বঙ্গপ্রদেশে সংস্কৃত সাহিত্যচর্চার পরম্পরা
প্রণব নন্দ
সংস্কৃতই ভারতবর্ষের সর্বাপেক্ষা প্রাচীনা
ভাষা। সংস্কার সাধনে গৃহীত হয়েছে তাই নাম
হয় সংস্কৃতম্। সংস্কারং কৃতম্ তাই নাম
সংস্কৃতম্। সংস্কৃতভাষা শুধুমাত্র সংযোগ
সাধরণের মাধ্যমে নয়। সংস্কৃতই আমাদের
ভারতীয় সংস্কৃতির পরিচয়। ভারতীয়
সংস্কৃতিকে জানতে হলে সংস্কৃতভাষা জানা
অত্যাবশ্যক।
স্বামী বিবেকানন্দের মতানুসারে–
‘আমাদের শাস্ত্র ভাণ্ডারে সঞ্চিত, মঠ ও
অরণ্যে গুপ্তভাবে রক্ষিত, অতি অল্প লোকের
দ্বারা অধিকৃত ধর্মরত্নগুলি প্রকাশ্যে বাহির
করা…। আর যতদিন না আমাদের সমগ্র জাতি
উত্তমরূপে সংস্কৃতভাষা শিখিতেছে… এই
অন্তরায় দূরীভূত হইবার নহে…। সংস্কৃত
শব্দগুলির উচ্চারণ মাত্রই জাতির মধ্যে একটা
গৌরব… একটা শক্তির ভাব জাগিবে।’
বঙ্গপ্রদেশে কবে থেকে সংস্কৃত চর্চা শুরু
হয়েছে তার নির্দিষ্ট করে বলা সম্ভব নয়।
সংস্কৃত চর্চার একটি পরিপূর্ণ চিত্র আমরা পাই
খ্রিস্টীয় সপ্তম শতকে। তদানীন্তন অনেক
বাঙ্গালি পণ্ডিতের রচনায় এর উল্লেখ পাওয়া
যায়। সংস্কৃত ভাষার চর্চা সম্পূর্ণ পূর্ব
স্বস্তিকা।। ৭ বৈশাখ – ১৪৩২।। ২১ এপ্রিল – ২০২৫
ভারতের সর্বত্র বিস্তৃত লাভ করেছিল।
পূর্ববঙ্গে প্রাচীনকাল থেকেই এই ভাষার চর্চা
সর্বত্র হয়ে আসছিল। যদিও বর্তমানে তা
অত্যন্ত ক্ষীয়মান। সমগ্র বঙ্গপ্রদেশে সর্বত্র
বিভিন্ন স্কুল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে সংস্কৃত
ভাষা চর্চা ও সাহিত্যের চর্চা লেগেই থাকতো।
এখনো সেখানে সংস্কৃতে স্নাতক,
স্নাতকোত্তর, পিএইচডি পর্যায়ে সংস্কৃত চর্চা
হচ্ছে। এছাড়াও বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি
সংস্থার অধীনে বিভিন্ন শ্রেণীতে সংস্কৃত
অধ্যয়নের ব্যবস্থা আছে। সহস্রাধিক
টোল-চতুষ্পাঠীর মাধ্যমে সনাতনী পদ্ধতিতে
সংস্কৃত শিক্ষা দেওয়া হয়ে থাকে।
চতুষ্পাঠীগুলির বিভিন্ন কেন্দ্রে আদ্য, মধ্য ও
উপাধি পরীক্ষার ব্যবস্থা আছে। যদিও
বর্তমানে সরকারি অসহযোগিতায় এবং
আর্থিক অনটনে টোল-চতুষ্পাঠীগুলির
অবস্থা অত্যন্ত সংকটজনক। তবু দৃঢ়প্রতিজ্ঞ
সংস্কৃতপ্রেমী মানুষ এবং সংস্কৃত
পণ্ডিত-অধ্যাপকদের প্রচেষ্টায় সংস্কৃত চর্চার
ধারা আজও অব্যাহত।
বঙ্গপ্রদেশে পালরাজত্বে ও সেনরাজত্বে
সংস্কৃতচর্চার ব্যাপকভাবে প্রসার ঘটেছিল।
পরবর্তী ইসলামি শাসনকালে সংস্কৃতচর্চার
ধারা কিছুটা ব্যাহত হলেও পরবর্তী সময়ে
তা থেমে থাকেনি। পঞ্চদশ থেকে সপ্তদশ
শতক পর্যন্ত নব্যন্যায় চর্চায় বঙ্গদেশ সমগ্র
ভারতে উল্লেখযোগ্য হয়ে উঠেছিল। বিশেষত
নবদ্বীপকে কেন্দ্র করে ন্যায়চর্চার কথা বলা
যেতেই পারে। ব্রিটিশ শাসনকালে প্রথম দিকে
অর্থাৎ আঠারো-উনিশ শতকে সংস্কৃত
অধ্যয়ন চর্চার জাগরণ সামান্য হলেও বিংশতি
শতকে সংস্কৃত চর্চার কিছুটা হ্রাস ঘটে। তবু
সংস্কৃত পণ্ডিত, অধ্যাপকদের দৃঢ় মনোভাবের
কারণে অদ্যাবধি সর্বত্র সংস্কৃত অধ্যয়ন চর্চা
সচল বিদ্যমান।
পালরাজত্ব (৭৫০-১১৬১)
পাল রাজাদের শাসনকালেও সংস্কৃতচর্চা
ও সাহিত্যের ব্যাপক প্রভাব ঘটেছিল। যদিও
তাঁরা বৌদ্ধমতাবলম্বী ছিলেন। ভট্টনারায়ণের
‘বেণীসংহার’, বিশাখদত্তের ‘মুদ্রারাক্ষস’,
নোয়াখালি নিবাসী মৎস্যেন্দ্রনাথের
‘কৌলজ্ঞাননির্ণয়’, বিক্রমপুর নিবাসী অতীশ
দীপঙ্করের ‘বোধিমার্গপঞ্জিকা’, গঙ্গাদাসের
‘ছন্দোমঞ্জুরী’, চক্রপাণি দত্তের
‘চিকিৎসাসারসংগ্রহ’, সন্ধ্যাকর নন্দীর
‘রামচরিতম্’, বিদ্যাকরের ‘সুভাষিতরত্নকোষ’
ইত্যাদি ওই সময়ের উল্লেখযোগ্য রচনাসম্ভার সংস্কৃতচর্চায় সংস্কৃত শিক্ষার্থীদের প্রেরিত প্রভৃতি গ্রন্থগুলি উল্লেখনীয়।
করে।
সেনরাজত্ব (১০৯৭-১২৫০)
সেন রাজাদের সময়েও সংস্কৃত
সাহিত্যের বিশেষ চর্চার প্রচলন ছিল। সেই
সময়টিকে সংস্কৃতচর্চার ‘স্বর্ণযুগ’ বলে
অনেকেই মনে করেন। সেনবংশের রাজা
বল্লাল সেন ও লক্ষ্মণ সেন দুজনেই ছিলেন
সংস্কৃতের বিদ্বান ও অত্যন্ত সাহিত্যপ্রেমী।
‘জয়দেব’, ‘ধোয়ী’, ‘উমাপতিধর’, ‘গোবর্ধন’
ও ‘শরণ’- এই পাঁচজন সংস্কৃত কবি ছিলেন
লক্ষ্মণ সেনের সভায় পঞ্চরত্নের মতোই।
বল্লাল সেনও অনেক গ্রন্থ রচনা
করেছিলেন— যেমন ‘দানসাগর’
‘অদ্ভুতসাগর’, ‘প্রতিষ্ঠাসাগর’, ‘আচারসাগর’,
‘ব্রতসাগর’ ইত্যাদি।
‘কালিকাপুরাণ’, ‘বৃহন্নন্দিকেশ্বর পুরাণ’
এবং ‘দেবীভাগবত’ এই সময়কালে
পুনর্লিখিত হয়।
ইসলামি শাসন (১২০৬-১৭৫৭)
বঙ্গপ্রদেশে সেই সময় ইসলামি
শাসনকালেও ব্যাপকরূপে সংস্কৃতচর্চা ও
সাহিত্যচর্চার উল্লেখ পাওয়া যায়।
বিশেষভাবে বৈষ্ণব কবিদের রচনা সম্ভার
তাদের মধ্যে অন্যতম। বৈষ্ণবদের তীর্থভূমি
নবদ্বীপকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে সংস্কৃত
সাহিত্য চর্চার অন্যতম কেন্দ্র। সেই সময়ের
উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলি হলো রূপ গোস্বামীর
‘পদাবলী’, মুরারি গুপ্তের ‘শ্রীকৃষ্ণচরিতামৃত’,
সনাতন গোস্বামীর ‘বৈষ্ণবতোষিণী’ ইত্যাদি।
তৎকালীন নব্যস্মৃতি চর্চার জন্য বহুবিধ
সাহিত্য রচনা করেন বিভিন্ন সংস্কৃত পণ্ডিত
ব্যক্তিরা ও সাহিত্যিকরা। সেই সকল
সাহিত্যগুলি হিন্দু সমাজে গভীরভাবে প্রভাব
বিস্তার করেছিল।
সেই সময়ের দর্শনশাস্ত্রে- ‘বাসুদেব
সার্বভৌম’, ‘রঘুনাথ শিরোমণি’, ‘রামভদ্র
সার্বভৌম’-এর রচনাও ব্যাপকভাবে প্রভাব
বিস্তার করেছিল। ব্যাকরণশাস্ত্রে বোপদেবের
‘মুগ্ধবোধ’, ক্রমদীশ্বরের ‘সংক্ষিপ্তসার’
প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলিও উল্লেখ করার
মতো। তন্ত্রবিষয়ে কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশের
‘তন্ত্রসার’, অলংকার ও ছন্দে চিরঞ্জিত ভট্টাচার্যের ‘কাব্যবিলাস’ ও ‘বৃত্তরত্নাবলী’ প্রভৃতি গ্রন্থগুলিও উল্লেখযোগ্য
ইংরেজ শাসনকাল (১৭৫৭-১৯৪৭)
ইংরেজ রাজত্বকালেও সমগ্র বঙ্গে শিক্ষা
ও সংস্কৃতির পাশাপাশি সংস্কৃতচর্চায় এক
নবজাগরণ সৃষ্টি হয়েছিল। সেই সময়
মৌলিক গ্রন্থসম্ভার অধিক রচিত না হলেও
অনুবাদ-সহ সংস্কৃত পঠনপাঠনের পদ্ধতি
বিস্তার লাভ করে থাকে। আমরা জানি
প্রাচীনকাল থেকেই সংস্কৃত চর্চায় নবদ্বীপের
নাম অত্যন্ত সুপরিচিত। এছাড়াও নদীয়ার
ভাটপাড়া, হুগলীর গুপ্তিপাড়া, ত্রিবেণী,
বর্ধমান, হাওড়ার বালি, বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুর,
পূর্ববঙ্গের বিক্রমপুর, চট্টগ্রাম, সিলেট,
রাজশাহীতেও সংস্কৃতের ব্যাপক চর্চার প্রচলন
ছিল। মূলত সংস্কৃতচর্চার কেন্দ্র হিসেবে টোল
বা চতুষ্পাঠী নামেই অধিক পরিচিত লাভ
করেছিল। তৎকালীন সরকারি সূত্র অনুসারে
জানা যায় সমগ্র বঙ্গে গ্রামেগঞ্জে অসংখ্য
সংস্কৃত টোল-চতুষ্পাঠী এবং পাঠরত
ছাত্রদের আধিক্য বিশেষ দৃষ্টি আকর্ষণ
করেছিল।
নব্যন্যায়, স্মৃতিচর্চায়ও বাঙ্গালি পণ্ডিতরা
অগ্রগণ্য ছিলেন। সেই সময়ে ন্যায়গ্রন্থ রচনা
করে অনেকেই উল্লেখযোগ্য স্বাক্ষর রেখে
গেছেন। ত্রিবেণী নিবাসী জগন্নাথ
তর্কপঞ্চানন ‘বিবাদভঙ্গার্ণব’ নামে সুবিশাল
স্মৃতিগ্রন্থ সংকলিত করেন। এই গ্রন্থটি
তৎকালীন সমগ্র ভারতবর্ষে হিন্দু আইন
সম্পর্কিত মীমাংসায় বিশেষ সহায়ক
হয়েছিল। বাণেশ্বর বিদ্যালঙ্কার ছিলেন হুগলী
জেলার গুপ্তিপাড়ার বিখ্যাত ‘শোভাকর’-এর
বংশধর। তিনি কয়েকজন বাঙ্গালি পণ্ডিতদের
সহায়তায় সহায়তায় ‘বিবাদার্ণবসেতু’ গ্রন্থ
সংকলিত করেন। এই গ্রন্থটিও হিন্দু নীতি
রীতি সম্পর্কিত মীমাংসায় খুবই সহায়ক
হয়েছিল।
উনিশ শতকের প্রায় শেষভাগে সংস্কৃত
চর্চায় অবিস্মরণীয় অবদান রেখে গেছেন
হরিদাস সিদ্ধান্তবাগীশ মহামহোপাধ্যায়। তাঁর
রচিত স্মৃতিগ্রন্থ ‘স্মৃতিচিন্তামণি’ হিন্দুদের জন্ম
থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সকল বিধি-বিধান চিহ্নিত
করে গেছেন।
নবদ্বীপের বিখ্যাত নৈয়ায়িক
মহামহোপাধ্যায় ‘কামাক্ষানাথ তর্কবাগীশ’
(১৮৪৩-১৯৩৬), ভাটপাড়ার ‘কমলকৃষ্ণ
স্মৃতিতীর্থ’ (১৮৭০-১৯৩৪) প্রমুখ পণ্ডিতরা
নব্যন্যায় চর্চায় তাঁদের উল্লেখযোগ্য অবদান
রেখে গেছেন।
তদানীন্তন অনেক দেশীয় রাজা এ
জমিদার সংস্কৃত চর্চার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ
ভূমিকা পালন করেছিলেন। তাঁদের মধ্যে
অন্যতম কয়েকজন হলেন নবদ্বীপের রাজা
‘কৃষ্ণচন্দ্র’ বর্ধমানের রাজা ‘কীর্তিচাঁদ’ ও
তিলকচাঁদ’, নাটোরের রাজা ‘রামকান্ত’ ও
‘রানি ভবানী’, বিষ্ণুপুরের মলরাজ ‘গোপাল
সিংহ’, ঢাকার ‘রাজবল্লভ সেন’ প্রমুখ
অন্যতম। নবদ্বীপের রাজা ‘কৃষ্ণচন্দ্র রায়’
সমগ্র বঙ্গে সংস্কৃত সাহিত্য চর্চার জন্য বিভিন্ন
স্থানে প্রচুর অর্থ দান করেছিলেন।
সেই সময়ের ইংরেজ সরকারি শিক্ষা
আধিকারিক উইলিয়াম অ্যাডাম-এর রিপোর্ট
(১৮৩৫-১৮৩৮) এবং রেভারেন্ড জেমস্ লং
(১৮৬৮)-এর রিপোর্ট অনুযায়ী তদানীন্তন
বঙ্গদেশে সংস্কৃত টোল-চতুষ্পাঠী ও
মহাবিদ্যালয়ে সংস্কৃতচর্চার বিবরণ বিস্তৃত
লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। এই রিপোর্ট অনুযায়ী
সমগ্র বঙ্গে সংস্কৃত অধ্যয়ন ও সংস্কৃতচর্চা
কীভাবে হতো তার একটা স্পষ্ট চিত্র আমরা
জানতে পারি।
ব্রিটিশরা এদেশে ব্যবসাবাণিজ্য ও
শাসনকার্য পরিচালনা করে অনুভব করেছিল
যে, এদেশে দীর্ঘকাল রাজত্ব করতে হলে
এদেশের ভাষা ও সাহিত্যজ্ঞান জানা একান্ত
প্রয়োজন। এঁদের মধ্যে কয়েকজন ইংরেজ
পণ্ডিত ও ভাষাবিদের অবদান বিশেষভাবে
স্মরণ করতেই হবে। উইলিয়াম জোন্স, চার্লস
উইলকিন্স, হেনরি টমাস, হোরেস হেম্যান
উইলসন এবং জেমস প্রিন্সেপ পাণ্ডুলিপি
সংগ্রহ করে অনুবাদ, গবেষণা ও সম্পাদনা
ইত্যাদির মাধ্যমে সংস্কতকে বিশ্বের সঙ্গে
পরিচিত করার ক্ষেত্রে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ
ভূমিকা পালন করেছিলেন।
বহু ভাষাবিদ উইলিয়াম জোন্স ১৭৮৩
খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় আসেন সুপ্রিম কোর্টের
বিচারপতি হিসেবে। তাঁর নেতৃত্বে ১৭৮৪
খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত হয় এশিয়াটিক
সোসাইটি। পরবর্তীকালে এশিয়াটিক
সোসাইটির সভাপতি এবং ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের অধ্যাপক কোলব্রুক সংস্কৃত
সাহিত্য চর্চার প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা
পালন করেছিলেন। ১৮০০ খ্রিস্টাব্দে ফোর্ট
উইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্ঠা হয়। তখন
এখানেও সংস্কৃতভাষা শিক্ষাকে বিশেষভাবে
প্রাধান্য দেওয়া হতো।
কিছুদিনের মধ্যে কোলব্রুক ইংরেজি
ভাষায় সংস্কৃত ব্যাকরণ রচনা করেন।
‘মুগ্ধবোধ ব্যাকরণ’, ‘সিদ্ধান্তকৌমুদী’,
‘অমরকোষ’ ইত্যাদি প্রকাশিত প্রকাশিত করা
হয়। প্রকাশিত হয় উইলসনের ‘সংস্কৃত
ইংরেজি অভিধান’। অর্থাৎ সংস্কৃত অধ্যয়ন
ও চর্চার ক্ষেত্রে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন
সংস্কৃতপ্রেমী বিদ্বানরা অনন্য ভূমিকা৪ পালন
করেছিলেন।
কলকাতায় সংস্কৃত কলেজ (১৮২৪)
গভর্নর হেস্টিংসের নির্দেশে কলকাতায়
প্রতিষ্ঠিত হয় সংস্কৃত কলেজ। ঈশ্বরচন্দ্র
বিদ্যাসাগর ১৮৫১ খ্রিস্টাব্দে এই কলেজের
অধ্যক্ষ নির্বাচিত হওয়ার পর শিক্ষা পদ্ধতির
আমূল পরিবর্তন করেছিলেন। সংস্কৃতকে
সকলেরই নিকট সহজবোধ্য করার জন্য তাঁর
অবদান অপরিসীম।
এই কলেজে অতীতে কেবল ব্রাহ্মণ
সন্তানদেরই সংস্কৃত শিক্ষার অধিকার ছিল।
কিন্তু বিদ্যাসাগরের প্রচেষ্টায় সকল হিন্দু
শিক্ষার্থীরাই কলেজে পড়ার সুযোগ লাভ
করেন। যেমন তিনি বাংলায় ‘শিশুপাঠ্য’
রচনা করেন তেমনিই সংস্কৃত ভাষায়
প্রাথমিক জ্ঞান অর্জনের জন্য রচনা করেন
‘উপক্রমণিকা’ ও ‘ব্যাকরণকৌমুদী’। তাঁর
সম্পাদিত ‘রঘুবংশ’, ‘মেঘদূত’,
‘কুমারসম্ভব’, ‘উত্তররামচরিত’, ‘হর্ষচরিত’,
‘কাদম্বরী’, ‘অভিজ্ঞানশকুন্তলম্’ ইত্যাদি
বিখ্যাত সংস্কৃতগ্রন্থ সমূহ সর্বসাধারণের
নিকট সংস্কৃত সাহিত্যের প্রণেতা।
তাঁর পরবর্তীকালে সংস্কৃত কলেজের
অধ্যক্ষ হন মহেশচন্দ্র ন্যায়রত্ন ১৮৭৭
খ্রিস্টাব্দে। তিনিই প্রথম টোল-
চতুষ্পাঠীগুলির সংস্কার সাধন করে সংস্কৃত
‘উপাধি’ পরীক্ষার ব্যবস্থা করেছিলেন।
১৮৭৯ সালে প্রথম ‘উপাধি’ পরীক্ষা সংস্কৃত
কলেজেই হয়। পরবর্তীকালে সংস্কৃত
কলেজের অনেক অধ্যাপকরা ছিলেন
স্বস্তিকা।। ৭ বৈশাখ – ১৪৩২।। ২১ এপ্রিল – ২০২৫
তারানাথ তর্কবাচস্পতি। তিনি অসংখ্য
মৌলিক গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। কলেজের
অধ্যাপনা শেষ করেও তিনি নিজ গৃহে
অবৈতনিক সংস্কৃত কলেজ প্রতিষ্ঠা করে বহু
শিক্ষার্থীকে বিদ্যাদান করেছিলেন। এই ভাবে
সংস্কৃত সাহিত্য চর্চায় শতসহস্র বাঙ্গালি
পণ্ডিত নিরবচ্ছিন্নভাবে তাঁদের অসংখ্য
অবদান রেখে গিয়েছিলেন।
বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব
রাজা রামমোহন রায় যাঁকে বঙ্গের
নবজাগরণের অগ্রদূত বলা হয় তিনিও
সংস্কৃত ভাষায় অত্যন্ত পারদর্শী ছিলেন।
রাজা রাধাকান্ত দেব সংস্কৃতকে জনপ্রিয়
করার জন্য সেই সময় প্রচুর অর্থ ব্যয়
করেছিলেন। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর সংস্কৃত চর্চার
ক্ষেত্রে অনেক অধ্যাপক ও বহু ছাত্রদের বৃত্তি
প্রদান করেছেন। নিজের সন্তান ও বাড়ির
বধূদেরও সংস্কৃত শিক্ষার ব্যবস্থা করেন
তিনি। দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর, সত্যেন্দ্রনাথ
ঠাকুর, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর সকলেই
সংস্কৃতের অনুরাগী ছিলেন। কবিগুরু
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সংস্কৃতজ্ঞান
