বাংলাদেশে হিন্দু নির্যাতনের প্রতিকারে ভারতের হস্তক্ষেপ জরুরি
অমিত কুমার চৌধুরী
কিছুদিন আগে আমার এক মুসলমান বাল্য বন্ধুর সঙ্গে তার বাড়িতে প্রায় পঁয়ত্রিশ বছর পর দেখা করতে গিয়েছিলাম। কথা প্রসঙ্গে জানতে পারলাম ওর স্ত্রী বাংলাদেশের। ওরই এক নিকট আত্মীয়ের কন্যা। বাংলাদেশের কথা উঠতেই আমার বন্ধু বলে উঠলো, বাংলাদেশ খুব সুন্দর দেশ, ওরা খুব অতিথিপরায়ণ ইত্যাদি। বহুদিন পর তার সঙ্গে সাক্ষাৎ হওয়ায় বিতর্কিত, রাজনৈতিক বা ধর্ম, সম্প্রদায়গত বিষয় এড়িয়ে গিয়ে পারিবারিক, ব্যক্তিগত বিষয়ের মধ্যে আলোচনা সীমাবদ্ধ রেখে ফিরে এলাম। মনে হলো আমার বন্ধু কি বাংলাদেশ তার শ্বশুরবাড়ি কিংবা মুসলমানপ্রধান দেশ বলেই বাংলাদেশের প্রশংসা করলেন?
অথচ কিছুদিন ধরে হিন্দুদের, বিশেষ করে হিন্দু নারীদের উপর মুসলমান জেহাদিদের ভয়ংকর, নির্মম, পাশবিক অত্যাচারের ঘটনা মনকে ভীষণ ভাবে বিচলিত করছে। ওই দেশটা বহু বছর থেকে হিন্দু ও প্রগতিশীল মুসলমানদের বধ্যভূমিতে পরিণত হয়েছে। চূড়ান্ত ভাবে হিন্দু নারীর লাঞ্ছনায় সমাজ ও সরকারের নিষ্ক্রিয়তায় মানবতা বিপন্ন, লাঞ্ছিত। এই নারী নির্যাতনের ঘটনাগুলি কি বাংলাদেশে হিন্দুদের অস্তিত্ব বিপন্নের ইঙ্গিত না নারী লাঞ্ছনার পাপের ফলে লঙ্কা ও কৌরবদের মতো বাংলাদেশের পতনের ইঙ্গিত? বাংলাদেশ কি বিশ্বমঞ্চে এক জেহাদি বর্বর দেশ হিসেবে নিজেদের প্রতিপন্ন করতে চলেছে? সেখানে কি কোনো সুশীল সমাজ বলে কিছু নেই? হিন্দুদের পাশে কোনো রাজনৈতিক দল, মুসলমান প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবী কেউই কি নেই? আসলে সমগ্র দেশটাই এতো বেশি জেহাদি, হিন্দু বিরোধিতায় আচ্ছন্ন যে সরকারি মদতেই চলছে বাংলাদেশকে হিন্দু শূন্য করার এই প্রক্রিয়া।
সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে সবকিছুই প্রকাশ্যে এসেছে। বরিশালের এক হিন্দু নারীকে ধর্ষণ করার পর হত্যা করে প্লাস্টিকে মুড়িয়ে ফেলে রাখা হয়েছে। এক হিন্দুর নিকট মোটা অঙ্কের টাকা দাবি করে, তা দিতে অপারগ হলে প্রকাশ্য স্থানে কিছু উন্মত্ত জেহাদি যুবক সেই হিন্দুটিকে কী নির্মম ভাবেই না প্রহার করছে। আরেক হিন্দুকে দড়ি দিয়ে বেঁধে তার সামনে তার স্ত্রীকে ধর্ষণ করছে ওই বর্বর জেহাদিরা। শুধু তাই নয়, ভিডিয়ো করে তা প্রকাশ্যে ছড়িয়ে দিচ্ছে। ভাবখানা এই যে দেখ, ইসলামি দেশে হিন্দুদের কী অবস্থা করে ছাড়ি আমরা। কুমিল্লায় এক অসহায় হিন্দু নারীকে তার দরজা ভেঙে ঘরে ঢুকে ধর্ষণ করে ভিডিয়ো ভাইরাল করে দেয় যা বিশ্ববাসী দেখছে। ঢাকায় খিলখিত এলাকায় মুসলমানদের অভিযোগের ভিত্তিতে প্রশাসন হিন্দু মন্দিরে বুলডোজার চালিয়ে ভেঙে দেয় এবং দেবমূর্তিও ছুঁড়ে ফেলে দেয়। অথচ সেখানে আরও কিছু বেআইনি মসজিদ, মাদ্রাসা ও রাজনৈতিক দলের কার্যালয় অক্ষত আছে। ভাবখানা এই যে ইসলামি দেশে হিন্দুর কোনো অস্তিত্ব মানা হবে না। রংপুরে মাত্র দশ টাকা নিয়ে ঝামেলায় মিথ্যা অপবাদ দিয়ে এক হিন্দু বৃদ্ধ ও তার ছেলেকে তাদের একটি ছোটো সেলুন থেকে টেনে বের করে বেদম মার দিয়ে পুলিশের হাতে তুলে দেয়। থানার পুলিশ প্রকাশ্যে সগর্বে ঘোষণা করছে যে, এমন কেস দেবে যাতে তার ফাঁসি বা যাবজ্জীবন জেল হয়।
