হারানো পত্রিকা- এক
অর্চ্চনা-পত্রিকার নামেই ডাকঘর
নন্দলাল ভট্টাচার্য
হারায় নাতো কিছুই। ‘রাতের সব তারাই আছে/ দিনের আলোর গভীরে।’ একদিন যেসব পত্রপত্রিকা চলত রমরমিয়ে, এখন তারা বিলুপ্ত। সেসব পত্রিকার ঠাঁই এখন ইতিহাসের পাতায়। কিন্তু সেসব পত্রিকা ধরে রেখেছে সমকালের সমাজ ও রুচির কথা। তার মধ্যেই রয়ে গেছে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের গড়ে ওঠার, এগিয়ে চলা এবং ক্ষেত্র বিশেষে মুখ থুবড়ে পড়ার কথা। আজকের বিস্মৃত সেসব পত্রিকায় রয়ে গেছে বর্তমানের শিকড়। আছে ভবিষ্যতের দিশা। তাই বিস্মরণ নয়, তাদের স্মরণেই এই গদ্যধারা।
পত্রিকার নামে ডাকঘর। কিছুটা অবাক করা কথা, তবুও সত্যি তা। পত্রিকার নামে আসা চিঠিপত্র, আর গ্রাহকের কাছে পাঠানো পত্রিকার চাপে হিমসিম খাওয়া ডাকঘরের অন্যান্য কাজ প্রায় শিকেয় ওঠার অবস্থা। সবকিছু সামাল দিতে তাই সেই পত্রিকার জন্য তারই নামে পৃথক একটি ডাকঘর খোলা। প্রায় বিরল এই ঘটনাই ঘটেছে এই রাজ্যে স্বাধীনতার বহু বছর আগে। সংখ্যাটা বেশিও হতে পারে, কারণসবগুলির হদিশ জানা নেই। তবে অন্তত দুটি ডাকঘর এখনো সংশ্লিষ্ট পত্রিকার নামে আজও চালিয়ে যাচ্ছে তাদের রোজকার কাজকর্ম। একটি দৈনিক পত্রিকা অমৃতবাজারের নামে, ঠিকানা যার বাগবাজারের ১১/১ আনন্দ চ্যাটার্জি লেনে। অন্যটি মাসিক সাহিত্য পত্রিকা ‘অর্চ্চনা’ বা ‘অর্চনা’-র নামে- জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির কাছে ১০, বারাণসী ঘোষ লেনে।
সাহিত্য পত্রিকা মাসিক ‘অর্চ্চনা’। রবীন্দ্রনাথের দেওয়া নাম। নামের বানানে ছিল দুটি ‘চ’। পরবর্তীকালে অবশ্য ‘বিদায় নেয় একটি ‘চ’- তখন থেকে পত্রিকার নাম শুধুই ‘অর্চনা’। পত্রিকার পরিচয় বা উপনাম ছিল ‘মাসিক পত্রিকা ও সমালোচনী’।
পত্রিকাটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৩২০ সালের ফাল্গুন মাসে, ইংরেজি ১৯০৪ খ্রিস্টাব্দে।
জোড়াসাঁকোয় ঠাকুরবাড়ির লাগোয়া গলি পার্বতীচরণ ঘোষ লেন এবং রাধানাথ সাধু লেন জুড়ে ছিল সুবর্ণ বণিক সমাজের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী তারিণীচরণ চন্দ্রর বিরাট বাড়ি। তারিণীচরণের ছেলে কৃষ্ণদাস চন্দ্রের পৈতৃক ব্যবসার চেয়ে বেশি আগ্রহ ছিল সাহিত্যচর্চা ও বেড়ানোর। দেশের নানা জায়গায় বেড়াতে গিয়ে সেখানকার সবকিছু নিয়ে তিনি লিখতেন ভ্রমণ কাহিনি। বাড়িতে তিনি নিয়মিত বসাতেন মজলিশ। সেই মজলিশি আড্ডায় আসতেন কৃষ্ণদাসের মতোই সাহিত্যপ্রেমিক বন্ধুবান্ধবের দল। বাংলা সাহিত্যের নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা করতেন তাঁরা। সেইসঙ্গে পড়তেন নিজেদের লেখা। সে লেখার দোষ-গুণ পর্যালোচনা করে তাঁরা নিজের সৃষ্টিকে আরও ত্রুটিহীন করার চেষ্টা চালিয়ে যেতেন। সেই সাহিত্যের