সর্বজনবিদিত। তিনি গভীরভাবে সংস্কৃত
অধ্যায়ন করেছিলেন এবং অন্যদেরও
সংস্কৃত পাঠে উৎসাহিত করেছেন। তাঁর
প্রতিষ্ঠিত শান্তিনিকেতনে তিনি বাংলা ভাষার
অধ্যাপক ও ছাত্রদের জন্য পাণিনির
অষ্টাধ্যায়ী সূত্রপাঠকে আবশ্যিক পাঠ্য
করেছিলেন। সংস্কৃত শিক্ষার জন্য তিনি
নিজে ‘সংস্কৃতপাঠঃ’ নামে একখানা সরলগ্রন্থ
রচনা করেন। তাঁর প্রতিষ্ঠিত বিশ্বভারতীর
ধ্যেয়বাক্য হলো ‘অথেয়ং বিশ্বভারতী, যত্র
বিশ্বং ভবত্যেকনীড়ম্…।’ কলকাতায় সংস্কৃত
কলেজ থেকে তাঁকে ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দে ২০
সেপ্টেম্বর ‘কবি সার্বভৌম’ উপাধিতে ভূষিত
করা হয়।
স্বামী বিবেকানন্দের (১৮৬৩-১৯০২)
সংস্কৃতে অগাধ পাণ্ডিত্য ছিল। তিনি বিদেশে
সংস্কৃত-বেদান্তের অধিক প্রচার করেছিলেন।
শ্রীরামকৃষ্ণদেবের বন্দনা-সহ অনেক সংস্কৃত
স্তোত্র তিনি নিজেই রচনা করেছেন।
ইংরেজি ভাষায় পণ্ডিত হয়েও ভূদেব
মুখোপাধ্যায় (১৮২৭-১৮৯৪) সংস্কৃত
ভাষার প্রচার ও প্রসারে বিশেষ যত্নশীল
ছিলেন। সেই সময়ও বিশ্বনাথ চতুষ্পাঠী তাঁর
দানেই পরিচালিত হতো। বন্দেমাতরম্-এর
স্রষ্টা ঋষি বঙ্কিমচন্দ্রের সংস্কৃতজ্ঞান সুবিদিত।
তাঁর পরিচয় বন্দেমাতরম্ ও গীতা অনুবাদে
আমরা পাই। রমেশচন্দ্র দত্ত, পদার্থবিজ্ঞানী
রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী, কবি নবীনচন্দ্র সেন
তাঁরা সকলেই সংস্কৃত যেমন অনুশীলন
করতেন, তেমনই ভাষার প্রচারে মুখ্য ভূমিকা
পালন করেছিলেন। সেই ধারা আজও
অব্যাহত।
বর্তমানেও পশ্চিমবঙ্গে প্রচারের
আড়ালে থেকে বিষম পরিস্থিতির মধ্যেও
সংস্কৃতচর্চার ধারা বয়ে নিয়ে চলেছেন অনেক
বিশিষ্ট সংস্কৃত পণ্ডিতব্যক্তি তথা বিভিন্ন
সংস্কৃতসংস্থা। তাদের মধ্যে অন্যতম সংস্কৃত
সংস্থা হলো সংস্কৃতভারতী। এর আগে
পশ্চিমবঙ্গে ১৯৮১ সালে বিশ্ব সংস্কৃত
প্রতিষ্ঠানম্ প্রতিষ্ঠা হয়। তখন উদ্যোক্তা
ছিলেন অধ্যাপক চপলাকান্ত ভট্টাচার্য,
কুমারনাথ ভট্টাচার্য, সুনীলেন্দু ভট্টাচার্য
প্রমুখ। ১৯৮৪ সালে কলকাতার স্বয়ংসেবক
অভিজিৎ চক্রবর্তীর এর দায়িত্ব পালন
করেন। ১৯৯৯ সালে কেশবজীর উদ্যোগে
সংস্কৃত ভারতী শুরু হয়। সংযোজক হিসেবে
দায়িত্ব পালন করেন অভিজিৎ চক্রবর্তী।
২০০৮ সালে কলকাতায় একটি সংস্কৃত
সম্ভাষণ শিবিরের দ্বারা শুরু হয় পশ্চিমবঙ্গে
সংস্কৃতচর্চার এই বিকাশ যাত্রা। আজও
নিরলস ভাবে সেই ধারায় প্রতি বছর সম্ভাষণ
শিবির, বর্গ, প্রশিক্ষণ চলছে। কোনো
প্রকারের সরকারি সহায়তা না পেয়েও
কেবলমাত্র কয়েকজন সংস্কৃতপ্রেমী
মানুষদের সহযোগিতা নিয়ে সরল সংস্কৃত
সম্ভাষণের মাধ্যমে সংস্কৃতভাষা চর্চার কাজ
এগিয়ে নিয়ে চলেছে সংস্কৃত ভারতী।
বর্তমানেও পশ্চিমবঙ্গে লক্ষাধিক
সংস্কৃতপ্রেমী মানুষ বিভিন্ন উপায়ে উপকৃত
হচ্ছেন এই সংস্কৃত সাহিত্য চর্চার মাধ্যমে।
সংস্কৃত সাহিত্যচর্চা নিয়মিত রাখতে
সংস্কৃতভারতীর পক্ষ থেকে প্রকাশিত হয়েছে
সহস্রাধিক গ্রন্থ। আসুন, আমরাও সকলেই
এই সংস্কৃতচর্চা শিক্ষণ যাত্রায় শামিল হই
এবং বঙ্গভূমিতে সংস্কৃতচর্চার ধারা যথাযথ
বয়ে নিয়ে চলি।
পূর্বাঞ্চল কল্যাণ আশ্রমের প্রারম্ভিক ইতিহাস
শক্তিপদ ঠাকুর
১৯৫২ সালের ২৬ ডিসেম্বর
মধ্যপ্রদেশের জশপুর নগরে (বর্তমানে
ছত্তিশগড়) জনজাতিদের জন্য শুরু হয়
বনবাসী কল্যাণ আশ্রম। প্রতিষ্ঠাতা রমাকান্ত
কেশব দেশপাণ্ডে নামের একজন আইনজীবী।
সবাই ডাকত বালাসাহেবজী বলে। সঙ্গে
ছিলেন প্রথমপূর্ণকালীন কার্যকর্তা মোরুভাউ
কেতকর’। জশপুরের তৎকালীন রাজাসাহেব
বিজয়ভূষণ সিংহ জুদেবজীর আনুকূল্যে ও
সহযোগিতায় কল্যাণ আশ্রমের কাজ থাকে।
ছাত্রাবাস, চিকিৎসাকেন্দ্র ও ভজনমণ্ডলী নিয়ে
কল্যাণ আশ্রম খুব ধীর গতিতে বিকশিত হতে
থাকে। সমাজের আর্থিক সহযোগিতার ওপর
সংস্থা চালানো ছিল কঠিন কাজ।
জশপুরনগরের সঙ্গে সঙ্গে আশ্রমের কাজ
বিহার ও ওড়িশায় শুরু হয়। এভাবেই
কোনোরকমে কল্যাণ আশ্রম এগোতে থাকে।
এসে পড়ে পড়ে জরুরি অবস্থার কাল। সঙ্ঘের
ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি হয়। কল্যাণ আশ্রমের
কার্যকর্তাদেরও গ্রেপ্তার করা হয়।
কংগ্রেসি গুণ্ডাদের হামলায় জশপুর
আশ্রম ক্ষতিগ্রস্ত হয়। রায়পুরে জেলে বসে
নিজের ছেলের মুখে এসব হামলার খবর
পেয়ে দেশপাণ্ডেজী বলেন, ‘আমি
বনবাসীদের হৃদয়ে কল্যাণ আশ্রম প্রতিষ্ঠা
করেছি। ওখান থেকে কেউ আমাকে সরাতে
পারবে না। ১৯৭৭-এ জরুরি অবস্থার
অবসানে বালাসাহেব দেশপাণ্ডেজী রাষ্ট্রীয়
স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের সরসঙ্ঘচালক বালাসাহেব
দেওরসজীর সঙ্গে দেখা করে আশ্রমের
পুনর্নির্মাণের জন্য সহযোগিতা প্রার্থনা করেন।
দুই বালাসাহেবজী পরস্পর আত্মীয় ছিলেন।
তাই দেওরসজী রসিকতা করে বলেন-
সারাদেশে কাজের বিস্তার করো। দেশপান্ডেজী
বললেন- জশপুরেই চালানো কঠিন হয়ে
উঠেছে। সারাদেশে কীভাবে হবে?
বালাসাহেব দেওরসজী সারাদেশে কিছু
প্রচারক দেবার পরিকল্পনা করেন। দেশের
পূর্বক্ষেত্রে কাজের বিস্তারের জন্য
পশ্চিমবঙ্গের প্রান্ত প্রচারক বসন্তরাওজী
ভট্টের নাম নিশ্চিত হয়। তৎকালীন
সরকার্যবাহ মাধবরাও মূলেজী তা ঘোষণা
করেন।
বসন্তদার সঙ্গে প্রথম থেকেই সহযোগী
হিসেবে যোগ দেন বিশ্বনাথ বিশ্বাস। বর্ধমানের
মদন মিত্র তখন সংস্কৃতে এমএ পাশ করেন।
তাঁর সঙ্গে পূর্ণকালীন কার্যকর্তা হিসেবে কাজ
করার কথা বলেন বসন্তদা। তারপর একদিন
খোঁজখবর নিয়ে পুরুলিয়া আসেন। পুরুলিয়ার
ব্যবসায়ী হীরামাল শর্মাজীকে নিয়ে বসন্তদা
বাগমুক্তি পৌঁছান। সঙ্গে ছিলেন বিশ্বনাথদা ও
মদনদা। স্থানীয় হাইস্কুলে তাঁরা যান। বসন্তদা
প্রধান শিক্ষক শ্রীমনোহর কুইরীর সঙ্গে
জনজাতিদের জন্য ছাত্রাবাস তৈরি করার কথা
বলেন। মাস্টারমশাই খুশি হন শুনে এবং
বিদ্যালয়ের করনিক নরেন্দ্র খাঁ-কে এ ব্যাপারে
সহযোগিতা করার দায়িত্ব দেন। নরেনদা
স্থানীয় সম্মিলনী ক্লাবে তাঁদের নিয়ে আসেন
এবং নাগরঞ্জন গাঙ্গুলীকে তাঁদের সঙ্গে
পরিচিত করান। নাগরঞ্জনদার পরামর্শে
অযোধ্যা পাহাড়ের কৃত্তিবাস মাহাতোর বাড়ি
যান সবাই। বাগমুণ্ডিতে ছাতাটাড় ময়দানের
পাশে কৃত্তিবাসবাবুর একটি কাঁচা দোতলা ঘর
ছিল। সেখানেই ছাত্রাবাস শুরু করার
পরিকল্পনা হয়, ইতিমধ্যে নভেম্বর মাসে
বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের আর একজন কৃতীছাত্র
নবকুমার সরকার পূর্ণকালীন হিসেবে
যোগদেন। পরবর্তী মকরসংক্রান্তিতে ছাত্রাবাস শুরু করার লক্ষ্যে ছাত্র সংগ্রহ করার কাজ শুরু
হয়।
১৯৭৮-এর মকরসংক্রান্তির দিনে
আনুষ্ঠানিকভাবে কল্যাণ আশ্রম, বাগমুণ্ডি
স্থাপিত হলো। এরপর ধীরে ধীরে বিভিন্ন
জেলায় কল্যাণ আশ্রমের বিস্তার হয়।
ছাত্রাবাসের সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসাকেন্দ্র শুরু হয়।
কার্যকর্তা বাড়তে থাকে। খরচও পাল্লা দিয়ে
বাড়তে থাকে। বেগুনকোদর (ঝালদা),
বান্দোয়ান, কুমারী, রাওতোড়া (বাঁকুড়া) ও
বীরভূমে ছাত্রাবাস শুরু হয়। পরে মেয়েদের
জন্য পুরুলিয়া শহরে নিবেদিতা ছাত্রীনিবাস
শুরু হয়। মেদিনীপুরের বেলপাহাড়ীতে
ছাত্রাবাস শুরু হয়। উত্তরবঙ্গের খড়িবাড়ীতে
ছাত্রাবাস শুরু হয়। কাজের বিস্তারের সঙ্গে
কার্যকর্তাও বাড়তে থাকে আর সমাজের
সহযোগিতাও বাড়তে থাকে। ১৯৭৮ সালেই
বসন্তদা অসম ও ত্রিপুরায় কল্যাণ আশ্রমের
কাজ শুরু করেন। ধীরে ধীরে উত্তর পূর্বাঞ্চলের
সমস্ত রাজ্যে কাজের বিস্তার হয়। এর মধ্যে
পশ্চিমবঙ্গের কল্যাণ আশ্রমের কাজের জন্য
সঙ্ঘ আরেকজন প্রচারক নিয়োগ করে-
রথীন্দ্রনাথ চক্রবর্তী। রথীনদা ছিলেন পূর্বাঞ্চল
কল্যাণ আশ্রমের প্রথম সংগঠন সম্পাদক।
১৯৮৭ সালে সঙ্ঘ প্রবীণ প্রচারক গজানন
বাপটজীকে আশ্রম কাজের জন্য দেয়।
ধীরে ধীরে আলাদা-আলাদা সেবাকার্য
শুরু হয়। কল্যাণ আশ্রমের বিভিন্ন আয়ামের
কাজ– ছাত্রাবাস, শিক্ষা, সংস্কার কেন্দ্র
শ্রদ্ধাজাগরণ, হিতরক্ষা, চিকিৎসা, ক্রীড়া এবং
বিবিধ গতিবিধি শুরু হয়ে যায়। মুর্শিদাবাদ,
বর্ধমান, হুগলী, নদীয়া যেখানে ছাত্রাবাস করা
সম্ভব হয়ে ওঠেনি সেখানে অন্যান্য গতিবিধির
মাধ্যমে কল্যাণ আশ্রম কাজ পরিচালনা করছে।
ইতিমধ্যে বসন্তদা আন্দামান ও সিকিমেও কাজ
শুরু করেন।
শিক্ষার দিক থেকে বনবাসী ক্ষেত্রে প্রভূত
বিকাশ হয়। শত শত ছেলে-মেয়ে সরকারি
চাকরি করে পরিবারের দায়িত্ব কাঁধে তুলে
নিয়েছে। শিকড়বাকড় আর ওঝা-বদ্যি যাদের
চিকিৎসার একমাত্র সাধন ছিল তারা
হাসপাতাল ও ডাক্তারের কাছে যাওয়াই শ্রেষ্ঠ
মনে করছে। নিজেদের ধর্ম, সংস্কৃতি ও
পরম্পরাকে যেখানে তুচ্ছ ভারত তারা আজ
তার বিকাশের জন্য কটিবদ্ধ হয়েছে।
খেলাধুলার ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গের জনজাতি
ছেলে-মেয়েরা ভীষণভাবে এগিয়ে এসেছে।
বনবাসী সমাজের ধর্ম, সংস্কৃতি, পরম্পরাকে
রক্ষা করে সমাজের বাকি লোকের সঙ্গে
নিজেদের যোগ্য করে তোলার প্রতিযোগিতা
সুন্দরভাবে এগোছে।
১৯৭৮ সালে পুরুলিয়ার বাগমুণ্ডি
ছাত্রাবাস থেকে ১৫-২০ বছরের মধ্যে সম্পূর্ণ
পূর্ব ভারতে কল্যাণ আশ্রমের কাজের বিস্তার
হয়। বনবাসী ক্ষেত্রে স্বাভিমান বোধ জাগানো
যেমন কিছু মাত্রায় সম্ভব হয়েছে তেমনই অধিক
মাত্রায় বনবাসীরা স্বাবলম্বী হয়ে উঠেছে।
কল্যাণ আশ্রমের প্রতিষ্ঠিতা বালাসাহেব
দেশপাণ্ডে বলতেন ‘বনবাসীর সর্বাঙ্গীন
বিকাশের অর্থ স্বাভিমানী ও স্বাবলম্বী বনবাসী
জাগরণ’। কল্যাণ আশ্রম এই লক্ষ্যে এগিয়ে
চলেছে।
সংযোজন আশীষ কুমার দাস।।
পশ্চিমবঙ্গে বনবাসী কল্যাণ আশ্রমের কাজ
স্বর্গীয় বসন্তদার (বসন্তরাও ভট্ট) মাধ্যমে
আরম্ভ হয় ১৯৭৮ সালে পশ্চিমবঙ্গের
পুরুলিয়া জেলার বাঘমুণ্ডিতে। সমগ্র উত্তর-পূর্ব
ভারতে শ্রদ্ধেয় বসন্তদাকে কল্যাণ আশ্রমের
স্থপতি বলা হয়।
প্রথম দিকে বঙ্গের বিশেষ করে
দক্ষিণবঙ্গের জনজাতি ছাত্রাবাস দিয়ে কাজ শুরু
হয়। ধীরে ধীরে গ্রামীণ বনবাসীদের সম্পর্ক ও
সহমতের ভিত্তিতে কাজের বিস্তার লাভ হয়।
উত্তরবঙ্গের সর্বপ্রথম শিলিগুড়ির অদূরে
নকশালবাড়ীর সন্নিকটে পাহাড়ীভিটায়
(খড়িবাড়ি) ১৯৮২ সাসে কল্যাণ আশ্রমের
কাজ আরম্ভ হয়। নকশাল নেতা কানু সান্যালের
বিচরণ ক্ষেত্র ছিল এই এলাকা। ভৌগোলিক
দিক দিয়েও ‘খড়িবাড়ী’র গুরুত্ব অপরিসীম,
একদিকে ‘নেপাল’ তো অন্যদিকে ‘বাংলাদেশ’
সীমানা বেশিদূরে নয়।
শিলিগুড়ি শহর উত্তর-পূর্বাঞ্চলের
প্রবেশদ্বার হওয়ার ‘বসন্তদা’ এখানে
জনজাতিদের সংগঠিত করার জন্য মনোনিবেশ
করেন, যার ফলশ্রুতিতে ১ জানুয়ারি ১৯৮৪
সালে খড়িবাড়ীতে কয়েকজন ছাত্র নিয়ে একটি
ছাত্রাবাস খোলা হয়। খড়িবাড়ির স্থান
নির্বাচনেও তাৎপর্য ছিল– এতো তো
আন্তর্জাতিক সীমান্ত নেপাল ও বাংলাদেশ
দ্বিতীয় কারণ জনজাতি ক্ষেত্রে নকশাল প্রভাব
হ্রাস। অনেক জনজাতি নেতা পরবর্তীকালে
কল্যাণ আশ্রমের কাজে প্রভাবিত হয়ে
নিজেদের ছেলেদের ছাত্রাবাসে ভর্তি করান।
উত্তরবঙ্গে কাজ দেখার জন্য দক্ষিণবঙ্গ
থেকে প্রথম পূর্ণকালীন হিসেবে গৌতমদা,
গৌতম কুমার নিয়োগীকে শিলিগুড়ি পাঠানো
হয়। পরবর্তীতে ডাঃ ভুবনমোহন মাইতি, ডাঃ
অশোক কুমার জানা এবং শক্তিপদ ঠাকুর
পর্যায়ক্রমে আসেন। বর্তমানে খড়িবাড়ি
ছাত্রাবাস যে স্থানে আছে তার ঠিক বিপরীত
দিকে রাস্তার ধারে ছোটো ছোটো দুটি খড়ের
ছাওনি দেওয়া ঘরে ছাত্রাবাস শুরু হয়। ঘর
দুটি ভাড়া দেন স্থানীয় জমিদার কুঞ্জমোহন রায়
সরকার। উল্লেখ্য এই কুঞ্জমোহন রায় সরকারের
স্ত্রী মানসী রায় সরকার বরিষ্ঠ প্রচারক মনমোহন
রায়ের সম্পর্কে বোন ছিলেন। কার্যকর্তাদের
ব্যবহার এবং কল্যাণ আশ্রমের কাজে প্রভাবিত
হয়ে কুঞ্জবাবু ব্যবহার এবং কল্যাণ আশ্রমের
কাজে প্রভাবিত হয়ে কুঞ্জবাবু আশ্রমকে ২ বিঘা
জমি দান করার প্রতিশ্রুতি দেন। ফলে ১৯৮৯
সালে বর্তমান ছাত্রাবাস ভবনটি নির্মিত এবং
পরবর্তীকালে এখানে ভব্য শ্রীরাম মন্দির এবং
মেডিক্যাল সেন্টার গড়ে উঠেছে।
স্থানীয় এলাকায় ভালো প্রাথমিক বিদ্যালয়
না থাকায় সরস্বতী শিশুমন্দিরের আদলে
১৯৯০ সালে খড়িবাড়িতে ৫ বিঘা জমির উপর
শিশু শিক্ষা কেন্দ্র নামে বিদ্যালয় স্থাপন করা
হয়। শক্তিদার উদ্যোগে যারা আচার্য প্রমুখ হন
স্থানীয় যুবক বিমল সিনহা। আশ্রমের স্থায়ী
দু’জন ডাক্তার- ভূবনদা, অশোকদা। গ্রামে
গ্রামে ঘুরে সম্পর্ক স্থাপন করে মেডিক্যাল কেন্দ্র স্থাপন করেন এবং স্বাস্থ্য সচেতনতা শিবির করতে থাকেন। খোলকুদ প্রতিযোগিতা। রক্ষাবন্ধন এবং বার্ষিক অনুষ্ঠান প্রভৃতি কার্যক্রম শহরবাসী এবং গ্রামবাসীদের মধ্যে সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে। সর্বস্তরে জাগরণ শুরু হয়, এক নতুন দিশা, নতুন ভাবধারা ছড়িয়ে পড়ে।
ছাত্রাবাসের ছাত্রদের বার্ষিক ফলাফল খড়িবাড়ী উচ্চ বিদ্যাসয়ে চর্চার বিষয়ে পরিণত হয় যখন প্রতিটি শ্রেণীতে ১-১০ এর মধ্যে জনজাতি ছাত্রদের স্থান থাকে। এমনকী প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থানও দখল করে। ফলে কল্যাণ আশ্রমের নাম চারিদিকে ছড়িয়ে যায়। অসাধ্য সাধন যাঁরা করছেন সেই কার্যকর্তাদের প্রতি সকলে আকর্ষিত হতে থাকে।
গৌতমদা প্রথম ২ বছরের মধ্যেই বিশেষ কারণে বাড়ি ফিরে আসেন হাল ধরেন শক্তিদা যাঁর সুযোগ্য নেতৃত্বে কল্যাণ আশ্রমের কাজ ডুয়ার্স অঞ্চল এবং পার্বত্য জেলা দার্জিলিং, কালিম্পং মালদহ বিভাগ ও দিনাজপুর বিভাগেও কাজ বিস্তৃত হয়। ১৯৯১ সালে তপন মজুমদারকে পার্বত্য বিভাগের দায়িত্ব দিয়ে পাঠানো হয় এবং প্রবোধ কুমার নন্দকে দায়িত্ব দেওয়া হয় দিনাজপুর বিভাগে।
