বহুমুখী প্রতিভায় ভরপুর স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়
প্রদীপ মারিক
তখন আশুতোষের কিশোর বয়স। কলকাতায় এক বইয়ের দোকানে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সঙ্গে তার দেখা হয়েছিল। এককপি রবিনসন ক্রুসোর পাতায় স্বাক্ষর করে উপহার হিসেবে তার হাতে তুলে দিয়ে বিদ্যাসাগর বলেছিলেন, ‘মনোযোগ দিয়ে পড়ো’। আশুতোষ সারা জীবন তাঁর উপদেশ বেদবাক্য মনে করে সেই কথার অমান্য করেননি। কোন দিন কি পড়েছেন তা তিনি লিপিবদ্ধ করে রাখতেন ডাইরির পাতায়। কোন বই থেকে কোন চ্যাপ্টার তিনি পড়েছেন তাও তিনি লিপিবদ্ধ করে রাখতেন। মাত্র ক’দিনে কতগুলো বই পড়ছেন তারও হিসাব পাওয়া যেত সহজে। কলেজে কোন সাহেব শিক্ষক কেমন পড়াচ্ছেন তাও লিখে রাখতেন। কোন কোন দিন কী পড়ছেন তার সাক্ষী থাকে তাঁর ডাইরি। কোন সময় সংস্কৃত পড়ছেন, বাঘা বাঘা অঙ্কের বই পড়ছেন, ফিজিক্সের বইও পড়েছেন- ব্যারাকপুর গঙ্গার তীরে স্বাস্থ্য ভালো রাখতে তিনি যখন গিয়েছিলেন, সেখান থেকে বাবাকে চিঠি দিতেন তার সবটাই থাকতো পড়াশোনার কথা। ইংরেজিতে লেখা তিন খণ্ডের ইতিহাস বই তিনি বাংলায় এবং ‘কথামালা’, ‘বোধোদয়’ ‘আখ্যানমঞ্জরী’ বইগুলো ইংরেজিতে অনুবাদ করেন।
কলেজে পড়ার সময় একটা জব্বর অঙ্কের বই পড়া হচ্ছে না এই ভেবে তিনি ফরাসি ভাষাটাই শিখে নিলেন। বই পড়ার সঙ্গে নিয়মিত ছিল বই কেনা। বাবার সঙ্গে তার কলকাতার বিখ্যাত সব বইয়ের দোকানে যাতায়াত সেই ছোটোবেলা থেকে। আমৃত্যু তিনি বই সংগ্রহ করেছেন, কিনছেন এবং তা পড়ে তার মর্মার্থ উপলব্ধি করেছেন। শুধু কলকাতার বইয়ের দোকানে নয়, তিনি নিয়মিত যেতেন নিলাম ঘরে, সেখানে তিনি কিনতেন পুরোনো বই ও পুঁথি। তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ ছিল জার্মান, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, সুইজারল্যান্ডের বিভিন্ন প্রকাশকের। ন্যাশনাল লাইব্রেরির সুবিখ্যাত, ‘আশুতোষ কালেকশন’-এ রয়েছে তাঁর সংগৃহীত বই এবং অন্যান্য সামগ্রী। সংখ্যাটা ৮৫ হাজারেরও বেশি। আইন, গণিত, পদার্থবিদ্যা, দর্শন, ইংরেজি সাহিত্যের বিপুল সম্ভার তো রয়েছেই, চিকিৎসা বিজ্ঞান, ইউরোপ, আমেরিকা, আফ্রিকার আধুনিক চিকিৎসা বিষয়ে, স্থাপত্যবিদ্যা, পুরাতত্ত্ব, নৃতত্ত্ব, চিত্রকলার অগুনতি বই। এছাড়াও ছিল ওক কাঠের প্রচ্ছদে ১৮৪৯ সালের বাইবেল, মরক্কো চামড়ায় বাঁধানো আর গথিক স্ক্রিপ্টে লেখা গেথেট ফাউস্ট-এর মতো কত দুর্লভ বই যে তাঁর সংগ্রহে ছিল তা বলে শেষ করা যাবে না। ছেলেবেলা থেকেই আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের দুটো লক্ষ্য ছিল- একটা ‘প্রেমচাঁদ রায়চাঁদ’ স্কলারশিপ পাওয়া আর একটি হাইকোর্টের জজ হওয়া। দুটো ইচ্ছাই তার পূর্ণ হয়েছিল।
তিনি ১৮৮৫ সালে গণিতে এবং পরের বছর পদার্থবিদ্যায় এমএ পাশ করেন। গণিতে এমএ পাশ করার পরের বছরই তিনি এমএ গণিতের পরীক্ষক হন। আগাগোড়া ভালো ফলাফল দেখে তাঁকে সাহেব কর্তারা চাকরির প্রস্তাব দিলেন। তাকে প্রেসিডেন্সি কলেজে যোগ দেওয়ার কথা বলা হয়। তিনি শর্ত দিলেন, চাকরি করতে পারেন তবে সাহেব শিক্ষকদের সমান বেতন ও পদমর্যাদা দিতে হবে এবং তাঁকে গবেষণার সুযোগ দিতে হবে। এই তরুণের স্পর্ধা দেখে
