পশ্চিমবঙ্গের গরিব, অনগ্রসর হিন্দুসমাজের উপর হওয়া অবিচার বন্ধ করার সময় এসেছে
সুদীপ্ত গুহ
‘ওবিসি’ শব্দটির অর্থ হলো- আদার ব্যাকওয়ার্ড ক্লাসেস। গরিব, আর্থিক ভাবে পিছিয়ে পড়া শ্রেণীর মানুষদের শিক্ষাগ্রহণ এবং সরকারি চাকরির সুবিধার জন্য মণ্ডল কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী ১৯৯০ সালে প্রধানমন্ত্রী বিশ্বনাথ প্রতাপ সিংহের নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকার চালু করে ২৭ শতাংশ ওবিসি সংরক্ষণ। আসমুদ্রহিমাচলে ওবিসি সংরক্ষণ চালু হলেও বাদ থাকে শুধু দু’টি রাজ্য। জম্মু-কাশ্মীর ও পশ্চিমবঙ্গ। এই রাজ্যের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু ঘোষণা করেন, তার ১৩ বছরের শাসনকালে রাজ্যের এতটাই উন্নতি হয়েছে যে এই রাজ্যে কেউ ওবিসি নেই। মণ্ডল কমিশনের রিপোর্টে উল্লেখিত ১৫০টি শ্রেণীর মানুষ বঞ্চিত হয় উচ্চশিক্ষার সুযোগ এবং সরকারি চাকরি পাওয়া থেকে। যার মধ্যে মাহিষ্য, সদগোপ, তিলি, বণিক শ্রেণীর বড়ো অংশ রয়েছেন। জ্যোতি বসু সেই সময় ‘সেন কমিশন’ নামে একটি কমিশন বসান। তারা শুনানির দ্বারা সাক্ষ্যগ্রহণ করে উপরোক্ত সমাজের বামপন্থী নেতা-কর্মীদের থেকে এবং কলকাতায় বসবাসকারী ওই সমাজের মাথাদের থেকে যারা বামেদের বন্ধু হয়ে কলকাতায় বসে চাকরি করতেন এবং ব্যক্তিগত ব্যবসায় বড়ো সুবিধা নিতেন। এই দুই পক্ষই দাবি করেন তাদের কোনো সমস্যা নেই এবং তাদের কোনোরকম সংরক্ষণ প্রয়োজন নেই। তৎকালীন সংবাদমাধ্যমের সিংহভাগ বামপন্থীদের
নিয়ন্ত্রণে থাকায় এই গভীর চক্রান্তের খবর পশ্চিমবঙ্গের গ্রামাঞ্চলে বসবাসকারী বৃহত্তর মাহিষ্য, কৈবর্ত, সদগোপ, বণিক, তিলি সমাজের মানুষ জানতে পারেনি, যাদের প্রতি প্রতিদিন অন্যায় ও অবিচার চলছিল। ১৯৭৭ থেকে ১৯৯১ পর্যন্ত ভূমি সংস্কারের নামে মাহিষ্যদের জমি কেড়ে নেয় বামপন্থী মন্ত্রী বিনয় চৌধুরী। ১৯৯১ থেকে ২০১১ পর্যন্ত টানা ভূমি সংস্কার মন্ত্রী ছিলেন আব্দুর রেজ্জাক মোল্লা। ফলে এই পর্যায়ে শুরু হয় মুসলমানদের নামে ভূমি সংস্কার হওয়া জমিগুলির মিউটেশন। রেজ্জাক মোল্লা তার অধীনস্থ দপ্তরের প্রতিটি ব্লক অফিসে নিজের লোক বসান। এখানে লক্ষণীয় বিষয় হলো, পশ্চিমবঙ্গে হওয়া ভূমি সংস্কারের দরুন এসসি-এসটি (তপশিলি জাতি ও উপজাতি)-দের একটি অংশও কিছুটা উপকৃত হয়। কিন্তু তাঁরা মুসলমানদের মতো জমির মালিক হতে পারেননি। গ্রামের জমি হাতছাড়া হওয়ার পর মাহিষ্যরা কৃষি বিষয়ক অন্যান্য ব্যবসাও হারাতে থাকে। চালকল, গমকল, হিমঘর, লজিস্টিক্স, রিটেল-সমেত পুরো সাপ্লাই চেন থেকে তাঁরা বেরিয়ে যান। একই অবস্থা হয় তিলি, তাঁতি, সদগোপ ও বণিকদের। তেলের ব্যবসা, গোপালন, দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্যের ব্যবসা,
