এইসব পরিচয়পত্র। এই বাংলাভাষী অনুপ্রবেশকারীরা আদতে ভারতবিরোধী। তৃণমূলের ভোেট মেশিনারি। ভোটের সময় তাদের এ রাজ্যে জামাই আদরে নিয়ে আসে তৃণমূল। এরাই ভুয়ো ভোটার, সমাজবিরোধী এবং বুথ লুটেরা।
বাংলাদেশি মুসলমানরা পিসিমাকে বলে খালা, মাসিমাকে ফুফা, বাবাকে আব্বা, নিমন্ত্রণের পরিবর্তে বলে দাওয়াত, ন্যায়বিচারকে বলে ইনসাফ, এছাড়াও এমন অসংখ্য আরবি শব্দ-জারিত ভাষায় তারা কথা বলে। কিন্তু কংগ্রেসি- কমিউনিস্টরা এগুলিকে একযোগে ‘বাংলাভাষা’ বলেই চালিয়ে দেয়।
অনুপ্রবেশকারীরাও ‘বাঙ্গালি’ পরিচয় দিয়ে পার পেতে চায়। সেই সব ফন্দিফিকির করেই তারা সীমান্ত পার হয়। সীমান্ত সংলগ্ন জেলাগুলিতে শাসক দল এবং শাসক দল ঘনিষ্ঠ মধ্যস্থতাকারী দালালচক্রকে তারা টাকা দেয়। তৈরি হয় তাদের ভুয়ো ভারতীয় পরিচয়পত্র। অনেকে পশ্চিমবঙ্গে আস্তানা গাড়লেও বাকিরা ছড়িয়ে পড়তে থাকে সারা দেশজুড়ে। পশ্চিমবঙ্গে যেখানে তারা ঘরবাড়ি, বস্তি তৈরি করে সেখানেও তাদের ঘিরে স্থানীয় লোকজনের পক্ষ থেকে অনেক প্রশ্ন উঠে আসাই স্বাভাবিক। কে? কবে এল? কী করে? পরিবারে ক’জন ইত্যাদি। অতএব শাসক দলের দাওয়াই হলো এখানে আস্তানা তৈরি করে তোমরা
ভিন রাজ্যে যাও। মোল্লাবাদের শ্রমিক তোমরা। যখন যখন ভারত বিদ্বেষের চক্রান্ত দরকার তখনই কোমর বেঁধে নেমে যাও। আর ভোেট এলে অতি
অবশ্যই ভোট লুঠেরার কাজ করে যেও পশ্চিমবঙ্গে এসে। এককথায় এরা হলো পরিযায়ী দুধেল গাই। শুনতে তিক্ত মনে হতে পারে। কিন্তু এটাই
পশ্চিমবঙ্গের দুধেল গাই পরিযায়ীদের আসল স্বরূপ। মলয় ঘটকের দেওয়া পরিসংখ্যানটাই যদি তর্কের খাতিরে ধ্রুব সত্য বলে ধরে নেওয়া হয় তাহলেও প্রশ্ন-
পশ্চিমবঙ্গ কি পরিযায়ী শ্রমিক সরবরাহের হাব? শিক্ষা হাব, সংস্কৃতি হাব থেকে এই রাজ্যের আজ এই দশা! পরিস্থিতি কতটা শোচনীয় হলে কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশন বলে যে, ভোটার কার্ড, আধার কার্ড চূড়ান্ত পরিচিতি নয়। এটা পশ্চিমবঙ্গবাসী বাঙ্গালির কাছে যেমন বিরক্তির, তেমনই লজ্জার। সম্প্রতি মিনাখাঁয় দেখা গেল জেরক্স বা ফোটোকপির দোকানের আড়ালে ভুয়ো ভোটার কার্ড তৈরির রমরমা ব্যবসা। জাল আধার কার্ড তৈরির চক্র ধরা পড়ল সন্দেশখালিতে। কাকদ্বীপে ধরা পড়ল একই চক্র। মেখলিগঞ্জেও একই ছবি। কুচলিবাড়ি, হলদিবাড়ি গ্রাম পঞ্চায়েতে দেখা গেল যুব তৃণমূল নেতাই এই চক্রে জড়িত।
