শিক্ষায় আধ্যাত্মিকতা ও মূল্যবোধ
ড. রামানুজ গোস্বামী
শিক্ষায় আধ্যাত্মিকতার প্রাসঙ্গিকতা সত্যই অনস্বীকার্য। আধ্যাত্মিকতাই মানুষকে প্রকৃত অর্থে শিক্ষিত করে তোলে। এমন মানুষেরাই পারেন সমাজের কল্যাণ করতে। কিন্তু আধ্যাত্মিকতা ও মূল্যবোধ বিহীন ব্যক্তি যদি উচ্চশিক্ষিত বা উচ্চপদাধিকারী কিংবা অতিশয় ধনীও হয়, তবুও সে এই সমাজ তথা পৃথিবীর পক্ষে বিপজ্জনক। ভারতের দুই সুপ্রাচীন মহাকাব্য রামায়ণ ও মহাভারতে এই সত্যই বর্ণিত হয়েছে। অধ্যাত্ম ও মূল্যবোধের শিক্ষা একজন সাধারণ মানুষকে করে তোলে অসাধারণ। পাশাপাশি এগুলির অভাবে মানুষকে নিশ্চিত রূপেই বিনাশের দিকেই এগিয়ে যেতে হয়। স্বর্ণলঙ্কার অধিপতি ও ত্রিভুবনবিজয়ী তথা অতুলনীয় বিদ্বান হওয়া সত্ত্বেও রাবণকে সমূলে বিনষ্ট হতে হয়েছিল। সেইরকমই অর্থ, ক্ষমতা, কৌলীন্য প্রভৃতি সর্বদিকে অতি উচ্চ স্থানে বিরাজ করলেও শেষ পর্যন্ত কিন্তু কৌরবকুলকে পরাজিতই হতে হয়েছিল। এই কারণে জীবনে চলার পথে আধ্যাত্মিক মূল্যবোধই মানুষকে সঠিক দিশা দেখাতে পারে। এর অভাবে অন্ধকারে পথ হারিয়ে বিভ্রান্ত হতে হয়। তাই আধ্যাত্মিক মূল্যবোধই হলো জীবনেব মহত্তম সম্পদ, যার প্রভাবে জীবন হয় সার্থক।
এখানে একটা কথা বলা দরকার। আধ্যাত্মিক মূল্যবোধ সাধারণ মানবিক গুণাবলী থেকে অনেক উঁচুতে অবস্থিত। প্রতিকূল পরিস্থিতিতে কিংবা কোনো
প্রলোভনে সাধারণ মানবিক মূল্যবোধ বিপর্যস্ত হলেও হতে পারে– কিন্তু আধ্যাত্মিকতা এমনই এক শক্তি যা অটল ও অবিচল। জীবনের কোনো পরিস্থিতিতেই
তার এতটুকুও বিচ্যুতি ঘটে না। তাই জীবনের সমস্ত ক্ষেত্রেই দরকার আধ্যাত্মিক মূল্যবোধেরই শিক্ষা।
শিক্ষাক্ষেত্রে বর্তমানে এক বিরাট নৈরাজ্য সৃষ্টি হয়েছে। ধ্বংসাত্মক রাজনীতির পাশাপাশি এক অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে অবহেলার কারণেই এই পরিণতি ঘটেছে।
শিক্ষাক্ষেত্রে মূল্যবোধের অনুপস্থিতির কারণেই আজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ঘটছে নানা অপরাধমূলক ঘটনা। শিক্ষাক্ষেত্র হয়ে চলেছে কলঙ্কিত। যে হিন্দুধর্মে, যে ভারতে ঈশ্বরকে মাতৃরূপে উপাসনা করা হয়, সেখানে নারী-নির্যাতন রীতিমতো আশ্চর্যের বিষয়। বহুক্ষেত্রে এমন ঘটনা ঘটে থাকে যে, পুত্র-কন্যাদের দুর্ব্যবহারের কারণে বৃদ্ধ বয়সে পিতা-মাতাকে নিজেদের শেষ সম্বলটুকু পর্যন্ত খুইয়ে চরম লাঞ্ছিত ও অত্যাচারিত হয়ে পথে আশ্রয় নিতে হয়। আসলে এই সবই হলো সামাজিক অবক্ষয়ের অনিবার্য পরিণতি। বর্তমানে যে প্রকার শিক্ষাব্যবস্থা প্রচলিত রয়েছে, তা আদর্শ মানুষ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে একেবারেই
উপযুক্ত নয়।
আজকের শিক্ষাব্যবস্থায় সর্বস্তরে শিক্ষার্থীরা তথা জ্ঞান-বিজ্ঞানের নানাবিধ শাখার সঙ্গে পরিচিত হলেও আধ্যাত্মিকতা ও মূল্যবোধের পাঠ প্রায় শেখে না বললেই