পশুপালন, মৎস্যচাষ, পোল্ট্রি সব ব্যবসা থেকেই তাঁরা দূরে সরে যেতে থাকেন। বামফ্রন্ট সরকারের প্রাণীসম্পদ বিকাশ দপ্তরের মন্ত্রী হন আনিসুর
রহমান। সরকারি সুযোগসুবিধার আওতার বাইরে চলে যেতে থাকে হিন্দু বাঙ্গালিরা।
তাঁদের পরিবর্তে সাপ্লাই চেনে মুসলমানরা ঢুকে পড়ায় কীভাবে বাঙ্গালি হিন্দুদের একের পর এক ব্যবসা ছাড়তে হয় সেটারও আলোচনা
প্রয়োজন। প্রতি শুক্রবার নমাজের পর যে বক্তৃতা হয়, সেখানে এই দ্বিতীয় সংখ্যাগুরুদের শেখানো হয়, ‘নিবা, কিন্তু দিবা না’। অর্থাৎ পণ্য ও পরিষেবা
নেবে, কিন্তু বিনিময়ে পয়সা দেবে না। এবার ধরা যাক মাছের ব্যবসা। কোনো হিন্দু মাছের জাল, ওষুধ, হরমোন বা নৌকা (মৎস্য পরিবহণ),
রেফ্রিজারেটর বা রিটেল বিক্রির ব্যবসা করে। কোনো একজন ক্রেতা যদি জিনিসপত্র নিয়ে পয়সা না দেয়, তবে বিক্রেতা ব্যবসায়ী দেউলিয়া হয়ে
যাবে। ব্যবসার পুঁজি, ব্যাংক ঋণ ইত্যাদি কীভাবে তিনি শোধ করবেন? অথচ এই তথাকথিত সংখ্যালঘুরা নিজেদের মধ্যে এই ফর্মুলা প্রয়োগ
করে না। এমনকী, ব্যাংক ঋণ শোধ করতে না পারলে এদের সম্প্রদায় সেটা শোধ করার ব্যবস্থা করে। এই দ্বিতীয় সংখ্যাগুরু সম্প্রদায় বিভিন্ন দিক থেকে পিছিয়ে রয়েছে বলে রিপোর্ট দাখিল করে সাচার কমিটি। এই রিপোর্ট পুরোপুরি মিথ্যা ও
উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।
কেন্দ্রের চাপে এবং সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতায় ১৯৯৭ সালের ৬ নভেম্বর একটি বিজ্ঞপ্তি জারি করে ৭ শতাংশ ওবিসি সংরক্ষণ ঘোষণা করে পশ্চিমবঙ্গ সরকার। মুসলমানদের ১১টি এবং অ-মুসলমানদের ৫৫টি অর্থাৎ মোট ৬৬টি সম্প্রদায়কে ‘অনগ্রসর’ হিসেবে চিহ্নিত করে এই রাজ্য। কিন্তু বিরাট সংখ্যক গরিব হিন্দুদের কাছে ওবিসি শংসাপত্র থেকে যায় অধরা। জ্যোতি বসু জমানার এই সামাজিক অন্যায় আরও বাড়ালেন জ্যোতি বসুর উত্তরসূরী বুদ্ধদেব
