ভাই-বোনের চিরন্তন সম্পর্কের প্রতীক ভাইফোঁটা
কানু রঞ্জন দেবনাথ
ভাইফোঁটা বা ভ্রাতৃদ্বিতীয়া একটি সর্বভারতীয় উৎসব। এটি কার্তিক মাসের শুক্লাদ্বিতীয়া তিথিতে কালীপুজার দু’দিন পরে অনুষ্ঠিত হয়। মহারাষ্ট্র, গোয়া ও কর্ণাটকে ভাইফোঁটাকে ভাইদুজ বা ভাউবিজ বলা হয়। নেপালে ও পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিং অঞ্চলে ভাইফোঁটা ভাইটিকা নামে পরিচিত। সেখানে বিজয়া দশমীর পর ভাইটিকা সবচেয়ে বড়ো উৎসব। এছাড়া এটি যমদ্বিতীয়া নামেও পরিচিত। উত্তর ভারতে এটি ভাইদুজ নামে পরিচিত। ওড়িশায় এটি ভাইজিন্তিয়া নামে পরিচিত। অন্ধ্রপ্রদেশ ও তেলেঙ্গানায় এটি ভাগিনী হস্ত ভোজনামু নামে পরিচিত।
ভাইফোঁটা বা ভ্রাতৃদ্বিতীয়া উপলক্ষ্যে স্থানভেদে নীচের যে কোনো একটি মন্ত্র পড়ে বোনেরা তাদের ভাইদের কপালে চন্দনের ফোঁটা পরিয়ে দিয়ে ছড়া কেটে তাদের ভাইদের দীর্ঘজীবন কামনা করেন। তারপর ভাইদের মিষ্টি খাওয়ায়। ভাইয়েরাও বোনদের বিভিন্ন উপহার দেয়।
১
‘ভাইয়ের কপালে দিলাম ফোঁটা, যমের দুয়ারে পড়ল কাঁটা। যমুনা দেয় যমকে ফোঁটা, আমি দিই আমার ভাইকে ফোঁটা।। যমুনার হাতে ফোঁটা নিয়ে যম হলো অমর, আমার হাতে ফোঁটা নিয়ে আমার ভাই হোক অমর’।
২
‘ভাইয়ের কপালে দিলাম ফোঁটা, যমের দুয়ারে পড়ল কাঁটা। যমুনা দেয় যমকে ফোঁটা, আমি দিই আমার ভাইকে ফোঁটা।। যম যেমন হন চিরজীবী, আমার ভাইও যেন হয় তেমন চিরজীবী’।।
৩
‘ভাইয়ের কপালে দিলাম ফোঁটা, যমের দুয়ারে পড়ল কাঁটা। কাঁটা যেন নড়ে না, ভাই যেন মরে না’।
8
‘ভাইয়ের কপালে দিলাম ফোঁটা, যমের দুয়ারে পড়ল কাঁটা। যম-যমুনা ভাই-বোন, যমুনা দেয় যমকে ফোঁটা, আমি দিই আমার ভাইকে ফোঁটা।।
আজ অবধি ভাইরে
যমের চিন্তা নাই রে,
যম দুয়ারে দিয়ে রাখলাম কাঁটা।।’
যম ও যমুনার গল্প: কিংবদন্তী অনুসারে সূর্য ও তাঁর পত্নী সংজ্ঞার দুটি সন্তান ছিল। একজন ছিল পুত্র যম, আরেকজন কন্যা যমুনা। পুত্র ও কন্যার
জন্মদানের পর সূর্যের উত্তাপ সংজ্ঞা সহ্য করতে না পেরে নিজের প্রতিমূর্তি ছায়ার কাছে যম ও যমুনাকে রেখে চলে যায়। সংজ্ঞার প্রতিরূপ ছায়া হওয়ায় কেউ ছায়াকে চিনতে পারেনি। কিন্তু ছায়ার কাছে ওই দুই সন্তান কখনো মাতৃস্নেহ ও ভালোবাসা পায়নি। দিনের পর দিন ছায়া যম ও যমুনার উপর অত্যাচার করতে থাকে। অন্যদিকে সংজ্ঞার প্রতিমূর্তি ছায়াকে চিনতে না পেরে বা বুঝতে না পেরে সূর্যদেবও কোনো দিন কোনো কিছু বলেননি। যম ছায়ার অত্যাচারে ব্যথিত হয়ে মনের কষ্টে নিজের যমপুরী প্রতিষ্ঠা করে এবং বোন যমুনাকে নিয়ে থাকেন। যমপুরীতে যম পাপীদের যেভাবে কঠোর শাস্তি দিতে থাকে তা দেখে যমুনা যমপুরী ছেড়ে অন্যত্র থাকতে শুরু করেন। এক সময় যমুনার বিয়েও হয়। বিয়ের পরে ভাই, বোন নিজের সংসার নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। যদিও যম ও যমুনা দুইজনে আলাদাভাবে থাকতে শুরু করছিলেন তথাপি ভাই-বোনের মধ্যে সম্পর্ক খুব মধুর স্নেহের ছিল।