অমলদা ১৯৯১ সালে ভাড়াবাড়িতে ‘সঙ্ঘমিত্রা ছাত্রী নিবাস’ শুরু করেন। পরবর্তীকালে নিজস্ব জমিতে বর্তমানে ছাত্রাবাস শুরু হয় সেবাসদন ১০ মাইল কালিম্পঙে। ১৯৯৩ সালে উদয়পুর রায়গঞ্জে মাতঙ্গিনী ছাত্রীনিবাসে কাজ শুরু হয়। ফলে দিনাজপুরে জনজাতি ছাত্রীবোনেদের শিক্ষার প্রতি আগ্রহ বৃদ্ধি পায় ডুয়ার্সে ও সমসামরিক সময়ে (১৯৯১) শ্রদ্ধাজাগরণ কেন্দ্র স্থাপনে এবং ঘরে ঘরে হনুমান ঝাণ্ডা উত্তোলন সমগ্র চা বাগান অঞ্চলে স্বাভিমান জাগানোর কাজ করে। শতাধিক বিস্তারকের (যুবক/যুবতী) যোজনার ফলে এলাকায় স্বধর্মের প্রতি আস্থা বৃদ্ধি পায়। বিশ্বনাথ দত্তকে এই বিভাগে পাঠানো হয়। ২০০৯ সালে ‘ভগত পাড়ায়’ (মাদারীহাট ব্লক) প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সঙ্গে আবাসিক ছাত্রাবাস শুরু হয়। পরবর্তীকালে ২০১১ সালে গয়ের কাটায় (ধূপগুড়ি ব্লকে) স্থানান্তরিত হয়। বর্তমানে ‘শ্রীরাম বনবাসী ছাত্রাবাস’ নামে নিজস্ব ভবন তৈরি হয়েছে।
শিলিগুড়ি শহরের অদূরে (মাত্র ৭ কিমি) মাটিগাড়া ব্লকের ‘শালবাড়ি’ প্রকল্প যেখানে
প্রায় ৩২ একর জমিতে দুটি প্রাথমিক বিদ্যালয় (বাংলা ও হিন্দি মাধ্যম) ১টা ক্রীড়া ছাত্রাবাস, চিকিৎসাকেন্দ্র, সেলাই প্রশিক্ষণ কেন্দ্র এবং ভব্য মন্দির বিরাজ করছে- এই প্রকল্পের জন্য তৎকালীন ক্ষেত্র সংগঠন সম্পাদক শ্যামজী গুপ্তা এবং জেলা সম্পাদক গোপীকৃষ্ণ আগরওয়ালের ভূমিকা স্মরণীয় হয়ে থাকবে। বিদ্যালয় স্থাপনার জন্য স্থানীয় জনজাতি যুবক বাণু ওরাওয়ের নামও উল্লেখযোগ্য।
২০২২ সালে দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার বুনিয়াদপুরের ‘বড়াইল’ গ্রামে সুকুমার রায়চৌধুরীর দান করা জমিতে ‘সুকুমার ছাত্রী নিবাস’ চালু হয়। সেখানে প্রাথমিক স্তরে ৫০ জন বালিকা পড়াশোনা করে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কাজ যেমন বেড়েছে, সেইমতো নতুন নতুন যুবা কার্যকর্তা কাজে যোগদান করে কাজকে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছে।
২০০৮/০৯ সালে অখিল ভারতীয় স্তরে সিদ্ধান্ত নিয়ে বঙ্গের কাজকে দু ভাগে ভাগ করা হয়: ১. পূর্বাঞ্চল কল্যাণ আশ্রম দক্ষিণবঙ্গ এবং বনবাসী কল্যাণ আশ্রম উত্তরবঙ্গ দক্ষিণবঙ্গে সংগঠন সম্পাদক থাকেন চক্রধর সরেন, সহকারী শ্রী মহীতোষ গোল এবং উত্তরবঙ্গে সংগঠনের দায়িত্ব দেওয়া হয় ডাঃ অশোক জানাকে। উত্তরবঙ্গের ভৌগোলিক সীমারেখা দক্ষিণে মালদহ আর উত্তরে পার্বত্য অঞ্চল দার্জিলিং, কালিম্পং জেলা মাখানে বিস্তীর্ণ এলাকা তরাই ডুয়ার্স তথা জলপাইগুড়ি, আলিপুরদুয়ার ও কোচবিহার জেলা। চা-বাগান এলাকায় জনজাতির একটা বিশাল অংশ বসবাস করে। মোট সাংগঠনিক ৯টি জেলাতেই কল্যাণ আশ্রমের কাজ বিস্তৃত হায়েছে। যেখানে মোট জনজাতির সংখ্যা প্রায় ১৫ লক্ষাধিক। (৮ শতাংশ) বঙ্গের মোট ৪২ প্রকার জনজাতির মধ্যে উত্তরবঙ্গে প্রায় ৩৮ প্রকার জনজাতির বসবাস করছে। প্রায় প্রতিটি জেলার সঙ্গে আন্তর্জাতিক সীমা থাকায় চোরাচালান, শিশু ও মহিলা পাচার-সহ সমাজ বিঘটনকারী শক্তি খ্রিস্টান এবং মুসলমানদেরও দ্রুত গতিতে বৃদ্ধি বিভিন্ন সমস্যার সৃষ্টি করছে।
কাজের পরিনাম: ১৯৮৪ সালে উত্তরবঙ্গে কল্যাণ আশ্রমের কাজ যখন শুরু হয় তখন ‘খড়িবাড়ি, পানীশালি।’ অঞ্চলে নকশাল আন্দোলন যথেষ্ট সক্রিয় ছিল। অনেক জনজাতি নেতা নকশাল আন্দোলনের সঙ্গে
যুক্ত হয়ে যায়, অন্যদিকে পার্বত্য ক্ষেত্রে (দার্জিলিং, কার্শিয়ান, কালিম্পং) মূলত নেপালী ভাষা জনজাতিরা ব্যাপকভাবে ধর্মান্তরিত হয়ে যায়- তাদের মধ্যে লেপচা, ভূটিয়া, রাই ও লিম্বু উল্লেখযোগ্য। ডুয়ার্সে চা-বলয় এলাকায় ওঁরাও মুন্ডা, খেরিয়া,
মেচ-এরাও খ্রিস্টানের অধীনে চলে যায়। এমতাবস্থায় কল্যাণ আশ্রমের কাজের ফলে নকশাল সমস্যা দূরীভূত হয়। পার্বত্য ক্ষেত্রে সতত সম্পর্ক ও কাজের পরিনামে লেপচা জনজাতির মধ্যে ধর্মান্তরণ বন্ধের দিকে এগুচ্ছে
এবং পরাবর্তন শুরু হয়ে গেছে অর্থাৎ একমুখী প্রবাহ বন্ধ হয়। অনুরূপভাবে ডুয়ার্সে শ্রদ্ধাজাগরণ কেন্দ্র, শ্রীরামনবমী উৎসব, ঘরে ঘরে হনুমান ঝাণ্ডা বিতরণ প্রভৃতি কার্যক্রমের ফলে জনজাতি সমাজ জাগ্রত ও স্বাভীমানী হয়ে নিজ সংস্কৃতি রক্ষার জন্য কার্যকর্তা হিসেবে যোগদান করে। ফলে মিশনারি ও অন্য বিঘটনকারী শক্তি অনেকাংশে কমেছে। সমতলে মালদা ও দিনাজপুরে সাঁওতাল ও অন্য জনজাতিদের মধ্যে জাগরণের জন্য কল্যাণ আশ্রম সতত প্রয়াসরত। ২০২১ সালে মালদা জেলার ‘কোটালহাটী’ নিবাসী শ্রীমতী কমলা সরেনের শিক্ষা এবং স্বধর্মরক্ষার জন্য পদ্মশ্রী পুরস্কার প্রাপ্তি একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা যিনি কল্যাণ আশ্রমের একজন কার্যকর্তা হিসাবে দীর্ঘদিন যুক্ত আছেন। উত্তরবঙ্গে মাদারীহাট ব্লকে একমাত্র টোটোপাড়ায় পিভিটিজি অর্থাৎ অতি দুর্বল জনজাতি গোষ্ঠীর মধ্যে কল্যাণ কাজ শুরু করে, যার পরিনামে ধনঞ্জয় টোটো উত্তরবঙ্গ বিশ্ব বিদ্যালয় থেকে এমএলআইবি ডিগ্রি অর্জন করেন। অরুণ টোটা বর্তমানে পুলিশ বিভাগে কার্যরত কল্যাণ আশ্রমের ছাত্রাবাসে পড়াশোনা করে এবং খেলাধূলার মাধ্যমে বর্তমানে ১৮-২০ জন বিভিন্ন বিভাগে কর্মরত। চার শতাধিক (৪০০ অধিক) প্রকল্পের মাধ্যমে সতত সম্পর্ক ও কাজের বিস্তার চলছে। উত্তরবঙ্গে ৩২ প্রকার
জনজাতি কাজের সঙ্গে যুক্ত আছে। বহুবিধ সমস্যাযুক্ত উত্তরবঙ্গে কল্যাণ আশ্রমের কাজকে অধিক গতি দেওয়া আবশ্যক। শিক্ষিত, দক্ষ যুবা কার্যকর্তা গতিকে ত্বরান্বিত করবে। প্রকৃতি মায়ের প্রিয় আত্মভোলা জনজাতি সমাজের জন্য তন, মন ও ধন দিয়ে কাজ করার আহ্বান জানাই।
পশ্চিমবঙ্গে রাষ্ট্র সেবিকা সমিতির অগ্রগতির ইতিহাস
মৌসুমী কর্মকার
স্বাধীনতা প্রাপ্তির প্রায় দেড়দশক আগে
ভারতবর্ষে মেয়েদের অবস্থানটা চিন্তিত করে
তুলেছিল এক মরাঠি গৃহবধূকে। কীভাবে
ঘটবে সুপ্ত নারীশক্তির স্ফুরণ? তারই পথ
খুঁজতে খুঁজতে দেখা মিলেছিল এক
রাষ্ট্রভাবনায় ওতপ্রোত তেজস্বী পুরুষ ডাঃ
কেশব বলিরাম হেডগেওয়ারের। তাঁরই
নির্দেশিত পথে, তাঁরই অনুপ্রেরণায় প্রতিষ্ঠা
হয়েছিল বিশ্বের সর্ববৃহৎ নারী সংগঠনের।
১৯৩৬ সাল। মহারাষ্ট্রের ওয়ার্ধার সেই
সাধারণ গৃহবধূ বন্দনীয়া লক্ষ্মীবাঈ কেলকর
তাঁর সুগভীর দূরদৃষ্টি আর অতুলনীয়
সাংগঠনিক প্রতিভায় শুরু করলেন এদেশের
মেয়েদের সার্বিক বিকাশের মাধ্যমে সংগঠিত
করার কাজ-গড়ে উঠল রাষ্ট্র সেবিকা
সমিতি। ক্রমে সমিতির শাখা মহারাষ্ট্রের সীমা
ছাড়িয়ে বিস্তৃত হতে লাগল দেশের অন্যান্য
রাজ্যেও।
তবে পশ্চিমবঙ্গে সমিতির কাজের সূচনা
হয় তারও তিনদশক পরে। মহারাষ্ট্রেরই আর
এক বিদুষী কন্যা বাসন্তী রাস্তে, বিবাহসূত্রে
কলকাতায় মরাঠি স্বয়ংসেবক শ্রীযুক্ত বসন্ত
বাপটের গৃহিণী রূপে বাসন্তী বাপট হয়ে
গেলেন। ছোটোবেলা থেকেই সক্রিয় সেবিকা
হিসেবে সমিতির সংস্কারে বেড়ে ওঠা
বাসন্তীদির মন-প্রাণ জুড়ে ছিল সংগঠন। সুদূর
বাসন্তী বাপট
মহারাষ্ট্র থেকে পশ্চিমবঙ্গে এসে বাংলাভাষা
শেখা, সাহিত্য পাঠ—এসব কিছুর
অনুশীলনের মধ্য দিয়ে তিনি যে শুধুমাত্র বঙ্গ
সমাজে প্রবেশাধিকার পেলেন তাই নয়,
পোশাক-পরিচ্ছদ এমনকী গৃহসজ্জাতেও হয়ে
উঠলেন আদ্যোপান্ত বাঙ্গালি।
১৯৬৭ সালে টালিগঞ্জের মুদিয়ালীতে
তাঁর ভাড়া বাড়িতেই তিনি শুরু করলেন
সমিতির কাজ। সঙ্ঘ কার্যকর্তাদের পারিবারিক
সম্পর্কের সূত্রেই শ্রীমতী মহুয়া ধর, প্রতিমা
লাখে, সুধা গোডসে, কৃষ্ণা সোনী-সহ আরও
কয়েকজন পরিচিত মহিলা এবং বৈশাখী ও
মঞ্জু নামের দুই তরুণীকে নিয়ে শুরু হলো
সমিতির শাখা। শাখার কাজ সুষ্ঠুভাবে
চালানোর জন্য বাসন্তীদি বৈশাখীকে দিল্লির
প্রশিক্ষণ শিবিরে পাঠান।
এরপর পশ্চিমবঙ্গে সমিতিকে সুদৃঢ়
ভিত্তির ওপর দাঁড় করানোর জন্য ১৯৬৯
সালের মে মাসে ১৫ দিনের গ্রীষ্মকালীন
প্রশিক্ষণ শিবিরের আয়োজন করেন দরগা
রোডে মহাদেবী বিড়লা বালিকা বিদ্যালয়ে।
ওই শিবিরে সর্বাধিকারী রূপে যোগ দেওয়ার
জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয় হাওড়ার রামকৃষ্ণ
সারদা বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা তথা
সঙ্ঘ কার্যকর্তা শ্রী কালিদাস বসুর স্ত্রী শ্রীমতী
প্রতিমা বসুকে। নাগপুর, ভিলাই, অসম-সহ
বেশ কয়েকটি স্থান থেকে শিক্ষিকারা আসেন
এবং পশ্চিমবঙ্গ ও অসম মিলে মোট ৭৫ জন
শিক্ষার্থী প্রশিক্ষণ নেন। শিবিরের সমারোপে
সমিতির প্রতিষ্ঠাত্রী বন্দনীয়া মৌসিজীর
উপস্থিতি এবং তৎকালীন সঙ্ঘের
সরসঙ্ঘচালক শ্রীগুরুজীর শিবির পরিদর্শনে
শিবির এক অনন্য মাত্রা লাভ করে।
এরপর পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন স্থানে
সমিতির নতুন নতুন শাখা শুরু হতে থাকে।
প্রশিক্ষিত সেবিকারা মহা উৎসাহে কার্যবিস্তারে
নেমে পড়েন। উত্তর কলকাতার টালা অঞ্চলে
অর্চনা কুণ্ডু ও মিতা চট্টোপাধ্যায়ের সুদক্ষ
পরিচালনায় ৬০-৭০ জন সেবিকাকে নিয়ে
দৈনিক শাখা শুরু হয়। হাওড়ার পঞ্চানন তলায়
ভারতী দাসের নেতৃত্বে ৪০-৫০ জনের দৈনিক
শাখা চলতে থাকে। ক্রমে কলকাতা-সহ বিভিন্ন
জেলায় শাখা শুরু হয়। উত্তরবঙ্গের মালদহ
শহরে শ্রীমতী মাধুরী চৌধুরী এবং কলিগ্রামে
প্রণতি গোস্বামীর উদ্যোগে শাখা শুরু হয়।
মালদা শহরেরই শ্রীমতী বন্দনা রায়
উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় শাখা বাড়ানোর
কাজে আত্মনিয়োগ করেন। এইসময় বাসন্তীদি,
প্রতিমাদি, বৈশাখীদি, আরতীদি, অজন্তাদি
বিভিন্ন স্থানে সেবিকাদের ৩ দিন বা ৫ দিনের
প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যবস্থা করেন। কলকাতার
বড়বাজার অঞ্চলে কুসুম মাহেশ্বরী ও ললিতা
লুন্ডিয়ার পরিচালনায় বেশ কয়েকটি শাখা শুরু
হয়। বর্ধমানে যুথিকা চৌধুরী ও অনুভা পাল,
বীরভূমের মল্লারপুরে শীলা ব্যানার্জি, নবদ্বীপে
লেখা গোস্বামী, মিহিজামে জ্যোৎস্না ওঝা এবং
আসানসোলে কৃষ্ণা ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে
সমিতির কাজ উৎসাহের সঙ্গে চলতে থাকে।
পরের বছর ১৯৭০ সালে কলকাতায়
শিবির করা সম্ভব না হওয়ায় বিহারের ঝরিয়ায়
বেশ কয়েকজন সেবিকাকে প্রশিক্ষণে পাঠানো
হয়। সঙ্গে বাসন্তীদি, প্রতিমাদি, কমলাদি যান।
এই সময় থেকে পশ্চিম বঙ্গের তৎকালীন
প্রান্তসঙ্ঘচালক শ্রদ্ধেয় কেশব চন্দ্র চক্রবর্তী
(মাস্টার মশাই)-এর জ্যেষ্ঠা কন্যা ঋতা
চক্রবর্তী সমিতির কাজে সক্রিয় হয়ে ওঠেন।
১৯৭০ থেকে ৭৫ এই সময়কালে প্রতিমাদি
ও ঋতাদির ব্যাপক ভ্রমণ এবং সম্পর্ক স্থাপনের
ফলে উত্তরবঙ্গ-সহ রাজ্যের বিভিন্ন জেলায়
সমিতির অনেক শাখা তৈরি হয়।
ইতিমধ্যে পশ্চিমবঙ্গে শুরু হয় সর্বনাশা
নক্শাল আন্দোলন। এই অবস্থায় শাখার
কাজের গতি কিছুটা স্তিমিত হয়। তবুও যেখানে
সম্ভব সেখানে শাখা চলত, কিন্তু ওই
পরিস্থিতিতে মেয়েদের শিবির করা একেবারেই
নিরাপদ ছিল না। ফলে স্থানীয়ভাবে কোথাও
কোথাও ২-৩ দিনের শিবির হয়।
এই আতঙ্কের অবস্থা কাটতে না কাটতেই,
জারি হলো চরম দুর্ভাগ্যজনক জরুরি অবস্থা।
১৯৭৫ এর জুন মাস। চারিদিকে ধরপাকড়
চলতে থাকে, সংবাদপত্রের কন্ঠরোধ হয়,
জনজীবন একেবারে মূক হয়ে যায়। রাষ্ট্রীয়
স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের অনেক কার্যকর্তা কারারুদ্ধ
হন। এই ভয়াবহ অবস্থার মধ্যে শাখা বন্ধ
হলেও ঘরে ঘরে কয়েকজন মিলে প্রার্থনা করা
চলতে। সেবিকারা কারারুদ্ধ সঙ্ঘ কার্যকর্তাদের
পরিবারের যথাসাধ্য খোঁজখবর নিতেন।
এইভাবেই সমিতির সঙ্গে সম্পর্কিত হন
কারারুদ্ধ অসীম মিত্রের স্ত্রী শ্রীমতী মায়া মিত্র।
পরে তিনি সমিতির একজন সক্রিয় কার্যকর্ত্রী
হয়ে ওঠেন। এত কঠিন পরিস্থিতির মধ্যেও
সমস্ত বিধিনিষেধ উপেক্ষা করে বাসন্তীদির
উৎসাহে ‘বন্দেমাতরম’-এর শতবর্ষ পালিত
হয়। এজন্যে সমিতি ‘নিবেদিতা সঙ্ঘ’ নাম
দিয়ে মানিকতলার কাছে জয়সোয়াল
বিদ্যামন্দিরে ‘আনন্দমঠ’ নাটকটি মঞ্চস্থ করে।
সব সংগঠনই জরুরি অবস্থার অবসানের
জন্য সচেষ্ট হয়। কেন্দ্রীয় স্তরে সমিতির পক্ষ
থেকে সেবাগ্রামে আচার্য বিনোবা ভাবের সঙ্গে
সাক্ষাৎ করে এক প্রতিবেদন দেওয়ার সিদ্ধান্ত
নেওয়া হয়। ওই অভিযানে পশ্চিমবঙ্গ থেকে
আরতী নন্দীও যোগ দেন।
১৯৭৬ সালে আরতী নন্দী, তুতুন নন্দী,
নন্দিতা চক্রবর্তী, অজন্তা মজুমদার, কুসুম
মাহেশ্বরী, ললিতা লুন্ডিয়া-এই ছয়জনকে
নাগপুরের প্রশিক্ষণ শিবিরে পাঠানো হয়।
পরের বার ১৯৭৯-তেও প্রতিমা লাখে, মীরা
লাহিড়ী, উজ্জ্বলা ভড়, কনক ব্যানার্জি, গৌরী
চক্রবর্তী, সঙ্ঘমিত্রা বর্ধন এবং অনিতা
বাগেড়িয়াকে প্রশিক্ষণের জন্য নাগপুরে
পাঠানো হয়।
জরুরি অবস্থার অবসানের পর ১৯৭৮
সালে হাওড়ার লিলুয়ায় পূজার ছুটিতে সমিতি
৩ দিনের শিবিরের আয়োজন করে।
সর্বাধিকারী ছিলেন কমল চক্রবর্তী (সঙ্ঘ
কাযকর্তা জ্যোতির্ময় চক্রবর্তীর সহধর্মিণী)।
এই শিবিরও ধন্য হয় বন্দনীয়া মৌসিজীর
পদার্পণে। তবে এটাই ছিল তাঁর পশ্চিমবঙ্গে
শেষবারের মতো আসা। ১৯৭৮ সালের
নভেম্বরেই মৌসিজী অমৃতলোকে যাত্রা
করেন।
এরপর থেকে প্রতিবছরই পশ্চিমবঙ্গে
সমিতি ১৫ দিনের গ্রীষ্মকালীন শিবির এবং ৫
দিনের শীতকালীন শিবিরের ব্যবস্থা করে।
প্রথম দিকে প্রতিবারই নাগপুর থেকে
শিক্ষিকারা আসতেন, আর এখানকার
প্রশিক্ষিত সেবিকারা তাঁদের সঙ্গে থাকতেন
সহশিক্ষিকা রূপে। ক্রমে এখানকার
সেবিকারাও স্বাবলম্বী হয়ে ওঠেন এবং ১৯৮০
থেকে ললিতা লুন্ডিয়া, গৌরী চক্রবর্তী, সোমা
