পশ্চিমবঙ্গের যুবসমাজকে মাদকাসক্তিতে বুঁদ করে রাখতে চায় রাজ্যের শাসক দল
ড. রাজলক্ষ্মী বসু
একটা প্রস্তাব রইল তৃণমূল কংগ্রেস এবং তাদের ছাত্র যুব সংগঠনের কাছেও। তৃণমূলের বক্তব্য অনুযায়ী তারা অন্যায়ের সঙ্গে ঘর করেই না। তাহলে একটা প্রতিবাদ কর্মসূচি হয়ে যাক, ছাত্র ও যুব সমাজের মাদকাসক্তির বিরুদ্ধে। হোক জোর প্রতিবাদ। যেহেতু মাঝে মধ্যেই তৃণমূল বলে তাঁরা আত্মশুদ্ধি করে, এই বিষয়ে একবার শুদ্ধীকরণ হোক তবে। যে রাজনৈতিক বেয়াদপির কারখানা এরাজ্যে চলছে তার চাকার বড়ো শক্তি যুবসমাজ এবং তাদের ফুর্তি আসে কারণ কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে, পাড়ার চত্বরে, ঠেকে, গুমটিতে মাদক মেলে। তার হিসেব আমাদের হাতে সরকারি ভাবে নেই। কিন্তু ড্রাগ, গাঁজা এবং অন্যান্য নানান ‘হরেকরকমবা’ নামের মাদক চক্রের খোঁজ বার বার এসেছে সংবাদে, অভিযোগে, খবরে, কখনো পুলিশের জালেও। রাজ্যের নামি বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর মাদকের আস্ত ঘাঁটিতে পরিণত হয়েছে। তৃণমূল দল যুবসমাজের সামনে এই আশু লোভটাই পেতেছে। নেশা করো তোমরা, তোমাদের বিচার-বিবেচনা, উন্নত চিন্তা, বিশ্লেষণ, বিরোধ করার শক্তি-ভুলকে ভুল বলার ন্যূনতম জোর, বোধ, সামাজিক দাযিত্ব, লেখাপড়া, চরিত্র, নৈতিকতা জাহান্নামে যাক। ২০১১ থেকে আজকে পর্যন্ত তৃণমূল দেখাতে পারবে না তাদের কোনো যুবনেতা সমাজ, সমাজ বা মানুষের জন্য ব্যতিক্রমী বা গঠনমূলক কোনো কাজ করেছে। দিক না তথ্য। এসব জিজ্ঞেস করলেই তাদের সেই রাজনীতির পঙ্কিল ধারা ধরা পড়বে, যাকে পরিভাষায় বলে ‘পলিটিক্যাল ইকোনমি’! এটি এমনই এক অর্থনীতি যা রাজনীতির স্বার্থেই তৈরি, যা ভোট লুট করার কৌশল, যা তথ্যে দেখায়- এই দেখো আমরা রাজস্ব আদায় করছি, বৃদ্ধিও করছি। কিন্তু দেখায় না ওই রাজস্বের জন্য রাজ্যের বাকি সব পথে রাজস্ব আসা থমকে যায়। পশ্চিমবঙ্গের এই ‘পলিটিক্যাল ইকোনমি’র অশ্বরথ চলছে মদ্যপান, মদ ব্যবসা, রাজ্য আবগারি দপ্তরের অবাধ দেশি মদের দোকানের লাইসেন্স দেওয়ার মাধ্যমে। মদ্যপান বিরোধী কোনো ক্যাম্পেইন তো দূরের কথা বরং মদ বিক্রি, মদ্যপানকে প্রোমোট করছে এই সরকার।