কাকদ্বীপের রামকৃষ্ণ গ্রাম পঞ্চায়েত তো ভুয়ো ভারতীয় পরিচয়পত্র তৈরির বড়ো ফ্যাক্টরি। কলকাতা হাইকোর্টে দায়ের হওয়া একটি মামলার সূত্রে জানা গিয়েছে যে, গোসাবার পাঠানখালি পঞ্চায়েত থেকে ২০২১ থেকে ২০২৫-এর মধ্যে চার হাজারেরও বেশি ভুয়ো বার্থ সার্টিফিকেট বা জন্ম শংসাপত্র ইস্যু করা হয়েছে।
করে উত্তরাখণ্ড সরকার। সেখানে নির্দেশিকা জারি হয় যে, সব পরিচয়পত্র খতিয়ে দেখতে হবে। অবৈধ কার্ড এবং সন্দেহজনক কাউকে দেখলে সতর্কতা ও প্রশাসনিক পদক্ষেপ একান্ত দরকার। তার বিপ্রতীপে মমতা ব্যানার্জি দাবি করছেন যে, ‘বাঙ্গালি’ ভিনরাজ্যে আক্রান্ত। ভুয়ো পরিচয়পত্র-সহ অনুপ্রবেশকারীদের ধরা পড়ার ক্ষেত্রে রাজ্যের এই শাসক দলই তো দায়ী। দিনের পর দিন বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীদের এরা আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়েছে। দেশের মধ্যে অনুপ্রবেশকারী ঢোকানোর প্রশাসনিক সিংহদ্বার এরাই তৈরি করেছে। একজন অনুপ্রবেশকারী তো মায়ানমার বা বাংলাদেশ থেকে উড়ে উড়ে গুরগাঁও, মুম্বই বা তামিলনাড়ু যায় না। তাকে পশ্চিমবঙ্গ পার করতে হয়, সেখানে থাকতে হয় এবং সেখান থেকে ভুয়ো ভোটার কার্ড, আধার কার্ড, রেশন কার্ড সংগ্রহ করতে হয়। মমতা ব্যানার্জির দুর্নীতিগ্রস্ত প্রশাসন এবং দুধেল গাই-প্রিয় ভোেট মেশিনারির জন্য আজ ভিনরাজ্যে মুড়িমিছরি একাকার। এটাই
বাঙ্গালির লজ্জা! প্রবাসী বাঙ্গালির চেয়ে পরিযায়ী বাংলাভাষী আজ সংখ্যায় বেশি। বাঙ্গালির আত্মসম্মান আরও নানা কারণে গড়াগড়ি খাচ্ছে। বাংলাভাষী, খেটে খাওয়া, পরিযায়ী শ্রমিকদের কে যে সত্যিই পশ্চিমবঙ্গের ভূমিপুত্র, ভারতীয় নাগরিক আর কে যে বাংলাদেশি, রোহিঙ্গা তা বোঝাটাই অন্য রাজ্যের লোকজনের কাছে অপেক্ষাকৃত কঠিন। এই বিভ্রান্তির কারণে কয়েকটি রাজ্যে এমন দশা যে সেখানে ধরে আনতে বললে, পুলিশ অনেক সময়ই বেঁধে আনছে। বিন্দুমাত্র সন্দেহ হলেই চলছে বাংলাভাষী পরিযায়ীদের ধরপাকড়। এই ব্যাপারে বলা যায় যে, অনুপ্রবেশকারী চিহ্নিতকরণ ও বিতাড়নের ক্ষেত্রে গাছাড়া মনোভাব দেখানোর পরিবর্তে সাময়িক সন্দেহের বশে ধরা পড়া অনুপ্রবেশকারীদের চিহ্নিতকরণের উদ্দেশ্যে কড়া পদক্ষেপ গ্রহণ পশ্চিমবঙ্গের বাঙ্গালি সেজে থাকা বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীদের প্রশাসনিক জেরা বিশেষভাবে দরকার। ভারতীয় নাগরিকত্বের প্রমাণ তারা দেখাতে না পারলে তাদের গ্রেপ্তারি ও বহিষ্কার ভারতের নিরাপত্তার জন্য অতীব গুরুত্বপূর্ণ।
মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি এখন বলছেন, ফিরে আসুক সব পরিযায়ী শ্রমিক, আমরা কাজ দেব। প্রশ্ন হলো, তাহলে এরা ‘পরিযায়ী’ হলো কেন? ভিন রাজ্যে একদিন কাজে, অর্থাৎ রোজের হিসেবে পশ্চিমবঙ্গের চেয়ে অনেক বেশি পারিশ্রমিক মেলে। তাই কোভিড পরবর্তী পর্যায়ে লকডাউন আংশিক শিথিল হতেই দলে দলে মানুষ আবার ভিনরাজ্যেই চলে যায়। মমতা ব্যানার্জি কিন্তু তাদের আটকে রাখতে পারেননি সেদিন। নির্বাচন কমিশনের নিবিড় সংশোধনের জন্য আরও একটা কারণে মমতা ব্যানার্জির মনে শঙ্কা জাগছে। তা হলো ১৯৫০-এর ভারতীয় জনপ্রতিনিধিত্ব আইনের ১৯(বি) ধারায় উল্লেখ রয়েছে ‘অর্ডিনারি
রেসিডেন্ট’ শব্দবন্ধটির। ২০ নং ধারায় এর ব্যাখ্যাও রয়েছে। ধরা যাক একজন থাকতেন মালদায়। তিনি বিগত দশ বছর বা তারও বেশি সময় ধরে দিল্লিতেই থাকছেন। ওটাই এত বছর ধরে তার রুটিরুজির ঠিকানা। তখন সেই ‘অর্ডিনারি রেসিডেন্ট’-এর নিয়মানুযায়ী সংশ্লিষ্ট পরিবর্তিত ঠিকানাতেই ভোটার তালিকায় তার নিজের নাম অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। দ্রুত নগরায়ণ, জীবন-অভ্যাসের পরিবর্তন, কর্মসংস্থান ইত্যাদি কারণে ঠিকানা পরিবর্তন মানুষের জীবনে স্বাভাবিক নিয়মেই উপস্থিত। নিবিড় সংশোধনের ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গে স্থায়ীভাবে বসবাস না করা পরিযায়ীদের নাম ভোটার তালিকায় থাকা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারে। কমিশন বলতে পারে যে রাজ্যে এই লোকজন বর্তমানে রয়েছেন, সেখানেই তারা ভোটার তালিকাভুক্ত হোক, বা যাদের একাধিক স্থানে ভোটার তালিকায় নাম
রয়েছে, তাদের নাম বাদ যাক। তাহলে তো তৃণমূলের মহা মুশকিল! মমতা ব্যানার্জির ভোটদুর্গ ভেঙে চুরমার হয়ে যাবে। তখন কারা দেবে জাল ভোট? কারা করবে ভোটে কারচুপি? কারাই বা ভোটের সময় এসে গুন্ডামি করবে? এটাই নিবিড় সংশোধনের ক্ষেত্রে মমতা ব্যানার্জির আপত্তির মূল কারণ। এর ফলাফল হলো নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে তার সংঘাত।