চক্রবর্তী, কুসুম মাহেশ্বরী, নন্দিতা চক্রবর্তী,
পুতুল চট্টোপাধ্যায়, উজ্জ্বলা ভড়, কনক
ব্যানার্জি, সঙ্ঘমিত্রা বর্ধন- শিক্ষিকা এদের
দায়িত্বে এবং মূলত বাসন্তীদির পরিচালনায়
শিবিরগুলি উৎসাহের সঙ্গে চলতে থাকে।
শিক্ষিকাদের মধ্যে নন্দিতাদি ও পুতুলদি ছিলেন
সুগায়িকা, শিবিরে শিক্ষার্থীদের নানারকম গান
শেখানোর দায়িত্ব থাকত এঁদের উপরেই।
১৯৭৮-এর শিবিরের পরে কাজের
বিস্তারের সুবিধার্থে পশ্চিমবঙ্গকে উত্তরবঙ্গ ও
দক্ষিণবঙ্গ দুই প্রান্তে বিভক্ত করা হয়।
উত্তরবঙ্গে প্রান্ত পালকের দায়িত্ব পান
মালদহের মাধুরী চৌধুরী এবং কার্যবাহিকার
দায়িত্ব নেন শ্রীমতী বাসন্তী বাপট। অন্যদিকে
দক্ষিণবঙ্গে প্রান্ত পালকের দায়িত্ব পান শ্রীমতী
প্রতিমা বসু এবং কার্যবাহিকার দায়িত্ব পান
শ্রীমতী মহুয়া ধর। বৌদ্ধিক প্রমুখ ঋতা
চক্রবর্তী, নিধি প্রমুখ কমল চক্রবর্তী, শারীরিক
প্রমুখ সংঘমিত্রা বর্দ্ধন এবং গীত প্রমুখ নন্দিতা
চক্রবর্তী- এরূপ প্রান্ত টোলি তৈরি হয়।
১৯৮২ সালে ঝাঁসীর রাণি লক্ষ্মীবাঈয়ের
১৫০ তম জন্মজয়ন্তী উপলক্ষ্যে দক্ষিণ
কলকাতার মহারাষ্ট্র নিবাস হলে এক
স্মরণোৎসবে রানির নামাঙ্কিত নাটক
মহাসমারোহে মঞ্চস্থ হয়। ভারতের বিভিন্ন
প্রদেশের লোকনৃত্যও পরিবেশিত হয়। এই উপলক্ষ্যেই বড়বাজারে ‘জাগে নারী জাগে
দেশ’ নামে স্মরণিকা উন্মোচন এবং ঝাঁসীর
রানির জীবনী সংবলিত চিত্র প্রদর্শনীর ব্যবস্থা
হয়। অনুষ্ঠানে কেন্দ্র থেকে লীলাতাঈ
বাকনকর এবং প্রমীলাতাঈ মেঢ়ে উপস্থিত হন।
১৯৮৯ সালে মালদহে শ্রীমতী বন্দনা
রায়ের পরিচালনায় পশ্চিমবঙ্গে সেবিকা
সমিতির সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। বন্দনীয়া
ঊষাতাঈ চাটী ও মাঃ কুসুমতাঈ শাঠে উপস্থিত
ছিলেন। বাসন্তীদির পরিচালনায় ঘোষ সহ চার
শতাধিক সেবিকার পথসঞ্চলন হয়।
১৯৯২ সালে ভগিনী নিবেদিতার ১২৫
তম জন্মজয়ন্তী উপলক্ষ্যে সমিতির উদ্যোগে
কলকাতার সুবোধ মল্লিক স্কোয়ারে তিনদিন
ব্যাপী অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
নিবেদিতার জীবনী সংবলিত চিত্র প্রদর্শনী সহ
স্বদেশী মেলারও আয়োজন করা হয়। ভগিনী
নিবেদিতার কর্মজীবন ভিত্তিক বিভিন্ন রচনার
সংকলনে স্মরণিকা ‘কস্তুরী’ প্রকাশিত হয়।
তিনদিন ব্যাপী সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের
বিভিন্ন সময়ে সমিতির দ্বিতীয় প্রমুখ সঞ্চালিকা
বন্দনীয়া সরস্বতীতাঈ আপটে, প্রমীলাতাঈ
মেঢ়ে এবং সস্ত্রীক লালকৃষ্ণ আদবানীজীও
উপস্থিত হন। সত্যানন্দ সেবায়তনের মাতাজী
অর্চনাপুরী মায়ের উদাত্ত কণ্ঠে ‘বন্দেমাতরম্’
সঙ্গীত পরিবেশন সকলকে উদ্বুদ্ধ করে।
এছাড়া ২৮ জানুয়ারি নিবেদিতার জন্মদিনে
সেবিকারা পথ সঞ্চলন করে বাগবাজারে
নিবেদিতার বসতবাড়িতে যান শ্রদ্ধা জানাতে।
উত্তরবঙ্গের মালদহেও এই উপলক্ষ্যে
একটি বর্ণাঢ্য পথ সঞ্চলনের আয়োজন করা
হয়। পরে ভগিনী নিবেদিতার একটি মর্মরমূর্তি
স্থাপিত হয় মালদহে। বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মধ্য
দিয়ে কলকাতা, মালদহ, শিলিগুড়ি ও
দার্জিলিঙে নিবেদিতার সমাধিস্থলে কয়েকটি
মহতী সভার আয়োজন করা হয়।
১৯৯৩ সালটি পশ্চিমবঙ্গ সমিতির পক্ষে
অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক ও বিষাদময়। দুরারোগ্য
ব্যাধি কেড়ে নেয় সমিতির প্রাণস্বরূপা
বাসন্তীদির প্রাণ। তাঁর অকালপ্রয়াণে
পশ্চিমবঙ্গে সমিতি একপ্রকার দিশাহারা হয়ে
পড়ে। তবুও এই ধাক্কা সামলে উঠে তাঁর
আদর্শকে সামনে রেখে চলতে থাকে সমিতির
কাজ। ১৯৯৬ সালে সমিতির ৬০ বছর
পূর্তিতে দশ হাজার সেবিকার সম্মেলন হয়
দিল্লিতে-সেখানে পশ্চিমবঙ্গ থেকে অনেক
সেবিকা যোগ দেন।
১৯৯৭ সাল নেতাজীর জন্ম শতাব্দীবর্ষ।
২৩ জানুয়ারি সেবিকারা সকালে ও বিকালে
পৃথকভাবে দুইটি বর্ণময় পথ সঞ্চলন করে
ময়দানে সঙ্ঘের সভায় যোগদান করে।
১৯৯৯ সালে কলকাতার গোয়াবাগান
অঞ্চলে ত্রিবেণী কমপ্লেক্সে সমিতির প্রান্ত
কার্যালয় নির্মাণ হয়। তৎকালীন প্রমুখ
সঞ্চালিকা বন্দনীয়া ঊষাতাঈজী ও মাননীয়া
প্রমীলাতাঈজীর উপস্থিতিতে গৃহপ্রবেশ
অনুষ্ঠান হয়। বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয়
রেখা পালের নাম। ১৯৮৯ সালে প্রথম বর্ষ
প্রশিক্ষণ নেওয়ার পরে তিনি সমিতির কাজে
বেশ সক্রিয় হয়ে ওঠেন। নতুন কার্যালয়
নির্মাণের পরে রেখাদি বেশ দক্ষতার সঙ্গে
কার্যালয়ের বিভিন্ন দায়িত্ব সামলাতে থাকেন।
পরে তাঁকে প্রান্ত কার্যালয় প্রমুখের দায়িত্ব দিলে
প্রচারিকা না হয়েও প্রচারিকার মতোই সমিতির
কাজ করতে থাকেন। এই সময় থেকে রেখাদির
তত্ত্বাবধানে কার্যালয়ে একটি ছাত্রীবাস গড়ে
ওঠে। কার্যালয়ের দায়িত্ব পালন ছাড়াও রেখাদি
অত্যন্ত সুচারুরূপে সম্পর্ক স্থাপনের কাজ
করতেন।
সোমনাথ মন্দির পুনঃনির্মাণের সুবর্ণ
জয়ন্তী উপলক্ষ্যে সমিতির উদ্যোগে
সোমনাথের ইতিহাস সংবলিত একটি পুস্তিকা
প্রকাশিত হয়। এছাড়াও সমিতির সম্বলিত
একটি পুস্তিকা প্রকাশিত হয়। এছাড়াও
সমিতির প্রকাশনা বিভাগের প্রচেষ্টায় বিভিন্ন
ছোটো ছোটো পুস্তিকা বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত
হয়েছে। যেমন- কর্মযোগিনী মৌসিজী,
নীলকণ্ঠ মূকনায়ক, ভগিনী নিবেদিতা,
বন্দেমাতরম্, বাংলায় সমিতির আচার পদ্ধতি,
গানের সংকলিত বই অর্ঘ্য, সংস্কার কণিকা,
জীবনের নানাক্ষেত্রে মৌসিজী, অগ্নিযুগের
বঙ্গললনা ইত্যাদি। পরবর্তীতে সেবিকা
প্রকাশনের সুবর্ণ জয়ন্তীতে পঞ্চাশ জন বঙ্গ
মহীয়সী নারীর জীবনী নিয়ে ‘বরণীয়াদের
পদপ্রান্তে’ নামক গ্রন্থটি ২০০৩ সালে
উন্মোচিত হয়। বন্দনীয়া মৌসিজীর
জন্মশতবর্ষে তাঁর অবদানের, তাঁর কীর্তির প্রতি
শ্রদ্ধার্ঘ্য স্বরূপ সেবিকা প্রকাশণের গবেষণাধর্মী
অনন্য প্রকাশণা দ্বিশতাধিক বাঙ্গালি মহিলার
সংক্ষিপ্ত জীবনী ও কর্মপ্রবাহ নিয়ে সংকলিত
গ্রন্থ ‘বঙ্গনারীর চরিতকোষ’।
২০০৫, মৌসিজীর জন্মশতাব্দীতে নানা
কার্যক্রমের যোজনা নেওয়া হয়। তৎকালীন
সহ-প্রমুখ সঞ্চালিকা মাননীয়া প্রমীলাতাঈ
মেঢ়ে মৌসিজীর জীবন ও কার্যধারার ব্যাপক
প্রচারের জন্য সমস্ত ভারতে ১০৮ টি স্থানে
তাঁর জীবনী সংবলিত এক ভ্রাম্যমাণ চিত্র
প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করেন। শিলিগুড়ি ও
কলকাতায় মহারাষ্ট্র নিবাস হলে সেই প্রদর্শনীর
ব্যবস্থা করা হয়। কেন্দ্র থেকে সুশীলা মহাজন
মৌসিজীর জীবনপটের যে চলচ্চিত্র নির্মাণ
করেন তা দূরদর্শনে প্রচারিত হয় এবং তার
সিডি ক্যাসেটের উন্মোচন হয় কলকাতায়।
বিভিন্ন সময়ে কেন্দ্র থেকে কয়েকজন
প্রচারিকা পাঠানো হয় পশ্চিমবঙ্গে সমিতি
কাজের বিস্তারের জন্য। তবে মৌসিজীর
জন্মশতাব্দী উপলক্ষ্যে ২০০৪ থেকে ডালিয়া
পুরকাইত নামে একজন সেবিকা দক্ষিণবঙ্গে
প্রচারিকা হিসেবে কাজ করে অনেকটাই
কাজের বিস্তার ঘটান।
২০০৯ সাল। অমৃতলোকে চলে গেলেন
শ্রীমতী প্রতিমা বসু। তাঁর প্রয়াণে বিশেষভাবে
ক্ষতি হলো প্রকাশনা বিভাগের। বাংলায় যা
কিছু সাহিত্য প্রকাশিত হয়েছিল তার মূল
উদ্যোক্তা ছিলেন প্রতিমাদি। নিজেও ছিলেন
সুলেখিকা। বেশ কিছু বাংলা গান রচনা
করেছিলেন সমিতির জন্য। তার মধ্যে ‘শোন
শোন সেবিকা বোন’ এবং ‘ছোট ছোট দীপ
মোরা’ সেবিকাদের অত্যন্ত প্রিয়।
প্রান্ত সঞ্চালিকার স্থানটি শূন্য হয়ে
যাওয়ায় উত্তরবঙ্গের রায়গঞ্জ নিবাসী সুশ্রী
মুক্তিপ্রদা সরকারকে দায়িত্ব দেওয়া হয়।
উল্লেখ্য, শ্রদ্ধেয়া বাসন্তীদির প্রয়াণের পর
পৃথক প্রান্ত হিসেবে উত্তরবঙ্গের কাজ কিছুটা
স্তিমিত হয়ে পড়ে। তখন মালদহের বন্দনাদির
অনুরোধে দক্ষিণবঙ্গ প্রান্ত টোলির সিদ্ধান্তে
আবার পশ্চিমবঙ্গ নামে একটি প্রান্তে পরিণত
হয়। এর পূর্বে দক্ষিণবঙ্গের প্রান্ত টোলিতে কিছু
পরিবর্তন হয়।
ঋতাদিকে প্রান্ত সহ কার্যবাহিকার দায়িত্ব
দেওয়া হয় এবং মায়া মিত্র দিদিকে প্রান্ত
বৌদ্ধিক প্রমুখের দায়িত্ব দেওয়া হয়। মুত্তিদিকে
প্রান্ত সঞ্চালিকার দায়িত্ব দেওয়ার পর,
মহুয়াদিকে প্রান্ত কার্যবাহিকা থেকে ক্ষেত্র
কার্যবাহিকার দায়িত্ব দেওয়া হয় এবং তাঁর স্থানে
ঋতাদিকে প্রান্ত কার্যবাহিকার দায়িত্ব দেওয়া
হয়। সহ-কার্যবাহিকা হন মৌসুমী কর্মকার।
বৌদ্ধিক প্রমুখ মায়া মিত্র এবং সহ বৌদ্ধিক
প্রমুখ শ্রীমতী শিবাণী চট্টোপাধ্যায়।
২০১০ সালে বন্দনীয়া তাঈজী (দ্বিতীয়
প্রমুখ সঞ্চালিকা, সরস্বতীতাঈ আপটে)-র জন্ম
শতাব্দী সম্মেলনে পশ্চিমবঙ্গ সহ অসম,
ওড়িশা ও বিহারের সেবিকারাও অংশগ্রহণ
করেন। অন্তিম দিনে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের
সরসঙ্ঘচালক মোহন ভাগবতের উপস্থিতি
সেবিকাদের মধ্যে উদ্দীপনার সঞ্চার করে। এই
সম্মেলনে সর্বাধিক আকর্ষণীয় ছিল প্রায়
এগারশো সেবিকার ঘোষ-সহ পথ
সঞ্চলন।
ঋতাদি একাধারে বিদ্যাভারতী এবং
সমিতির দায়িত্ব পালন করতে থাকেন।
মুক্তিদির প্রচুর ভ্রমণের ফলে সমিতির কাজে
গতি আসে। ২০১২ সালে বিদ্যার্থী বিস্তারিকা
সুশ্রী নমি সরকারকে প্রান্ত প্রচারিকার দায়িত্ব
দেওয়া হয়। সব মিলিয়ে পশ্চিমবঙ্গের জেলায়
জেলায় সমিতির কাজের বেশ প্রসার ঘটতে
থাকে। প্রতি বছরই ৭ দিনের প্রারম্ভিক বর্গ
এবং ১৫ দিনের প্রথমবর্ষ-সহ দ্বিতীয়বর্ষ
প্রশিক্ষণ বর্গের ব্যবস্থা করা হতে থাকে।
২০১২ সালে পশ্চিমবঙ্গে সমিতির
অখিল ভারতীয় বৈঠকের আয়োজন হয়।
কেন্দ্রীয় অধিকারী ছাড়াও ভারতবর্ষের বিভিন্ন
প্রান্ত থেকে কার্যকর্ত্রীরা সমবেত হয় খঙ্গপুরের
গোপালী আশ্রমে।
২০১৮ সাল, মুক্তিদির শারীরিক
অসুস্থতার জন্য মহুয়াদিকে প্রান্ত সঞ্চালিকার
দায়িত্ব দেওয়া হয়। ঋতাদিকে দেওয়া হয় পূর্ব
ক্ষেত্র সম্পর্ক প্রমুখের দায়িত্ব। মীরা বড়াল
প্রান্ত সহ সঞ্চালিকা। প্রান্ত-কার্যবাহিকা শ্রীমতী
মৌসুমী কর্মকার, প্রান্ত সহ-কার্যবাহিকা শ্রীমতী
গরিমা বেঙ্গনী, প্রান্ত নিধি প্রমুখ মিনতি সেন,
সহ নিধি প্রমুখ শ্রীমতী ঝর্ণা সাহা, প্রান্ত সম্পর্ক
প্রমুখ শ্রীমতী অঞ্জনা রায়, প্রান্ত সহ সম্পর্ক
প্রমুখ শ্রীমতী নন্দিতা বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রান্ত
প্রচার প্রমুখ শ্রীমতী কাকলি বাগ। ২০১৮
সালে দুরারোগ্য কালব্যাধিতে অকালে চলে
যান প্রান্ত কার্যালয় প্রমুখ রেখাদি।
শ্রদ্ধেয়া সুনীতাদি (সুনীতা হলদেকর)
অখিল ভারতীয় সহ কার্যবাহিকার দায়িত্ব
পাওয়ার পরে পশ্চিমবঙ্গে তাঁরই উৎসাহে
২০১৮ সালের ডিসেম্বর মাসে শ্রীশ্রী মা সারদা
দেবীর জন্মতিথিতে ঘোষ-সহ সেবিকাদের পথ
সঞ্চলন, তার সঙ্গে মাঙ্গলিক বেশে
মা-বোনেদের শোভাযাত্রায় প্রায় ৪০০ জন
অংশগ্রহণ করেন। উত্তর কলকাতার স্বামী
বিবেকানন্দের পৈতৃক বাড়ি থেকে শুরু করে
শেষ হয় বাগবাজারে শ্রীশ্রী মায়ের বাড়িতে।
পরে বাগবাজারের গঙ্গার ধারে একটি সভা
অনুষ্ঠিত হয়।
২০২০ সাল, করোনাকালেও থেমে
থাকেনি সমিতির কাজ। আধুনিক প্রযুক্তির
সহায়তায় ঘরে বসেই অনলাইন শাখা চলতে
লাগল। এরপর লকডাউন উঠে যেতেই
সেবিকার জীবনের ঝুঁকি নিয়েও শুরু করলেন
ত্রাণের কাজ স্বতঃস্ফূর্তভাবে। বিভিন্ন জেলায়
জেলায় ছোটো ছোটো দলে ভাগ হয়ে তারা
অর্থ ও জিনিসপত্র সংগ্রহ করে পৌঁছে দেন
অভাবগ্রস্ত, দুর্দশাগ্রস্তদের ঘরে ঘরে। এমনকী
জীবনের ঝুঁকি নিয়ে করোনা আক্রান্ত এলাকা,
রেলস্টেশন প্রভৃতি স্থানে সেনিটাইজেশন
(জীবাণুমুক্তকরণ)-এর কাজও করেন। এরই
মাঝে বিধ্বংসী ঘূর্ণিঝড় আমফান আছড়ে
পড়ল উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগণার সাগর
সংলগ্ন বিস্তির্ণ এলাকায়। বিপর্যস্ত মানুষগুলির
দুর্দশার কথা ভেবে সম্পূর্ণ বঙ্গ প্রান্তের
সেবিকারা স্বেচ্ছায় অর্থ সংগ্রহ করে, দান করে
পাঠিয়ে দেন কলকাতায়-নতুন উদ্যমে শুরু
হয় ত্রাণের কাজ।
যেদিন ঘূর্ণিঝড় আঘাত হেনেছিল, সেই
দুর্যোগের রাতেই আমরা হারিয়েছিলাম
আমাদের আর এক বরিষ্ঠ কার্যকর্তী শ্রদ্ধেয়া
কমলদিকে (কমল চক্রবর্তী)। দায়িত্বে
থাকাকালীন প্রায় প্রতিটি বর্গে তিনি উপস্থিত
থাকতেন আর নিপুণ হাতে সামলাতেন
রন্ধনশালার কাজ।
২০২১ সালে রাজনৈতিক টানাপোড়েনে
আবার সমিতির কাজ কিছুটা স্তিমিত হয়ে
পড়ে। কিছু কিছু জেলার সক্রিয় কার্যকর্তীদের
উপর প্রত্যক্ষ আক্রমণ হয়। অনেকেই বাধ্য
হলেন ঘর ছেড়ে অন্যত্র চলে যেতে। চেষ্টা
চলতে থেকে হতাশাগ্রস্ত কার্যকর্ত্রীদের
মনোবল, আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে আনার।
পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে অনেকটা সময়
লাগে। অভিভাবকেরা আতঙ্কে মেয়েদের
শাখায় পাঠানো বন্ধ করে দেন। এভাবে নষ্ট
হয়ে যায় অনেককটি শাখা। পশ্চিমবঙ্গে
সমিতির কাজ অনেকটা পিছিয়ে পড়ে।
তবুও আদর্শকে ভালোবেসে আবার উঠে
দাঁড়ানোর চেষ্টা হয়। ২০২২ সালে
শিলিগুড়িতে অসম, পশ্চিমবঙ্গ ও ওড়িশার
সেবিকাদের জন্য একটি ঘোষবর্গের আয়োজন
করা হয়। ঘোষের অভ্যাস চলতে থাকে
অনলাইন, অফলাইন দুভাবেই। লক্ষ্য হলো,
ঘোষ সহ কলকাতার বুকে একটি পথ সঞ্চলন
করা। উপলক্ষ্য হিসাবে বেছে নেওয়া হয়
ভগিনী নিবেদিতার ভারতে আগমনের ১২৫
বছর পূর্তির দিনটিকে। ২৮ জানুয়ারি ২০২৪
সাল, ৩৫০ সেবিকার অংশগ্রহণে ঘোষ-সহ
পথ সঞ্চলন এবং তার সঙ্গে একটি বর্ণাঢ্য
শোভাযাত্রা বাগবাজারস্থিত নিবেদিতা উদ্যান
থেকে রওনা হয়ে সিমলাস্থিত স্বামীজীর
পৈতৃক বসত বাড়িতে এসে পৌঁছায়। তারপর
রামকৃষ্ণ মঞ্চে সমাজের বিশিষ্ট জনেদের
উপস্থিতিতে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়।