সাহেবরা হতভম্ব। তদানীন্তন সাহেব উপাচার্য তাকে ডেকে জিজ্ঞাসা করলেন কী সাহায্য তিনি করতে পারবেন। তিনি চাইলেন সেনেটের সদস্যপদ। তিনি এই সেনেট সদস্য হয়েই ছাড়লেন যখন তার মাত্র ২৫ বছর বয়স।
কলকাতার বৌবাজারে মলঙ্গা লেন থেকে মুখুজ্যে বাড়ির ছেলে ছোটোবেলা থেকে পড়াশোনার মধ্য দিয়ে যে জায়গায় নিজেকে নিয়ে গিয়েছিলেন সে জায়গায় পৌঁছতে তার অধ্যাবসায়ের কথা ভাবলে বাঙ্গালি হিসেবে গর্বে আমাদের বুক ফুলে ওঠে। এত ছোটোবেলা থেকে যে এত পড়াশোনা করা যায়, পড়াশোনা করলে মনেও রাখা যায়। শুধু মনে রাখা নয়, তা কাজে লাগানো যায়। শুধু কাজে লাগানো বললে ভুল হবে ব্রিটিশদের অধীনে সরকারি চাকরি আর নিরাপদ জীবনের গন্তব্যে এসেও ব্রিটিশদের অনুগত দাস হয়ে না থেকে নিজের সঙ্গে নিজের ভাষা জাতি ও সংস্কৃতির এবং তার সঙ্গে সেই সময়ের সব মানুষের ভাবনাচিন্তা ও আদর্শকে তুলে ধরা যায় শুধু নয়, গবেষণামূলক শিক্ষার প্রসারের মাধ্যমে জীবন যাপনের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া যায়, তা তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন।
চেষ্টা করলে পারা যায়। তিনিই পেরেছিলেন। তাই তো তিনি বাঙ্গলার বাঘ স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়। আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের বাবা গঙ্গাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ছিলেন যশস্বী ডাক্তার। কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের ছাত্রদের বাংলা বইয়ের খুব অভাব দেখে তিনি প্র্যাকটিসের ফাঁকেই লিখলেন বেশ কয়েকটা বই। যে মানুষটি রামায়ণ অনুবাদ করেছিলেন কবিতায়, আবার তিনিই সাংসারিক হিসাবনিকাশ লিখে রাখতেন তার খাতায়।
গঙ্গাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের খাতাগুলি ঐতিহাসিক এই কারণে, সেই খাতায় আশুতোষের জন্মতারিখ থেকে তার বই কেনার জন্য কত টাকা খরচ হয়েছিল সব হিসেব লিখে রেখে দেওয়া হয়েছিল। নীলমণি মিত্রের পূজাদালানে বসতো চক্রবেড়িয়া শিশু শিক্ষালয়। যখন তাঁর পাঁচ বছর বয়স, তখন তাকে এই শিক্ষালয়ে ভর্তি করানো হয়। প্রথমদিন স্কুল থেকে ফিরেই ছেলে বলল, ও তো স্কুল নয় যেন যাত্রার আসর। কারণ সে কিছুদিন আগেই একটা যাত্রা দেখতে গিয়েছিল। পূজাদালানে ওই চেঁচামেচিকে যাত্রার আসর ভেবে থাকবে। বাবার সঙ্গে খুব ভোরে ওঠা, বাবার সঙ্গে খানিক বেরিয়ে এসে পড়তে বসা, তার সঙ্গে পুরোনো পড়া ঝালিয়ে নেওয়া- এটাই ছিল তার নিত্য দিনের কাজ। বাবা ভাবলেন, ছেলে ঘরেই ভালো পড়বে, তাই গৃহ শিক্ষকের ব্যবস্থা করলেন। তিনি যখন তৃতীয় শ্রেণীতে তখন মিল্টনের ‘প্যারাডাইস লস্ট’ কবিতার প্রথম পরিচ্ছদ কণ্ঠস্থ করে ফেলেছিলেন যা এখন স্নাতকস্তরের পাঠ্য।
