শতবর্ষের সাধনা
ভারতবর্ষে শক্তিসাধনার ইতিহাস বহু প্রাচীন। দুর্গাপূজা বাঙ্গালির শ্রেষ্ঠপূজা হইলেও দুর্গাকেন্দ্রিক শক্তিসাধনা অর্থাৎ অষ্টনায়িকা, নবদুর্গা, দশমহাবিদ্যা,
পার্বতী, উমা, সতী, গৌরী, আদ্যাশক্তি, মহামায়া, শ্যামা, তারা, মহালক্ষ্মী, মহাসরস্বতী, অন্নপূর্ণা, জগদ্ধাত্রী, গন্ধেশ্বরী প্রভৃতি শক্তিদেবীর সাধনা
বঙ্গদেশব্যাপী পরিলক্ষিত হয়। বঙ্গদেশে শক্তিসাধনার মূল ধারা হইল মা কালী বা দেবী কালিকা। মা কালীই বঙ্গদেশে শক্তিসাধনার ক্ষেত্রে সর্বপ্রধান
হইয়া উঠিয়াছেন। মা কালী বেদোল্লিখিত দেবী না হইলেও ঋগ্বেদের দেবীসূক্ত ও রাত্রিসূক্তকে কেন্দ্র করিয়া যে রাত্রিদেবীর উদ্ভব ঘটিয়াছে, পরবর্তীকালে
তিনিই দেবী কালীর রূপ পরিগ্রহ করিয়াছেন বলিয়া বহু গষেকের ধারণা। মা কালীর প্রথম উল্লেখ রহিয়াছে মুণ্ডকোপনিষদে এবং তারপর মার্কণ্ডেয়
পুরাণ ও শ্রীশ্রীদেবীভাগবতে। কালী সাধনায় বঙ্গীয় সাধকদিগের নাম উল্লেখযোগ্য হইলেও ভারতব্যাপী বহু শক্তিসাধক রহিয়াছেন। ভারত ভূখণ্ড
জুড়িয়া শক্তিপীঠগুলিই তো ইহার সাক্ষ্য বহন করিতেছে। শক্তিসাধনায় ভারতবর্ষ আত্মবলে বলীয়ান হইয়াছে। মাতৃসাধক কবি ও গীতিকারগণ রচনা
করিয়াছেন শাক্ত পদাবলী। বিশ্ববরেণ্য স্বামী বিবেকানন্দ, স্বামী অভেদানন্দ প্রমুখ শ্রীরামকৃষ্ণশিষ্যগণ কালী সাধনাকে বিশ্বময় বিস্তার করিয়াছেন।
শক্তিসাধক স্বামী বিবেকানন্দ পরাধীন ভারতবাসীকে শক্তিমন্ত্রে উজ্জীবিত করিয়া ভারতের স্বাধীনতাকে ত্বরান্বিত করিয়াছিলেন। স্বামীজী শিষ্যা ভগিনী
নিবেদিতা ‘কালী দ্য মাদার’ পুস্তক রচনা করিয়া মা কালীকে ভয় ও বিপদ হইতে মুক্তিদাত্রী দেবী হিসাবে বর্ণনা করিয়া দেশবাসীকে উজ্জীবিত
করিয়াছেন।
এই প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য যে, ভারতের সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ হিন্দু জাতির মনকে ভয় ও বিপদমুক্ত করিবার
সাধনায় যাত্রা শুরু করিয়া এই বৎসর বিজয়াদশমীতে একশত বর্ষ পূর্ণ করিয়াছে। মহারাষ্ট্রের যুবক ডাঃ কেশব বলিরাম হেডগেওয়ার ১৯২৫ সালে
এই সংগঠনের বীজারোপণ করিয়াছিলেন। তিনি অনুভব করিয়াছিলেন জাতিকে আত্মবলে বলীয়ান করিয়া সংগঠিত করিতে না পারিলে দেশ ও
জাতির হৃতগৌরব পুনরুদ্ধার করা সম্ভব হইবে না। তিনি কতিপয় বালক-কিশোর লইয়া সেই সাধনায় মগ্ন হইয়াছিলেন। পরাধীনতার কালে বৈদেশিক
শাসকের রক্তচক্ষুকে ভ্রূক্ষেপ না করিয়া দেশব্যাপী সংগঠনের জাল বিস্তার করিয়াছেন। দেশের স্বাধীনতা প্রাপ্তির পূর্বেই তাঁহার দেহাবসান ঘটিয়াছে।