তৃণমূলের আরও একটা দ্বিচারিতা লক্ষণীয়। বিএসএফ ২০২৪ সালে ২,৪২৫ জন বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীকে বাংলাদেশে পুশব্যাক করেছে। ২০২৫-এর মে মাস পর্যন্ত সীমান্তের ওপারে ঠেলেছে ৫৫৭ জন অনুপ্রবেশকারীকে। দক্ষিণ ২৪ পরগনাতেই ধাওয়া করে ২৭৪ জনকে তারা তাড়িয়েছে বলে সংবাদসূত্রে খবর। এই পরিসংখ্যান সামনে আসার পর মমতা ব্যানার্জির মন্তব্য শুনলে হাস্যকর মনে হবে। তিনি বলেছেন যে, বিএসএফ অনুপ্রবেশকারীদের ঢুকতে সাহায্য করে। তর্কের খাতিরে মমতা ব্যানার্জির কথা মেনে নিলে নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব তো আরও বেড়ে গেল। কে আসল, কে জাল; কে বাঙ্গালি আর কে
বাঙ্গালির মতো, কে পশ্চিমবঙ্গের ভূমিপুত্র আর কে অনুপ্রবেশকারী বাংলাদেশি তা চিহ্নিত করা যে দরকার- সেই ইঙ্গিত তো মমতা ব্যানার্জির কথাতেই পাওয়া গেল। তার কথা অনুযায়ী, বিএসএফ ভীষণ দুষ্টু, কিন্তু নির্বাচন কমিশন তো ভালো! তারা তো রাজ্যে অনুপ্রবেশকারী ঢোকায় না। বাস্তব হলো এই যে, ভিনরাজ্যের পুলিশ কিন্তু সেখানে বসবাসকারী প্রবাসী বাঙ্গালিদের ওপর একটা আঁচড়ও দিচ্ছে না। সেই রাজ্যগুলিতে বাঙ্গালি পাড়ায় হিন্দিভাষী মানুষ একজন বাঙ্গালিবাবুকে ডাকে ‘দাদা’ বলেই। প্রবাসী বাঙ্গালিদের অন্য মর্যাদা রয়েছে ভারত ও বিশ্বজুড়ে। প্রবাসী বাঙ্গালি আর পরিযায়ী বাংলাভাষীর মধ্যে অনেক তফাত। সেই গুণগত মানের তফাতটা হয়েছে বাঙ্গালি সেজে জনারণ্যে মিশে থাকা বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীদের জন্য। বাঙ্গালির দুর্ভাগ্য যে,
এই মোল্লাবাদীদের আর নদীয়ার বাসিন্দা, কাঠের কাজ করা তুলসীমালা পরা একজন পরিযায়ী শ্রমিককে ভাষাগত বিভ্রান্তির কারণে ভিনরাজ্যের পুলিশ অনেক ক্ষেত্রেই পৃথক করতে পারছে না। ভদ্রলোকের ভাষা বাংলা আজ মোল্লাবাদী, বাংলাদেশিদের জন্য চিহ্নিত হচ্ছে আতঙ্কের ভাষা হিসেবে। সব ব্যাপারে মমতা ব্যানার্জি রাজনৈতিক তর্ক জুড়ছেন। কিন্তু বাঙ্গালি জাতিসত্তার যে কী ভীষণ দুর্গতি উপস্থিত হচ্ছে সেই ব্যাপারে কিছু বলছেন না। বাংলাভাষী, পরিযায়ী শ্রমিকরা সন্দেহের শিকার- এটা বলার আগে বলতে হবে যে এই পরিযায়ীদের একটা বড়ো অংশ হলো বাংলাদেশি, মোল্লাবাদী এবং তারা আরবি-মিশ্রিত বাংলাটাই জানে। কাঁটাতার দেওয়ার জন্য বিএসএফ-কে জমি না দিয়ে মমতা ব্যানার্জি সীমান্তকে শতছিদ্র রাখবেন এবং সেই সুযোগ নিয়ে চোরাবালিতে ভোট