এক সময় আইন পড়লেন এবং ১৮৮৮ সালে কলকাতা হাইকোর্টের উকিল হলেন। তারপর কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি হলেন। বিচারপতি থাকাকালীন তিনি প্রায় দু’ হাজার রায় দিয়েছিলেন। ১৯০৬ সালে যখন তিনি উপাচার্যের পদে আসীন সেই সময় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে বঙ্গের মান্যগণ্য মানুষরা বলতো, ‘গোলদিঘির গোলামখানা’- ব্রিটিশদের চাকর তৈরির জায়গা। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় হাতে নেওয়ার পরই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে ছোটালেন অশ্বমেধ যজ্ঞের ঘোড়ার মতো। নিয়মিত ক্লাস, পড়াশোনা এবং পরীক্ষার ব্যবস্থা করা। তিনি বুঝিয়ে দিলেন উচ্চশিক্ষার মধ্যেই গবেষণা লুকিয়ে আছে। সেই গবেষণার দিক তিনি উন্মোচিত করলেন। পাঠ্যসূচি সংস্কার করলেন, খুললেন নতুন নতুন বিষয়। সেই বিষয়ের জন্য চাই উপযুক্ত শিক্ষক।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতে এলেন পদার্থবিদ্যায় সিভি রমণ, রসায়নে প্রফুল্লচন্দ্র রায়, গণেশ প্রসাদ, মেঘনাথ সাহা, সতেন্দ্রনাথ বসু, দীনেশচন্দ্র সেন, সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতো দিকপাল শিক্ষকরা। আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের ডাকে সাড়া দিয়ে পড়াতে এলেন দর্শনশাস্ত্রের জন্য
সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণন, অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক পল ভিনোগ্রাডফ, বিখ্যাত ফরাসি অধ্যাপক সিলভাঁ লেভি। বিশ্ববিদ্যালয় স্বশাসিত সংস্থা হলেও এক সময় এমএ শিক্ষকদের বেতন দেওয়ার টাকার অভাব দেখা দেয়। ব্রিটিশ সরকার টাকা দেবে তার বদলে মুচলেখা দিতে হবে তা প্রকারন্তরে দাসখত নেওয়ার নামান্তর। বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে স্যার আশুতোষ দীপ্ত কণ্ঠে ঘোষণা করেন, না খেয়ে থাকবো তবু ব্রিটিশদের গোলামি করবো না।
ফ্রিডম ফার্স্ট, ফ্রিডম সেকেন্ড, ফ্রিডম অলওয়েস। তিনি সব থেকে বেশি গুরুত্ব দিতেন গবেষণাকে। যে ছেলের মাত্র সতেরো বছর বয়সে গণিতের ওপর লেখা কেমব্রিজ গণিত পত্রিকায় ছাপা হয়, তার তো গবেষণাকেই প্রাধান্য দেওয়া উচিত। ‘মৈমনসিংহ-গীতিকার’ সম্পাদনার কাজ দীনেশচন্দ্র সেন করতে পেরেছিলেন তাঁরই প্রেরণায়। আশুতোষ মুখোপাধ্যায় উপাচার্য থাকার সময় বাংলাভাষাকে যোগ্য মর্যাদায় বিশ্ববিদ্যালয়ে এনেছিলেন। তিনি দীনেশচন্দ্র সেনকে বললেন এমএ বাংলা চালু করার জন্য সিলেবাস তৈরি করুন। পুত্র শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ইংরেজিতে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হলে আবার তাকে বাংলায় এমএ পড়ানোর জন্য ভর্তি করেন।
কোর্টের সময়টুকু ছাড়া তিনি বাকি সময়ে ধুতি, পঞ্জাবি, চাদর পরতেন, বলতে গেলে তিনি ছিলেন ধোপদুরস্ত বাঙ্গালি। নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু তাঁর মৃত্যুর পর এক স্মরণসভায় বলেছিলেন, ‘এখন যে বাংলাভাষায় আমরা কথা বলছি, তার জন্য আমরা স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের কাছে ঋণী।’ তিনি পাশ্চাত্য শিক্ষা এবং জাতীয় শিক্ষার সুফলগুলি সুন্দরভাবে তুলে ধরেছিলেন। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে রেনেসাঁ ঘটিয়ে ফেলেন। তিনি একধারে গণিত, রসায়ন, সংস্কৃত, আইনবিদ, শিক্ষাবিদই ছিলেন না। তিনি ছিলেন বহু বিদেশি ভাষায় পারদর্শী। এমন বহুগুণসম্পন্ন মানুষের জন্যই তো ফরাসি পণ্ডিত, সিলভাঁ লেভি বলতে পারেন, এই বেঙ্গল টাইগার ফ্রান্সে জন্মালে ফ্রান্সের টাইগার জর্জেস ক্লেমেন্সোকেও ছাড়িয়ে যেতে পারতেন।