ত্রিপুরার সামাজিক মিলনমেলা
খার্চি পূজা
অপু সাহা
ত্রিপুরার ঐতিহ্যবাহী উৎসবগুলির মধ্যে খার্চি পূজা অন্যতম। প্রতি বছর আষাঢ় মাসের শুক্ল অষ্টমী তিথিতে নির্ঘণ্ট অনুযায়ী চতুর্দশ দেবতার মন্দিরে খার্চি পূজা হয়ে থাকে। সাতদিনব্যাপী উদ্যাপিত হয় এই উৎসব। খার্চি মূলত ত্রিপুরার রাজ পরিবারের কুলদেবতা। সময়ের প্রবহমানকালে বর্তমানে এই উৎসব সকল মত-পথ, সংস্কৃতি, জাতি, জনজাতিদের মাঝে মিলন মেলাতে পরিণত। এই উৎসবে রাজ্য এবং অন্যরাজ্য থেকে সাধু-সন্ত, পুণ্যার্থী, দর্শনার্থীর আগমন ঘটে। রাজমালা থেকে জানা যায়, আগে এই উৎসব উদয়পুরে অনুষ্ঠিত হতো। কিন্তু রাজা কৃষ্ণকিশোর মাণিক্য রাজধানী উদয়পুর থেকে বর্তমানে খয়েরপুর অঞ্চলে স্থানান্তরিত করেন। যা পুরাতন হাভেলি নামে পরিচিত। এখানেও রাজা গড়ে তোলেন চতুর্দশ দেবতার মন্দির। ১৭৬০ সাল থেকে রাজা কৃষ্ণকিশোর মাণিক্য পুরাতন হাভেলিতে খার্চি পূজার সূচনা করেন। এ বছর খার্চি পূজা ২৬৫তম বছরে পদার্পণ করেছে। ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দে রাজধানীর পরিবর্তন হয় কিন্তু চতুর্দশ দেবতার মন্দির খয়েরপুরে থেকে যায়। বর্তমানে উদয়পুরে চতুর্দশ দেবতার মন্দিরে কোনো বিগ্রহ নেই। এই মন্দিরটি প্রাচীন স্থাপত্যশৈলীর এক নিদর্শন।
‘খার’ শব্দটির অর্থ পাপ এবং ‘চি’ শব্দের অর্থ মোচন। রাজামালায় উল্লেখিত আছে, ত্রিপুরার মহারাজ ত্রিপুর-পত্নী মহারানি হীরাবতী চতুর্দশ দেবতার দর্শন পান। হীরাবতী চোদ্দদেবতার জন্য দৈনন্দিন ভোগ, নৈবিদ্য ও বলি সহকারে পূজার্চনার ব্যবস্থা করেন। সেই থেকে এই পূজার প্রচলন।
সাতদিনব্যাপী এই পূজার শুরুতে চোদ্দ দেবতার হাওড়া নদীতে স্নান করিয়ে মন্দিরে আনা হয়। স্নান পর্ব শেষে মন্দিরে যাবার পথে মাদল বাজিয়ে, পাতায় ছায়াদান করে শোভাযাত্রা সহকারে পুরোহিত ও সহ-পুরোহিতরা মন্দিরের বেদীতে দেবতাদের বসিয়ে থাকেন। পুরোহিতকে বলা হয় ‘চন্তাই’ এবং সহ-পুরোহিতদের বলা হয় ‘দেওয়াই’। রাজ আমল থেকে রাজ সৈন্যরা দেবতাদের ‘গার্ড অফ অনার’ জানাতেন বলে জনশ্রুতি রয়েছে। বর্তমানে ত্রিপুরা পুলিশ দেবতাদের ‘গার্ড অফ অনার’ জানায়।