করাবেন। নির্বাচন কমিশন পদক্ষেপ নিলেই আওয়াজ তুলবেন- গেল গেল বাঙ্গালিয়ানা গেল! তার হয়তো বলা উচিত- গেল গেল আরবি-জারিত বাংলা বলা, বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীটা, আমার ভোটারটা ধরা পড়ে গেল! নির্বাচন কমিশন রোগ বুঝে চিকিৎসা করছে আর মমতা ব্যানার্জি ভোটব্যাংক হারানোর আতঙ্ক এবং ব্যালট জ্বরে কাতর। তাই রাজনৈতিক ব্যাকরণে সজাগ থেকেই তিনি তার অকৃত্রিম স্বৈরতান্ত্রিক ভঙ্গিমাতে হুকুম দিয়েছেন যেন বুথ লেভেল অফিসার বা বিএলও-রা কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশনের নির্দেশ পালন না করেন, কমিশনের কথামতো তাঁরা যেন না চলেন। বিএলও-দের উদ্দেশ্যে ঠাণ্ডা
হুমকি দিয়েছেন যে, নির্বাচন হয়ে যাবে, তারপরতো আপনারা আমার রাজ্যেই চাকরি করবেন। সত্যিই ভয়াবহ তার বাক্যরাজি বা মৌখিক নির্দেশ! নিজের রাজনৈতিক সুবিধার ক্ষেত্রে যা যা অনিয়ম হচ্ছে, তাতে যদি বিন্দুমাত্র নড়চড়ের হাওয়া বোঝেন, তখন যেভাবে রাজনীতির হাওয়া উত্তপ্ত করার দক্ষতা তিনি রাখেন, তা যেন সত্যিই এক দৃষ্টান্ত। যেখানে যত স্বেচ্ছাচার, সেখানে নিয়ম বা আইন-কানুনের প্রয়োগ ঘটলে তার কাছে সেটা ততটাই অগণতান্ত্রিক ঠেকে। বহুমাত্রিক দেশ ভারতে কোনো আইনি বা প্রশাসনিক প্রক্রিয়ার প্রয়োগ মানেই তাতে কিছু জটিলতা, টুকরো টুকরো সমস্যা সৃষ্টি হয়। সাধারণ মানুষেরও কখনও কখনও অসুবিধা হয়। দিনের শেষে তা যদি দেশরক্ষার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ বলে প্রমাণিত হয় তবে বুঝতে হবে মমতা ব্যানার্জির এইসব খেলো যুক্তি
পলিটিকাল নয়, ব্যালটিকাল। পাশ্চাত্যের দেশগুলিতে একটি কথা প্রচলিত রয়েছে। ‘জেরিম্যানডারিং ইজ আনফেয়ার অ্যান্ড আনডেমোক্রেটিক’। অর্থাৎ নির্বাচনে কারচুপির জন্য অবৈধভাবে নির্বাচনী কেন্দ্রের সীমানা পরিবর্তন হলো একটি চূড়ান্ত অগণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া। আমেরিকাতেও জেলা ভোট ম্যানিপুলেশনের উদাহরণ রয়েছে। মমতা ব্যানার্জির জেরিম্যানডারিং-এর অঞ্চল হলো পুরো পশ্চিমবঙ্গ। এই তৃণমূলি জেরিম্যানডারিং-এর চোটে পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে অনুপ্রবেশ
করছে বাংলাদেশ, রাজ্যের জনবিন্যাস সম্পূর্ণ পালটে দেওয়ার মাধ্যমে ছক চলছে বৃহত্তর ইসলামিক বাংলাদেশ গঠনের। মমতা ব্যানার্জি যে ন্যারেটিভ তৈরি করছেন তা শুধুমাত্র তার রাজনৈতিক চাল নয়। তা হিন্দু, জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে প্রকৃত বাঙ্গালি এবং বৃহত্তর আঙ্গিকে অতি অবশ্যই ভারতের সুরক্ষার সঙ্গে তঞ্চকতা।