মা দুর্গার এবার সরকারি গাড়িতে আগমন
দরাজেষু দিদি,
আপনার তুলনা আপনিই। এই বছর পূজাকে আপনি একেবারে হট বানিয়ে দিলেন। ঠিকই ধরেছেন, ভাষার ঠিক থাকছে না। আনন্দে এটা হয়। আসলে এত এত টাকা ভাবা যায় না। আমি তো ভাবছি পঞ্জিকাকাররা যদি আগে জানতেন তবে লিখেই দিতেন, ‘মা দুর্গার আগমন সরকারি গাড়িতে। আর গমন টোটোয়।’ সেটাও দিদির পয়সায়।
এবার আপনি দিদি, পূজার ক্লাবগুলিকে এক লক্ষ দশ হাজার টাকা সরকারি সহায়তা দেওয়া হবে বলে নেতাজী ইনডোর স্টেডিয়ামে যখন ঘোষণা করছিলেন তখন আনন্দে আমার হৃদ্স্পন্দন প্রায় স্তব্ধ হয়ে যাচ্ছিল। খুব সামলে নিয়েছি।
আপনি বলেছিলেন, ‘খুশি তো?’ প্রশ্নটা মোক্ষম কিন্তু দিদি। হাতে-হাতে কিছুমিছু দিয়ে খুশি করার রাজনীতিই তো আপনি করে আসছেন দিদি। তার ফলে বাজেটের মূল স্রোতে, অর্থাৎ পরিকাঠামো ও পরিষেবার বিধিবদ্ধ খাতে, বরাদ্দ কমই রয়ে যাচ্ছে, কখনো তা কমতে কমতে তলানিতে যাচ্ছে। রাজনীতি তৈরি করছে রাজস্ব ব্যয়ের নতুন নতুন খাত- অনুদান, ভরতুকি, কর মাফ, জামা-জুতো, মেলা- খেলা।
এসবের কারণটিও স্পষ্ট। সভা করে অনুদান ঘোষণা করলে দাতার চেহারাটা বেশ স্পষ্ট দেখা যায়। খুশি খুশি মুখটা। যিনি দিচ্ছেন, তিনি তো না-ও দিতে পারতেন, কিন্তু দিলেন। তিনি দিতে চাইলেন বলেই দিলেন, তা নিয়ে কারও সন্দেহের অবকাশমাত্র থাকে না। এক দিকে না চাইতেই পাওয়ার আনন্দই আলাদা। কৃতজ্ঞতা প্লাস দাসত্বও এসে যায়। অন্য দিকে, পেয়েও হারানোর ভয়, এই দুই অনুভূতির জমিতে তৈরি হয় জনমোহিনী রাজনীতি। কন্যাশ্রী, খাদ্যসাথী, কৃষকবন্ধু, লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের মতো প্রকল্পগুলি আপনাকে ভোট এনেও দিয়েছে।
অনেকে প্রশ্ন তোলেন সরকারের কর্তব্য-সংস্কৃতি নিয়ে। বলেন, টাকার অভাবে প্রশাসনে বহু পদ শূন্য, সেচ বা রাস্তাঘাট তৈরির মতো জরুরি পরিকাঠামো নির্মাণ, মেরামতি স্থগিত। অগণিত সরকারি কর্মী তাঁদের নানা আইনি প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত। বকেয়া ডিএ দেওয়া যাচ্ছে না, কারণ সরকারের কোমর ভেঙে যাবে। অন্যদিকে কি পূজার রোশনাইয়ে পাঁচশো কোটি টাকা খরচ করা উচিত? এসব প্রশ্ন করে বেআক্কেলরা। আরে বাবা! মানুষ যখন খারাপ রয়েছে তখন তো তাঁকে ফুর্তিতে রাখতে হয়। এটাই কেউ বোঝে না।
অনেকে আদালতেও গিয়েছে এই সব প্রশ্ন নিয়ে। কিন্তু উত্তর মেলেনি, মিলবেও না। জনমোহিনী রাজনীতির মজাই আলাদা। একবার বাঘের পিঠে উঠে পড়লে নামার উপায় নেই। বরং যে কোনো বাহুল্যকে সরকারি আধিকারিক হাতসাফাইয়ের খেলায় দেখিয়ে দেবেন ‘একান্ত প্রয়োজন’ বলে। অতএব অকারণ রাগারাগি, প্রতিবাদে সময় নষ্ট না করে মেনে নেওয়াই ভালো।
দিদি, অনুদান যে ভালো কাজ করতে পারে তার অনেক উদাহরণ রয়েছে। ১৯৮২ সালে তামিলনাড়ুর একটি গ্রামে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী এমজিআর শুরু করেছিলেন মিড-ডে মিল। পরে সেটাই প্রসারিত হয় সারা রাজ্যে। এটি তাঁর দলকে যেমন বিপুল জনসমর্থন দিয়েছিল, তেমনই শিশুর পুষ্টি ও পড়াশোনাতেও উন্নতি ঘটিয়েছিল, তা প্রমাণিত। ২০০৬ সালে নীতীশ কুমার ‘মুখ্যমন্ত্রী বালিকা সাইকেল প্রকল্প’ শুরু করায় স্কুলের উপরের ক্লাসে ছাত্রী-সংখ্যা বেড়েছিল। এখন গোটা দেশে মিড ডে মিল চালু হয়েছে। এই রাজ্যে সেই টাকা চুরি হয় বটে কিন্তু উৎসবের টাকায় কোনো খামতি নেই।
আমি বলি কি দিদি, এবার মনে হয় এসব খরচ করে খুব কিছু হবে না। পশ্চিমবঙ্গের মানুষ কিন্তু মুখে হাসি, বুকে রাগ নিয়ে বসে রয়েছে। আপনি অবশ্য ভালোই চাইছেন। সবাই উৎসবে মেতে থাকবেন। ভুলে যাবেন দুঃখ-কষ্ট। ভোট দিয়ে দেবেন। তবে এবার আর সেটা হবে কি না তা নিয়ে কিন্তু আমার মনে অনেক উদ্বেগ রয়েছে। আপনারও নিশ্চয়ই আছে। ও আচ্ছা, বুঝেছি দিদি, ওই জন্যই আপনি মেঘ না চাইতেই জল দিয়ে দিলেন। গত বছর বলেছিলেন ভোটের বছরে পূজা পিছু এক লক্ষ টাকা দেবেন। কিন্তু ম্যাজিক দেখালেন। কেউ যখন ভাবতেই পারেনি, তখন আপনি কেমন সুন্দর বলে দিলেন, এক লক্ষ দশ হাজার। উফ্! ভাবা যায় না। কী একটা মুহূর্ত। গোটা পশ্চিমবঙ্গ কেঁপে গেল। রানি রানি। রানি মাঈ কী জয় বলে ধ্বনি উঠতে পারত।।