জাতগণনা সংরক্ষণ ব্যবস্থাকে মজবুত করে সামাজিক ন্যায়ের পথ প্রশস্ত করবে
ধর্মানন্দ দেব
ভারতীয় সমাজ এক বিস্তৃত ও বৈচিত্র্যময় পরিসর, যেখানে অসংখ্য জাতি, ধর্ম, ভাষা ও সংস্কৃতির সহাবস্থান ঘটেছে। ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে বিশেষত ব্রিটিশ শাসনকালে, এই বৈচিত্র্যকে একটু সুসংগঠিত সামাজিক কাঠামোর আওতায় এনে বিভাজনের রূপ দেওয়া হয়। এই বিভাজন কখনো ধীরে ধীরে, কখনো-বা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে শক্তিশালী হয়েছে। জাতপাতের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা সামাজিক শ্রেণীবিন্যাস, বৈষম্য এবং একে অপরের প্রতি অবজ্ঞার মানসিকতা ভারতের রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিকাঠামোকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে।
ভারতীয় সমাজে ‘জাত’ শুধুমাত্র একটি সাংস্কৃতিক বা আঞ্চলিক ধারণা নয়; বরং এটি রাজনীতি, শিক্ষা, কর্মসংস্থান ও সামাজিক সুযোগ-সুবিধার ক্ষেত্রেও একটি কেন্দ্রীয় ইস্যু। ব্রিটিশরা ১৮৭১-৭২ সালে প্রথমবারের মতো বর্ণভিত্তিক গণনার সূচনা করে ভারতীয় সমাজকে শ্রেণীবদ্ধভাবে বোঝার জন্য। ১৮৮১ সালের প্রথম পূর্ণাঙ্গ জনগণনাতে বর্ণের তথ্য অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এরপর একাধারে পাঁচ দশক ধরে, প্রতি দশ বছর অন্তর জনগণনাতে জাত-বর্ণভিত্তিক তথ্য সংগ্রহ করা হয়। সর্বশেষবার, ১৯৩১ সালের জনগণনায় সারা দেশে ৪,১৪৭টি জাত ও উপজাত গণনা করা হয়। যদিও ১৯৪১ সালের যুদ্ধকালীন জনগণনাতেও জাত ও বর্ণসংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছিল, তা আর কখনো প্রকাশ করা হয়নি। স্বাধীনতার পর ভারত সরকার সিদ্ধান্ত নেয়,
জাতপাতের ভিত্তিতে জনগণনা করা হবে না, শুধুমাত্র তফশিলি জাতি ও উপজাতির (এসসি/এসটি) তথ্য সংগ্রহ চালু থাকে।
ভারতের ঐতিহ্যগত জাতপাতের মূল ভিত্তি ছিল ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক উপাদানগুলো, যা পরবর্তীতে একটি সামাজিক ব্যবস্থা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ব্রাহ্মণ, কায়স্থ ও শূদ্র- এই জাতভিত্তিক শ্রেণীবিভাগ অভ্যন্তরে গভীরভাবে প্রোথিত ছিল। যদিও প্রাচীন ভারতীয় সমাজের সমাজের মধ্যে এই শ্রেণীবিভাগ অনেকটা ন্যায় ও শৃঙ্খলার ভিত্তিতে তৈরি হয়েছিল, তা ক্রমশ এক রকম বৈষম্য ও শোষণের চেহারা নেয়।
আজ প্রয়োজন এমন এক সুনির্দিষ্ট নীতিগত ও আইনি কাঠামোর, যা একদিকে ঐতিহাসিক বৈষম্য দূর করবে। অন্যদিকে জাতভিত্তিক বিভাজনকে স্থায়ী সামাজিক পরিকাঠামো হিসেবে প্রতিষ্ঠা না করে একটি ভারসাম্যপূর্ণ, অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজের পথ দেখাবে।
ভেদভাবের ভিত্তিতে সংরক্ষণ ব্যবস্থা এবং বৈষম্য তৈরি করা হয় যা শিক্ষার, চাকরির এবং অন্যান্য সুযোগ- সুবিধায় প্রভাব ফেলতে থাকে।
