কাদের মমতা ব্যানার্জি ‘বাঙ্গালি’ বলছেন? এরাই তো কালনেমি সেজে হিন্দুধর্মের অবমাননা করছে
সুদীপনারায়ণ ঘোষ
পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ১৬ জুলাই, ২০২৫ হাস্যকরভাবে মেঠো রাজনীতিবিদের মতো রাস্তায় নেমে মিছিল ও শেষে সভা করে অন্য
রাজ্যে অবৈধ বাংলাদেশি ও রোহিঙ্গা মুসলমান অনুপ্রবেশকারীদের সমর্থন জানান। তিনি স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে একটা ইস্যু বানিয়েছেন, ‘বাংলাভাষীদের হয়রানি
করা হচ্ছে বিজেপি শাসিত রাজ্যে’। এটা সর্বৈব মিথ্যা।
প্রথমত, বাংলা বললেই কেউ বাঙ্গালি হয় না। দ্বিতীয়ত, এটা তিনি নিজেই খুব ভালো মতো জানেন যে মুসলমান অনুপ্রবেশকারীরা পশ্চিমবঙ্গ হয়ে সমগ্র
ভারতে ছড়িয়ে পড়েছে। পশ্চিমবঙ্গ মুসলমান অনুপ্রবেশকারীদের স্বর্গরাজ্য এবং তাদের ভোটেই তাঁর এত বাড়বাড়ন্ত, এত ভোট প্রহসনের মাধ্যমে তাঁর ক্ষমতা দখল। রাজ্যে এত খারাপ অবস্থা মাৎস্যন্যায়ের সময় ছাড়া আর কখনো হয়নি। তর্ক করে লাভ নেই। তথ্য আছে মানুষের হাতে। পশ্চিমবঙ্গে অবৈধ অনুপ্রবেশের শুরু জ্যোতি বসুর নেতৃত্বে বামফ্রন্ট সরকারের। মমতা ব্যানার্জি নিজেই ১৯৯৮ সালে লোকসভায় অধ্যক্ষের উদ্দেশে কাগজ ছুঁড়ে মেরেছিলেন এর
বিরুদ্ধে। সকলে দূরদর্শনের পর্দায় লাইভ দেখেছে। তিনি ক্ষমতায় এসে সেই চরম দেশদ্রোহিতাকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গেছেন। এখন বিহারের বিশেষ নিবিড়
সংশোধন দেখে ভয় পাচ্ছেন।
এই অনুপ্রবেশকারীদের সারাদেশে ধরা হচ্ছে। মমতা অন্য রাজ্যে বাঙ্গালি হয়রানির অভিযোগে বাঙ্গালি সেন্টিমেন্টে সুড়সুড়ি দিয়ে সাধারণ বাঙ্গালিদের ভোটের জন্য ভিক্ষা চাইছেন। তারা বাংলাভাষী মুসলমান দেখলে সন্দেহ করবেনই যে এরা অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গা বা বাংলাদেশি। উত্তরাখণ্ডে ‘অপারেশন কালনেমি’ মানে হিন্দু সাধুর ছদ্মবেশে রোহিঙ্গা জালিয়াতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। ২০০ জনেরও বেশি আটক হয়েছে এই অভিযানে। বাংলাদেশের এক প্রতারকও গ্রেপ্তার হয়েছে। দেরাদুনে রাস্তার ধারে সাধু বেশধারী রোহিঙ্গা ভণ্ডবাবা, গলায় গেরুয়া মালা পরা, সে দাবি করছিল কারও দিকে চাল ছুঁড়ে তার আয়ু বলে দিতে পারে। সে এই করে টাকা কামাতো। এসএসপির সামনে কেরামতি দেখাচ্ছিল। তাঁর দিকে চালের দানা ছুঁড়ে ভণ্ড দাবি করে যদি সেটা তাঁর কপালে লাগে তিনি ১০০ বছর বাঁচবেন। এসএসপি জিজ্ঞাসা করেন সে কত টাকা এইভাবে কামিয়েছে। অবশেষে ‘বাবাকে’ গ্রেপ্তার করা হয়। এটা ‘অপারেশন কালনেমি’র একটা উদাহরণ। দেরাদুন পুলিশের অভিযান শুরু হওয়ার