আড্ডাতেই তাঁরা মূলত নিজেদের লেখা প্রকাশের জন্যই একটি সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশের উদ্যোগ নেন। পত্রিকা প্রকাশের সিদ্ধান্ত পাকা হয়ে যায়, কৃষ্ণদাস সেটি প্রকাশের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের জোগানদার হওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়ায়। সকলে আলাপ আলোচনা করেও কিন্তু পত্রিকার নাম ঠিক করতে পারেন না। আর তখনই সিদ্ধান্ত, এ ব্যাপারে তাঁরা দ্বারস্থ হবেন রবীন্দ্রনাথের।
জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি আর তারিণী চন্দ্রর বাড়ির মধ্যে ছিল খুবই হৃদ্যতা। পড়শি হিসেবে দু’বাড়ির লোকজনের মধ্যে ছিল নিয়মিত যাতায়াত। সেই সূত্রে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে যথেষ্ট সখ্য ছিল কৃষ্ণদাসের। তাই রবীন্দ্রনাথের কাছে যাওয়াটা কোনো কঠিন ব্যাপার হলো না। রবীন্দ্রনাথের কাছে নিজেদের আর্জি জানালেন তাঁরা। সব শুনে রবীন্দ্রনাথ তাঁদের যথেষ্ট উৎসাহ দিলেন। একটি ভালো সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশের জন্য কী কী করা দরকার সে সম্পর্কে তাঁদের নানা পরামর্শ দিলেন।
রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকে যে এমন উৎসাহ পাওয়া যাবে কৃষ্ণদাস এবং তাঁর বন্ধুরা অতটা আশা করেননি। তাই প্রস্তাবিত নতুন পত্রিকার জন্য নিয়মিত লেখা দিয়ে সাহায্য করার আবদার জানান তাঁরা। এ ব্যাপারে কবি কী বলেছিলেন তা সঠিকভাবে জানা যায়নি। তবে পত্রিকার নামকরণের কথা বলতে প্রায় না ভেবেই রবীন্দ্রনাথ বলেন, তোমাদের নতুন কাগজের নাম রাখো ‘অর্চ্চনা’।
রবীন্দ্রনাথের আশীর্বাদ ও উৎসাহ পেয়ে কৃষ্ণদাস চন্দ্র এবং তাঁর বন্ধুরা এবার তাঁদের ওই আড্ডার নামও দিলেন ‘অর্চ্চনা সমিতি’। ২৯নং পার্বতীচরণ ঘোষ লেন হলো অর্চ্চনা সমিতির কার্যালয়। সেটাই হলো পত্রিকারও ঠিকানা।
নতুন পত্রিকার সম্পাদক হলেন তরুণ ব্যবহারজীবী জ্ঞানেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, এমএবিএল। পত্রিকার সহকারী সম্পাদক হলেন কৃষ্ণদাস চন্দ্র। প্রকাশকও তিনিই। ত্রিশ পৃষ্ঠার কাগজটির মাসিক মূল্য ছিল দু’ আনা। ডাকমাশুল-সহ বার্ষিক মূল্য রাখা হয় এক টাকা চার আনা।
পত্রিকাটির প্রথম সংখ্যায় ছিল রামদয়াল মজুমদার, এমএ-র প্রবন্ধ ‘আদি দম্পতী’, উমাচরণ ধরের ধারাবাহিক গাথাকাব্য ‘রাঠোর-বালক’ এবং অন্য একটি কবিতা, কেশবচন্দ্র গুপ্ত, এমএবিএল-এর প্রবন্ধ ‘মুদ্রা’, ‘শ্রী’ নামে লেখা একটি পত্রিকা ‘প্রেম ও শ্মষু’, কৃষ্ণদাস চন্দ্রর একটি গান। প্রথম সংখ্যায় সে-অর্থে নামকরা বা প্রতিষ্ঠিত প্রায় কোনো লেখকের রচনা না থাকা সত্ত্বেও পত্রিকাটি সাধারণ মানুষের বেশ ভালোই লাগে। তাতেই উৎসাহিত হয়ে কর্তৃপক্ষ ‘অর্চ্চনা’-কে একটি সফল পত্রিকায় রূপান্তরিত করার কঠিন লড়াইয়ে শামিল হন।