যখন জাতের প্রসঙ্গ ওঠে, তখন তা সাধারণত এই সমাজের ভেতরে একটি স্পর্শকাতর ও গোপনীয় বিষয় হিসেবে বিবেচিত হয়। সাধারণত রাস্তাঘাটে কেউ কাউকে প্রথমবার দেখা করলে আমরা প্রশ্ন করি, ‘আপনার নাম কী?’ বা ‘আপনি কোথাকার লোক?’ কিন্তু কখনোই প্রশ্ন করি না, ‘আপনি কোন জাতের?’ কারণ এই প্রশ্নের মাধ্যমে জাত নিয়ে এক ধরনের সামাজিক অস্থিরতার সৃষ্টি হতে পারে। ভারতের সামাজিক কাঠামো এতটাই জটিল যে, এই জাত নিয়ে সরাসরি প্রশ্ন করা সামাজিক অস্বস্তির সৃষ্টি করতে পারে, তবে যখন প্রশ্ন আসে সরকারি চাকরি বা শিক্ষায় সুযোগের, তখন জাতের পরিচয় একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হয়ে দাঁড়ায়। এটা আমাদের সমাজের পরিপূর্ণতার ছবি। একদিকে জাত নিয়ে অত্যন্ত সংবেদনশীল, অপরদিকে জাতভিত্তিক সুযোগসুবিধার বিষয়টিও আমাদের সমাজের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ভারতের সংবিধান প্রণয়নের সময় সংরক্ষণ ব্যবস্থা নিয়ে বিভিন্ন বিতর্ক ছিল। তবে দেশের বৃহত্তর জনগণের জন্য বিশেষভাবে এসসি, এসটি ও বাকি অনগ্রসর শ্রেণীর জন্য কিছু সুযোগ তৈরি করার উদ্দেশ্যে ১৯৫০ সালে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। এর মাধ্যমে পিছিয়ে পড়া শ্রেণীর মানুষদের শিক্ষার সুযোগ এবং সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে একটি সুরক্ষা ব্যবস্থা করা হয়। এর মাধ্যমে পিছিয়ে পড়া শ্রেণীর মানুষদের শিক্ষার সুযোগ এবং সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে একটি সুরক্ষা দেওয়া হয়েছিল। তবে, যখন এই সংরক্ষণ ব্যবস্থার প্রয়োগ ঘটে, তখন এটি শুধু সমাজের জন্য একটি সুযোগের সৃষ্টি করেছিল, বরং এটি দ্রুত রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়ে উঠেছিল। ১৯৫১ সালে স্বাধীন ভারত প্রথম লোকগণনার সময় সংগৃহীত তথ্যে হিন্দু ও মুসলমান ছাড়াও তফশিলি জাতি ও উপজাতিভুক্ত মানুষের সংখ্যাও অন্তর্ভুক্ত ছিল। তফশিলি জাতি ও উপজাতি ব্যতীত অন্যান্য গোষ্ঠীর সদস্যদের গণনা আলাদাভাবে করা হয়নি। তবে ১৯৬১ সালের আগেই তৎকালীন কেন্দ্রীয় সরকার রাজ্যগুলিকে জনগণনা সংক্রান্ত তাদের নিজস্ব সমীক্ষা পরিচালনা করার এবং ইচ্ছা করলে রাজ্যভিত্তিক অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণীর তালিকা সংকলনের অনুমতি দিয়েছিল।
এর মধ্যে বিহারের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী কপূরী ঠাকুরের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তিনি ১৯৭৮ সালে বিহার রাজ্যে প্রথম ২৬ শতাংশ সংরক্ষণ ব্যবস্থা চালু করেছিলেন। এটি ছিল একটি ঐতিহাসিক পদক্ষেপ, যা জাতভিত্তিক সংরক্ষণের নতুন যুগের সূচনা করে। কপূরী ঠাকুরের এই পদক্ষেপ, যদিও সামাজিক ন্যায়ের উদ্দেশ্যে ছিল, তা রাজনীতির মঞ্চে একটি নতুন বাঁক নেয়। সরকারি চাকরি ও শিক্ষায় পিছিয়ে পড়া শ্রেণীর জন্য সংরক্ষণ ব্যবস্থা চালু করা এই সময়ে একটি অত্যন্ত শক্তিশালী রাজনৈতিক পদক্ষেপ হয়ে ওঠে, যা না শুধুমাত্র সমাজের উন্নতির দিকে নিয়ে যায়, বরং দেশের রাজনৈতিক বাস্তবতাও পরিবর্তন করে। এই পদক্ষেপের পর কপূরী ঠাকুরের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক আক্রমণ শুরু হয়। বিশেষত, বিহারে জনসঙ্ঘের (বর্তমান বিজেপি) নেতৃত্বাধীন জোট সরকার কপূরী ঠাকুরের সংরক্ষণ ব্যবস্থা বাস্তবায়নের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। জনসঙ্ঘের প্রতিরোধের ফলে বিহারের জোট সরকার ভেঙে যায়, তবে কপুরী ঠাকুর তাঁর অবস্থানে অটল থাকেন এবং এই সংরক্ষণ ব্যবস্থা কার্যকর করতে নিজের লড়াই চালিয়ে যান। তাঁর এই সাহসী পদক্ষেপ দেশব্যাপী এক নতুন রাজনীতি সৃষ্টি করে, যা বিশেষত মণ্ডল কমিশনের সুপারিশের পরবর্তীতে ভারতজুড়ে আলোচনায় আসে।