২০২৩ সালের জুন মাসে আমরা
হারিয়েছি আমাদের সকলের অত্যন্ত প্রিয়
মায়াদি (রেবেকা মিত্র)-কে।
এও সত্যি, শত ঝড় ঝঞ্ঝা, জোয়ার-ভাটার
মধ্য দিয়ে টালমাটাল করেও ভেসে আছে
সমিতির নৌকাটি, ডুবে যায়নি। শুধু লক্ষ্য স্থির
রেখে সঠিক দিশায় আমরা যদি এগিয়ে যেতে
থাকি, নিশ্চিত বিশ্বাস— জয় একদিন
আসবেই।।
অখিল ভারতীয় রাষ্ট্রীয় শৈক্ষিক মহাসঙ্ঘ, পশ্চিমবঙ্গ আদর্শ শিক্ষক সমাজ গঠনে কাজ করেছে
তারাশংকর চক্রবর্তী
অখিল ভারতীয় রাষ্ট্রীয় শৈক্ষিক মহাসঙ্ঘ (এবিআরএসএম) নামক শিক্ষক সংগঠনটি অন্যান্য শিক্ষক সংগঠনের তুলনায় নবীন হলেও বর্তমানে এটি ভারতের শিক্ষক সমাজে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ স্থান অর্জন করতে সমর্থ হয়েছে। ভারতবর্ষের শাশ্বত সনাতন মূল্যবোধগুলি আমাদের চলার পাথেয়। ব্যক্তিকে সমাজ ও রাষ্ট্রের কল্যাণের জন্য গড়ে তোলা শিক্ষকসমাজের আদর্শ। প্রতিটি বিদ্যার্থীকে দেশ ও জাতির জন্য নিবেদিতপ্রাণ করে তোলা শিক্ষকদের লক্ষ্য। আর শিক্ষক সমাজের কল্যাণ এবং সমস্যার সমাধান করা সমাজের কর্তব্য। ভারতবর্ষে প্রাচীনকাল থেকে যে জগৎ কল্যাণের আদর্শ বিদ্যমান তার প্রতি স্বয়ংসেবকদের দৃঢ় বিশ্বাস রয়েছে। এই আদর্শকে সামনে রেখে তারা কাজ করে চলে।
১৯৮৫ সাল থেকে এরকম একটি সংগঠন সৃষ্টির কথা ভাবা হচ্ছিল। সেই সময় দেশে অনেক শিক্ষক সংগঠন ছিল। সেই হিসেবে এতগুলি শিক্ষক সংগঠন থাকা সত্ত্বেও নতুন করে আরেকটি শিক্ষক সংগঠন গঠন করার কাজটি আদৌ সহজ ছিল না। কিন্তু তা সত্ত্বেও স্বয়ংসেবকরা নতুন আর একটি শিক্ষক সংগঠনের কথা ভাবলেন কেন, সেটা বোঝা দরকার।
স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে আমাদের দেশে মেকলে শিক্ষার বদলে স্বদেশী শিক্ষা প্রবর্তিত হবে- এই আশা সকলের ছিল। কিন্তু নতুন শাসনব্যবস্থায় জাতীয় শিক্ষা সংস্কারের রূপ ও রূপায়ণ ক্রমশ রাজনৈতিক দল দ্বারা প্রভাবিত হয়ে পড়ে। দেশে শিক্ষার বিভিন্ন স্তরে যে সমস্ত শিক্ষক সংগঠন ছিল, তারাও এই সমস্ত রাজনৈতিক দলের লেজুড় বৃত্তি করে চলছিল। দেশে শিক্ষার বিভিন্ন স্তরে যে সমস্ত শিক্ষক সংগঠন ছিল, তারাও এই সমস্ত রাজনৈতিক দলের অঙ্গীভূত হতে গিয়ে ক্রমশ সংকীর্ণ দলীয় রাজনীতির পথ ধরলো। সেই
সময় ১৯৫৫ সালে মহারাষ্ট্রের পুনায় রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের স্বয়ংসেবক মুকুন্দ কুলকর্ণীজী শিক্ষকতা জীবন শুরু করেন। তিনি ১৯৫৭ সালে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের দ্বিতীয় সরসঙ্ঘচালক শ্রীগুরুজীর প্রেরণায় পুনার শিক্ষকদের নিয়ে ওই শহরেই একটি সংগঠন গড়ে তোলার কাজে হাত দেন।
এই সময় সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষকদের নিয়ে এআইএসটিএফ (অখিল ভারতীয় মাধ্যমিক শিক্ষক ফেডারেশন) নামক একটি সংগঠন গড়ে ওঠে। যদিও এদেশে স্বাধীনতার পর থেকে শিক্ষক আন্দোলন তথা শিক্ষক সংগঠনকে কমিউনিস্টরাই নেতৃত্ব দিয়ে এসেছে। ১৯৬১ সালে ওড়িশার কটক শহরে অল ইন্ডিয়া সেকেন্ডারি টিচার্স ফেডারেশন (এআইএসটিএফ)-এর প্রথম সর্বভারতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সেই সম্মেলনে মুকুন্দ
কুলকর্ণীজী মহারাষ্ট্র রাজ্যের শিক্ষক সংগঠনের পক্ষ থেকে প্রতিনিধি হিসেবে যোগদান করেন। এই সম্মেলনে সভাপতি হিসেবে নির্বাচিত হন পশ্চিমবঙ্গের কমিউনিস্ট শিক্ষক নেতা সত্যপ্রিয় রায়। যিনি পরবর্তী ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গের বামফ্রন্ট সরকারের শিক্ষামন্ত্রী হন। এই সম্মেলনে কমিউনিস্টদের প্রাধান্য থাকা সত্ত্বেও মহারাষ্ট্রের তরুণ শিক্ষক নেতা মুকুন্দ কুলকর্ণীজী এআইএসটিএফ-এর কার্যকরী সমিতির সদস্য নির্বাচিত হন। ধীরে ধীরে এই সংগঠনে সঙ্ঘের স্বয়ংসেবক শিক্ষকদের সংখ্যা বাড়তে থাকে। সেই সময় রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের উত্তরপ্রদেশের প্রান্ত প্রচারক ভাউরাও দেওরসজী এই সংগঠনকে বিস্তৃত করার কাজে সহায়তা করেন। ১৯৬৪ সালে এআইএসটিএফ-এর পরবর্তী সর্বভারতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় উত্তরপ্রদেশের বারাণসীতে। ফলে সেই সম্মেলনে মোট ১২০০ জন শিক্ষকের মধ্যে ৬০ জন স্বয়ংসেবক শিক্ষক উপস্থিত ছিলেন। পরবর্তী ১৯৬৭ সালে মধ্যপ্রদেশের গোয়ালিয়রে এআইএসটিএফ-এর সর্বভারতীয় সম্মেলনে মুকুন্দ কুলকর্ণীজী সর্বভারতীয় সভাপতি নির্বাচিত হন কমিউনিস্ট নেতা সত্যপ্রিয় রায়কে পরাজিত করে।
কুলকর্ণীজী দেখলেন কমিউনিস্টরা শিক্ষক সংগঠনকে একটা সময় ট্রেড ইউনিয়ন হিসেবে চালাতো। এই দল কেবল শিক্ষকদের দাবিদাওয়া নিয়েই কাজ করে। এই সংগঠনে রাষ্ট্রীয় চিন্তাভাবনার বড়োই অভাব। কুলকর্ণীজী সত্যপ্রিয় রায়কে এই বিষয়ে বোঝাবার চেষ্টা করেন যে, ‘শুধুমাত্র শিক্ষকদের দাবিদাওয়া নিয়ে আন্দোলন করলেই হবে না, সেই সঙ্গে শিক্ষা কী হবে, কেমন হবে, সেই কাজ আমাদের সংগঠনকেই করতে হবে।’ তার উত্তরে শ্রী রায় বলেন, ‘শিক্ষা কী হবে, কেমন হবে সে কাজ করবে সরকার।’
কুলকর্ণীজীর এই মত পছন্দ না হওয়ায় ১৯৬৯ সালের মহারাষ্ট্রের মুম্বাই শহরে একটি নতুন সংগঠন শুরু করেন। নাম হলো ভারতীয় শিক্ষণ মণ্ডল। পরবর্তীতে সঙ্ঘের তৃতীয় সরসঙ্ঘচালক বালাসাহেব দেওরসজী এই সংগঠনের প্রথম সম্মেলনে পথনির্দেশ করেন।
শুরু থেকে ২১ বছর তিনি ভারতীয় শিক্ষণ মণ্ডলের সভাপতি ছিলেন। ১৯৭০ সাল থেকে কলকাতায় শুরু হলো ভারতীয় শিক্ষণ মণ্ডলের কাজ। ভারতীয় শিক্ষণ মণ্ডল শিক্ষায় ছটি বিষয় নিয়ে আসার জন্য আন্দোলন করেছে। তার মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ দাবি ছিল ছাত্র-ছাত্রীদের নৈতিক ও আধ্যাত্মিক শিক্ষা। ভারতীয় শিক্ষণ মণ্ডলের এই আন্দোলনের ফলে মহারাষ্ট্র সরকার নৈতিক এবং আধ্যাত্মিক শিক্ষা চালু করে। মহারাষ্ট সরকার ১৯৭২ সালে কুলকার্ণীজীর নেতৃত্বে ভারতীয় শিক্ষণ মণ্ডলকেই সিলেবাস তৈরি করা ও শিক্ষক-শিক্ষণের দায়িত্ব দেন। ভারতীয় শিক্ষণ কুলকর্ণীজীর নেতৃত্বে এই দায়িত্ব সুন্দরভাবে পালন করেন।
এআইএসটিএফ-এর কাজের সময় তিনি দেখলেন মাধ্যমিক শিক্ষকদের নিয়েই বেশি আন্দোলন হচ্ছে। প্রাথমিক বিদ্যালয়, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা বাদ পড়ে যান। তাই কুলকর্ণীজী আরও একটি নতুন সংগঠন তৈরির কথা ভাবলেন। ১৯৮৮ সালে রাষ্ট্রীয় শৈক্ষিক মহাসঙ্ঘের কাজ একই সঙ্গে চলতে থাকে। পশ্চিমবঙ্গের রাষ্ট্রবোধসম্পন্ন শিক্ষকরা সঙ্ঘের কার্যকর্তা অজিত কুমার বিশ্বাসের নেতৃত্বে মুকুন্দ কুলকর্ণীজীর সঙ্গে শিক্ষক আন্দোলনের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলাপ আলোচনা করতে থাকেন। অজিত বিশ্বাস দেশপ্রেমিক শিক্ষকদের ১৯৯৩ সালে কলকাতার হরিয়ানা ভবনে দু-দিনের সম্মেলন ডাকেন। পশ্চিমবঙ্গে অখিল ভারতীয় রাষ্ট্রীয় শৈক্ষিক মহাসঙ্ঘের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষকদের নিয়ে গঠিত হয় বঙ্গীয় শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মী সঙ্ঘ। সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন
সংগঠনের পথপ্রদর্শক মুকুন্দ কুলকর্ণীজী। প্রায় ১০০ জন প্রতিনিধি উপস্থিত হন। সেখানে ২৮ জন মহাবিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকেরাও উপস্থিত ছিলেন। সভাপতির দায়িত্ব দেওয়া হয় জ্ঞান বন্দ্যোপাধ্যায়কে,
সম্পাদকের দায়িত্ব ড. অজিত বন্দ্যোপাধ্যায় এবং সংগঠন সম্পাদকের দায়িত্ব অর্পণ করা হয় অজিত কুমার বিশ্বাসের উপর।
পশ্চিমবঙ্গে এর দু’ বছর পরে অর্থাৎ ১৯৯৫ সালে প্রাথমিক শিক্ষকদের নিয়ে গড়ে উঠে বঙ্গীয় নবউন্মেষ প্রাথমিক শিক্ষক সঙ্ঘ। এবিআরএসএম-এর প্রতিষ্ঠাতা মুকুন্দ কুলকর্ণীজী বঙ্গীয় নবউন্মেষ প্রাথমিক শিক্ষক সঙ্ঘের তৃতীয় রাজ্যস্তরের সাধারণ সভা মালদায় উপস্থিত ছিলেন। সেই সভায় দীনেশ সাহা সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পান। এই সংগঠনেরও অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন অজিত বিশ্বাস।
এর দু’ বছর পরে অর্থাৎ ১৯৯৭ সালে মহাবিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের নিয়ে প্রথম সম্মেলনের মাধ্যমে গঠিত হয়েছিল জাতীয় অধ্যাপক মঞ্চ। যেটা এবিআরএসএম অনুমোদিত উচ্চশিক্ষার শিক্ষক সংগঠন। প্রথম সভাপতি দায়িত্ব পেয়েছিলেন অধ্যাপক তরুণ মজুমদার এবং সম্পাদকের দায়িত্ব পান অধ্যাপক চণ্ডীলাল বন্দ্যোপাধ্যায়। পরবর্তী ক্ষেত্রে এই সংগঠনের নাম হয় জাতীয়তাবাদী অধ্যাপক ও গবেষক সঙ্ঘ। পশ্চিমবঙ্গে এই তিনটি স্তরের সংগঠন সৃষ্টিতে মুকুন্দ কুলকর্ণীজী এবং অজিত বিশ্বাসের ভূমিকা অবিস্মরণীয়।
অখিল ভারতীয় রাষ্ট্রীয় শৈক্ষিক মহাসঙ্ঘের কার্যকর্তারা ভারতীয় আদর্শে শিক্ষা ব্যবস্থাকে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করতে আমাদের জাতীয় সংস্কৃতির ভিত্তিতে শিক্ষা ব্যবস্থাকে অরাজনৈতিক ভারতীয় রূপ দিতে কৃতসংকল্প। রাজনৈতিক শাসকদের অঙ্গুলিহেলনে শিক্ষা ও শিক্ষক আন্দোলন চলতে পারতো না। তাই রাজনৈতিক চিন্তাধারা মুক্তসংগনই রাষ্ট্র। ভারতবর্ষের ইতিহাসে এই প্রথম একটি জাতীয়তাবাদী শিক্ষক সংগঠন যেখানে ‘কেজি টু পিজি’-শিক্ষকরা সঙ্ঘবদ্ধ হয়েছেন। কুলকর্ণীজী পথনির্দেশ করেন যে, শিক্ষকদের মধ্যে রাষ্ট্রীয় ভাবনা জাগাতে হবে। শিক্ষকদের দুঃখ দুর্দশা দূর করতে হবে এবং সেই সঙ্গে সুখ বৃদ্ধি করতে হবে। শিক্ষকদের ভালো-মন্দের বিষয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেই হবে না, শিক্ষাক্ষেত্রের সার্বিক সমস্যারও চিন্তাভাবনাও করতে হবে। রাষ্ট্রের মঙ্গলের জন্য শিক্ষা, শিক্ষার মঙ্গলের জন্য
শিক্ষক। সেই হিসেবে রাষ্ট্রের যারা অমঙ্গলের কথা চিন্তা করে সেই রকম রাষ্ট্রবিরোধীদের স্থান এই সংগঠনে হবে না। এই সংগঠন শিক্ষকদের সমাজনিষ্ঠ এবং সমাজসেবার মাসিকতা তৈরি করতে বদ্ধপরিকর। সমাজের মঙ্গলই শিক্ষকদের মঙ্গল। কুলকর্ণীজী এবিআরএসএম-এর একটি ধ্যেয়বাক্য ঠিক করে দেন- ‘রাষ্ট্রের হিতে শিক্ষা। শিক্ষার হিতে শিক্ষক এবং শিক্ষকের হিতে সমাজ।’
পশ্চিমবঙ্গে অজিত বিশ্বাস ছিলেন এই তিন সংগঠনের সংগঠন সম্পাদক। পরবর্তী সময়ে সংগঠন সম্পাদকের দায়িত্ব পান সঙ্ঘের প্রচারক নারায়ণ চন্দ্র পাল। তাঁর প্রয়াণের পর এই দায়িত্ব পালন করছেন সঙ্ঘ প্রচারক আলোক চট্টোপাধ্যায়।
মাধ্যমিক স্তরের বঙ্গীয় শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মী সঙ্ঘ এবং প্রাথমিক স্তরের বঙ্গীয় নবউন্মেষ প্রাথমিক শিক্ষক সঙ্ঘ- এই দুই শিক্ষক সংগঠন ২০২৩ সালের ২৯ ও ৩০ জুলাই রাজ্য বার্ষিক সাধারণ সভার বৈঠকের মাধ্যমে একটিই সংগঠন যেটা ‘অখিল ভারতীয় রাষ্ট্রীয় শৈক্ষিক মহাসঙ্ঘ’ (বিদ্যালয় শিক্ষা)
নামে খ্যাত হয় এবং জাতীয়তাবাদী অধ্যাপক ও গবেষক সঙ্ঘ ‘অখিল ভারতীয় রাষ্ট্রীয় শৈক্ষিক মহাসঙ্ঘ (উচ্চ শিক্ষা) নামে পরিচিত হয়। সেই রাজ্য বার্ষিক সাধারণ সভায় উপস্থিত ছিলেন অখিল ভারতীয় সংগঠন সম্পাদক মহেন্দ্র কাপুর, পূর্বক্ষেত্রের সংগঠন সম্পাদক আলোক চট্টোপাধ্যায়, এই দুই সংগঠনের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকরা যথা, আশিস কুমার মণ্ডল ও বাপি প্রামাণিক (বিএসএসএস); অনিমেষ মণ্ডল এবং কানুপ্রিয় দাস (বিএনইউপিএসএস)। এছাড়াও যাঁদের উজ্জ্বল উপস্থিতি ছিল তাঁরা হলেন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের পূর্বক্ষেত্রের সহ-ক্ষেত্র প্রচারক জলধর মাহাতো, মধ্যবঙ্গ
প্রান্তের বৌদ্ধিক প্রমুখ শিবাজী প্রসাদ মণ্ডল এবং মধ্যবঙ্গ প্রান্তের প্রান্ত প্রচারক কৃষ্ণ মণ্ডল। ওই সভায় অখিল ভারতীয় রাষ্ট্রীয় শৈক্ষিক মহাসঙ্ঘের (বিদ্যালয় শিক্ষা) সভাপতির দায়িত্ব লাভ করেন আশিস কুমার মণ্ডল এবং সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব লাভকরেন বাপি প্রামাণিক। এছাড়া সংগঠন সম্পাদকের মতো গুরু দায়িত্ব অলোক চট্টোপাধ্যায়কে অর্পণ করা হয়।
বর্তমানে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক এই দুই সংগঠন একসঙ্গে মিলিতভাবে কাজ করার ফলে সংগঠন যেমন বৃদ্ধি প্রাপ্ত হয়েছে, সেই সঙ্গে সংগঠনের কার্যক্রম অধিকাধিক স্থানে করা সম্ভব হচ্ছে। এছাড়াও প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষকদের সকল সমস্যার নিরসন হেতু জোরালো প্রতিবাদ আন্দোলন করা সম্ভব হচ্ছে। সেই আন্দোলনের ফলে সরকারও আমাদের কিছু কিছু ন্যায্য দাবি মেনে
নিতে বাধ্য হতে হচ্ছে। এর ফলে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষক শিক্ষিকা ও শিক্ষা কর্মীদের পেশাগত সমস্যার কিছুটা হলেও সুরাহা হচ্ছে।
এবিআরএসএম-এর বিভিন্ন সময়ে যে সকল কার্যকর্তারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এসেছেন, তাঁদের অবদানকে কখনোই ভোলা সম্ভব নয়। তেমনই কয়েকজন দেবতুল্য কার্যকর্তা হলেন অবনীভূষণ মণ্ডল, অরূপ সেনগুপ্ত, পঙ্কজ নিয়োগী, স্বপন সমাদ্দার ও সোমেন দাস। এছাড়াও সঙ্ঘের পক্ষ থেকে যাঁরা পালক হিসেবে বিভিন্ন সময়ে উল্লেখযোগ্য গুরুদায়িত্ব পালন করেছেন,
তাঁদের ভূমিকাকে কখনোই আমরা অস্বীকার করতে পারি না। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন সত্যনারায়ণ মজুমদার, অতুল বিশ্বাস, ড. জয়ন্ত রায়চৌধুরী, প্রদীপ চন্দ্র অধিকারী ও সাধন কুমার পাল।