কয়েক দিনে ১০০ জনের বেশি গ্রেপ্তার হয়েছে। এই অভিযান হিন্দু সাধু সেজে থাকা রোহিঙ্গা ভণ্ডদের চালাকি ফাঁস করার লক্ষ্যে পরিচালিত হয়। উত্তরাখণ্ড জুড়েই এই ঘটনা ঘটেছে।
১১ জুলাই উত্তরাখণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী এই অভিযান শুরু করেন পবিত্র শ্রাবণ মাসে। তখন লক্ষ লক্ষ হিন্দু কাঁওরিয়া রাজ্যে আসেন। প্রতারকরা বেশিরভাগই উত্তরাখণ্ডের বাইরের। এরা বিপুল সংখ্যক ভক্তের সঙ্গে মিশে দেবভূমিতে প্রবেশ করে হিন্দুধর্মের সুনাম নষ্ট করে সহজে অর্থ উপার্জন করে। এরা বিশেষ করে মহিলাদের ঠকায়। অভিযোগ পেয়ে রাজ্য প্রশাসন এই অভিসন্ধি ধরে ফেলে।
অভিযান শুরু করে মুখ্যমন্ত্রী ধামি বলেন, ‘এরা শুধু মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করছে না, সামাজিক সম্প্রীতি ও সনাতন ঐতিহ্যের ভাবমূর্তি নষ্ট করছে। যদি কোনো ব্যক্তিকে এই ধরনের কাজ করতে দেখা যায় তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া যাবে।’
এযাবৎ দেরাদুনে, উধম সিংহ নগর ও হরিদ্বার জেলার প্রতিটায় ১০০ জনেরও বেশি করে গ্রেপ্তার হয়েছে। দেরাদুনে গ্রেপ্তার হওয়াদের কমপক্ষে এক ডজন প্রতারক রোহিঙ্গা মুসলমান, একজন বাংলাদেশি মুসলমানও রয়েছে। ২৬ বছরের বাংলাদেশি রুকম রাকাম, শাহ আলম নামে ভারতে অবৈধভাবে বসবাস করছিল। এবং দেরাদুনের সাহসপুর এলাকা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। পুলিশ এখন তাকে দেশ থেকে বহিষ্কারের প্রস্তুতি নিচ্ছে।
আরেকজন কারি আব্দুল রেহমান, বিকাশ নগর এলাকায় কাজ করত এবং ভেলকি দেখিয়ে মানুষের কাছ থেকে টাকা আদায় করত। এসএসপি ব্যাখ্যা করে বলেন, ‘এই মুসলমানরা হিন্দু পরিচয় দিয়ে মানুষকে প্রতারণা করছিল। ‘তিনি আরও বলেন গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিদের ৯০ শতাংশেরও বেশি অন্যান্য রাজ্যের, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গ, উত্তরপ্রদেশ, হরিয়ানা ও রাজস্থানের। তাদের কর্মকাণ্ডে উত্তরাখণ্ডের সুনাম নষ্ট হচ্ছে।
অভিযান পরিচালনায় পুলিশ একাধিক দল গঠন করে প্রতারকদের শনাক্ত করার দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট স্টেশন হাউস অফিসারদের উপর অর্পণ করে।