কিন্তু তাঁহার উত্তসূরীগণ সেই সাধনা অব্যাহত রাখিয়া সংগঠনের বিস্তারই শুধু ঘটান নাই, সমাজজীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সমস্যা নিরসনে ব্রতী
হইয়াছেন। ইহার ফলে সমাজকে যেমন তাহারা আপন করিয়া লইয়াছেন, তেমনই সমাজও তাহাদিগকে সর্বপ্রকার আশীর্বাদ প্রদান করিয়াছে। শতবর্ষের
যাত্রাপথে দেশের ভোটভিখারি রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, বৈদেশিক মদতপুষ্ট অরাষ্ট্রীয় শক্তি, জেহাদি শক্তি পদে পদে বাধা সৃষ্টি করিয়াছে কিন্তু সমাজ
আত্মবলে বলীয়ান হইবার ফলে তাহারা পিছু হঠিতে বাধ্য হইয়াছে।
একথা স্বীকার করিতে হইবে যে, শতবর্ষের সাধনায় আজ রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ এবং ভারতীয় সমাজ প্রায় একাত্ম হইয়া গিয়াছে। যতটুকু অধরা
রহিয়াছে তাহার জন্য সঙ্ঘ পঞ্চপরিবর্তনের কর্মসূচি গ্রহণ করিয়াছে। তাহা হইল, জাতির জীবনে ‘স্ব’-এর প্রতিষ্ঠা, পরিবার জীবনে মূল্যবোধের
পুনঃস্থাপন, অস্পৃশ্যতা নির্মূল করিয়া সমরস সমাজ নির্মাণ, ব্যক্তিজীবনে যথাযথ কর্তব্য পালন এবং প্রকৃতির সংরক্ষণ করিয়া পরিবেশ-বান্ধব জীবন
রচনা। সঙ্ঘের স্বয়ংসেবকগণ নিজ নিজ জীবনে ইহা যথাযথ পালন করিয়া সমাজের দ্বারে দ্বারে যাইয়া ইহার জন্য উদ্বুদ্ধ করিবেন। আনন্দের বিষয় যে,
ভারত সরকার সঙ্ঘের শতবর্ষ পূর্তি উপলক্ষ্যে সঙ্ঘের সেবাকার্য এবং দিল্লিতে ১৯৬৩ সালের সাধারণতন্ত্র দিবসে স্বয়ংসেবকদের কুচকাওয়াজে
অংশগ্রহণের চিত্র সংবলিত ডাকটিকিট এবং ভারতমাতা ও তিন স্বয়ংসেবকের চিত্র সংবলিত একশত টাকার স্মারক মুদ্রা প্রকাশ করিয়াছে। এই
সরকারি স্বীকৃতি নিঃসন্দেহে স্বয়ংসেবকদের রাষ্ট্রসেবার সাধনায় আরও অধিক মনোবল বৃদ্ধি করিবে। সঙ্ঘের শতবর্ষ পূর্তিতে যখন সমগ্র দেশ
স্বয়ংসেবকদিগকে অভিনন্দিত করিতেছে, সর্বভারতীয় প্রচারমাধ্যম যখন বিভিন্ন কর্মসূচির ইতিবাচক সম্প্রচার করিতেছে, তখন পশ্চিমবঙ্গের একশ্রেণীর
বাজারি পত্রিকার গাত্রদাহ শুরু হইয়াছে। একটি দেশদ্রোহী, বিজাতীয় রাজনৈতিক দল এই ডাকটিকিট প্রকাশকে আক্রমণ ও সমালোচনা পর্যন্ত
করিয়াছে। প্রকাশ্যে আসিয়াছে তাহাদের অরাষ্ট্রীয় চিন্তাধারা। সমাজ যখন সঙ্ঘকে আপন করিয়া লইয়াছে, তখন সামান্য অপপ্রচার রাষ্ট্রসেবায়
নিয়োজিত সঙ্ঘের অগ্রগতিকে রুদ্ধ করিতে পারিবে না, রাষ্ট্রসাধক স্বয়ংসেবকগণ এই কথা ভালো করিয়াই জানেন।

