বাংলা পত্রপত্রিকার জগতে কোনো নতুন আদর্শ বা মতবাদ প্রচারের লক্ষ্যে ‘অর্চ্চনা’ প্রকাশিত হয়নি। সাহিত্য জগৎকে সৎকে নতুন কোনো দিশা দেখানোর দাবিও করতে পারে না পত্রিকাটি। সেভাবে অতি জনপ্রিয় কোনো লেখকের রচনা না-থাকা সত্ত্বেও ‘অর্চ্চনা’ প্রথম দু’ বছরের মধ্যেই
সাহিত্য-জগতে গ্রাহক সংখ্যার দিক থেকে একটা বড়ো ধরনের বিপ্লব আনে।
যতদূর জানা যায়, ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে পত্রিকাটির গ্রাহক সংখ্যা পঁচাত্তর হাজার ছাড়িয়ে যায়। ফলে ওই অঞ্চলের একমাত্র ডাকঘর বড়বাজারের ওপর প্রচণ্ড চাপ পড়তে থাকে। কৃষ্ণদাস চন্দ্র তাই স্টেটসম্যান পত্রিকায় একটি পৃথক ডাকঘরের দাবি জানিয়ে চিঠি লেখেন। একই সঙ্গে তিনি দরবার করেন গভর্নর জেনারেল কার্জনের কাছে। কৃষ্ণদাসের সে আবেদন মঞ্জুর হলো। বড়বাজার ডাকঘরের অধীনে একটি উপডাকঘর খোলা হলো ১৮নং পার্বতী ঘোষ লেনে ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে। কিন্তু ডাকঘরের জন্য জায়গাটা ছোটো হওয়ায় ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে সেটি উঠে যায় কৃষ্ণদাসের বন্ধু যুগলকিশোর মুখোপাধ্যায়ের বাড়িতে। ১০নং পার্বতী ঘোষ লেনে ৫১ টাকা চার আনা ভাড়ায়।
‘অর্চ্চনা’ পত্রিকা উঠে গেছে বছর পঁয়ষট্টি আগে, কিন্তু এই নামের ডাকঘরটি আজও আছে। অবশ্য ওই বাড়িটির অবস্থা এখন খুবই খারাপ। মালিকানা বদলের পর মূলত শরিকি বিবাদের জন্য করা যাচ্ছে না প্রয়োজনীয় মেরামতি। প্রসঙ্গত, এই ডাকঘরেই আসে রবীন্দ্রনাথের নোবেল প্রাপ্তির চিঠিটি।
যাক সে কথা। আবার বরং আসা যাক ‘অর্চ্চনা’ পত্রিকার আলোচনায়। পত্রিকাটি চলেছিল দীর্ঘ ছাপ্পান্ন বছর। নানা কারণে ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দে উঠে যায় এটি। তখন পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন প্রাক্তন কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী ড. প্রতাপচন্দ্র চন্দ্র। পত্রিকা বন্ধের অন্যতম কারণ হিসেবে তিনি দায়ী করেছিলেন সিনেমা জাতীয় লঘু পত্রপত্রিকাগুলিকে।
প্রথম থেকেই ‘অর্চ্চনা’ পত্রিকায় স্থান পেত নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা, গল্প, প্রবন্ধ, কবিতা, নাটক, বিভিন্ন পত্রপত্রিকার সমালোচনা, ভ্রমণ কাহিনি, বৈদেশিক সমাচার এবং নানা রোমাঞ্চকর গল্প, প্রাচীন ঐতিহাসিক কাহিনি, প্রাচীন পুঁথি ও গ্রন্থ সংক্রান্ত রচনা, স্বদেশ চেতনার গল্প, নারী জাগরণের কথা, জ্ঞানবিজ্ঞানের কাহিনি এবং আরও নানা বিষয়।