পশ্চিমবঙ্গে শিশুমন্দির যোজনার ইতিকথা
বিমলকৃষ্ণ দাস
পশ্চিমবঙ্গে শিশুমন্দির যোজনার প্রথম বিদ্যালয় শুরু হয়েছিল শিলিগুড়িতে, সাল ১৯৭৫। প্রকৃতপক্ষে শুধু পশ্চিমবঙ্গ নয়, এটি ছিল বিদ্যাভারতীর পূর্ব ভারতে প্রথম বিদ্যালয়-ওড়িশা, পশ্চিমবঙ্গ, শিকিম, অসম হয়ে ত্রিপুরা, মণিপুর পর্যন্ত। সরস্বতী শিশুমন্দির যোজনার প্রথম বিদ্যালয় শুরু হয় ১৯৫২ সালে উত্তরপ্রদেশের গোরক্ষপুরে। মাতৃভাষার মাধ্যমে ভারতীয় সংস্কৃতি কেন্দ্রিক এক নবীনতম শিক্ষাদান পদ্ধতি। শত শত সঙ্ঘকার্যকর্তা শিক্ষানুরাগীদের ত্যাগ, তপস্যা ও পরিশ্রমের ফলে শিশুমন্দির উত্তরপ্রদেশের গণ্ডি ছেড়ে ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ে রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ, বিহার প্রভৃতি রাজ্যগুলিতে। এক সময় এই শিক্ষা বিস্তারের ঢেউ এসে পৌঁছয় পশ্চিমবঙ্গে, শিলিগুড়ির কার্যকর্তাদের মনে। তৎকালীন দার্জিলিং জেলা প্রচারক লক্ষ্মীনারায়ণ ভালা এ বিষয়ে মূল হোতার ভূমিকা গ্রহণ করেন।
সহযোগী মার্গদর্শক, পথপ্রদর্শকের ভূমিকায় ছিলেন জলপাইগুড়ি বিভাগ প্রচারক ডাঃ দেবব্রত সিংহ। লক্ষ্মীদা শিশুমন্দির পরিকল্পনার কর্মযোজনা শুরু করলেন শিলিগুড়িতে কর্মসংস্থানের জন্য আসা সদ্য বিজ্ঞানে স্নাতক,
তৃতীয় বর্ষ সঙ্ঘ শিক্ষা বর্গ শিক্ষণ প্রাপ্ত, দীর্ঘকালীন বিদ্যার্থী বিস্তারকের অভিজ্ঞতালব্ধ এক যুবককে কেন্দ্র করে। শৈশব থেকে সংস্কার উপযোগী শিক্ষাদানের মাধ্যমে প্রকৃত মানুষ তৈরির এমন শিক্ষাকেন্দ্র শিলিগুলিতেও শুরু হোক এরকম আগ্রহ স্থানীয় সঙ্ঘ কার্যকর্তাদের মনে দৃঢ় হলে প্রয়োজন হলো সঙ্ঘের উচ্চ অধিকারীদের অনুমোদনের।
লক্ষ্মীদা এ বিষয়ে তৎকালীন প্রান্ত প্রচারক বসন্তরাও ভট্টর সঙ্গে আলোচনা করলে তিনি পরামর্শ দেন তখনকার পূর্বাঞ্চল প্রচারক ভাউরাওজীর সঙ্গে কথা বলার জন্য। ভাউরাওজী উত্তরপ্রদেশে সঙ্ঘকার্য শুরুর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, শুধু তাই নয় এই শিশু মন্দির যোজনার মাগদর্শক হিসেবেও ছিলেন তিনি অন্যতম। লক্ষ্মীদা ভাউরাওজীর সঙ্গে দেখা করে মনের ইচ্ছাটি প্রকাশ করলে দু’ একটি প্রশ্নের পরে অনুমতি পেতে খুব সমস্যা হয়নি। তার
একটি কারণ হয়তো হবে- যে যুবককে কেন্দ্র করে এই ভাবনা সেই নদীয়া জেলার স্বয়ংসেবকটিকে তিনিই প্রথম এক বৈঠকে তৎকালীন জেলা প্রচারক শ্যামলাল বন্দ্যোপাধ্যায়কে সঙ্ঘ শিক্ষা বর্গে পাঠাবার জন্য বলেছিলেন এবং পরবর্তীতে তিনি তাকে বিদ্যার্থী
বিস্তারক রূপে নিয়োজিত করারও প্রস্তাব দিয়েছিলেন। ভাউরাওজী লক্ষ্মীদাকে সেই যুবককে শিশুমন্দির শুরুর আগে প্রশিক্ষণ লাভের জন্য লক্ষ্ণৌয়ে ছ’ মাসের ‘আচার্য প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে’ পাঠাবার পরামর্শ দেন এবং সেই মতো ১৯৭৪-এর আগস্টের শুরুতে তাকে প্রশিক্ষণের উদ্দেশ্যে লক্ষ্ণৌ পাঠানো হয়। সফলতার সঙ্গে প্রশিক্ষণ শেষ করে মার্চের শেষের দিকে (১৯৭৫) শিলিগুড়ি ফিরে এলে শুরু হয় শিলিগুড়িতে শুরু হয় শিশুমন্দির স্থাপনার কর্মযোজনা। সাধারণের ধারণায় তখন এটা ছিল না যে মাতৃভাষার মাধ্যমে বেসরকারি
বড়ো কোনো বিদ্যালয় হিসেবে সমাজে প্রতিষ্ঠা লাভ করা যেতে পারে। কিন্তু সকলের অদম্য উৎসাহে সরস্বতী শিশুমন্দির, শিলিগুড়ি’ নামে প্রাথমিক কার্য, কাগজপত্র ছাপা ইত্যাদি শুরু হলো।
বিশিষ্ট স্বয়ংসেবক কার্যকর্তা সত্যনারায়ণ রামপুরিয়া খালপাড়ার সীমানায় তাঁর আত্মীয়ের কাঠা দশেক জমির উপরে ছোট্ট বাড়িটি শিশুমন্দিরের জন্য স্বল্প ভাড়ায় ব্যবস্থা করে দেন। চলছিল বিদ্যালয় সজ্জা ও অন্য প্রস্তুতির কাজ। কিন্তু হঠাৎ দেশজুড়ে নেমে আসে জরুরি অবস্থার কালো ছায়া। ২৫ জুন ১৯৭৫ সমস্ত দেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে সঙ্ঘকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয় এবং স্বয়ংসেবকদের প্রেরণায় প্রতিষ্ঠিত শিশু মন্দিরগুলিকে সরকার অধিগ্রহণ করে নেয়। এই খবরে শিলিগুড়ির কার্যকর্তারা একটি জরুরি বৈঠকে স্থির করেন এর থেকে রেহাই পেতে শিশু মন্দিরের নাম পরিবর্তন করে নাম হবে ‘সারদা শিশুতীর্থ’। বাধ্য হয়ে সমিতি থেকে বিশেষ স্বয়ংসেবক কার্যকর্তাদের বাইরে রাখা হলো। কিন্তু ঈশ্বরের আশীর্বাদ ছিল তাই এই দুঃসময়ে এগিয়ে এলেন এতদঞ্চলের স্বনামধন্য শিক্ষাপ্রেমী নানা ব্যক্তিত্ব। সম্পাদক অধ্যাপক প্রলয় কুমার মজুমদার, সভাপতি অধ্যক্ষ হরেন ঘোষ, কোষাধ্যক্ষ ক্রীড়াবিদ পানুদত্ত মজুমদার, অধ্যাপক নন্দদুলাল ব্যানার্জি, অধ্যাপক তরণীকান্ত ভট্টাচার্য (উ.ব.বি.) ডাঃ চারুচন্দ্র সান্যাল- জলপাইগুড়ি, কান্তি চন্দ্র ভট্টাচার্য, সূচ্চা সিংহ বেইন্স, তোলারাম গিদরা প্রমুখ। তাঁরা সকলেই আজ প্রয়াত। শিক্ষাবর্ষ জানুয়ারি হলেও পরিচিতির তথা আগামী শিক্ষাবর্ষের প্রস্তুতির উদ্দেশ্যে ১৯৭৫-এর সেপ্টেম্বর শিক্ষক দিবসের শুভদিনে শিলিগুড়িতে শুভ সূচনা হলো ‘সারদা শিশু তীর্থ’-এর। হিন্দি বিভাগে ১৩ এবং বাংলা বিভাগে ১১ জন শিশু নিয়ে শুরু হলো সারদা শিশু তীর্থ।
কিন্তু এ যেন ছিল কংস কারাগারে কৃষ্ণের জন্মের মতো- বহু বাধা বহু বিঘ্ন। দু-মাস পরে ১১ নভেম্বর স্থানীয় ডিআইবি ইন্সপেক্টর এসে স্কুল সিল করে দিলেন, বললেন- উপরতলার নির্দেশ। বোঝার কোনো উপায় ছিল না এই ২৫টি শিশু নিয়ে দেশের কোন অপরাধ কার্য সাধিত হচ্ছিল শিশুতীর্থে। তারপর জরুরি অবস্থার বিরুদ্ধে আন্দোলন, সত্যাগ্রহ-জেল-দেশজুড়ে সে অপূর্ব ইতিহাসের কথা আমাদের সকরের জানা। ১৮৭৭-এ জরুরি অবস্থার অবসান হলো, ‘৭৮-এর জানুয়ারি থেকে পুনরায় শুরু হলো শিশুতীর্থে শিক্ষাদানের পুণ্যপ্রবাহ।
শিলিগুড়ি শিশু তীর্থের উদাহরণ, প্রেরণায় পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন স্থানে কার্যকর্তাদের প্রয়াসে প্রতিষ্ঠিত হতে থাকলো শিশুতীর্থ বা সরস্বতী শিশুমন্দির। স্থানীয় নতুন আচার্য-আচার্যাদের এবং বিভিন্ন স্থানে নতুন বিদ্যালয় স্থাপন উদ্দেশ্যে নিযুক্ত আচার্যদের জন্য শুরু হলো আচার্য প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা (১৯৮০)। শিলিগুড়ির পরেই শিশুতীর্থ প্রতিষ্ঠা হয় কোচবিহারে (১৯৮১), পরবর্তী বছর নবদ্বীপ (১৯৮২)।
নদীয়া বিভাগ সঙ্ঘচালক বৃন্দাবন ধর গোস্বামী নবদ্বীপে শিশুতীর্থ শুরু করতে হবে বলে ৮১-র প্রশিক্ষণে আচার্য-আচার্যা হিসেবে চারজনকে পাঠিয়েছিলেন। এই সময় ত্রিপুরার কৈলাশহর, ধর্মনগর থেকেও ৮ জন আচার্য-আচার্যাকে প্রশিক্ষার্থী হিসেবে পাঠানো হয়েছিল। নবদ্বীপে প্রথম প্রধানাচার্য ছিলেন সমীর কুমার দাস এবং সম্পাদক দীপক চৌধুরী। পুরুলিয়ায়ও শিশুমন্দির শুরু হয় ১৯৮১-তে। প্রথম প্রধানাচার্য শক্তিপদ ঠাকুর ও সম্পাদক হীরালাল শর্মা। কোচবিহার প্রথম প্রধানাচার্য ছিলেন চঞ্চল রঞ্জন দাস ও সম্পাদক অধ্যাপক চন্দন মুখার্জী। মালদহ শিশুমন্দির শুরুর জন্য শিলিগুড়ি থেকে আচার্য অরুণ কুমার মহন্তকে তিন মাসে জন্য সেখানে পাঠানো হয়েছিল। রামকৃষ্ণ সিংহল প্রথম সম্পাদকের দায়িত্বে ছিলেন। প্রধানাচার্য ছিলেন প্রদীপ ভট্টাচার্য, সহযোগিতায় ছিলেন অহীন্দ্র কুমার দে, জীবেন্দ্রনাথ পোদ্দার প্রমুখ কার্যকর্তা।
এমনভাবে ক্রমশ বিভিন্ন স্থানে প্রসারিত হতে থাকে সারদা শিশুতীর্থ বা সরস্বতী শিশুমন্দিরের কাজ। শুরু হয় বর্ধমান, মেদিনীপুর (১৯৮৫), তাঁতিবেড়িয়া (১৯৮৫), বহরমপুর (১৯৮৬), রায়গঞ্জ (১৯৮৫) প্রভৃতি স্থানে। শিশু মন্দির প্রসারের ধারা যেন জোয়ারে পরিণত হয়। বিভিন্ন স্থানে শিশু মন্দিরের বিস্তার ঘটেছে, স্বাভাবিকভাবেই প্রয়োজন হয়ে পড়ল কেন্দ্রীয় ভাবে সকলকে একসঙ্গে পরিচালিত করার। তৎকালীন পশ্চিমবঙ্গ প্রান্ত সঙ্ঘচালক কালিদাস বসুর পথপ্রদর্শন ও সহযোগিতায় ১৯৮২ সালে স্থাপিত হয় ‘বিবকোনন্দ বিদ্যাবিকাশ পরিষদ, পশ্চিমবঙ্গ। প্রথম সম্পাদকের দায়িত্বে ছিলেন নারায়ণ চন্দ্র পাল এবং সভাপতি ছিলেন অধ্যাপক অমল কুমার বসু।
সর্বত্র জনমানসে শিশুতীর্থ বা শিশু মন্দিরগুলি ঠাঁই করে নেওয়ার মূল আকর্ষণের বিষয় ছিল শিক্ষাদান পদ্ধতি, অনুশাসন, সসংস্কার ও নৈতিক শিক্ষাদান পদ্ধতি। এক সময় দার্জিলিঙে নেপালি ভাষার মাধ্যমে শিশুতীর্থ শুরু হয়েছিল (১৯৮৫-৮৬)। দেহরাদুনের একজন স্বয়ংসেবক তখন দার্জিলিঙে থাকতেন- হরক বাহাদুর গুরং। তিনি প্রধানাচার্যের দায়িত্ব নিলেন। এক-দেড় বছর ভালোই চলছিল, কিন্তু সুভাষ ঘিসিঙের গোর্খাল্যান্ড আন্দোলনের কারণে সমতলের সঙ্গে (শিলিগুড়ি) সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যাওয়ায় খুব
বেশিদিন বিদ্যালয়টি স্থায়িত্ব লাভ করেনি। বিদ্যাভারতীর উত্তর-পূর্ব ক্ষেত্র সংগঠক সম্পাদক কৃষ্ণচন্দ্র গান্ধীর নেতৃত্বে ১৯৯৪ সালে শিলিগুড়িতে আয়োজিত হয় তিন হাজার শিশুর ‘পূর্বাঞ্চল শিশুসঙ্গম’। বিহার, ওড়িশা থেকে মণিপুর পর্যন্ত শিশুমন্দিরের তৃতীয় থেকে অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র-ছাত্রী এই অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেছিল।
অভূতপূর্ব এই কার্যক্রম পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন শোণ্ডেজী। মাতৃভাষার মাধ্যমে মাধ্যমিক স্তরে বিদ্যা ভারতীর প্রথম বিদ্যালয় ‘পশ্চিমবঙ্গ মধ্যশিক্ষা পর্ষদ’-এর অনুমোদন লাভ করে (২০০৮) শিলিগুড়িতে। পরে তা উচ্চমাধ্যমিকে উন্নীত হয়। তার আগেই রায়গঞ্জে শুরু হয় সিবিএসই-র মাধ্যমিক স্তরে বিদ্যালয়। অমল কুমার বসুর পথনির্দেশ সারা পশ্চিমবঙ্গে শিশুমন্দির বিস্তারের উদ্দেশ্যে, বিশেষত কলকাতায় পরিচিতির জন্য স্টার থিয়েটারে বিভিন্ন বিদ্যালয়ের শিশুদের নিয়ে অনুষ্ঠিত হয়েছিল শিশু বিচিত্রা (১০ ফেব্রুয়ারি, ১৯৮২) নামে এক মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। বিদ্যালয়ের বিস্তার ও ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে ২০০৫ সালে বিদ্যা ভারতীর দৃষ্টিতে উত্তরবঙ্গ আলাদা প্রদেশ বলে ঘোষণা হয় এবং ‘বিদ্যাভারতী উত্তরবঙ্গ’ নামে প্রদেশ সমিতি গঠিত হয়।
বর্তমানে ‘বিবেকান্দ বিদ্যাবিকাশ পরিষদ প.ব. (দক্ষিণবঙ্গ)’ দ্বারা পরিচালিত বিদ্যালয়ের আনুমানিক সংখ্যা ২১০, আচার্য-আচার্যা ২,৫০০ এবং পাঠরত ছাত্র-ছাত্রীদের সংখ্যা- ৫৬,০০০। সংস্কার কেন্দ্র-৩০টি। ‘বিদ্যা ভারতী উত্তরবঙ্গ’ (উ.ব.) পরিচালিত বিদ্যালয়ের সংখ্যা ১০১। আচার্য-আচার্যা- ২০০০ এবং ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা- ৫০,০০০। সংস্কার কেন্দ্র ৪৫টি। ১৯৯৬ সালে শেণ্ডেজীর প্রয়াসে শিলিগুড়ি দুই মাইলে ‘মাতৃভবন’-এ অনুষ্ঠিত হয়েছিল ‘উত্তর পূর্বাঞ্চল আচার্য প্রশিক্ষণ কেন্দ্র’। বর্তমানে এটি না থাকলেও দক্ষিণবঙ্গের কেশিয়াড়ীতে বিশাল পরিসরে গড়ে উঠেছে নতুন আচার্য প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। উত্তরবঙ্গের আচার্য প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা পরিচালিত হয় ‘বিদ্যা ভারতী উত্তরবঙ্গ’
শিলিগুড়ি থেকে। শিক্ষাক্ষেত্রে বহু আশা, নিরাশা, প্রশ্নের মধ্যেও পশ্চিমবঙ্গে শিক্ষাক্ষেত্রে বিদ্যাভারতী আজ এক আলোকবর্তিকার মতো, অনুকরণীয়, অনুসরণীয়, আমাদের ধ্যেয় কর্তব্যপথে এগিয়ে যাওয়ার এক বিশাল আহ্বান।
সঙ্ঘ শতবর্ষে দক্ষিণ অসম প্রান্তের কার্যবিস্তার
ক্ষৌণীশ চক্রবর্তী
দেশ বিভাজনের আগে অবিভক্ত ভারতের অসম প্রদেশ ছিল বর্তমান অসম, মেঘালয়, নাগারাজ্য অরুণাচল প্রদেশ, মিজোরাম এবং পূর্ববঙ্গের শ্রীহট্ট জিলা নিয়ে। ওই সময়ে শ্রীহট্টে একজন প্রচারক এসেছিলেন তাঁর নাম ছিল মনোহর গুজ্জর। শ্রীহট্ট বা সিলেটকে কেন্দ্র করে তিনি সঙ্ঘের কাজ করতেন। সিলেট থেকেই উনি শিলঙে সঙ্ঘের কাজ শুরু করেন।
১৯৪৬ সালে মনোহরজী শিলচর শহরে আসেন আর শহরের ইটখোলা অঞ্চলে দ্বারিকা প্রসাদ যাদব মহেন্দ্র শ্রীবাস্তব এবং আরও কয়েকজন বালককে নিয়ে শাখা শুরু করেন। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাজন হলো। ১৯৪৮-এর ৩০ জানুয়ারি গান্ধীহত্যার ঘটনা ঘটল। সঙ্ঘের উপর নিষেধাজ্ঞা এল। শিলচরের বালক স্বয়ংসেবকরা ঘটনার কিছুই জানত না। তারা শাখায় ছিল, থানার দারোগা এসে তাদের থানায় নিয়ে গেল। ওই সময়ের একটা মজার ঘটনার কথা দ্বারিকাপ্রসাদ যাদব
আমাদের বলেছিলেন। থানায় নিয়ে গিয়ে দারোগাবাবু লাঠি দেখিয়ে স্বয়ংসেবকদের ধমকাচ্ছেন আর বলছেন- ‘বলো, গান্ধীকে কে হত্যা করেছে?’ ভিতর থেকে দারোগাবাবুর স্ত্রী বেরিয়ে এসে দারোগাবাবুকে ধমক দিয়ে বললেন, ‘আচ্ছা লোক তো তুমি, কোথায় দিল্লিতে গান্ধী হত্যার ঘটনা ঘটেছে, আর এখানে এই শিশুরা কীকরে বলবে যে গান্ধীজীকে কে হত্যা
করেছে? ছাড়ো এদেরকে।’ স্ত্রীর ধমক খেয়ে দারোগাবাবু স্বয়ংসেবকদের ছেড়ে দিলেন।
স্বাভাবিকভাবেই এরপর সঙ্ঘের কাজ শিলচরে বন্ধ হয়ে যায়। ১৯৪৯ সালে সঙ্ঘের উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা উঠার পর মোঙ্গালাল বারই নামের নবমশ্রেণীর এক ছাত্র শিলচরে সঙ্ঘকাজ শুরু করার জন্য নাগপুরে পত্র লিখেন। ওই সময়ে অসমে প্রান্ত প্রচারক হয়ে আসেন ঠাকুর রাম সিংহ। ওই সময়েই অসমে সঙ্ঘকাজের জন্য মহারাষ্ট্র থেকে আসেন বসন্ত ফড়নিস্। মোঙ্গালালের চিঠির সূত্রধরে বসন্তজীকে শিলচরে পাঠানো হয়। বসন্তজী মোঙ্গালালকে চিঠি দিয়ে জানিয়ে দেন উনি যে কোনো দিন ট্রেনে করে শিলচরে আসছেন। কিন্তু বালক মোঙ্গালাল বাড়িতে কাউকে এই ব্যাপারে কিছু বলেনি। সে বিদ্যালয়ে চলে যায় আর বসন্তজী এসে দেখেন স্টেশনে কেউ নেই। সম্পূর্ণ অপরিচিত জায়গা। ধীরে ধীরে স্টেশন শূন্য হয়ে গেল। তখন দেখা গেল একজন লোক এসে বসন্তজীর সঙ্গে কথা জুড়ে দিল। তিনি
