পশ্চিমবঙ্গে বিশেষ নিবিড় সংশোধন: নিরাপত্তা, গণতন্ত্র ও মানবিক ভারসাম্যের চালেঞ্জ
উত্তম অধিকারী
ভারতের নির্বাচন ব্যবস্থার নির্ভুল ও গ্রহণযোগ্যতা বজায় রাখার জন্য কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশন (ইসিআই) মাঝে মাঝে ‘বিশেষ নিবিড় সংশোধন’ বা SIR (Special Intensive Revision) প্রক্রিয়া চালু করে। এই বছর জুন-জুলাইয়ে বিহারে এই প্রক্রিয়ার বাস্তবায়নের পর এবার পশ্চিমবঙ্গে তার প্রয়োগ ঘিরে শুরু হয়েছে রাজনৈতিক বিতর্ক, জনমত নিরাপত্তা-সংক্রান্ত নানা আলোড়ন। এই প্রবন্ধে আমরা বিশ্লেষণ করব- পশ্চিমবঙ্গে SIR কেন প্রয়োজন, বিহারের অভিজ্ঞতা কী ছিল, তৃণমূল কংগ্রেস কেন এর বিরোধিতা করছে এবং এর মধ্যে ধর্মীয় নিপীড়িতদের মানবিক অধিকার কীভাবে রক্ষিত হতে পারে।
বিহারের অভিজ্ঞতা: SIR-এর বাস্তব প্রভাব:
বিহারে গত ১ আগস্ট নির্বাচন কমিশন দ্বারা SIR যে খসড়া প্রকাশ করা হয়েছে সেখানে ৬৫ লক্ষ ভুয়ো ভোটারের নাম বাদ গেছে। SIR হওয়ার আগে বিহারের ভোটার ছিল ৭ কোটি ৮৯ লক্ষ, বর্তমানে তা হয়েছে ৭ কোটি ২৪ লক্ষ। এই নিয়ে সরকার বিরোধী দলগুলি উষ্মা প্রকাশ করলেও, নির্বাচন কমিশন কর্তৃক ভোটার তালিকায় স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার জন্য বিহারের ২৪৩টি বিধানসভার ৯০ হাজার ৭১২টি বুথের ভোটারদের বিস্তারিত বিবরণ প্রত্যেক রাজনৈতিক দলের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে এবং তাদের উপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে কোনো আপত্তি থাকলে আগামী ১ মাস অর্থাৎ ১ সেপ্টেম্বরের মধ্যে জমা দিতে। অর্থাৎ বিহারে SIR প্রক্রিয়া যথেষ্ট স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে সক্ষম হয়েছে। এই ব্যাপক পরিসরে ভোটার পরিচয় যাচাই বিহারে নির্বাচনের স্বচ্ছতা ও নিরাপত্তাকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যায়।
পশ্চিমবঙ্গের প্রেক্ষাপট: অনুপ্রবেশ, দ্বৈত ভোটার কার্ড এবং নিরাপত্তা সংকট:
পশ্চিমবঙ্গ দীর্ঘদিন ধরেই বাংলাদেশ সীমান্ত সংলগ্ন একটি সংবেদনশীল রাজ্য। এখানে ধারাবাহিকভাবে অনুপ্রবেশ ঘটে চলেছে এবং রাজনৈতিক সুবিধার জন্য একাংশ বাংলাদেশি মুসলমান ও রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশকারীদের অবৈধভাবে ভোটার তালিকায় যুক্ত করছে। সম্প্রতি একাধিক অনুপ্রবেশকারী ধরা পড়েছে যাদের কাছে ভারত ও বাংলাদেশ- উভয় দেশের ভোটার কার্ড রয়েছে। এটি স্পষ্টতই এক আন্তর্জাতিক জালিয়াত চক্র, যা দালাল, কিছু রাজনৈতিক কর্মী এবং দুর্নীতিগ্রস্ত আধিকারিকদের যোগসাজশে সক্রিয়। এর প্রভাবে শুধু নির্বাচন ব্যবস্থার পবিত্রতা ক্ষুণ্ণ হচ্ছে না, জাতীয় নিরাপত্তাও চরম বিপদের মুখে পড়েছে।
ধর্মীয় নিপীড়নের শিকার হিন্দু শরণার্থীদের মানবিক প্রশ্ন:
বাংলাদেশে বিশেষ করে সাম্প্রতিক হাসিনা সরকারের পতনের পর সংখ্যালঘু হিন্দুদের উপর হামলা, লুটপাট, ধর্মান্তর ও হত্যার ঘটনা বেড়ে গিয়েছে। এই কারণে বহু হিন্দু পরিবার পশ্চিমবঙ্গে আশ্রয় নিচ্ছে। তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হলে তা একদিকে মানবাধিকার লঙ্ঘন হবে, অন্যদিকে ভারতবর্ষের ঐতিহাসিক হিন্দু শরণার্থী সহানুভূতি নীতির বিরুদ্ধেও যাবে। তাই এসআইআর প্রক্রিয়ায় মানবিক সংবেদনশীলতাও বজায় রাখা জরুরি।
তৃণমূল কংগ্রেসের বিরোধিতা: রাজনীতি না জনগণের স্বার্থ?