এ এক অতি জীর্ণ অর্থনীতি, কারণ এটা কেবলমাত্রই রাজনীতি। এমন রাজনীতি, যেখানে বলি হচ্ছে এরাজ্যের যুবসমাজ। গোল্লায় গেছে যুবসমাজের বড়ো অংশ। অগণিত ছবি, খবর আসছে সামনে। কলেজে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বেলেল্লাপনা, অশ্লীল মন্তব্য, কুরুচিকর প্রস্তাব তো জলভাত এখন। একাংশের তরুণীরাও তা উপভোগ করছে। অনেক সময়ই প্রত্যাশা পূরণ না হলে তখন প্রতিবাদ করার কথা মনে আসে, প্রতিষ্ঠানের মধ্যেই চটুল নাচ-গান চলে যেন নাইট ক্লাব।
একাধিক ভিডিয়ো চোখে পড়েছে যেখানে মফস্সলের কালীপূজা, মনসাপূজাকে কেন্দ্র করে পাড়ার ক্লাবে নেশার আসর এবং স্বল্পবাস তরুণীর অশ্লীল নাচ। ওই ক্লাবগুলি নিশ্চিতভাবে আগের মাসে ডিজে বাজিয়ে ‘খেলা হবে’ নেচেছিল। কুরুচিকর ইঙ্গিত কলেজ ইউনিয়ন রুম থেকে পাড়ার ক্লাব— সর্বত্র এক স্বাভাবিক রূপান্তরের রূপ নিচ্ছে। যেন বার্তাটা এরকম- এটাই এবার মেনে নেওয়ার পালা। স্মার্ট বাঙ্গালি হতে হবে তো! আন্তর্জাতিক মানের বাঙ্গালি হতে হবে- তাই ফ্রি লাইসেন্স সবেতেই। নিশ্চিত, লিঙ্গ বৈষম্যহীন সাবলীল মেলামেশা একান্ত দরকার। কিন্তু সেই দরকার পূরণের আগে আরও বেশি দরকার সেই সাবলীলতা অর্জনের সাবালকত্ব। তার জন্য চাই শিক্ষা।
কলেজ, ইউনিভার্সিটির খাতায় নাম লেখানো আছে- বললে আমরা দশ বছর আগেও এটা বুঝতাম, খুব দুষ্ট ফাঁকিবাজ। সারাদিন খেলে। বা সিনেমা দেখে। বা বন্ধুবান্ধব নিয়ে হইচই, আড্ডা মারে। ওইসব ফাঁকিবাজ দুষ্ট ছেলেদের ভালো-মন্দ সবেতেই পাওয়া যেত। তৃণমূল কংগ্রেস একটা এমন ‘এগিয়ে বাংলা’ প্রকল্প করল- যেখানে দলে দলে যুবক যখনই নানান অপরাধ অপকম্মে ধরা পড়ছে, তখনই তাদের একটা সাধারণ মিল এটাই- নেশা করে। কারও মাথায় কোনো ‘প্রভাবশালী’ কোনো ‘হেভিওয়েট’ কোনো দাদার হাত যদি থাকে, তাহলে নিশ্চিত সেই অপকম্ম করা ছেলে বা মেয়েটি নেশা করে। মদের নেশায় বুঁদ তৃণমূলি যুবসমাজ। তাই আচরণ ভারসাম্য তারা হারাচ্ছে। হালে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কী দেউলিয়া মান, তা দিবালোকের মতো পরিষ্কার। এবার যদি ক্লাবে ক্লাবে টাকা আর মদ আসে, তার সঙ্গে চটুল নাচানাচি ফ্রি! বোধশূন্য তৃণমূলি যুবসমাজের কাছে এতো লটারি! এই মাদকাসক্তি এখন পশ্চিমবঙ্গের মহামারী। যুবসমাজকে নাইজিরিয়ার কোয়ারা রাজ্যের মতো যদি নেশার ঘোরে রাখা যায় তবে তো সোনায় সোহাগা। ওরা মদ কিনছে দেদার, ওরাই দলের গ্রাসরুট, ওরাই পরিসংখ্যানে তৃণমূলকে এগিয়ে রাখছে, ওরাই গুন্ডামি করছে, টাকা তুলছে, ভর্তির সময় মেরিটের