ভট্টাচার্য। ২০০৯ সালের লোকসভা ভোটে পশ্চিমবঙ্গের অধিকাংশ আসনে বামফ্রন্ট হেরে যাওয়ার পর মুসলমান ভোটব্যাংক ফিরিয়ে আনতে ২০১০ সালে ওবিসি সংরক্ষণের সীমা ৭ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৭ শতাংশে নিয়ে গেলেন পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। ৭৭টি সম্প্রদায়কে ওবিসি সংরক্ষণের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এর মধ্যে দিয়ে নির্লজ্জ মুসলমান তোষণের নজির সৃষ্টি করে বামফ্রন্ট সরকার। কারণ ৭৭টির মধ্যে ৭৫টি সম্প্রদায়ই
ছিল মুসলমান। এর মধ্যে শুধুমাত্র ২০১০ সালেই নতুন ওবিসি স্ট্যাটাস পায় ৪২টি মুসলমান সম্প্রদায়। ওবিসি সংরক্ষণকে সচতুরভাবে ওবিসি-এ ও বি দু’টি শ্রেণীতে বিভক্ত করে বাম সরকার। অতি পিছড়ে বর্গ বা অধিক মাত্রায় অনগ্রসর শ্রেণীটির পরিচয় হয় ‘ওবিসি-এ’। এর সংরক্ষণ সীমা ছিল ১০ শতাংশ। কোনো অ-মুসলমান সম্প্রদায় এই শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত ছিল না। অর্থাৎ মোট ১৭ শতাংশ ওবিসি সংরক্ষণের মধ্যে ১০ শতাংশ শুধুমাত্র বরাদ্দ ছিল মুসলমানদের জন্য। ‘ওবিসি বি’-র সংরক্ষণ সীমা ছিল ৭ শতাংশ। হিন্দু-মুসলমান উভয়েই ছিল তার অন্তর্গত। মণ্ডল কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী ২৭ শতাংশ ওবিসি সংরক্ষণের পরিবর্তে ১৭ শতাংশ ওবিসি সংরক্ষণের নীতি গ্রহণ করে বামফ্রন্ট। বাকি ১০ শতাংশ তারা রেখে দেয় ভবিষ্যৎ রাজনীতির লাভের গুড় খাওয়ার জন্য। কিন্তু বামেদের পক্ষ থেকে এতরকমের পদক্ষেপ সত্ত্বেও ২০০৬ সালে প্রকাশিত সাচার কমিটির রিপোর্ট বিশ্বাস করে মুসলমানরা। ভোটে হেরে যায় বামফ্রন্ট। ২০১১ সালে বামফ্রন্টকে পরাজিত করে পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতাসীন হয় তৃণমূল কংগ্রেস ও কংগ্রেস জোট। মুখ্যমন্ত্রী হলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
এরপর নিজের ভোটব্যাংক ধরে রাখতে ওবিসি-এ’র পাশাপাশি ওবিসি’বি-তেও ৯৯ শতাংশ মুসলমানের নাম তুলে দেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ২০২৩-এর ২৩ নভেম্বর নেতাজী ইন্ডোর স্টেডিয়ামে আয়োজিত দলীয় সভায় একথা তিনি গর্বের সঙ্গে ঘোষণাও করেন। ২০২১-এর বিধানসভা নির্বাচনের আগে তৃণমূল
প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যে, মাহিষ্যদের জন্য কোটা দেবে। কিন্তু মুসলমান ভোটের কথা ভেবে ভোটের পর আবার চুপ করে যায়। ২০১০ সালের পর