কে, কোথা থেকে এসেছেন, কোথায় যাবেন ইত্যাদি। এই ব্যক্তিই একটি রিকশা ডেকে বসন্তজীকে মোঙ্গালালের বাড়িতে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিলেন। পরে জানা গেল এই ব্যক্তি সরকারি গোয়েন্দা ছিলেন এবং বসন্তজীর আসার খবর আগেই তিনি পেয়ে গিয়েছিলেন।
বসন্তজী মোঙ্গালালের বাসায় এসে পৌঁছলেন। ভারতীয় পরম্পরা অনুযায়ী তাঁকে অতিথির মর্যাদা দেওয়া হলো। মোঙ্গালাল বিদ্যালয় থেকে আসার পর পরিচয় হলো। মোঙ্গালালের বাবা রামদেও বারই সজ্জন ব্যক্তি, মনোহরজীর সময়ে শাখায় গিয়েছিলেন। শাখার কাজ শুরু হলো।
এই সময় শিলং থেকে অতুল চক্রবর্তী নামের একজন তরুণ স্বয়ংসেবক শিলচরের পাশে (৭ মাইল দূরে) উদারবন্দ নামের গ্রামে এসে দর্জির কাজ করেন। আর দেশ বিভাজনের পর উদ্বাস্তু হয়ে আসা দশমশ্রেণীর ছাত্র কবীন্দ্র পুরকায়স্থও উধারবন্দে বিদ্যালয়ে পড়তেন।
অতুলদা ও কবীন্দ্রদার মধ্যে বন্ধুত্ব হয়ে গেল। ওই সময় ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় শিলচরে আসেন। উধারবন্দের তরুণ যুবকেরা ঠিক করলেন তারা ডঃ শ্যামাপ্রসাদকে স্বাগত জানাবেন। অতুলদা তার সাংগঠনিক শক্তি দিয়ে কবীন্দ্রদা ও অন্য যুবকদের নিয়ে প্রস্তুতি শুরু করলেন। ডঃ শ্যামাপ্রসাদ শিলচর থেকে চলে যাওয়ার পরও অতুলদা তার কাজ চালিয়ে যেতে থাকলেন। সঙ্গে কবীন্দ্রদা। বসন্তজী যখন এই খবর জানতে পারলেন তখন তিনিও সাইকেলে উধারবন্দে এসে যোগাযোগ করলেন। কবীন্দ্রদার পরিবার ছিল কংগ্রেসি। বাড়ির অভিভাবক কবীন্দ্রদার কাকা কামিনী কুমার পুরকায়স্থ কংগ্রেসের উদ্বাস্তু নেতা। ওই বাড়িতেই বসন্তজী এসে থাকতেন। ১৯৫১ সালে কবীন্দ্রদা ম্যাট্রিক পাশ করার পর শিলচরে এসে কার্যালয়ে থেকেই পড়াশোনা আর সঙ্ঘের কাজ চালিয়ে যেতে লাগলেন।
১৯৫৩ সালে ব্যক্তিগত কারণে বসন্তজীকে বাড়িতে যেতে হয়। শিলচর তখন প্রচারক শূন্য। প্রান্ত প্রচারক রামসিংহজী শিলচরে এসে কবীন্দ্রদাকে জানালেন যে বসন্তজী এখন আর আসবেন না। কবীন্দ্রদাকে বললেন ‘এখন থেকে তুমিই প্রচারক, তুমিই কার্যবাহ, তুমিই এখানে সঙ্ঘের কাজ দেখবে।’
বসন্তজী থাকাকালীন কার্যকর্তাদের একটি ভালো গট তৈরি হয়ে গিয়েছিল। তাদের মধ্যে ছিলেন শুধাংশুনাথ মজুমদার, বেণীমাধব দাস, অরবিন্দ ভট্টাচার্য, অরুণ ভট্টাচার্য, শ্যামলকান্তি সেনগুপ্ত, উষারঞ্জন চক্রবর্তী, জগদানন্দ
ভট্টাচার্য, দ্বারিকাপ্রসাদ যাদব, রাজকুমার ভট্টাচার্য প্রমুখ। এদেরকে সঙ্গে নিয়ে কবীন্দ্রদা বরাক উপাত্যকা ত্রিপুরা এবং মণিপুরে সঙ্ঘকাজের বিস্তার করেন।
১৯৫০ সালে রাঘবনজী নামে একজন প্রচারক করিমগঞ্জে (বর্তমান শ্রীভূমি) আসেন। কিন্তু বেশিদিন তাঁর থাকা হয়নি। ব্যক্তিগত প্রয়োজনে তাঁকে ফিরে যেতে হয়।
১৯৫০ সালে অসমে প্রচণ্ড ভূমিকম্প হয়। সময় শ্রীগুরুজী ডিব্রুগড়ে আসেন। পথে শিলচর বিমানবন্দরে অল্প সময়ের জন্য সঙ্ঘের কার্যকর্তাদের সঙ্গে কথাবার্তা বলেন। শিলচরে শ্রীগুরুজীর আনুষ্ঠানিক প্রবাস হয় ১৯৫২ সনে।
১৯৯৪ সালে অসম প্রান্তকে ভাগ করে উত্তর ও দক্ষিণ অসম প্রান্ত তৈরি হয়। দক্ষিণ অসম প্রান্তে ছিল শ্রীভূমি, হাইলাকান্দি, কাছাড় ও ডিমা হাসাও জিলা, ত্রিপুরা রাজ্য, মণিপুর রাজ্য ও নাগাল্যান্ড। পরবর্তী কালে নাগারাজ্যকে উত্তর অসমের সঙ্গে যুক্ত করা হয়। ২০১৩ তে মণিপুর আলাদা প্রান্ত ঘোষিত হয়। আর ২০১৭ সালে ত্রিপুরা প্রান্ত ঘোষিত হয়। বর্তমানে দক্ষিণ অসম প্রান্ত বলতে আসামের ৪ জিলা কাছাড়, হাইলাকান্দি, শ্রীভূমি ও ডিমাহাসা ও মিজোরাম রাজ্য।
এই প্রান্তের প্রথম প্রান্ত প্রচারক গৌরীশঙ্কর চক্রবর্তী, প্রথম প্রান্ত কার্যবাহ ডঃ শঙ্কর ভট্টাচার্য এবং প্রথম প্রান্ত সঙ্ঘচালক শ্রীযুক্ত বিমল নাথ চৌধুরী।
দক্ষিণ অসম প্রান্তের বর্তমান প্রান্ত সঙ্ঘচালক শ্রীযুক্ত জোৎস্নাময় চক্রবর্তী, প্রান্ত কার্যবাহ সুভাষচন্দ্র নাথ, সহ প্রান্ত কার্যবাহ বিমান বিহারী নাথ এবং প্রান্ত প্রচারক গৌরাঙ্গ রায়।
কৃষকদের দ্বারা, কৃষকদের জন্য অখিল ভারতীয় কিষাণ সঙ্ঘ
অজিত বারিক
রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের বিশিষ্ট চিন্তাবিদ ও সংগঠক দত্তোপন্থ ঠেংড়ীজীর উদ্যোগে ১৯৭৯ সালের ৪ মার্চ রাজস্থানের কোটা শহরে অখিল ভারতীয় কিষাণ সঙ্ঘের প্রথম আত্মপ্রকাশ ঘটে। প্রতিষ্ঠার সময় অসম ও তামিলনাড়ু বাদ দিয়ে সারাদেশ থেকে প্রায় দেড় হাজার কৃষক প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন। পশ্চিমবঙ্গ থেকেও তিনজন প্রতিনিধি অধিবেশনে অংশগ্রহণ করেন। সেই অধিবেশনে সংগঠনের জন্য একটি সংবিধানও রচিত হয়।
এর দু’বছর পরে ১৯৮২ সাল থেকে পশ্চিমবঙ্গে ভারতীয় কিষাণ সঙ্ঘ সরকারি স্বীকৃতি লাভ করে। তারপর ১৯৮৬ সালের জুন মাসে কলকাতার জয়সোয়াল ধর্মশালায় বর্ধমান, বাঁকুড়া, মুর্শিদাবাদ, বীরভূম ও হাওড়া জেলা থেকে কয়েকজন কৃষক মিলিত হয়ে প্রথম পশ্চিমবঙ্গের ভারতীয় কিষাণ সঙ্ঘ একটি অ্যাড-হক কমিটি গঠন হয়। তৎকালীন সঙ্ঘের প্রান্ত প্রচারক কেশব রাও দীক্ষিতের সঙ্গে সঙ্ঘের মধ্যাঞ্চল ক্ষেত্র প্রচারক ভাউসাহেব ভুস্কুটেজীর উপস্থিতিতে সর্বসম্মতিক্রমে একটি কমিটি গঠিত হয়। সুনীল কুমার চৌধুরী সভাপতি, অজিত কুমার বারিক সাধারণ সম্পাদক হিসেবে ঘোষণা করা হয়। উপস্থিত সদস্যদের মধ্যে দু’জন সহ-সভাপতি, একজন সহ-সম্পাদক ও একজন কোষাধ্যক্ষ হিসেবে সভায় মনোনীত হন। বাকি উপস্থিত সকলে কমিটির সদস্য হিসেবে বিবেচিত হন। সঙ্ঘের প্রচারক সুকুমার পাত্র সংগঠন সম্পাদক রূপে ঘোষিত হন।
অখিল ভারতীয় কিষাণ সঙ্ঘ কৃষকদের দ্বারা, কৃষকদের জন্য একটি অরাজনৈতিক কৃষক সংগঠন। কৃষির উপর নির্ভরশীল ও আশ্রিত সকলেই কৃষক বলে ধরা হয়। অর্থাৎ গ্রামীণ কারিগর ও খেতমজুরও কৃষক শ্রেণীভুক্ত। প্রথম নিয়মাবলীতে বলা হয় যে প্রতি কৃষক বছরে এক টাকা দিয়ে সদস্যতা গ্রহণ করবেন। পরে জানানো হয় যে প্রতি তিন বছর অন্তর কৃষকদের এই সংস্থার জন্য সদস্য ফি ধার্য করা হবে। গ্রাম সমিতি, খণ্ড সমিতি ও জেলা সমিতি গঠনের মাধ্যমে সংগঠনকে সক্রিয় ও শক্তিশালী করার কথা বলা হয়। ঠিক হয় গ্রাম সমিতিতে কমপক্ষে সাতজন, খণ্ড বা ব্লক, জেলা সমিতিতে ২১ জন এবং প্রদেশ সমিতিতে ২১ জন সদস্য থাকবেন। সংগঠনের কাজের বিকাশ ও অগ্রগতির জন্য তিনটি পদ্ধতি গ্রহণ করা হয়- সংগঠনাত্মক, রচনাত্মক ও আন্দোলনমুখী। সংগঠনের কাজের অগ্রগতির জন্য ৭টি নিয়মবিধি অনুসরণের কথা বলা হয়েছে। প্রথমত, সদস্যতা সংগ্রহ, সাধারণত লোক ও সম্পর্ক লোক ও সংগ্রহ ও লোক নিয়োজনের বিষয়। প্রথমে প্রত্যেক গ্রামে গ্রাম সমিতি কমপক্ষে ৭ জন কৃষক নিয়ে গঠন করতে হবে। দ্বিতীয়ত, কমপক্ষে মাসে একবার বৈঠক গ্রাম সমিতি মণ্ডল সমিতি জেলা সমিতিতে করা কর্তব্য। কমপক্ষে দু’মাস অন্তর সমিতিতে বৈঠক হওয়া বাঞ্ছনীয়। প্রতিটি
সমিতিতে নিয়মিত বৈঠক ইত্যাদি কার্যক্রম না হলে সক্রিয় কার্যকর্তা মাধ্যমে সক্রিয় সংগঠন গড়ে উঠবে না।
ভারতীয় কিষাণ সঙ্ঘে কয়েকটি উৎসব পালন করার কথা বলা হয়েছে। প্রতিবছর ৪ মার্চ প্রতিষ্ঠা দিবস বা সমর্পণ দিবস হিসেবে পালন করা হয়। গ্রামের কৃষকরা সংগঠনের পতাকার সামনে সামর্থ্য অনুসারে অর্থ সমর্পণ করেন। ভাদ্র শুক্লা ষষ্ঠীতে ভগবান বলরামের জন্ম দিবস ভারতীয় কিষাণ সঙ্ঘ পালন করে থাকে। বলা হয় ভগবান বলরাম স্বয়ং কৃষক। তাঁকে ভারতীয় কিষাণ সঙ্ঘ কৃষকের দেবতা রূপে পূজা করে। বলরাম জয়ন্তীকে কৃষি দিবস হিসেবেও পালন করা হয়। কার্তিক মাসে গোপাষ্টমী তিথিতে গো-পূজন করা হয়। সর্বশেষে ২৬ জানুয়ারি ভারতমাতার পূজন করা হয়। দেশমাতা তথা জন্মভূমির প্রতি অনুরাগ ও রাষ্ট্রীয় কর্তব্য বোধ নির্মাণই এই দিনটির একমাত্র উদ্দেশ্য।
পশ্চিমবঙ্গে সংগঠনের প্রথম সংগঠন সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পান প্রচারক সুকুমার পাত্র। পশ্চিমবঙ্গে কিষাণ সঙ্ঘের কাজ তাঁর হাত দিয়েই শুরু। বিভিন্ন জেলায় কিষাণ সঙ্ঘের কাজ ধীরে ধীরে শুরু হয়। পরে তার শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটায় তাকে দায়িত্ব মুক্ত করা হয়। এই দায়িত্বে আসেন কঠোর পরিশ্রমী প্রচারক কে রঙ্গনাথন বা রাঙ্গাদা। রাঙ্গাদার প্রচেষ্টায় হাওড়া হুগলি ও উত্তরবঙ্গের বেশ কয়েকটি জেলায় সংগঠনের কাজের বিস্তার ঘটে। জেলা সদস্যদের প্রতিনিধি নিয়ে একটি সক্রিয় প্রদেশ সমিতি গঠন করেন। ২০০০ সালে উত্তরপ্রদেশে অখিল ভারতীয় সম্মেলন চলাকালীন রাঙ্গাদার আকস্মিক মৃত্যু ঘটে। ২০০২ সালে প্রচারক অমর ভদ্র সংগঠন সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব নেন। তিনি খুব অল্পদিনই তিনি কিষাণ সঙ্ঘের দায়িত্বে থাকেন। এরপরে অমল কুমার ঘোষ দায়িত্বভার সামলান। অমলদা দিনরাত এক করে জেলায় জেলায় প্রবাস করে সমিতিগুলোকে সক্রিয় করেন। কয়েক বছর পর সংগঠন সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পান প্রচারক অনিল রায় এবং অমলদাকে তাঁর সহ রূপে ঘোষণা করা হয়। অনিলদা মূলত উত্তরবঙ্গের কাজ দেখতে থাকেন এবং অমলদা দক্ষিণবঙ্গের। এই সময়ই অমলদার তত্ত্বাবধানে বর্ধমান জেলায় পানাগড়ের নিকট সোয়াই গ্রামে ভগবান শ্রীবলরামের মন্দির নির্মাণের কাজ শুরু হয়। মন্দির নির্মাণ চলাকালীন অমলদার শারীরিক অবস্থা অবনতি হলে তিনি বাড়ি ফিরে যান। এবছরের ১৮ মার্চ অমলদার মৃত্যু ঘটে।
দক্ষিণবঙ্গে ভারতীয় কিষাণ সঙ্ঘের কাজ অমলদার সময়েই গতিশীলতা পায়। অমলদার শারীরিক অবনতি পরবর্তীতে তার বাড়ি ফিরে যাওয়া সংগঠনের এক অপূরণীয় ক্ষতি। বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গ সংগঠনের সদস্য সংখ্যা প্রায় ২৪০০০ জন। অনিল রায় সুরে পশ্চিমবঙ্গের সংগঠন সম্পাদক হিসেবে কাজ করছেন। বর্তমান সভাপতি অনিমেষ পাহাড়ি ও সম্পাদক আশিস সরকার।
সক্ষম স্থাপনার পূর্ব কথন এবং পশ্চিমবঙ্গে কার্যধারার সূত্রপাত
ডা: সনৎ কুমার রায়
সঙ্ঘের ভাবধারায় ভাবিত বিবিধ সংগঠন বিভিন্ন ক্ষেত্রে জনহিতার্থে নির্দিষ্ট কর্ম করে চলেছে। কিছু বরিষ্ঠ কার্যকর্তা বিশেষ করে তৎকালীন সহ সরকার্য মদন দাসজী এবং পূর্বক্ষেত্রের তৎকালীন সঙ্ঘচালক কালিদাস বসুর আগ্রহে কলকাতায় ১৯৯৭ সালের ২১ ডিসেম্বর ‘অখিল ভারতীয় দৃষ্টিহীন কল্যাণ সঙ্ঘ’ স্থাপনা করা হয়। সঙ্ঘ কার্যকর্তা বিনয়কৃষ্ণ রস্তোগী সভাপতি, সংগঠন সম্পাদক দৃষ্টিহীন স্বয়ংসেবক দিলীপ ঘোষ এবং দৃষ্টিহীন অধ্যাপক অরবিন্দ পাত্র সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব ভার গ্রহণ করেন। তৎকালীন সঙ্ঘের প্রদেশ ও ক্ষেত্রের সকল কার্যকর্তা এই নতুন সংগঠনের পূর্ণতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে আন্তরিক প্রচেষ্টা ও সহযোগিতা প্রদান করেন। এই সংগঠন কিছুদিনের মধ্যে দেশের প্রায় সব প্রদেশে বিস্তার লাভ করে।
পরবর্তীকালে গভীরভাবে চিন্তাভাবনা ও বিবেচনা করে কেবল মাত্র দৃষ্টিহীনদের জন্য এই সংগঠনকে সবশ্রেণীর প্রতিবন্ধী বন্ধুদের সহযোগী হবার জন্য সর্বভারতীয় সংগঠন ‘সক্ষম’ স্থাপনা করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। তৎকালীন সরকার্যবাহ ভাইয়াজী যোশীর একান্ত আগ্রহে।
নাগপুর নগরে বিগত ২০০৮ সালের ২০ জুন সক্ষম স্থাপনা করা হয়। এই সংগঠনের প্রথম সভাপতি নিযুক্ত হন মধ্যপ্রদেশের চাঁপা কুষ্ঠাশ্রমের প্রধান দামোদর গণেশ বাপট, সহ-সভাপতি ডাঃ মিলিন্দ কস্নেকর, সাধারণ সম্পাদক অবিনাশ সাংহাই, সংগঠন সম্পাদক ডাঃ কমলেশ কুমার এবং কোষাধ্যক্ষ অরুণ বাজোরিয়া।
সক্ষম দক্ষিণবঙ্গের কার্যনির্বাহক সমিতি গঠনকল্পে কলকাতায় কেশব ভবনে প্রথম
সমদৃষ্টি, ক্ষমতা বিকাশ এবং অনুসন্ধান মণ্ডল
বৈঠক হয় ২০০৪ সালের ২ নভেম্বর। উপস্থিত ছিলেন ১৫ জন। ওই বৈঠকেই নতুন কার্যনির্বাহক সমিতি গঠনের জন্য ডাঃ সনৎ কুমার রায়কে আহ্বায়ক নিযুক্ত করা হয় এবং লক্ষণাপুরীতে (লক্ষ্ণৌ) প্রথম রাষ্ট্রীয় অধিবেশনে প্রতিনিধিরা অংশগ্রহণ করবেন স্থির হয়।
২০০৯ সালের ২৩ জানুয়ারি কলকাতায় কেন্দ্রীয় কোষাধ্যক্ষ অরুণ বাজোরিয়ার উপস্থিতিতে প্রথম কার্যনির্বাহক সমিতি গঠিত হয়। সভাপতি ডাঃ সনৎ কুমার রায়, সহ-সভাপতি নারায়ণ সোমানী, সম্পাদক অজয় কুমার বিশ্বাস, কোষাধ্যক্ষ মানিক দাস, সদস্য অরবিন্দ পাত্র-সহ আরও চারজন ওই সমিতিতে যুক্ত হন।
২০১১ সালের ১৭-১৮ ডিসেম্বর সক্ষম
দক্ষিণবঙ্গের প্রাদেশিক অধিবেশন মুর্শিদাবাদ জেলার মহুরাকান্ডি গ্রামে শ্রীরামকৃষ্ণ আশ্রমে অনুষ্ঠিত হয়। স্থানীয় দিব্যাঙ্গজন-সহ ৪৫ জন উপস্থিত ছিলেন। বিশ্বরূপ ঘোষ, অরিন্দম উপাধ্যায়, সমীর মণ্ডল-সহ কার্যকর্তাদের পরিশ্রমের ফলে ওই অধিবেশন সাফল্যলাভকরে। ৬টি জেলার প্রতিনিধিত্ব সংগঠনের ভবিষ্যতের শ্রীবৃদ্ধির লক্ষণ দেখা যায়। ওই
অধিবেশনে পূর্ণ সময় কেন্দ্রীয় তৎকালীন সংগঠন সম্পাদক ডাঃ কমলেশ কুমার, কেন্দ্রীয়
কোষাধ্যক্ষ অরুণ বাজোরিয়া সঙ্গের স্থানীয় অনেক কার্যকর্তা উপস্থিত ছিলেন। অরিন্দম উপাধ্যায় নতুন সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব ভার গ্রহণ করেন।