জ্ঞানেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় পাঁচ বছর সম্পাদনার পর বন্ধু কেশবচন্দ্র গুপ্তকে এক চিঠিতে ব্যক্তিগত কারণে কর্মভার ত্যাগের কথা জানিয়ে তাঁকেই সম্পাদনার দায়িত্ব নিতে বলেন। সেইমতো ‘অর্চ্চনা’র ষষ্ঠ বর্ষ থেকে সম্পাদক হন কেশব চন্দ্র গুপ্ত। একসময় কেশব চন্দ্র গুপ্তর সঙ্গে যুগ্ম সম্পাদক হন কৃষ্ণদাস চন্দ্র। ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দে কৃষ্ণচন্দ্র মৃত্যুর পর সম্পাদক হন তাঁর ছেলে রণজিৎ চন্দ্র। ‘অর্চ্চনা’ পত্রিকার ৫৬ বছরের জীবনকালে পত্রিকাটি সম্পাদনা করেন চিত্রিতা দেবী, প্রতাপ চন্দ্র।
‘অর্চ্চনা’র প্রথম দিকে ওই পত্রিকায় লেখালেখি করতেন বাংলা সাহিত্য ও পত্রপত্রিকার বিভিন্ন গৌণ লেখক। কিন্তু সেসব লেখা সাধারণ পাঠক-পাঠিকার কাছে ছিল অত্যন্ত প্রীতিপ্রদ। ফলে সে যুগে প্রবাসী, ভারতবর্ষ বা মাসিক বসুমতীর মতো উচ্চমানের পত্রিকা বাজারচলতি পত্রপত্রিকাকে মাত করে ‘অর্চ্চনা’। গ্রাহক সংখ্যা বৃদ্ধির ফলে প্রথম থেকেই পত্রিকাটি ছিল লাভজনক। সে কারণেই কৃষ্ণদাস চন্দ্রর ছোটোছেলে বাসুদেব চন্দ্র ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে ২২০০ টাকায় নিজেদের বাড়িতে অর্চনা প্রিন্টিং ওয়ার্কস এবং অর্চনা পাবলিশার্স প্রতিষ্ঠা করেন। এই প্রকাশন সংস্থা থেকেই প্রতাপ চন্দ্রর ‘জব চার্নকের বিবি’, বাণী রায়, আশাপূর্ণা দেবী থেকে শুরু করে বাংলাসাহিত্যের বহু খ্যাতনামা লেখক-লেখিকার বিভিন্ন বই।
‘অর্চ্চনা’ পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথও লিখতেন বলে কেউ কেউ দাবি করেছেন। কিন্তু সে ব্যাপারে নির্ভরযোগ্য কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে পার্বতী ঘোষ লেনে অর্চ্চনা ভবনে অর্চ্চনা সমিতির যে সাহিত্য মজলিশ বসতো সেখানে বিভিন্ন সময় আসতেন রবীন্দ্রনাথ, নাট্যাচার্য গিরিশচন্দ্র ঘোষ, কবি কুমুদরঞ্জন মল্লিক, অন্নদাশঙ্কর রায়, প্রেমেন্দ্র মিত্র, আশাপূর্ণা দেবী, মৈত্রেয়ী দেবী, বিপিনচন্দ্র পাল, প্রতাপচন্দ্র চন্দ্র, চিত্রিতা দেবী, শিবরাম চক্রবর্তী, কবি কালিদাস রায় প্রমুখ বঙ্গের বিশিষ্ট লেখক-লেখিকা।
‘অর্চ্চনা’র প্রথম দিকের লেখক তালিকায় ছিলেন কৃষ্ণদাস চন্দ্র, সরসীবালা দেবী, নগেন্দ্রনাথ সোম, নলিনী ঘোষ, ফণীন্দ্রনাথ রায়, ধরিত্রী দেবী, কেশবচন্দ্র গুপ্ত, জীবনেন্দ্র দত্ত, ব্রহ্মসুন্দর সান্যাল, ফকিরচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় প্রভৃতির সঙ্গে কবি কালিদাস রায়, হরিহর শাস্ত্রী, কুমুদরঞ্জন মল্লিক, বিষ্ণুপদ শাস্ত্রী, পাঁচকড়ি দে, গিরিশচন্দ্র ঘোষ প্রমুখ।
পরবর্তীকালে পত্রিকার নামের বানান বদল হয়ে ‘অর্চনা’ হয়। সেইসঙ্গে পত্রিকায় বাংলা সাহিত্যের প্রতিষ্ঠিতদের লেখাও প্রকাশিত হতে থাকে। ওই তালিকায় আছেন, বিপিনচন্দ্র পাল, অন্নদাঙ্কর রায়, অখিল নিয়োগী (স্বপনবুড়ো), শিবরাম চক্রবর্তী, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, প্রেমেন্দ্র মিত্র, আশাপূর্ণা দেবী, কালিদাস নাগ প্রমুখ।