এভাবেই সময় কাটছিল। এমনিতে তো যম যমুনাকে খুবই স্নেহ করতেন ও ভালোবাসতেন, কিন্তু সময়ের অভাবে বোনের সঙ্গে দেখা করতে পারছিলেন না। একদিন কার্তিক মাসের শুক্লপক্ষ দ্বিতীয়ার দিনে যমুনা তাঁর ভাই যমকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন নিজের বাড়িতে আসার জন্য। যমও বোনের নিমন্ত্রণ স্বীকার করে নিয়েছিলেন এবং প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে তিনি বোন যমুনার বাড়িতে যাবেন। এতদিন যম মনে করতেন যেহেতু তিনি সকলের প্রাণ কেড়ে নিয়ে যান, তাই কোনো কেউই তাঁকে ভালোবেসে তাদের ঘরে ডাকেন না। কিন্তু বোন যমুনা যেহেতু যমরাজকে সদিচ্ছা নিয়ে নিমন্ত্রণ করেছেন; তাই তাকে ভালোবেসে সেটা পালন করা কর্তব্য। এই উপলক্ষ্যে যম বোনের বাড়ি যাবার আগে নরকে বসবাসকারী জীবদের মুক্তি দেন।
যমুনা তাঁর ভাই যমরাজকে নিজের বাড়িতে আসতে দেখে যারপরনাই খুশি হলেন। স্নান করার পর যমুনা যমের কপালে ফোঁটা দিয়ে বা তিলক পরিয়ে সুস্বাদু খাবার পরিবেশন করেন। যমুনার এই আতিথেয়তায় যম অত্যন্ত খুশি হলেন এবং বোনকে বর চেয়ে নিতে বলেন। তখন যমুনা বললেন, ‘দাদা! আপনি প্রতি বছর এই দিনে আমার বাড়িতে যেন আসেন এবং আমার মতো, যে বোন তার ভাইকে এই দিনে শ্রদ্ধার সঙ্গে ভাইফোঁটা দিয়ে এই দিনটিকে উদ্যাপন করবে তার ভাইদের আপনি অকালমৃত্যু থেকে রক্ষা করবেন।’ যম বললেন, তাই হবে। মানে যমরাজ নিজেও অমরত্ব লাভ করলেন এবং তার বোনকেও অমরত্বের বর দিলেন, উপরন্তু যেসব বোনেরা এই দিনে তাদের ভাইদের ভাইফোঁটা দিবে সেই বোনেদের ভাইয়েরা অকাল মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করার বর দিয়ে গেলেন। সেই থেকে এই উৎসব পালনের রীতি চলে আসছে।
আরও এক পৌরাণিক কাহিনিতে বলা হয়েছে, একসময় বলির হাতে পাতালে বন্দি ছিলেন শ্রীবিষ্ণু। সেই কারণে চরম বিপদে পড়লেন স্বর্গের সব দেবতা। কোনো ভাবেই যখন বিষ্ণুকে উদ্ধার করা যাচ্ছিল না, ঠিক সেই সময় মা লক্ষ্মীর উপর সবাই ভরসা করতে লাগলেন। নারায়ণ (বিষ্ণু)-কে উদ্ধার করার জন্য লক্ষ্মী বালিকে ভাই পাতিয়ে ফেলেন। তাঁকে ফোঁটাও দেন লক্ষ্মী। সেই দিনটি ছিল কার্তিকমাসের শুক্লা দ্বিতীয়া তিথি। লক্ষ্মীর হাতে ফোঁটা পেয়ে বলি লক্ষ্মীকে উপহার দিতে চাইলে লক্ষ্মী তখন বিষ্ণুর মুক্তির উপহার চেয়ে বিষ্ণুকে বালির কাছ থেকে মুক্ত করে নিয়ে যান। ভাইফোঁটা নিয়ে কৃষ্ণ ও সুভদ্রার একটি কাহিনিও শোনা যায়। অতি শক্তিশালী ও অত্যাচারী নরকাসুর পৃথিবীর সকল রাজ্য জয় করার পর স্বর্গ আক্রমণ করে। এই নরকাসুরের ভয়ে ইন্দ্র পালাতে বাধ্য হন। ইন্দ্র-সহ সকল দেবতা তখন শ্রীবিষ্ণুর কাছে গিয়ে নরকাসুরের বিনাশের জন্য কাকুতি-মিনতি করেন। বিষ্ণু তাঁদের কৃষ্ণ অবতারে সেই কাজ সমাপন করবেন বলে কথা দেন। বিষ্ণুর ভূ-দেবীকে (ভূমি দেবী) দেওয়া বর অনুসারে নরকাসুর দীর্ঘ জীবন লাভ করেছিলেন। পরবর্তীসময়ে শ্রীকৃষ্ণ দ্বারকার রাজা থাকাকালীন অতি দুর্ধর্ষ নরকাসুরকে বধ করেন এবং নরকাসুরের কাছে বন্দি থাকা ১৬ হাজার রমণীকে মুক্ত করে দ্বারকায় ফিরে এলে বোন