একবার শনাক্ত হওয়ার পর পুলিশের দল সন্দেহজনক ব্যক্তিদের কাছে গিয়ে পরিচয় জিজ্ঞাসা করে, সরকারি নথিপত্র চায়। না পেলে থানায় নিয়ে প্রাসঙ্গিক ধারায় মামলা করা হয়। বেশিরভাগের বিরুদ্ধে ভারতীয় নাগরিক সুরক্ষা সংহিতার ১৭০ ধারায় অভিযোগ আনা হয়। আদালত সতর্ক করে জামিন দেয়। কিছুর বিরুদ্ধে কর্মকাণ্ডের গুরুত্ব অনুযায়ী আরও গুরুতর ধারায় অভিযোগ আনা হয়।
রাজ্যব্যাপী এই অভিযানের যুক্তি দিয়ে এসএসপি কালনেমি রাক্ষসের গল্প উল্লেখ করেন। সে ঋষির ছদ্মবেশে হনুমানকে বাধা দিয়েছিল লক্ষ্মণকে রক্ষা করার জন্য সঞ্জীবনী আনা থেকে। রাবণ কালনেমিকে হনুমানের জরুরি অভিযান দেরি করার দায়িত্ব দিয়েছিলেন। কালনেমি হনুমানের যাওয়ার পথে নকল আশ্রম বানিয়ে তাকে বিশ্রাম করতে দেয়।
হনুমান কালনেমিকে হত্যা করে অভিযান সম্পন্ন করেন। এসএসপি সিংহ এই সাধুর ছদ্মবেশে থাকা ভণ্ডদের সঙ্গে কালনেমির তুলনা করেন। তাদেরও
একইভাবে মোকাবিলা করতে হয়। অভিযানের শুরুতে উত্তরাখণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী এই অনুভূতির প্রতিধ্বনি করে বলেন, ‘যেভাবে কালনেমি রাক্ষস অন্যদের প্রতারণা করার জন্য সাধুর রূপ ধারণ করেছিল, তেমনই এখন অনেক ‘কালনেমি’ দেশে সক্রিয়, হিন্দু সন্ন্যাসীর বেশে অপরাধ করছে।’ তিনি জোর দিয়ে বলেন রাজ্য সরকার ধর্মের নামে প্রতারণা করা কাউকে ছাড় দেবে না। একই সঙ্গে সরকার সনাতন ধর্মের মর্যাদা উঁচুতে তুলে রাখবে।
বিপুল সংখ্যক তীর্থযাত্রী আগমনের প্রেক্ষিতে উত্তরাখণ্ড সরকার শ্রাবণ মাস থেকে অক্টোবরের শেষের দিকে চারধাম যাত্রা শেষ না হওয়া পর্যন্ত অপারেশন কালনেমি চালিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করছে।
চারধামের অন্যতম বদ্রীনাথে পুলিশ ৬০০ জনেরও বেশি সাধুর নথিপত্র পরীক্ষা করার পর পশ্চিমবঙ্গ থেকে দুই সন্দেহভাজন বাবাকে খুঁজে পেয়েছে, যা অবিরাম প্রচেষ্টার সাফল্য তুলে ধরে। কেউ ভাবতে পারেন কেন এই ধরনের উদ্যোগ মূলত সাধু-সন্ন্যাসীদের উপর নজর দেওয়া হচ্ছে? কারণ পির বাবা বা চার্চের ফাদারদের মধ্যেও প্রতারক আছে।
প্রথমত, এই উদ্যোগ উপাসনা পদ্ধতিভিত্তিক নয়। উত্তরাখণ্ডের স্থানীয় প্রেক্ষাপট এবং চলতি তীর্থযাত্রার মরসুম মাথায় রেখে ভণ্ড সাধুদের উপর দৃষ্টি দেওয়া হয়েছে। দ্বিতীয়ত, হিন্দুধর্ম প্রাতিষ্ঠানিক নয়। তাই আব্রাহামিক রিলিজিয়নের তুলনায় প্রতারিত হওয়ার ঝুঁকি বেশি। ফলে হিন্দুধর্মের অভ্যন্তরীণ শুদ্ধির জন্য সরকারি সহায়তা প্রয়োজন।