‘অর্চ্চনা’ পত্রিকার আত্মপ্রকাশের কিছুদিন পর থেকেই এই পত্রিকার সুখ্যাতিতে সমকালীন পত্রিকাগুলি মুখর হয়ে ওঠে। বলা হয়, ‘অর্চ্চনার আলোচনা করিতে আমাদের আনন্দ হয়। অল্পদিনের মধ্যে মাসিক পত্রিকাখানিতে সাধারণের আদরণীয় হইয়াছে দেখিয়া আমরা সুখী হইলাম। আমরা সর্বান্তঃকরণে অর্চ্চনার উন্নতি দেখিতে ইচ্ছা প্রকাশ করি’ (চুঁচুড়া বার্তাবহ)।
প্রায় একই সুরে ‘হিতবাদী’ পত্রিকার মন্তব্য, ‘অর্চ্চনা বাঙ্গলায় শ্রেষ্ঠ মাসিক পত্রসমূহের অন্যতম বলিয়া পরিগণিত।’ ‘বঙ্গবাসী’ পত্রিকায় বলা হয়, ‘সাহিত্যে অর্চ্চনার উচ্চস্থান’। একইভাবে ‘বসুমতী’তে বলা হয়, ‘অর্চ্চনা পত্রিকাখানি বিশেষ দক্ষতার সহিত পরিচালিত হইতেছে। প্রবন্ধগুলি সারগর্ভ ও সুখপাঠ্য।’ তৎকালীন বিশিষ্ট পত্রিকা ‘সাহিত্য’-র অভিমত, ‘অর্চ্চনা অনেক মাসিকের আদর্শ হইতে পারে। -অর্চ্চনা ক্ষুদ্র হইলেও অনেক লব্ধপ্রতিষ্ঠ মাসিকের অপেক্ষা উৎকৃষ্ট।’
কেবল বাংলা পত্রপত্রিকায় নয়, সমকালীন ইংরেজি পত্রিকাগুলিও ছিল ‘অর্চ্চনা’-র প্রশংসায় মুখর। যেমন দি স্টেটসম্যান অ্যান্ড ফ্রেন্ড অব ইন্ডিয়া মনে করে ‘The publication is devoted to philosophical and incidentally Bengal interests’। ‘দি বেঙ্গলি পত্রিকায় বলা হয়, ‘… Bengali monthly Archana is an assured place among the vermacular periodicals of the country and one of the organs of Indian Public Opinion in Calcutta.’
এইসব মন্তব্য থেকে বোঝা যায়, যে সময় প্রবাসী, ভারতবর্ষ, মাসিক বসুমতীর মতো পত্রিকাগুলি রমরমিয়ে চলছে তখনও অর্চ্চনার এক বিশেষ ধরনের পাঠকগোষ্ঠী গড়ে উঠেছিল। তার ফলে প্রচার সংখ্যায় অর্চনা সবসময়েই অনেকটাই এগিয়ে ছিল। সে কারণে পত্রিকাটির আর্থিক অবস্থা প্রথম থেকেই ছিল যথেষ্ট লাভজনক। অর্চ্চনার শুরুর কয়েক বছরের সংখ্যাগুলি পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, প্রথম থেকেই পত্রিকাটিতে বেশ ভালো সংখ্যক বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হতো। বিভিন্ন আয়ুর্বেদিক ওষুধ, তেল ইত্যাদির সঙ্গে সঙ্গে প্রথম সংখ্যা থেকেই বেঙ্গল সোপ ফ্যাক্টরি, কিলবার্ন কোম্পানি, বটকৃষ্ণ পালের এডওয়ার্ডস টনিক ইত্যাদির বেশ কয়েক পাতাজোড়া বিজ্ঞাপন পেত। পরবর্তীকালে টাটা স্টিল, বামারলরি, বসন্ত মালতী, জিসি লাহা ইত্যাদির মতো বিখ্যাত সংস্থার বিজ্ঞাপন পত্রিকাটির জনপ্রিয়তার কথাই মনে করিয়ে দেয়।
সব মিলিয়ে, গুণগত মান অত্যন্ত উঁচুস্তরের না হলেও সাধারণ পাঠককুলের মনোরঞ্জন করার মতো রচনার কারণেই এই মাসিক পত্রিকাটি টানা ছাপান্ন বছর পর্যন্ত প্রকাশিত হয়। নিঃসন্দেহে বাংলা সাময়িক পত্রের ইতিহাসে এক ধরনের নজির গড়ার দাবি রাখে এই পত্রিকা।