শতবর্ষে সঙ্ঘ এবং বঙ্গে রামনবমী
শতবর্ষে এসে একথা স্বীকার করার সময় হয়েছে যে, রাষ্ট্রীয়
স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ একটি আদর্শের নাম। যদি ১৯৪৭-এর আগে
দেশভাগজনিত পরিস্থিতি না হতো, কিংবা ভারতবর্ষ যদি হাজার বছরের
পরাধীনতা ভোগ না করতো, তাহলেও একটি জাতির আত্মোন্নতির
জন্য সঙ্ঘের আদর্শকে বিশেষ প্রয়োজন ছিল। সঙ্ঘের প্রয়োজনীয়তা
আপেক্ষিক না হলেও বর্তমান যুগের প্রয়োজনে সঙ্ঘের প্রাসঙ্গিকতা
আরও বেশি উপলব্ধি হয়। আমাদের রাজ্যকে দিয়েই শুরু করা যাক।
২০০৪ সালে লোকসভা নির্বাচনের প্রাক্কালে সিপিএম মহম্মদ
সেলিমের নির্বাচনী ক্যাম্পেনে উত্তর কলকাতায় ধুয়ো তুললো,
‘সঙ্ঘ-বিজেপি’ নাকি বঙ্গ সংস্কৃতির সঙ্গে খাপ খায় না। এহেন যুক্তির
অসারতা নিয়ে বলার আগে সিপিএমের এই অজ্ঞতাপ্রসূত
সঙ্ঘ-বিজেপিকে একই পঙ্ক্তিভুক্ত করার ব্যাপারেও কিছু বলা দরকার।
রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের উচ্চাদর্শের সঙ্গে ভারতের দলীয়
রাজনৈতিক কোন্দলের যোগ কোনোদিনই ছিল না, আজও নেই।
কোনো সন্দেহ নেই যে বিজেপি একটি রাষ্ট্রবাদী দল এবং বিজেপির
শীর্ষনেতৃত্বের একটা বড়ো অংশই সঙ্ঘের স্বয়ংসেবক। কিন্তু সঙ্ঘ যে
সামাজিক জাগরণের মধ্য দিয়ে ভারতবাসীর আত্মগরিমা, দেশপ্রেম
ফিরিয়ে আনতে চায়, তার সঙ্গে ক্ষুদ্র দলীয় রাজনীতির কোনো সম্পর্ক
নেই। তাই আজ যখন রামনবমী উদ্যাপনকে কেন্দ্র করে আপামর
হিন্দু বাঙ্গালি পথে নেমেছে তখন ‘সেকুলারিজম’-এর আড়ালে
ভারতবাসীকে আপন গরিমা ভুলিয়ে দেওয়ার চক্রান্তকারীরা প্রমাদ
গুনেছেন। সঙ্ঘ বিশ্বাস করে প্রত্যেক ভারতবাসীর উপাসনাপদ্ধতি
ভিন্ন হতে পারে, কিন্তু রাষ্ট্রীয়তা এক।
তাই এবার রামনবমী উদ্যাপনে দেখা গেল, এরাজ্যের নারী ও
শিশুকল্যাণ মন্ত্রী শশী পাঁজা মন্দির টুরের আয়োজন করেছেন। তিনি
বাগবাজারের হনুমান ও শীতলা মন্দিরে পূজা দিয়ে এই বিশেষ দিনটি
শুরু করেছেন। চুঁচুড়ায় তৃণমূল বিধায়ক অসিত মজুমদারের নেতৃত্বে
রামনবমীর মিছিলে রবীন্দ্রসঙ্গীত ও নাম সংকীর্তনের মিশ্রণে ‘বঙ্গের
হিন্দুত্ব’ ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। আবার ক্যানিঙের তৃণমূল বিধায়ক
সওকত মোল্লা মিছিলে সাঁওতালি নাচ ও মাদল বাজিয়ে হিন্দু ঐক্যের
বার্তা দিয়েছেন, যা সঙ্ঘের ‘সামগ্রিক সমাজ’ আদর্শেরই প্রতিফলন।
শিলিগুড়ির মেয়র গৌতম দেব সত্যনারায়ণ মন্দির থেকে রামকৃষ্ণ
মিশন পূজানুষ্ঠানে যোগ দিয়ে, রাতে বাড়িতে নারায়ণ পূজার আয়োজন
করেন। সিউড়িতে তৃণমূলের মিছিলে শ্রীরামচন্দ্রের বিশাল কাটআউটের
পাশাপাশি মনীষীদের ছবি তুলে ধরা হয়েছে, যা একদিকে ধর্মীয় আবেগ
এবং অন্যদিকে সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবোধের মিশ্রণ।
রাজ্যের শাসক দলের শীর্ষ নেতৃত্ব কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়, ফিরহাদ
হাকিম, সায়ন্তিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, সৌগত রায়, কুণাল ঘোষ-সহ স্থানীয়
নেতারা- সকলেই পূজা, মিছিল ও ধর্মীয় শোভাযাত্রায় শামিল হন।