চিন্ময়কৃষ্ণ প্রভু আজও জেল থেকে মুক্তি পাননি। আদৌ পাবে কি না তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। আইনের রক্ষক মুসলমান উকিলরাই প্রকাশ্যে হুমকি দিচ্ছেন, কোনো উকিল চিন্ময়কৃষ্ণ প্রভুর হয়ে মামলা লড়লে তাকে দেখে নেবে। এক স্কুলে একমাত্র হিন্দু শিক্ষক ছিলেন, তাঁকে গলায় জুতোর মালা পরিয়ে স্কুল থেকে বলপূর্বক বিতাড়ন করা হয়েছে। এ যেন জোর যার মুলুক তার। চাকরি বাঁচানোর জন্য এক হিন্দুকে মুসলমান হতে বাধ্য করা হয়। আওয়ামি লিগ করার জন্য হিন্দুর মন্দির ভাঙা হয় কিন্তু মুসলমানের একই পার্টি করার জন্য মসজিদ ভাঙা হয়নি। হামাসের সমর্থনে কথা বলেও আক্রান্ত হতে হয়, বাড়ি ছাড়তে হয় জলের গানের রাহুল আনন্দকে। যতই মুসলমানদের পক্ষে কথা বলো আসলে তুমি তো হিন্দু, কাফের, তাই ইসলামি দেশে তোমার কোনো স্থান নেই। শুনলাম তিনি বাংলাদেশ ছেড়েছেন। এগুলো কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। বাংলাদেশকে হিন্দুশূন্য করার এক বহমান ধারা।
ঘটনাগুলি কয়েক মাসের বা গত জুলাই মাস থেকে। কিন্তু হিন্দু নির্যাতন ১৯৪৭ সালের পর থেকে কোনো দিনই বন্ধ হয়নি, ধারাবাহিক ভাবে আজও চলেছে সমানে, নেই তার কোনো থামার লক্ষণ। দেশভাগের ঠিক পরেই এক বিশালসংখ্যক হিন্দু সর্বস্বান্ত হয়ে পশ্চিমবঙ্গে চলে আসে। ১৯৫০ সালে এক কোটির উপর হিন্দু দেশত্যাগ করে। ১৯৭১ সালেও এক কোটি লোক এপারে চলে আসতে বাধ্য হয়। প্রত্যেকটি দশকে- পঞ্চাশ, ষাট, সত্তর, আশি, নব্বই এবং তারপরে আজ পর্যন্ত হিন্দু নির্যাতনের কোনো ছেদ পড়েনি। অতীতের কিছু ঘটনা উল্লেখ করলেই তার প্রমাণ মেলে। বাংলাদেশের চট্টগ্রামের
নাজিরহাট কলেজের অধ্যক্ষ গোপাল কৃষ্ণ মুহুরীকে তার নিজ বাস ভবনে বিএনপি-জামাতে ইসলামি গুন্ডারা তাঁর মাথায় গুলি করে তাকে হত্যা করে। ২০০১ সালের নির্বাচনের পর ভোলায় গৌর নদীতে হিন্দু যুবতীদের নির্যাতন করা হয়, রামশীলে তারা পালিয়ে গিয়েও রেহাই পায়নি।
২০০৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন একটি নিবন্ধে লিখেছেন- এক হিন্দু বালিকাকে ধর্ষণ করতে এসেছে বিএনপি-জামাতের লোকেরা। তার মা হাতজোড় করে বলছেন, ‘বাবারা আপনারা একজন একজন করে যান, আমার মেয়েটা ছোটো।’ ২০০৪ সালে ভোরের কাগজ