তৃণমূল কংগ্রেস এসআইআর-এর ঘোরতর বিরোধিতা করছে, যার পেছনে কিছু সুস্পষ্ট রাজনৈতিক ও ভোটব্যাংক সংক্রান্ত কারণ রয়েছে
: ১. অনুপ্রবেশকারী ভোটারদের একটি বড়ো অংশ তৃণমূলের ভোটব্যাংক বলে অভিযোগ রয়েছে। তাদের তালিকা থেকে বাদ পড়লে রাজনৈতিক
ক্ষয় হতে পারে। ২. ‘ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের টার্গেট করা হচ্ছে’- এই অভিযোগ তুলে মুসলমান ভোটারদের মন জয় করার প্রচেষ্টা চলছে।
৩. তৃণমূল দাবি করছে, এটা এনআরসি-র মতো একটি প্রকল্প এবং পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির ভোটব্যাংক রাজনীতির অংশ। যদিও কমিশন বহুবার বলেছে- এসআইআর হলো সম্পূর্ণ আইনি ও নিরপেক্ষ ভোটার যাচাই প্রক্রিয়া, ধর্মীয় ভিত্তিতে নয়। তবে প্রশ্ন থেকে যায়- যদি প্রকৃত নাগরিক হন, তবে এসআইআর-এ ভয় কীসের?
এসআইআর: শুধুই ভোটার তালিকা সংশোধন নয়, নিরাপত্তা ও গণতন্ত্র রক্ষার অস্ত্র। বর্তমানে এসআইআর কেবল একটি ভোটার যাচাই প্রক্রিয়া নয়, বরং পশ্চিমবঙ্গে ভোটার তালিকার স্বচ্ছতা, অনুপ্রবেশ রোধ, সন্ত্রাসবাদ ও জালিয়াত চক্রের উৎস অনুসন্ধান, ভোট ব্যবস্থার গ্রহণযোগ্যতা বজায় রাখা। এর জন্য এটিই একমাত্র পথ। যদি এই প্রক্রিয়া কার্যকর হয়, তবে জাল ভোটার চক্র ভেঙে যাবে, ভোটব্যাংক ভিত্তিক রাজনীতি দুর্বল হবে এবং প্রকৃত ভোটারদের মর্যাদা ফিরবে।
সুপারিশ ও করণীয় :
হিন্দু শরণার্থীদের আইনি সুরক্ষা নিশ্চিত করে যাচাই করা হোক। প্রতিটি ব্লকে সমাজকর্মী ও নিরপেক্ষ প্রতিনিধি রাখার মাধ্যমে এসআইআর পরিচালিত হোক। যেকোনো ধর্মীয় বা রাজনৈতিক পক্ষপাত এড়িয়ে শুধুমাত্র বৈধ নাগরিকত্ব ভিত্তিক যাচাই নিশ্চিত হোক। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও নির্বাচন কমিশনের যৌথ সমন্বয়ে সংবেদনশীল অঞ্চলগুলোতে বিশেষ নজরদারি চালানো হোক। পশ্চিমবঙ্গে এসআইআর প্রক্রিয়ার সঠিক প্রয়োগ একদিকে যেমন দেশের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে, তেমনই ভোটার তালিকার ন্যায়সঙ্গত ও বৈধ রূপ গঠনে সহায়তা করবে। তবে এই প্রক্রিয়াকে শুধু রাজনৈতিক লড়াইয়ের হাতিয়ার বানিয়ে তৃণমূলের মতো কিছু দল যদি বিরোধিতা করে, তাহলে একদিকে জাতীয় নিরাপত্তা এবং অন্যদিকে গণতন্ত্র দুটোই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এই পরিস্থিতিতে নির্বাচন কমিশনের উচিত- সাংবিধানিক নিরপেক্ষতা বজায় রেখে, তথ্য ও প্রমাণের ভিত্তিতে সঠিকভাবে এসআইআর প্রয়োগ করা, যাতে পশ্চিমবঙ্গের মানুষ একটি নির্ভরযোগ্য ও নিরাপদ ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেন।
(লেখক: অধ্যাপক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও নির্বাচনী গবেষক)