১৯৯০ সালে মণ্ডল কমিশনের সুপারিশ অনুসারে ভারতের জাতভিত্তিক সংরক্ষণ ব্যবস্থার ক্ষেত্রে একটি বড়ো পরিবর্তন ঘটে। মণ্ডল কমিশন সরকারের উদ্দেশ্য রাখে যে, পিছিয়ে পড়া জনগণের উন্নয়নের জন্য কর্মসংস্থান ও শিক্ষা ক্ষেত্রে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এটি ছিল একটি মূল ভিত্তি, যার ভিত্তিতে ভারতীয় রাজনীতিতে জাতভিত্তিক সংরক্ষণ ব্যবস্থার কার্যক্রম শুরু হয়।
এই পরিবর্তনের মাধ্যমে, একটি নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতা উদ্ভাবিত হয়। তখন ভারতীয় সমাজে এমন এক যুগের সূচনা হয়, যেখানে জাতভিত্তিক রাজনীতি প্রধান হয়ে ওঠে। ১৯৯০ সালে, প্রধানমন্ত্রী ভিপি সিংহের নেতৃত্বে মণ্ডল কমিশনের সুপারিশ কার্যকর করার পর, ভারতজুড়ে জাতভিত্তিক সংরক্ষণ ব্যবস্থার বিরোধিতা শুরু হয়। বিজেপি এই ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়, বিশেষ করে লালকৃষ্ণ আদবাণী ছিলেন প্রতিবাদকারীদের মধ্যে অন্যতম। তার নেতৃত্বে এই বিরোধিতা চূড়ান্ত রূপ নেয় এবং সারা দেশে তিনি রথযাত্রা শুরু করেন। সেই সময়েই আজকের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এই আন্দোলনের অংশ হিসেবে রথযাত্রায় যোগ দিয়েছিলে।
বর্তমানে ভারতের সরকারি চাকরি ও শিক্ষাক্ষেত্রে জাতভিত্তিক সংরক্ষণের প্রভাব অত্যন্ত ব্যাপক। ২০২১ সালের তথ্য অনুসারে, ভারতের মোট জনগণের মধ্যে ১৫.৪ শতাংশ এসসি, ৭.৪ শতাংশ এসটি এবং ২৭ শতাংশ হওয়া উচিত ওবিসি। এই শ্রেণীর জন্য নির্দিষ্ট সংখ্যক পদ সংরক্ষিত থাকে, যা সরকারি চাকরি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং অন্যান্য সুবিধায় তাদের অংশগ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি করে। তবে এর সঙ্গে রয়েছে একটি বড়ো বিতর্ক- সংরক্ষণের ব্যবস্থাকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হচ্ছে এবং এতে একদিকে সুবিধা সৃষ্টি হলেও, অন্যদিকে সমাজে বিভাজন ও বঞ্চনা আরও তীব্র হয়ে উঠেছে।
সুতরাং, জাতভিত্তিক সংরক্ষণ ব্যবস্থাকে একদিকে দেখা যায় সামাজিক ন্যায়ের একটি প্রয়োজনীয় হাতিয়ার হিসেবে, যা পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করে। অপরদিকে, এর রাজনৈতিক ব্যবহার ও অপব্যবহার অনেক সময় সমাজে নতুন ধরনের বৈষম্য ও বিভাজনের বীজ বপন করে। যে সংবেদনশীল প্রশ্ন আমরা দৈনন্দিন জীবনে জিজ্ঞাসা করতে সাহস পাই না- ‘আপনি কোন জাতের?’ সেই প্রশ্ন শিক্ষাঙ্গন ও সরকারি চাকরিতে প্রবেশের মূল চাবিকাঠি হয়ে ওঠে। তাই আজ প্রয়োজন এমন এক সুনির্দিষ্ট নীতিগত ও আইনি কাঠামোর, যা একদিকে ঐতিহাসিক বৈষম্য দূর করবে। অন্যদিকে জাতভিত্তিক বিভাজনকে স্থায়ী সামাজিক পরিকাঠামো হিসেবে প্রতিষ্ঠা না করে একটি ভারসাম্যপূর্ণ, অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজের পথ দেখাবে।

