পত্রিকার সম্পাদক আবেদ খান লেখেন, শেখ হাসিনাকে প্রাণনাশের হুমকি দিয়ে ই-মেইল পাঠানোর মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে কুমিল্লার মুরাদনগরের এক দরিদ্র মেধাবী ছাত্র শৈবাল সাহা পার্থর উপর এমন অত্যাচার করা হয় যে সে তাকাতে পারছে না হাঁটতে পারছে না, দাঁড়াতে পারছে না। কে বলেছে পার্থ অপরাধী নয়? তার নামটাই তো তার অপরাধের প্রমাণ। ঢাকেশ্বরী মন্দিরে পূজা দিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ে পার্থর মা বলেন, ঠাকুর আমার ছেলেকে ফিরিয়ে দাও। ও কোনো দোষ করেনি। ও বড়ো ভালো ছেলে। ওর কিছু হলে আমরা বাঁচবো না। ঢাকা নিবাসী এক হিন্দু যুবতীর একটি স্কুটার এক মুসলমান যুবক বলপূর্বক ছিনিয়ে নেয়। তাদের পরিবারে আগেও আক্রমণ, অত্যাচার হয়েছে, থানায় অভিযোগ করে কোনো সুরাহা না পেয়ে ওই হিন্দু যুবতী অসহায়ের মতো বলেছিলেন- ১৯৪৭ সালে তখন আমার দাদু কেন এই দেশ ছেড়ে ভারতে চলে যায়নি।
২০০৫ সাল নিউইয়র্ক টাইমস এক রিপোর্টে বাংলাদেশে তালিবানীকরণের এক রোমহর্ষক বিবরণ পাওয়া যায়। উঁচু বাঁশের কাঠামোতে দুই পা বেঁধে মাথা নীচে ঝুলিয়ে রাখা হয়। তারপর লোহার হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে, লোহার রড দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মেরে ফেলা হয়। মৃত্যুর আগে এই অমানুষিক ভয়ংকর লোকটি যখন যন্ত্রণায় আর্তনাদ করতে থাকে, তখন এলাকার মানুষ যাতে তা পরিষ্কার ভাবে শুনতে পায়, তার জন্য তার মুখে মাইক্রোফোনের স্পিকার বেঁধে দেয়া হয়।
বাংলাদেশ থেকে প্রাণভয়ে পালিয়ে আসা এক হিন্দু নারীর কথা শোনা যাক। ‘বাংলাদেশে এক গ্রামে আমাদের বুথে বিএনপি হেরে যাওয়ার ফলে ওরা আমাদের বাড়িতে এসে আমার স্বামীকে বেধড়ক পেটায়। আমি ওদের পায়ে ধরি, না মারার জন্য। ওই ছেলেরা আমার স্বামীর স্কুলেরই ছাত্র। তবুও তারা তাদের শিক্ষককে মারতে তাদের এতটুকু হাত কাঁপেনি। পরে আমাকে ও আমার মেয়েকে প্রায় অর্ধনগ্ন করে ফেলে। সেই হিন্দু নারী কাতর কণ্ঠে বলেন আমি এদেশে অনুপ্রবেশকারী নই, এক শরণার্থী। বাংলাদেশে হিন্দু নারী নির্যাতনের প্রতিবাদে নিউ ইয়র্কের শান্তিবাদী এক গায়ক লোরকান অটওয়ে তার গানে লিখেছেন:
I can not show my face to you.
I’m forced to flee in shame.
I can not find the words to tell,
what they did to me.
When the gangs come to my vil-
lage and robbed my dignity.
শেষ পঙ্ক্তিটি হচ্ছে:
Why is it not the rapist, who is
forced to hide his face.
বিশিষ্ট সাংবাদিক বিবেকানন্দ মুখোপাধ্যায়ের কন্যা এষা দে-র মতে হিন্দুরা মুসলমান মোল্লাবাদের বিরুদ্ধে উত্থান ঘটাচ্ছে না বলেই বাকিরা এহেন হিন্দু নির্যাতনের ঘটনাকে গুরুত্ব দিচ্ছে না। বিগত ৫০০ বছরের মধ্যে বঙ্গের একমাত্র যশোরের প্রতাপাদিত্য ছাড়া হিন্দুরা মুসলমান জেহাদিদের বিরুদ্ধে উত্থান ঘটায়নি। ভীরুতা, ক্লীবতা প্রদর্শন করে এসেছেন। পশ্চিমবঙ্গেও শাসক দলের মদতে মুসলমান মোল্লাবাদীদের দাপট যেভাবে বেড়ে চলেছে তা রুখতে হিন্দুরা ব্যর্থ হলে হিন্দু বাঙ্গালির অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে পড়বে। এই পরিস্থিতিতে দুই বঙ্গেই হিন্দুদের অস্তিত্ব রক্ষায় ভারত সরকারের হস্তক্ষেপ অত্যন্ত জরুরি।