দেশের ঐক্য ও অখণ্ডতার পক্ষে বিপজ্জনক
কথাটি উত্থাপন করিয়াছিলেন এবং সেই সঙ্গে দাবি জানাইয়াছিলেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই। তাঁহার অভিযোগের নিশানা ছিল ভারতীয় জনতা পার্টি। বিহার, ঝাড়খণ্ড, উত্তর প্রদেশ ও রাজস্থানের বহু নাগরিক বহু বৎসর যাবৎ এই রাজ্যে বসবাস করিতেছেন। তাঁহারা নাকি একাধিক স্থানে ভোটাধিকার প্রয়োগ করিয়া থাকেন এবং তাঁহারা নাকি ভারতীয় জনতা পার্টিকেই ভোটদান করিয়া থাকেন। তাহা মনে করিয়াই তিনি তাহাদিগের নাম ভোটার তালিকা হইতে বাতিল করিবার দাবি জানাইয়াছিলেন। নির্বাচন কমিশনে তিনিই প্রথম অভিযোগ করিয়াছেন যে একই নম্বরের ভোটার পরিচয়পত্রধারী একাধিক ভোটারের নাম তালিকায় রহিয়াছে। মুখ্যমন্ত্রীর অভিযোগ ভারতের নির্বাচন কমিশন সদর্থক অর্থেই গ্রহণ করিয়াছে। এই বৎসরেই বিহার বিধানসভা নির্বাচনের কথা মাথায় রাখিয়া বিহারেই নির্বাচন কমিশন প্রথম ভোটার তালিকার বিশেষ নিবিড় সংশোধনের কার্য শুরু করিয়াছে। তাহারা স্বীকার করিয়াছেন একই নম্বরের পরিচয়পত্রধারী একাধিক ভোটারের অস্তিত্ব রহিয়াছে। এই প্রক্রিয়ায় নির্বাচন কমিশন বিহার রাজ্যে ৬৫ লক্ষ ভোটারের নাম চিহ্নিত করিয়াছে। ইহার মধ্যে ২২ লক্ষ ভোটারের মৃত্যু হইয়াছে, ৩৫ লক্ষ ভোটার অন্যত্র স্থানান্তরিত হইয়াছে, ৭ লক্ষ ভোটারের নাম একাধিক ভোটকেন্দ্রে রহিয়াছে এবং ১ লক্ষ ভোটারের
কোনোরূপ অস্তিত্বই নাই। স্বাভাবিকভাবেই এই বিশাল সংখ্যক ভোটারের নাম নির্বাচন কমিশন ভোটার তালিকা হইতে বাদ দিয়াছে। আশ্চর্যের বিষয় হইল, নির্বাচনী ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা আনয়ন করিবার নির্বাচন কমিশনের এই প্রক্রিয়াকে রাজনৈতিক বিরোধীরা সহজভাবে গ্রহণ করিতে পারে নাই। ইহাকে তাহারা কেন্দ্রীয় সরকারের রাজনৈতিক অভিসন্ধি বলিয়া চিৎকার শুরু করিয়াছে।
নির্বাচন কমিশন ঘোষণা করিয়াছে, বিহারের পর ভোটার তালিকায় নিবিড় সংশোধনের প্রক্রিয়া শুরু হইবে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে। এই মর্মে ভারতের নির্বাচন কমিশন রাজ্য সরকারকে লিখিতভাবে অবগত করাইয়াছে। এই কার্য পরিচালনার জন্য দেড়হাজার বিএলও কর্মীর প্রশিক্ষণও সম্পন্ন করিয়াছে নির্বাচন কমিশন। ইহাতেই প্রমাদ গণিতেছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী। তাঁহার অভিযোগ যে ব্যুমেরাং হইয়া যাইবে তাহা তিনি কল্পনাও করিতে পারেন নাই। পশ্চিমবঙ্গে ভুয়া ভোটার যে আসলে অনুপ্রবেশকারীরা তাহা দিবালোকের ন্যায় পরিষ্কার। পশ্চিমবঙ্গে অনুপ্রবেশের অভিযোগ আজকের নহে, বামফ্রন্টের শাসনকালেই এই অভিযোগ উঠিয়াছে। বিগত শতাব্দীর সত্তর দশকের শেষভাগ হইতে বর্তমান শতকের প্রথমভাগের সংবাদপত্রগুলিতে নজর রাখিলেই ইহার প্রমাণ মিলিবে। অনুপ্রবেশকারীদের বামফ্রন্ট সরকারই প্রথম তাহাদের ভোটব্যাংকে পরিণত করিবার জন্য অবৈধভাবে ভোটার কার্ড, রেশন কার্ড প্রদান করিয়াছে। তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য অনুপ্রবেশকারীদের বিতাড়ন করিতে কেন্দ্রের নির্দেশ অমান্য করিয়াছেন। সেই সময় বিরোধী নেত্রীরূপে মমতা ব্যানার্জি ভোটার তালিকায় অনুপ্রবেশকারীদের নামের বিরুদ্ধে সোচ্চার হইয়াছিলেন। তিনি দাবি করিয়াছিলেন ভোটার তালিকা হইতে অনুপ্রবেশকারীদের নাম বাদ দিতে হইবে। ক্ষমতার কী বিষম লোভ যে তিনিই মুখ্যমন্ত্রী হইয়া সেই অনুপ্রবেশকারীদের পক্ষে দাঁড়াইয়াছেন। তাহাদের সর্বপ্রকার পরিচয়পত্র প্রদান করিয়া ‘বাঙ্গালি’ বলিয়া পরিচয় দিতেছেন। সমগ্র দেশে যে ভোটার তালিকা সংশোধনের কার্য চলিতেছে তাহাতে পরিযায়ী শ্রমিকদের যে বৃহদংশ অনুপ্রবেশকারী তাহাও সামনে আসিয়াছে। তাহাদের পরিচয়পত্রও পশ্চিমবঙ্গের শাসকদলের পক্ষ হইতে প্রদান করা হইয়াছে। পশ্চিমবঙ্গের ভোটার তালিকায় যে বিশাল সংখ্যক ভুয়া ও অনুপ্রবেশকারীদের নাম রহিয়াছে তাহাও ধীরে ধীরে সামনে আসিতেছে। এই অনৈতিক কাজের জন্য নির্বাচন কমিশন ইতিমধ্যেই রাজ্যের চারজন আধিকারিকের বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের করিয়া উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ করিয়াছে। এই নির্দেশ পালনে অসম্মত হইবার কারণে রাজ্যের মুখ্যসচিবকে তলব করিয়াছে নির্বাচন কমিশন। খুবই দুঃখের বিষয় যে, নির্বাচন কমিশনের ভোটার তালিকা সংশোধনের ন্যায় এক সাংবিধানিক কার্যে বাধা উৎপন্ন করিবার প্রবণতা যে দেশের ঐক্য ও অখণ্ডতার পক্ষে বিপজ্জনক তাহা পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর বোধগম্য হইতেছে না।