হিন্দু ধর্মীয় নেতারা সবসময় এই ধরনের উদ্যোগ সমর্থন করেছেন, কিন্তু অন্যান্য সম্প্রদায়ের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে একই ধরনের পদক্ষেপ নিতে গেলে প্রায়ই বাধার মুখে পড়ছে। সংখ্যালঘু অধিকার রক্ষার নামে এটা করা হয়। অপারেশন কালনেমি শুরুর পর মুখ্যমন্ত্রী ধামি বলেন, ‘আমি রাজ্যের প্রবীণ সাধুদের সঙ্গে দেখা করে অভিযানের সাফল্যের জন্য তাঁদের আশীর্বাদ নিয়েছি, তাঁদের সহযোগিতা চেয়েছি।’ মহামণ্ডলেশ্বর স্বামী যতীন্দ্রানন্দ গিরি মহারাজ মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে সরকারি বাসভবনে দেখা করে অভিযানের জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। এই উদ্যোগ সমর্থন করে অখিল ভারতীয় আখড়া পরিষদের সভাপতি মহন্ত রবীন্দ্র পুরী মহারাজ বলেন, ‘ভুয়া সাধুরা কাঁওরিয়াদের কাছ থেকে টাকা চায়, প্রতারণা করে এবং যারা টাকা দিতে অস্বীকার করে তাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে; এই লোকদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।’
এই ধরনের অভিযানের সময় পুলিশ কীভাবে ধর্মীয় সংবেদনশীলতার সম্মান নিশ্চিত করে তা জানতে চাইলে, এসএসপি সিংহ বলেন যে তারা এখনো পর্যন্ত এই ধরনের কোনো অভিযোগ পাননি, ‘যখনই আমরা কোনো সাধুদের পরিচয় জানতে চেয়েছি, তাঁরা আমাদের সঙ্গে সহযোগিতা করে প্রয়োজনীয় সমস্ত তথ্য দেখিয়েছেন। স্থানীয় বাসিন্দারাও আমাদের সমর্থন করেছেন, তারা বিশ্বাস করে এই প্রতারকরা হিন্দুধর্মকে কলঙ্কিত করে। তাদের গ্রেপ্তার করা হয় হিন্দুধর্মের স্বার্থে।’
যে ধর্মের কেন্দ্রীয় কর্তৃত্ব নেই, সেখানে পুলিশ কীভাবে প্রকৃত সাধু ও প্রতারকদের মধ্যে পার্থক্য করে, সে সম্পর্কে এসএসপি সিংহ ব্যাখ্যা করেন যে হিন্দুধর্মের কোনো কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠান না থাকলেও, এর বেশ কয়েকটি সম্প্রদায়, ঐতিহ্য ও আশ্রম রয়েছে, ‘আমরা সন্দেহভাজন ব্যক্তির বংশ জিজ্ঞাসা করি- সে কোনো নির্দিষ্ট সম্প্রদায়, ঐতিহ্য, আশ্রম বা মঠের কিনা। যখন তারা তাদের পশ্চাদপট ও ধর্মানুশীলনের নাম এবং ব্যাখ্যা করতে পারে, তখন আমরা তাদের যথার্থ বলে মনে করি। যদি তারা তা করতে ব্যর্থ হয়, তাহলে আমরা ব্যবস্থা নিই।’
অপারেশন কালনেমি সফল হচ্ছে। এটা এক সময়োপযোগী পদক্ষেপ। এর একাধিক উপযোগিতা আছে। এটা শুধু জনসাধারণকে প্রতারিত হওয়া থেকে বাঁচায় না, হিন্দুধর্মের যাথার্থ ও সম্মানজনক ভাবমূর্তিও তুলে ধরে। আশা করা হচ্ছে যে, অন্যান্য রাজ্যগুলিও নিয়ন্ত্রণের বাইরে যাওয়ার আগেই সকল প্রতারকদের বিরুদ্ধে একই রকম উদ্যোগ গ্রহণ করবে।