তোয়াক্কা ছাড়াই কলার তুলে বলে- এত দাও, ভর্তি হও। এরাই কলেজ ইউনিয়ন দখল করে। নেশাগ্রস্ত বলেই এরা ধর্ষণ করতে পারে। ধর্ষকাম মানসিকতার মালিক কত শত যুবক, তার হিসেব কে রাখছে? সেই পচনশীল মানসিকতা ধর্ষকের চাইতেও ভয়ানক। চীনে পর্যন্ত দেখা গেল- শি জিনপিং প্রশাসন গত ২২ মে অ্যালকোহল ব্যান করল। তারা মনে করছে অবাধ মদ্যপান ও দুর্নীতির মধ্যে যোগ রয়েছে। এবং এ প্রতিষ্ঠিত সত্য-তত্ত্ব। সরকার যখন সুরাসক্তিতে উৎসাহ দেয় বুঝতে হবে সেই সিস্টেম আধমরা।
রাজ্যবাসী সদ্য দেখল, নতুন বছর শুরু হতেই রাজ্য সরকার লক্ষ্য নিল প্রতি পঞ্চায়েতে অন্তত একটি যেন মদের দোকান থাকে। বিগত অর্থবর্ষে মদ বিক্রির ফলে সরকারের প্রতিমাসে গড় আয় হয়েছিল ১৮০০ কোটি টাকা! শুধুমাত্র কলকাতাতেই ৩০০ কোটির! এবার টার্গেট আরও বেশি। প্রতি মাসে খবর আসে আরও দশটা সরকারি স্কুল বন্ধ হলো। বা শিক্ষক নেই। বা শিক্ষক আছে, একটাও ছাত্র নেই। বা স্কুল বারান্দায় ছাগল বাঁধা। স্কুল পালানোর সংখ্যা হু হু করে বাড়ছে। উত্তর থেকে দক্ষিণ কলেজে স্নাতকের আসন হাজারে হাজারে খালি। ২০২৩ সালে সারারাজ্যে স্নাতকে শূন্য আসন ছিল ৫৮ শতাংশ। তখন শিক্ষা দপ্তর জোড়াতালি উত্তর দেয়, জাতীয় শিক্ষা নীতি বিষয়ে সবাই সন্দিহান, তাই ভর্তি নেই এমন সব আজগুবি যুক্তি সাজায়। করোনাকালেও এ রাজ্যের মদের দোকান খোলা ছিল। আয় চাইতো রাজ্য সরকার। সরকারের কোষাগার ভরুক, তৃণমূলের যুব ক্যাডার বাড়ুক। এইতো সহজ সমীকরণ। বাঙ্গালি যুব
সমাজের অবক্ষয় এই মাত্রাতেও হতে পারে। কেবলমাত্রই নিজের মহলে নিজের রুচির মানুষের সঙ্গে মদ্যপান তাও একরকম মন্দের ভালো। কিন্তু তা যদি দেদার প্রাতিষ্ঠানিক সুরক্ষা পায় এবং ডাবের জলের মতো অসচেতন অথচ স্মার্ট ফোন ধরা যুবসমাজে বিকোয়, তখন তা চরিত্রকে আপাদমস্তক কলুষিত করে, ভালো মন্দের বিচার বোধটুকুও কেড়ে নেয়, বিকৃতির সঙ্গে আত্মীয়তা তৈরি হয়, শরীর-স্বাস্থ্য-মেধা- রুচি-ভয়-বোধ-শিক্ষা সবকিছুই যখন হরণ করে তখন অবশিষ্ট হিসেবে থেকে যায় লাম্পট্য আর অসভ্যতা করার সহজলভ্যতা।