সুভদ্রার আর আনন্দের সীমা থাকে না। কৃষ্ণের আদরের বোন সুভদ্রা। সুভদ্রাও কৃষ্ণকে খুব শ্রদ্ধা করতেন, ভালোবাসতেন। কৃষ্ণকে অনেকদিন পরে দেখতে পেয়ে বোন সুভদ্রা তখন কৃষ্ণের কপালে বিজয় তিলক পরিয়ে দেন। আরও একটি কাহিনিতে বলা হয়েছে চতুর্দশ শতাব্দীর পুঁথি অনুসারে জৈন মতের অন্যতম প্রচারক বর্ধমান মহাবীরের মহাপ্রয়াণের পর তাঁর অন্যতম সঙ্গী রাজা নন্দীবর্ধন মানসিক ও শারীরিকভাবে ভেঙে পড়েন। খাওয়াদাওয়া একেবারেই ছেড়ে দিয়ে মৃত্যুশয্যায় শায়িত হবার উপক্রম হয়েছিল। সেই সময়ে তাঁর বোন অনসূয়া নন্দীবর্ধনকে নিজের বাড়িতে নিয়ে যান কার্তিক মাসের শুক্ল পক্ষের দ্বিতীয়া তিথিতে। সেখানে বোনের অনেক প্রার্থনার পরে নন্দীবর্ধন বোনের কাছে অনশন ভঙ্গ করেন। বোনের আদর ভালোবাসায় নন্দীবর্ধন খাদ্য গ্রহণ করে সাক্ষাৎ মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পেলেন।
দীপাবলী শেষ হলেই শুরু হয়ে যায় ভাইফোঁটার প্রস্তুতি। ভাই-বোনের স্নেহ, প্রেম, প্রীতি, ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার এক বিশেষ উৎসব এই ভাইফোঁটা। এই দিন ভাইয়ের কপালে কড়ে আঙ্গুল ঠেকিয়ে বোন ভাইকে ফোঁটা দেয়। সঙ্গে স্থানভেদে উপরের যে কোনো একটি মন্ত্র উচ্চারণ করেন। পরপর তিনবার মন্ত্রটি উচ্চারণ করে তিনবার ফোঁটা দিতে হয়।
বোন কেন তাঁর বা হাতের কড়ে আঙ্গুল ব্যবহার করে ভাইয়ের কপালে ফোঁটা দেয় তার কারণ নারী প্রকৃতির রূপ। আর তাঁর কড়ে আঙ্গুল হলো মহাশূন্যের প্রতীক। আমাদের পাঁচটি আঙ্গুলে পঞ্চভূত তথা ক্ষিতি (পৃথিবী), অপ (জল), তেজ (আগুন), মরুৎ (বায়ু) ও ব্যোম (মহাশূন্য বা আকাশ) অবস্থান করে। এই ব্যোম বা মহাশূন্য বা বিশাল আকাশ কড়ে আঙ্গুলে থাকে। এই কড়ে আঙ্গুল দিয়ে ফোঁটা দেওয়ার অর্থ হলো ভাই-বোনের একে অপরের প্রতি ভালোবাসা মহাশূন্যের বা বিশাল আকাশের মতো উদার, অসীম ও অনন্ত। এই জন্যই ভাই ও বোনের ভালোবাসা অটুট রাখতে এবং সম্পর্ক আরও মধুর করতে এই কড়ে আঙ্গুলে ফোঁটা দেওয়ার প্রচলন রয়েছে।
আগে কানে কণ্ঠে ফোঁটা দেওয়া দেওয়ার চল থাকলেও এখন শুধু কপালেই ফোঁটা দেওয়া হয়। কপাল আমাদের চেতনার প্রথম স্তর। তাই কপালে ফোঁটা হয়ে থাকে। এছাড়াও সাংসারিক চিন্তাভাবনায় কপাল ভাগ্যের স্থান। এই জন্য বোনেরা ভাইয়ের সৌভাগ্য কামনায় কড়ে আঙ্গুল দিয়ে ভাইয়ের কপালে ফোঁটা দিয়ে থাকে। কোনো কোনো জায়গায় কানের লতিতে টিকা দিয়ে থাকে। এর কারণ হলো কান, কান হলো শ্রবণ অঙ্গ। আর জগৎ ধ্বনিময়। সেই ধ্বনিতেই ব্রহ্মের পদধ্বনি অনুচ্চারিত হচ্ছে। ভাইয়ের কর্ণে যেন সেই ব্রহ্মধ্বনি শ্রুত হয়। অনেকে কণ্ঠেও টিকা দিয়ে থাকে। এর কারণ কণ্ঠ থেকে বাক্যের প্রকাশ, তাই বোনেরা কণ্ঠে টিকা দিয়ে থাকেন। যাতে ভাইয়ের বাক্য মধুর হয়। বাক্যই ব্রহ্ম। এই টিকা বা ফোঁটা কিন্তু শুধুই মাঙ্গলিক নয়, শরীরের বিশেষ বিশেষ স্থান মাহাত্ম্যেরও প্রতীক।

