থেকে সংবিধান-প্রদত্ত অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছিল পশ্চিমবঙ্গের গরিব এবং আর্থিকভাবে অনগ্রসর হিন্দুসমাজ। পরিণামে কলকাতা হাইকোর্টে দায়ের হয় একের পর এক জনস্বার্থ মামলা। সেই আবেদনগুলির শুনানির শেষে গত বছর ২২ মে, ২০১০ সালের এপ্রিল ও সেপ্টেম্বরে প্রণীত ওবিসি সংরক্ষণ পদ্ধতি এবং ৭৭টি অনগ্রসর সম্প্রদায় নির্বাচন-সহ ওবিসি শ্রেণীবিভাগের গোটা প্রক্রিয়াটিকেই বাতিল ঘোষণা করে কলকাতা হাইকোর্ট। এই রায়ে ‘দ্য
ওয়েস্ট বেঙ্গল ব্যাকওয়ার্ড ক্লাসেস (আদার দ্যান শিডিউলড ক্লাস্টস্ অ্যান্ড শিডিউলড ট্রাইবস্) (রিজার্ভেশন অফ ভ্যাকেন্সিজ ইন সার্ভিসেস অ্যান্ড পোস্টস্) অ্যাক্ট, ২০১২’ অনুযায়ী ৩৭টি সম্প্রদায়কে ওবিসি সংরক্ষণের আওতায় আনার প্রক্রিয়াটিও খারিজ করে দেয় হাইকোর্ট। একইসঙ্গে ২০১০ সাল থেকে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের দেওয়া সব ওবিসি সার্টিফিকেট অবৈধ বলে ঘোষণা করে কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি রাজাশেখর মান্থা ও বিচারপতি তপোব্রত চক্রবর্তীর ডিভিশন বেঞ্চ।
আদালতে ওবিসি সংরক্ষণ সংক্রান্ত মামলায় হেরে যাওয়ার পর সেই রায় সুপ্রিম কোর্টে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে স্পেশাল লিভ পিটিশন দায়ের করে রাজ্য। গত বছর ৯ ডিসেম্বর সেই মামলার শুনানির সময় সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি বিআর গাভাই ও কেভি বিশ্বনাথনের বেঞ্চের একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। সুপ্রিম কোর্টের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, ধর্মের ভিত্তিতে কোনো সংরক্ষণ দেওয়া যায় না। এই বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের
ওবিসি শ্রেণীবিভাগের প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন তোলে সুপ্রিম কোর্ট। তাদের পর্যবেক্ষণে সুপ্রিম কোর্ট বলে যে, সংরক্ষণ ঘোষণার ক্ষেত্রে ধর্মই হয়ে উঠেছে
একমাত্র মানদণ্ড। ৭৫টি সম্প্রদায়ের মুসলমানদের ‘অনগ্রসর’ বা ‘পিছিয়ে পড়া শ্রেণী’ হিসেবে নির্বাচন করার বিষয়টি সমগ্র মুসলমান সম্প্রদায়ের
জন্যও বিশেষ অপমানজনক। এর মধ্যে রাজ্যে মাধ্যমিক, উচ্চ-মাধ্যমিক পরীক্ষার ফলপ্রকাশ হলে স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ক্ষেত্রে সৃষ্টি