চতুর্দশ দেবতা হলেন লাংমা লাংমা (শিব), লাংকুই (বিষ্ণু), বার্মা (ব্রহ্মা), তুইরুং (দুর্গা), সাইব্রা (লক্ষ্মী), সান্দ্রা (সরস্বতী), নাখাই (কার্তিক), হোলাই (গণেশ), হাদ্রা (অগ্নি), মাংখি (বায়ু), চান্তাই (চন্দ্র), হামতাই (সূর্য), রাইথোং (ইন্দ্র), নোইসাং (বরুণ)। শিব, উমা ও হরি প্রতিদিন পুজিত হন। কিন্তু এই পুণ্য তিথিতে চতুর্দশ দেবতা একত্রে পূজিত হন। চোদ্দ দেবতার মস্তক মূর্তি পূজিত হয়। এই দেবতারা ত্রিপুরা রাজ্যের রক্ষাকর্তা ও অভিভাবকস্বরূপ।
১৯৪৮ সাল থেকে পূজা ও মেলার দায়িত্বভার রাজ্য সরকারের। প্রতি বছর শত শত ব্যবসায়ী তাদের পসরা নিয়ে বসেন। প্রতিটি দোকানের ভিটি লটারির মাধ্যমে নির্ধারিত হয়। এবছর সফটওয়ারে সব আবেদন অন্তর্ভুক্ত করা হয় এবং কৃষ্ণমালা মঞ্চে প্রজেক্টারের মাধ্যমে দোকান ভিটি বিলি করা হয়। রাজ্য সরকার ২০১৮ সাল থেকে উৎসবে আগত সাধুসন্তদের জন্য প্রতিদিন সম্পূর্ণ বিনামূল্যে থাকা, খাওয়া ও বিশ্রামের সুব্যবস্থা করে আসছে। এ বছরের থিম ‘অপারেশন সিঁদুর’। রাজ্য পর্যটন দপ্তর থেকে মন্দির ও মন্দিরের প্রাঙ্গণ উন্নয়নের জন্য প্রায় ১৩ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে।
খার্চি উৎসব কেবল একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়, এটি একটি বিশাল সামাজিক মিলনমেলা। এই পূজাকে ঘিরে সাতদিনব্যাপী এক বৃহৎ মেলা অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে অসংখ্য মানুষ অংশ নেন। মেলায় স্থানীয় হস্তশিল্প, বস্ত্র, মাটি ও কাঠের তৈরি খেলনা, খাবারদাবার, গৃহস্থালির সামগ্রী, কৃষিপণ্য ইত্যাদির বিশাল বিপণন চলে। বিকাল থেকে গভীর রাত অবধি চলে লোকনৃত্য, সংগীত, নাটক এবং সাংস্কৃতিক পরিবেশনা। রাজা ত্রিপুরের আমল থেকেই এই পূজায়
রাজপরিবারের সরাসরি অংশগ্রহণ ছিল। আজও রাজপরিবারের প্রতিনিধি ও সদস্যরা এই পূজায় অংশগ্রহণ করে থাকেন, যা রাজসভার ঐতিহ্যকে জাগ্রত রাখে। ত্রিপুরার বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মানুষ এই উৎসবে অংশগ্রহণ করেন।
অভ্যন্তরীণ সম্প্রীতির এক অনুপম দৃষ্টান্ত স্থাপন করে রাজ্য সরকার ও পর্যটন দপ্তরের উদ্যোগে খার্চি উৎসব আন্তর্জাতিক পরিচিতি লাভ করছে। রাজা ত্রিপুর প্রবর্তিত খার্চি পূজা ত্রিপুরার ইতিহাস, ঐতিহ্য, ধর্মীয় সহাবস্থান ও সাংস্কৃতিক চেতনার বহমান ধারা। চতুর্দশ দেবতার পূজার মাধ্যমে জনমানসে ভক্তি, বিশ্বাস ও ঐক্যের যে জাগরণ ঘটে, তা যুগের পর যুগ ধরে ত্রিপুরার সাংস্কৃতিক পরিচয়কে বহন করে চলেছে।