রাষ্ট্রীয় অধিবেশনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ২০১৪ সালের ২১ মে রাষ্ট্রীয় পরিষদ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় কলকাতায় ‘হরিয়ানা ভবনে’। বিভিন্ন প্রদেশের প্রতিনিধিরা ওই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন, তৎকালীন ক্ষেত্র প্রচারক অদ্বৈতচরণ দত্ত সমাপ্তি অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। প্রাদেশিক কার্যকর্তাদের সক্রিয় সহযোগিতায় এই বৈঠকে সূচারু ভাবে সম্পন্ন হয়। ২০১৭সালে যোজনা বৈঠকে অনিখ ব্যানার্জী সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। বর্তমানে ডাঃ অরবিন্দ ব্রহ্ম সভাপতি, অনিখ ব্যানার্জী সম্পাদক এবং কমল গোয়েল কোষাধ্যক্ষ হিসাবে অন্যান্য সদস্যদের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেন। উত্তরবঙ্গ প্রান্ত আলাদা হওয়ায় সেখানের প্রান্ত সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন জলপাইগুড়ি নগরের স্বয়ংসেবক চন্দন রায়।
প্রাদেশিক এবং জেলা স্তরে সমাজের সবক্ষেত্রে বিশেষ করে দিব্যাঙ্গ জনদের ক্ষেত্রে চক্ষুপরীক্ষা শিবির, রক্তদান শিবির এবং
করোনাকালে সেবা ইন্টার ন্যাশনালের সহযোগিতায় সেবা বস্তু, চিকিৎসা সরঞ্জাম বিতরণ করে; দিব্যাঙ্গ বিদ্যালয়গুলিতে খাদ্যবস্তু প্রদান করে সহায়তা করা হয়েছে এবং আগামী দিনেও হবে। এছাড়া প্রতি বছর নেত্রদান সচেতনা পক্ষ পালনের মাধ্যমে কর্নিয়াগত অন্ধত্ব দূরীকরণের প্রচেষ্টা করা হয়। জনসচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে দিব্যাঙ্গ জনদের সমাজে প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে বিবিধ কার্যক্রম করা হয়।
অধিবক্তা পরিষদ-পশ্চিমবঙ্গে ন্যাশনালিস্ট ল’ইয়ার্স ফোরাম
দীপঙ্কর দণ্ডপাট
সত্তরের দশকে জরুরি অবস্থা জারির অভিশপ্ত কালখণ্ডের বিভীষিকাময় পরিস্থিতিতে যখন সমগ্র ভারতবাসীর কণ্ঠরোধ করে প্রতিবাদীদের বেআইনিভাবে কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়েছিল সেই সময় কলকাতা হাইকোর্টের বিশিষ্ট আইনজীবী ও স্বয়ংসেবক কার্যকর্তা কালিদাস বসু তাঁর কয়েকজন রাষ্ট্রভক্ত আইনজীবী বন্ধুর সহযোগিতায় ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তে ভারতমাতার নিরপরাধ সন্তানদের মুক্তির জন্য সাহসিকতার সঙ্গে বিভিন্ন আদালতে সওয়াল করেন এবং
নিরন্তর আইনি পরিষেবা দেওয়ার চেষ্টা করেন। জরুরি অবস্থার অবসানের পর ১৯৭৭ সালের ২৯ আগস্ট কালিদাস বসুর নিরলস প্রচেষ্টায় তৈরি হয় ন্যাশনালিস্ট ল’ইয়ার্স ফোরাম তৈরি হয়। এটাই ছিল সারা ভারতবর্ষের প্রথম রাষ্ট্রবাদী বিচারধারাসম্পন্ন আইনজীবীদের
অরাজনৈতিক, সামাজিক সংগঠন যার প্রধান উদ্দেশ্য সমাজের প্রান্তিক স্তরে বসবাসকারী-মানুষদের আইনি সহায়তা প্রদান করা এবং হিন্দুরাষ্ট্র ও সনাতনী চিন্তাধারাকে ভারতীয় আইন ব্যবস্থার মধ্যে আগামীদিনে সুদৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করে বিভেদহীন বন্ধুত্বপূর্ণ এক সমাজ তৈরির প্রচেষ্টা। ১৯৭৭ সালের পর থেকে ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তে এভাবে একে একে বিভিন্ন নামে রাষ্ট্রভক্ত আইনজীবীদের সংগঠন তৈরি হয় স্বয়ংসেবকদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায়।
বিশিষ্ট চিন্তাবিদ, রাষ্ট্রনেতা ও রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের বরিষ্ঠ কার্যকর্তা দত্তোপস্ত ঠেঙড়ীজী এক সুচারু চিন্তাধারার মাধ্যমে সারা ভারতের সমস্ত রাষ্ট্রভক্ত ও সম্ভাবনাসম্পন্ন অরাজনৈতিক আইনজীবী সংগঠনগুলিকে একই ছাতার তলায় এনে ১৯৯২ সালের ৭সেপ্টেম্বর প্রতিষ্ঠা করেন অখিল ভারতীয় অধিবক্তা পরিষদ।
ন্যাশনালিস্ট ল’ইয়ার্স ফোরাম পশ্চিমবঙ্গের প্রান্তের প্রতিটি জেলায় তাদের কার্যকর্তাদের মাধ্যমে অখিল ভারতীয় অধিবক্তা পরিষদ নির্ধারিত সারা বছরের কার্মসূচি ও কার্যক্রম নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করে। বর্তমান চারটি আয়াম দ্বারা সংগঠনের কাজগুলিকে পশ্চিমবঙ্গের সমস্ত কোর্ট ইউনিট নিয়মিতভাবে এগিয়ে নিয়ে চলেছে। বিশেষ উল্লেখযোগ্য- সঙ্ঘের শতবর্ষ উপলক্ষ্যে ন্যাশনালিস্ট ল’ইয়ার্স ফোরাম পঞ্চ পরিবর্তনের যোজনাকে সর্বাগ্রে রেখেছে।
শিবজ্ঞানে জীবসেবার উদ্দেশ্যে ভারতীয় হোমিওপ্যাথিক সমাজ
ডাঃ সুকুমার মণ্ডল ও ডাঃ জয়দেব কুণ্ডু
১৯৮৪ সালের ৩০ এপ্রিল কয়েকজন তরুণ চিকিৎসক ‘হোমিওপ্যাথি চিকিৎসাশাস্ত্রের’ আলোচনার জন্য একটি মাসিক পাঠচক্র শুরু করেন। নাম দেন ‘ভারতীয় হোমিওপ্যাথিক সমাজ। স্থান: ডাঃ সুকুমার মণ্ডলের চেম্বার-৫৩৩, রামদুলাল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা-৬। পরবর্তীকালে সংগঠন রূপে আত্মপ্রকাশ করে প্রান্ত প্রচারক কেশবরাও দীক্ষিতের অনুপ্রেরণায়। তিনি ছিলেন সংগঠনের প্রাণপুরুষ। সেই শুভ দিনটি ছিল ১ ফেব্রুয়ারি ১৯৯০, স্থান কেশব ভবন। এই সংগঠন গড়ার অন্যতম কারিগর হলেন ডাঃ সনৎ বসু মল্লিক, ডাঃ সুকুমার মণ্ডল, ডাঃ আশিস কুমার মণ্ডল, ডাঃ প্রবীর কুমার মুখার্জি ও ডাঃ জয়দেব কুণ্ডু।
ভারতীয় হোমিওপ্যাথিক সমাজ একটি জাতীয়তাবাদী, সংগঠনাত্মক, সংস্কারাত্মক অরাজনৈতিক সংগঠন। বিশুদ্ধ হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক নির্মাণের লক্ষ্যে তৈরি হয়।
বিশুদ্ধ হোমিওপ্যাথি:
(ক) উন্নতর চর্চার মাধ্যমে বিশুদ্ধ হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা শাস্ত্রের অনুকূল বাতাবরণ তৈরি করা, সংরক্ষিত ও পরিবর্ধিত করা। বিশুদ্ধ হোমিওপ্যাথির মূলনীতিগুলি হলো- (১) সদৃশ বিধান, প্রত্যেক রোগীর প্রতি সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গী ও ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্য দ্বারা (এককভাবে) স্বতন্ত্রীকরণ পদ্ধতি; স্বাস্থ্য, রোগ ও আরোগ্য বিষয়ে গতিময়, চৈতন্য স্বরূপ ও মায়জমজনিত দৃষ্টিভঙ্গী।
(২) প্রতিবারে একটিমাত্র ওষুধ প্রদান।
(৩) স্বল্প (সূক্ষ্মমাত্রা) ব্যবহার।
একজন আদর্শ হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক হিসেবে নিজেকে গড়ে উঠতে এবং অন্যদের গড়ে তুলতে সচেষ্ট হবেন। ফলস্বরূপ, জনগণের মধ্যে হোমিওপ্যাথির প্রতি শ্রদ্ধাশীলতা বাড়বে এবং হোমিওপ্যাথির নামে
অপহোমিওপ্যাথিক ওষুধ দেওয়া নেওয়া থেকে বিরত হবে।
(খ) ভারতীয় দর্শন-সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও পরম্পরার প্রতি শ্রদ্ধা জাগৃতির বিষয়ে চর্চা হয়। সর্বদা সদস্যদের স্বাধ্যায়ের প্রেরণা দেওয়া হয়, নীতি মননের উৎসাহ দেওয়া হয় এবং চিন্তনের সামগ্রী জোগানো হয়, চিকিৎসকদের হোমিও নীতির প্রতি নিষ্ঠা ও প্রত্যয় বৃদ্ধি হয়। ফলশ্রুতিতে চিকিৎসকদের চিকিৎসাকার্য এবং ব্যক্তিজীবন উভয়েরই সংস্কার সাধন সম্ভব হয়।
(গ) সেবা: ‘শিবজ্ঞানে জীব সেবা’ মনোভাব নিয়ে স্বাস্থ্য সচেতন শিবির এবং সমাজের বিভিন্ন সেবা প্রকল্পে অংশগ্রহণ করা হয়।
কার্যক্রম:
উদ্দেশ্য সিদ্ধির উপায়রূপে (১) হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক নির্মাণ।
(২) সংগঠক।
(১) বার্ষিক হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক সম্মেলন শুরু হয় ১৯৯৭ সাল থেকে। এই উপলক্ষ্যে স্মরণিকা প্রকাশ শুরু হয় ১৯৯৪ সাল থেকে।
(২) মাসিক পাঠচক্র শুরু হয় ১৯৯৭ সালে। প্রতি মাসের চতুর্থ বৃহস্পতিবার দুপুর ২টায় কেশব ভবনে আজও তা অব্যাহত আছে।
(৩) বার্ষিক শিক্ষা শিবির শুরু হয় ১৯৯৮ সালে।
শিবির রচনার বিন্দু:
হোমিও বিজ্ঞান ও দর্শনের উন্নতর চিন্তন, মনন
এবং ব্যবহারিক দিক নিয়ে।
সংগঠন-কার্যপদ্ধতি।
পরিবার সমাজ-পরিবেশ, শুদ্ধ ও সুন্দর করা এবং সবার মধ্যে। একাত্মবোধ নির্মাণ করা।
আধ্যাত্মিক- প্রভাতী ধ্যানের ক্লাস, ধর্মগ্রন্থ থেকে আলোচনা ও ব্যাখ্যা।
দেশভক্তি- রাষ্ট্রীয় মহাপুরুষের জীবনীর আলোকপাত।
(৪) মূল্যায়ন অথবা চিন্তন বৈঠক:
একজন কার্যকর্তারূপে বা সংগঠক রূপে ব্যক্তিগত ও সংগঠনগত আত্ম সমীক্ষা করা। সংগঠনের প্রসার এবং চিকিৎসক জীবনে উৎকর্ষতা নিয়ে ভাবনা-চিন্তন। বৈঠকের মূল কথা হলো- প্রতিযোগিতা নয়, সহযোগিতা; বিরোধ নয়, সহমর্মিতা।
(৫) সাংগঠনিক কর্মসূচি:
বার্ষিক চিকিৎসক সম্মেলনের জন্য জেলা শাখা বৈঠক ও ভ্রমণ।
শাখা মিলন ও হোমিও বিজ্ঞান ও দর্শন আলোচনা কেন্দ্র।
স্বাস্থ্য সচেতন শিবির আয়োজন।
(৬) বার্ষিক অনুষ্ঠান সূচি:
মহাত্মা হ্যানিম্যান ও বিজ্ঞান সভা।
রাখিবন্ধন- কার্যালয় কেন্দ্রে ও শাখা কেন্দ্রের আয়োজনে।
৩৫ বছর এই ব্যতিক্রমী কার্যক্রম করার পর ভারতীয় হোমিওপ্যাথিক সমাজ একটি আদর্শগত গঠনমুখী সংগঠন রূপে পরিচিতি লাভ করেছে পশ্চিমবঙ্গের হোমিওপ্যাথিক জগতে।
বর্তমানে সংগঠনের শাখার সংখ্যা তিনশতাধিক। সকলের সহযোগিতা ও শুভকামনা নিয়ে সংগঠনের পরিচালন সমিতি সম্প্রতি একটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে একটি স্থায়ী সেবাকেন্দ্র তথা কার্যালয় স্থাপনের জন্য উত্তর কলকাতার হাতিবাগান ও হেদুয়ার সন্নিকটে ৮০০ বর্গ ফুটের একটি ফ্ল্যাট কেনার জন্য চুক্তিপত্রে আবদ্ধ হয়েছে। এর জন্য আনুমানিক ৮০ লক্ষ টাকার প্রয়োজন। শুভাকাঙ্ক্ষী মানুষের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ অভিযান চলছে। আয়কর আইনে ৮০ জি ধারায় এই দান আয়করমুক্ত।
শ্রমিকের রাষ্ট্রীয়করণে
ভারতীয় মজদুর সঙ্ঘ
বিশ্বজিৎ বসু
ভারতীয় মজদুর সঙ্ঘ একটি সর্বভারতীয় সর্ববৃহৎ অরাজনৈতিক দেশভক্ত শ্রমিক তথা মজদুর সংগঠন।
১৯৫৫ সালের ২৩ জুলাই মধ্যপ্রদেশের ভোপাল শহরে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের আদর্শ মাথায় নিয়ে দ্বিতীয় সরসঙ্ঘচালক মাধবরাও সদাশিব রাও গোলওয়ালকরের নির্দেশে তথা পরামর্শে ঋষিপ্রবর সঙ্ঘের প্রচারক দত্তোপন্ত ঠেংড়ীজী সারা ভারতের শ্রমিক তথা মজদুর ক্ষেত্রে ভারতীয় মজদুর সঙ্ঘ প্রতিষ্ঠা করেন। ভোপাল থেকে তিনি ধীরে ধীরে ধীরে ভারতের বিভিন্ন শহরে তথা বিভিন্ন প্রদেশে সংগঠনের কার্যধারা বিস্তৃত ও পরিচালনা করেন। এই মহৎ কার্যে ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের সঙ্ঘের প্রচারকদের সঙ্গে মিলিত হয়ে স্থানীয় শ্রমিক তথা মজদুর ক্ষেত্রে সংগঠনের কার্যধারা চালু করেন।
সেই মতো এই পশ্চিমবঙ্গেও বিভিন্ন শ্রমিক তথা মজদুর ক্ষেত্রে সংগঠনের কাজ শুরু হয় এবং ধীরে ধীরে তা বিস্তারলাভ করে। সেসময় এই মহৎ কার্যে যোগদান করেন নরেশচন্দ্র গাঙ্গুলী। তাঁকে তখন এ রাজ্যে সংগঠনের সদস্যকরণ ও কার্যধারা পরিচালনা করতে সাহায্য ও সহযোগিতা করেন এই প্রদেশের বহু প্রচারক তথা শ্রমিকনেতা যেমন-রাসবিহারী মৈত্র, বৈজনাথ রায়, অরুণ মজুমদার প্রমুখ কুশলী সংগঠকরা। নরেশচন্দ্র গাঙ্গুলী দত্তোপন্ত ঠেংড়ীজীর নির্দেশে কলকাতা হাইকোর্ট পাড়ায় ১০নং কিরণ শংকর রায় রোডের একটি ঘরে বিএমএস পশ্চিমবঙ্গের কার্যালয় প্রতিষ্ঠা
করেন। ওই সময় সঙ্ঘের বহু প্রচারক ও শ্রমিক নেতাদের অক্লান্ত প্রচেষ্টায় ও প্রবাসের ফলে এ রাজ্যের বিভিন্ন শহরে তথা বহু জেলায় কার্যালয় তৈরি হয় এবং
সদস্য সংগ্রহ অভিযান চালু হয়। ধীরে ধীরে এই রাজ্যের শ্রমিক তথা মজদুরদের সদস্য বানিয়েও সংগঠিত করে এই বিএমএস সংগঠনটি সরকারি মান্যতা প্রাপ্ত ট্রেড ইউনিয়নের মর্যাদালাভ করে। বর্তমানে এই ভারতীয় মজদুর সঙ্ঘ সারা ভারতে সর্ববৃহৎ ট্রেড ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় সরকার দ্বারা স্বীকৃতি লাভ করেছে।
আমরা পশ্চিমবঙ্গের বিএমএস সদস্য এবং সঙ্ঘ কার্যেরত প্রচারকরা বিএমএস-এর ব্যাপকতা ও শক্তিশালী সংগঠনের জন্য গর্বিত ও অনুপ্রাণিত। বর্তমানে এই প্রদেশে বিএমএস পশ্চিমবঙ্গের সকল কার্যকর্তা নিষ্ঠার সঙ্গে
সংগঠন পরিচালনা করছেন। যেমন কেন্দ্রীয় সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে কর্মরত কর্মচারীদের ক্ষেত্রে, এই রাজ্যের সরকারি কর্মচারীদের ক্ষেত্রে এবং সেখান থেকে অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারীদের ক্ষেত্রে, বিভিন্ন জুটমিলে কর্মরত শ্রমিকদের ক্ষেত্রে, এরাজ্যের সব বরিষ্ঠ নাগরিকদের ক্ষেত্রে, ব্যাংক কর্মচারীদের ও রেল কর্মচারীদের ক্ষেত্রে প্রভৃতি ক্ষেত্রে বিএমএস পশ্চিমবঙ্গ তাদের সংগঠন মজবুত করে চলেছে।
এছাড়া পাবলিক সেক্টর, প্রাইভেট সেক্টর, সোশ্যাল সিকিউরিটি সেক্টর, আন অরগানাইজড সেক্টর প্রভৃতি স্থানে বিএমএস সর্বভারতীয় স্তরে দায়িত্ব পালন করে চলেছে এবং এক দেশভক্ত শ্রমিকদের নিয়ে একশক্তিশালী মজবুত সংগঠন তৈরি করতে পেরেছে। ডাঃ কেশব বলিরাম হেডগেওয়ারের প্রত্যাশিত ও স্বপ্নের এক বৈভবশালী হিন্দুরাষ্ট্র গঠনে বিএমএস-এর এই সদস্যরা ও সদস্যারা আগামীদিন এক উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করবে। আমরা যারা বর্তমানে এই রাজ্যে বিএমএস দ্বারা পরিচালিত ও স্বীকৃত সংগঠনের সদস্যপদ গ্রহণ করে নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করে চলেছি তাদের জীবন ও কর্মধারা সার্থকতা লাভ করেছে। একজন দেশভক্ত শ্রমিক তথা মজদুর রাজ্যে তথা ভারতের সম্পদ ও যোগ্য নাগরিক। বিএমএস-এর লক্ষ্য হলো ‘রাষ্ট্রের উদ্যোগীকরণ’, উদ্যোগের শ্রমিকীকরণ ও শ্রমিকের রাষ্ট্রীয়করণ’।