হয় সংকট। ওবিসি সংরক্ষিত আসনে ভর্তির ক্ষেত্রে তৈরি হয় গোলযোগ। গরিব ছাত্র-ছাত্রীরা ভর্তির ক্ষেত্রে চরম সমস্যার সম্মুখীন হয়। সুপ্রিম কোর্টে মামলা ঝুলে থাকায় উচ্চশিক্ষায় ওবিসি আসন সংরক্ষণ করা যাচ্ছে না বলে অজুহাত দেয় রাজ্য সরকার। গত ১৮ মার্চের শুনানিতে রাজ্য সরকার সুপ্রিম কোর্টকে জানায় যে, অনগ্রসর শ্রেণী চিহ্নিতকরণের জন্য তারা একটি নতুন সমীক্ষা শুরু করতে চলেছে এবং আগামী তিন মাসের মধ্যে শেষ হবে সেই সমীক্ষা। এরপর ইচ্ছাকৃতভাবে ফের একটি ভুলে ভরা সমীক্ষা শুরু করে রাজ্য জুড়ে। কলকাতা হাইকোর্টের রায়ে স্পষ্টভাবেই উল্লেখিত হয়েছিল যে, বিজ্ঞানসম্মত
প্রক্রিয়ায় এবং নির্ভরযোগ্য তথ্যের ভিত্তিতে একটি শ্রেণীকে ‘অনগ্রসর’ ঘোষণার প্রয়োজন। সেই ক্ষেত্রে কেবলমাত্র আর্থিক দিক থেকে পিছিয়ে থাকার কারণে কোনো সম্প্রদায় বা শ্রেণী ‘অনগ্রসর’ হিসেবে ঘোষিত হতে পারে না। কেন্দ্র ও রাজ্যের অধীনস্থ সরকারি চাকরিক্ষেত্রে শ্রেণীটির যোগদান বা প্রতিনিধিত্ব অপর্যাপ্ত হলে সেই বিষয়টি শ্রেণীটিকে ওবিসি হিসেবে ঘোষণার একটি ভিত্তি হতে পারে। অন্যান্য অসংরক্ষিত শ্রেণী-সহ সমগ্র জনসংখ্যার তুলনায় শ্রেণীটির
প্রতিনিধিত্বের অপ্রতুলতার মূল্যায়ন প্রয়োজন। এই তুলনামূলক বিশ্লেষণের রাস্তায় না হেঁটে মুসলমান ভোটব্যাংক ও তুষ্টীকরণের রাজনীতিতে পটু তৃণমূল সরকার সম্পূর্ণ অবৈজ্ঞানিক কায়দায় একটি মনগড়া সমীক্ষা শুরু করে। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমে প্রকাশিত খবরে দেখা গিয়েছে যে, বিভিন্ন বিধানসভা এলাকায় ওবিসি হিসেবে নাম তোলার জন্য মুসলমানরা যেসব ফর্ম পূরণ করছে, সেখানে তাদের যে সম্প্রদায়ের উল্লেখ তারা করছে, সেই সম্প্রদায়গুলির নাম আগে কোনোদিন শোনাই যায়নি। এই সমীক্ষার মাধ্যমে তাদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সিদ্ধি ও তাদের সরকারের দেওয়া ওবিসি সার্টিফিকেট বৈধ বলে আদালতে প্রমাণ করার চেষ্টায় মরিয়া রাজ্যের শাসক দল এবং তাদের নেত্রী।
পশ্চিমবঙ্গ স্বাস্থ্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ক্ষেত্রে ওবিসি সংরক্ষণে বঞ্চিতদের পক্ষ থেকে দায়ের করা একটি মামলায় গত ২২ মে পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে রীতিমতো ভর্ৎসনা করে কলকাতা হাইকোর্ট। সুপ্রিম কোর্টে মামলা চলার কারণে এই সমস্যা বলে হাইকোর্টকে জানায় রাজ্য। বিচারপতি কৌশিক চন্দ তাঁর দেওয়া রায়ে বলেন যে, ২০২৪-এ কলকাতা হাইকোর্টের দেওয়া রায়ের উপর কোনো স্থগিতাদেশ দেয়নি সুপ্রিম কোর্ট। অতএব, রাজ্যের দেওয়া অজুহাত কোনোভাবেই