তৃণমূল ছাত্র পরিষদ দায়িত্ব নিয়ে দেখাক তো গত দশ বছরে কটা বিজ্ঞান সভা, ইতিহাস সম্মেলন, বিতর্ক সভা, যথাযথ ফুটবল ম্যাচ তারা আয়োজন করেছে বা ক’জন ফুটবলার বা শিল্পী তারা তৈরি করেছে। যে পথে তাদের চলৎশক্তি তা হলো কেবল বেলেল্লাপনা। যতক্ষণ না ধরা পড়ে ততক্ষণ ওরা সমাজ সেবক। ধরা পড়লে তখন সে অন্যায়ের সমর্থন করে না তৃণমূল। উপায় কী? সমর্থন করি তো আর বলা যায় না! তাই, আরও একটা চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেওয়া যেতে পারে- ঝাড়খণ্ডের মতো শিক্ষা, স্বাস্থ্য-সহ অর্থনীতির নানা সূচকে পিছিয়ে থাকা একটি রাজ্যে ২০২২-এ গুমলা জেলার পালকোটে মহিলারাই দেশি মদের বিরুদ্ধে গড়ে তুললেন প্রতিরোধ। কারণ মাতাল থাকলে সামাজিক অশান্তি বাড়ছিল। পশ্চিমবঙ্গের কোনো একটা গ্রাম পারবে? তখন তো সেটা আবার হয়ে যাবে রাজ্য সরকারের বিরোধ, কারণ সরকার চাইছে স্কুল বন্ধ হোক, মদের বিক্রি বাড়ুক। ২০২১-এর পূজার পরের দুটো ঘটনার উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। পশ্চিমবঙ্গের রিপোর্ট আসল-পূজাতে রেকর্ড মদ বিক্রি। রাজস্থানের দুটো গ্রাম পঞ্চায়েতও রেকর্ড তৈরি করল সমান্তরাল ভাবে। রাজসমন্দ জেলার দুটি গ্রামের মানুষ তাদের ৪৫ বছরের পুরনো রাজস্থান এক্সাইজ ল’ (Rules 1975 Closure of Country Liquor Shop by Local Option. Published 1976, 8th January) প্রয়োগ করল।
যদি কোনো অঞ্চলের ৫১ শতাংশ মানুষ দেশি মদের দোকানের বিরুদ্ধে থাকে তবে দোকান বন্ধ করার সুযোগ আছে আইনের ওই ধারায়। ওখানে ৯০ শতাংশ মানুষ বলল- না, দেশি মদ দোকান চলবে না। ওদের কিন্তু আমাদের মতো রবীন্দ্রনাথ, সত্যজিৎ, ঋত্বিক ঘটক, যামিনী রায়, উত্তম কুমারের অহংকারটা নেই জাতিসত্তায়। আমাদের জাতিসত্তার অহংকার সারাবিশ্ব মেনেছে। আকিরা কুরোশাওয়া থেকে উইলিয়ম রোটেনস্টাইন- কে কৃতজ্ঞ নন এই বাঙ্গালির কাছে? মদ খাওয়া কী মন্দ? যদি যুবসমাজ এই প্রশ্ন করে। সত্যিইতো প্রশ্ন বটে। মদ খেয়ে যদি আচরণে অসামাজিকতা অসভ্যতা ইতরামি পাকা জায়গা ধরে, বুঝতে হবে তা অজ্ঞের অতিরিক্ত নেশা হচ্ছে। তখন তাদের হাতুড়ি পেটানি দরকার। তা খুব শক্ত কাজ। ঋত্বিক ঘটক, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, দেবব্রত বিশ্বাস বা এমন গুণীজনদের ভাঙিয়ে আর ক’দিন? ‘খেলা হবে টিম’কে এটাই বলার যে, আর একটা ঋত্বিক ঘটক তারা তৈরি করে দেখাক, মাসে ১৮০০ কোটির মদ বিক্রির অঙ্কটা তবে খানিকটা বিচার পাবে। নচেৎ ‘নেশাড়ু বাঙ্গালি’ শুনতে আর বেশি দিন বাকি নেই। পশ্চিমবঙ্গে যুবসমাজের গভীর অবক্ষয়, তাদের মধ্যে চেতনার গুরুতর অভাব সবচেয়ে দুশ্চিন্তার।