চলে। তাই নামি-দামি প্রতিষ্ঠান থেকে ম্যানেজমেন্টের ডিগ্রি লাভ করলেও জীবনে চলার পথে কীভাবে একজন ভালো ম্যানেজার হওয়া যায়, তার শিক্ষা শিক্ষার্থীরা পায়না। এই কারণেই প্রাচুর্য থাকলেও জীবন অশান্তিতে ভরে ওঠে, সম্পর্কের বিনাশ ঘটে, মনুষ্যত্বের ক্রমাবনতিতে অমৃতের সন্তান ক্রমশ পশুতে এবং তারপর ধীরে ধীরে দানবে পরিণত হয়। আজ সমাজে বেড়ে চলেছে অপরাধপ্রবণতা। জীবন তার স্বাভাবিক ছন্দ তথা ভারসাম্য হারিয়ে ফেলছে প্রতি ক্ষণে। প্রকৃতপক্ষে, একজন ব্যক্তি হলো পরিবারের একক। কয়েকজন ব্যক্তি নিয়ে গঠিত হয় পরিবার। পরিবারগুলিই গঠন করে থাকে শিক্ষাক্ষেত্রে বর্তমানে এক বিরাট সমাজব্যবস্থা। তাই ব্যক্তি যদি আধ্যাত্মিকতা তথা মূল্যবোধ সম্পর্ক না হয়, তবে সম্পূর্ণ সমাজ ব্যবস্থাই ভেঙে পড়বে।
পশ্চিমি সংস্কৃতির অন্ধ অনুকরণে উন্মত্ত হয়ে আজ ভারতীয়দের এক খুব বড়ো অংশই আজ ধর্মীয় চেতনা তথা নৈতিকতা বিসর্জন দিয়েছে। এর ফলে স্বাভাবিক ভাবেই সমাজে এমন বহু ঘটনা ঘটছে, যা একেবারেই কাম্য নয়। মানুষ বাহ্যিক সৌন্দর্য বজায় রাখতে ব্যবহার করে নানাবিধ প্রসাধন-সামগ্রী। কিন্তু
অন্তরের সৌন্দর্য যা মানুষকে প্রকৃত অর্থে মান ও হুঁশ সম্পন্ন করে তোলে তার প্রয়োজন অনস্বীকার্য। এই অন্তরে সৌন্দর্য বজায় রাখতে দরকার হয় মূল্যবোধের। মূল্যবোধ না থাকলে জীবনের মূল্য বোঝা যায় না। ফলে জীবন হয়ে পড়ে মূল্যহীন। আধ্যাত্মিকতার অর্থ কিন্তু শুধুমাত্র মন্দিরে যাওয়া দেব-দেবীর পূজার্চনা করাই নয়, বরং আধ্যাত্মিকতা এক অতি বিস্তৃত পরিসর বা ক্ষেত্র যা পশুত্ব থেকে মনুষ্যত্ব এবং মনুষ্যত্ব থেকে দেবত্বে উত্তরণ ঘটায়। মানুষ থেকে আদর্শ মানুষ হয়ে ওঠার যাত্রাপথেরই অপর নাম হলো আধ্যাত্মিকতা। তাই শিক্ষার্থীদের সবরকম ভাবে হিন্দুধর্ম ও ভারতীয় সনাতন মূল্যবোধ সম্পর্কিত শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করা দরকার।
এটা বোঝা দরকার যে, আধ্যাত্মিকতা ও মূল্যবোধবিহীন শিক্ষায় তৈরি হবে দুর্নীতিগ্রস্ত, স্বার্থপর, হিংস্র ও দানবিক মনোভাবাপন্ন একদল শিক্ষিত তথা রুচিবোধহীন ব্যক্তি যারা আসলে মূর্তিমান শয়তান ছাড়া আর কিছুই নয়। স্বামীজী বলেছিলেন যে, ‘Education is the manifestation of perfection al- ready in man.’ এই শিক্ষা হলো তা পূর্ণত্বের দিকে যাত্রা। জীবনের প্রতিটি পর্যায়ে ও প্রতিটি ক্ষেত্রে আদর্শ আচরণ কেমন হবে তারই পাঠ দেয় মূল্যবোধ। আজ ব্যক্তিস্বাধীনতার নামে উচ্ছৃঙ্খলতা সমাজকে গ্রাস করছে। ফল খুবই বিপজ্জনক। তাই, জীবনকে সুন্দর ও সার্থক করে তুলতে হলে আধ্যাত্মিকতা ভিত্তিক, ভারতীয় মূল্যবোধসম্পন্ন শিক্ষার প্রয়োজন।