ধোপে টেকে না। ২০১০ সাল থেকে রাজ্য প্রণীত ওবিসি সংরক্ষণ বাতিল বলে ঘোষণা করেছে হাইকোর্ট। ২০১০ সাল থেকে রাজ্য সরকারের ইস্যু করা ওবিসি সার্টিফিকেটগুলিতে সার্টিফিকেট প্রাপকের কাস্ট (জাতি বা সম্প্রদায়)-এর উল্লেখ রয়েছে। সেক্ষেত্রে ছাত্র-ছাত্রীরা যে জাতি বা সম্প্রদায়ভুক্ত, সেই সম্প্রদায়টির উল্লেখ ২০১০-এর আগে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অনগ্রসর শ্রেণী কল্যাণ দপ্তর দ্বারা প্রকাশিত বা স্বীকৃত ‘ওবিসি তালিকা’য় যদি থাকে, তাহলে তাঁদের ওবিসি হিসেবে গণ্য করা যেতেই পারে এবং ওবিসি-দের জন্য সংরক্ষিত আসনে তাঁরা ভর্তি হতে পারেন।
এমতাবস্থায় তাদের ষড়যন্ত্রের ফলশ্রুতি হিসেবে, মনগড়া সমীক্ষা শেষে গত ৩ জুন তাদের নতুন ওবিসি সংরক্ষণ নীতি ঘোষণা করে পশ্চিমবঙ্গ সরকার। ১৯৯৭ সালের ৭ শতাংশ ওবিসি সংরক্ষণের বিপ্রতীপে ‘1106-BCW/ MR-33/2025, Dated June 3, 2025’- শীর্ষক বিজ্ঞপ্তিতে উচ্চশিক্ষা ও সরকারি চাকরিতে পদ সৃষ্টির ক্ষেত্রে ফের ১৭ শতাংশ ওবিসি সংরক্ষণ সীমা ঘোষণা করে রাজ্য। ফের তৈরি করা হলো দুটি শ্রেণী- ১০ শতাংশ সংরক্ষণ সীমাসম্পন্ন ক্যাটিগরি-এ (মোর ব্যাকওয়ার্ড ক্লাসেস) এবং ৭ শতাংশ সংরক্ষণ সীমার ক্যাটিগরি-বি (ব্যাকওয়ার্ড ক্লাসেস)। এই বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে মুসলমান তোষণের নতুন দৃষ্টান্ত তৈরি করলেন তৃণমূলনেত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এই রাজ্যে ওবিসি-র অর্থ ‘আদার ব্যাকওয়ার্ড ক্লাসেস’ থেকে পরিবর্তিত হয়ে দাঁড়াল ‘ওয়ান-সাইডেড বেনিফিশিয়ারি ক্লাসেস’। গত ১০ জুন, ২০২৪-২৫ অর্থবর্ষের ‘পশ্চিমবঙ্গ অনগ্রসর শ্রেণী কমিশন’-এর বার্ষিক রিপোর্ট রাজ্য বিধানসভায়
পেশ করার সময় তার দেওয়া বক্তৃতায় ধর্মের ভিত্তিতে পশ্চিমবঙ্গে কোনো সংরক্ষণ দেওয়া হয় না বলে এক অলীক দাবি করে বসেন মমতা
বন্দ্যোপাধ্যায়। তার বক্তব্য যে, অনৃতভাষণ তা বলাই বাহুল্য। ২০১০ সালের আগের রাজ্য সরকার কর্তৃক গৃহীত ওবিসি সংরক্ষণ নীতি এবং গত ৩ জুন রাজ্যের জারি করা বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী ওবিসি সংরক্ষণের একটি তুলনামূলক পরিসংখ্যান নীচে উপস্থাপন করা হলো।
২০১০ পূর্ববর্তী পরিস্থিতি:
মোট ওবিসি সম্প্রদায়: ৬৬
মুসলমান সম্প্রদায়: ১১
অ-মুসলমান সম্প্রদায়: ৫৫
মুসলমান সম্প্রদায়ের সংরক্ষণ প্রাপ্তির
পরিমাণ: ২০ শতাংশ
২০২৫ সালে তৃণমূল সরকারের অধীনে অন্তর্ভুক্ত ওবিসি সম্প্রদায়ের পরিসংখ্যান:
পার্ট ১ (ক্যাটিগরি-এ):
মোট ওবিসি সম্প্রদায়: ৫১