স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী রামনবমীর প্রাক্কালে টুইট করে লিখেছেন, ‘সবাইকে
রামনবমীর শুভেচ্ছা। শান্তি বজায় রেখে উৎসব পালন করুন।’
মর্যাদাপুরুষোত্তম শ্রীরামচন্দ্র সমগ্র ভারতবর্ষের আস্থার প্রতীক।
কোনো রাজনৈতিক সম্পত্তি বলে সঙ্ঘ কখনো মনে করেনি। একথা
ঠিক যে, রাজনৈতিকভাবে যখন তাঁকে ভুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছিল,
তখন ভারতীয় জনতা পার্টি তাঁকে সামনে রেখে পথ চলেছিল। আজ
যখন ‘রামনবমী বাংলার সংস্কৃতি নয়’ বলে বামপন্থীদের প্রচার সত্ত্বেও
শোভাযাত্রায় সাধারণ মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত ঢল, আর চাপে পড়েই হোক
বা অন্য যে কোনো কারণেই হোক রাজ্যের শাসক দলের নেতা-নেত্রীদের
রামনবমী পালন, বুঝিয়ে দিচ্ছে বাঙ্গালিয়ানা বৃহত্তর ভারতীয়ত্বের সঙ্গে
মিশে যাচ্ছে, যা আটাত্তর বছর আগেই হওয়া বাঞ্ছনীয় ছিল, তা বহু
সংগ্রামের পথ পেরিয়ে এসে আজ সম্ভব হয়েছে।
বঙ্গভূমিতে শ্রীরামচন্দ্রের জনপ্রিয়তা লক্ষ্য করা যায় রামায়ণ
অনুবাদের প্রয়াসেও। চতুর্দশ শতকের শেষে শান্তিপুরের কাছে ফুলিয়ায়
জন্ম হলো মধ্যযুগের অন্যতম উল্লেখযোগ্য কবি কৃত্তিবাস ওঝার। নদীয়া
তখন বঙ্গের সংস্কৃতি ও জ্ঞানচর্চার কেন্দ্র, স্মৃতিশাস্ত্র, তর্কশাস্ত্রজ্ঞ
পণ্ডিতদের বাসভূমি। তেমনই এক পণ্ডিত গৌড়েশ্বর গণেশনারায়ণ
ভাদুড়ির পৃষ্ঠপোষকতায় বাল্মীকি রামায়ণের সহজবোধ্য বঙ্গানুবাদ করেন
কৃত্তিবাস। আজও যা কৃত্তিবাসী রামায়ণ নামে সমাদৃত। বঙ্গে রামের পূজা
ও রামনাম সংকীর্তনের প্রচলন তখন থেকেই।
এছাড়াও শ্রীরামপুর, রামরাজাতলা, রঘুনাথপুর ইত্যাদি একাধিক
স্থানের সঙ্গে শ্রীরাম পূজার ইতিহাস জড়িত ওতপ্রোতভাবে। বিভিন্ন
স্থানের নামে রাম শব্দটি আছে বলেই রাম বঙ্গ সংস্কৃতির অঙ্গ, এতটা
সরলীকৃত না হলেও বঙ্গে রামের প্রভাব অস্বীকারের উপায় নেই। হাওড়ার
রামরাজাতলায় পূজিত হন রাজা শ্রীরামচন্দ্র। গাত্রবর্ণ সবুজ, গুম্ফসমন্বিত
মুখমণ্ডল। তাত্ত্বিকদের মতে বাঙ্গালির নিজস্ব নির্মাণশৈলী অনুসারে গড়া
এই রাম। রামের পূজার পর এখানে প্রায় চার মাস ধরে মেলা চলে, যা
বঙ্গের বৃহত্তম মেলা। পুরুলিয়ার বিখ্যাত শহর রঘুনাথপুর। শহরের
নামকরণ হয়েছিল ওই এলাকার প্রায় ৩০০ বছরের পুরনো রঘুনাথ
জিউর মন্দিরের নামে। রঘুনাথ জিউ আদতে শ্রীরামচন্দ্র। শ্রীরামপুর
নামের উদ্ভব প্রসঙ্গে তাত্ত্বিকেরা বলছেন শ্রীপুর ও শ্রীরাম শব্দদ্বয়ের
কথা। অতএব স্থানের নাম শ্রীরামপুর হওয়া অস্বাভাবিক নয়। ভগবান
শ্রীরামচন্দ্রকে নিয়ে গান লিখেছিলেন মুসলমান কবি কাজী নজরুল
ইসলাম। তাঁর রচিত ‘মন জপ নাম শ্রী রঘুপতি রাম’ সংগীতটি শ্রীরামের
পূজানুষ্ঠানে এবং রামনবমীতেই বাজানো হয়।
যাইহোক, কং-সিপিএম একে বিজেপি-তৃণমূল সেটিং বা
আরএসএসের এটিম-বিটিম যা খুশি বলেই আখ্যায়িত করুক না কেন,
আজ জনমানস পরিবর্তনে তারা ভীতসন্ত্রস্ত। আর এই ভয়ের চিহ্নই
ফুটে উঠেছে তাদের চোখেমুখে। মনে রাখতে হবে, রাজ্যজুড়ে সীমাহীন
আর্থিক দুর্নীতি, শিক্ষা জালিয়াতি করে একটি গোটা প্রজন্মকে ধ্বংস
করে দেওয়ার মতো পাপ কাজ থেকে কিন্তু রামনামে রেহাই মিলবে না।