মুসলমান সম্প্রদায়: ৪৬
অ-মুসলমান সম্প্রদায়: ৫
মুসলমান সম্প্রদায়ের সংরক্ষণ প্রাপ্তির আর্থিক সঙ্গতি-সহ নানা মাপকাঠি সংক্রান্ত তথ্য
পরিমাণ: ৯০ শতাংশ
পার্ট ২ (ক্যাটিগরি-বি):
মোট ওবিসি সম্প্রদায়: ২৫
মুসলমান সম্প্রদায়: ২১
অ-মুসলমান সম্প্রদায়: ৪
মুসলমান সম্প্রদায়ের সংরক্ষণ প্রাপ্তির
পরিমাণ: ৮৪ শতাংশ
উপরোক্ত পরিসংখ্যান থেকে এটা স্পষ্ট যে, ১৭ শতাংশ ওবিসি সংরক্ষণের প্রায় পুরো ফয়দা পাবে মুসলমানেরাই। বার বার এই একতরফা সংরক্ষণ পদ্ধতি প্রণয়নের ফলে মমতা ব্যানার্জির নেতৃত্বাধীন সরকারের দিকে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নচিহ্ন উঠে আসে। প্রশ্নটি হলো, ১৯৯৭ সালে রাজ্যে ২০ শতাংশ অনগ্রসর মুসলমান সম্প্রদায় ২০২৫ সালে এসে কীভাবে প্রায় ৯০ শতাংশে পরিণত হলো? এই পরিসংখ্যান কি প্রমাণ করে না যে বামফ্রন্ট ও তৃণমূলের শাসনে নানাভাবে পিছিয়ে পড়ছে এই রাজ্যের মুসলমানেরা? নাকি হিন্দুদের বঞ্চিত করতেই দুধেল গাইদের জন্য পরিকল্পিতভাবে এই পক্ষপাতদুষ্ট সংরক্ষণ? কয়েকদিন আগেই এই ধরনের সংরক্ষণ নীতিকে খারিজ করেছিল বিচারবিভাগ। ফের সেই এক নাীতি ঘোষণা করে রীতিমতো আদালত অবমাননার নজির সৃষ্টি করল পশ্চিমবঙ্গ সরকার।
রাজ্যের জারি করা নতুন তালিকাকে চ্যালেঞ্জ করে কলকাতা হাইকোর্টে পুনরায় মামলা দায়ের হয়। গত ১৭ জুন এই বিজ্ঞপ্তি ও তালিকায় অন্তর্বর্তীকালীন স্থগিতাদেশ দেয় কলকাতা হাইকোর্ট। বিচারপতি রাজাশেখর মান্থা ও বিচারপতি তপোব্রত চক্রবর্তীর ডিভিশন বেঞ্চ বলে যে, সুপ্রিম কোর্টে রাজ্যের করা আবেদনের শুনানি এখনও চলছে। সেই মামলায় এখনও রায়দান করেনি সুপ্রিম কোর্ট। হাইকোর্টের রায়ে ২০১২ সালের রাজ্যের ওবিসি সংরক্ষণ সংক্রান্ত আইন অনুযায়ী সংরক্ষণ পদ্ধতি আগেই বাতিল ঘোষিত হয়েছে। সেই আইনে সংশোধন করে নতুন ওবিসি তালিকা কেন প্রকাশ করা হলো জানতে চায় হাইকোর্ট।
এছাড়াও নতুনভাবে ওবিসি সংরক্ষণ ঘোষণার ক্ষেত্রে ২০১২-র আইনটিকে অর্ধেক ব্যবহারের পাশাপাশি ‘দ্য ওয়েস্ট বেঙ্গল কমিশন ফর ব্যাকওয়ার্ড ক্লাসেস অ্যাক্ট, ১৯৯৩’-আইনটিকেও এক্ষেত্রে ব্যবহার করার যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যা রাজ্যের কাছে চায় হাইকোর্ট। প্রায় ১৪০টি সম্প্রদায়ের আর্থিক সঙ্গতি-সহ নানা মাপকাঠি সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ রাজ্যের দাবি অনুযায়ী মাত্র দেড় মাসে সম্পূর্ণ হয়েছে শুনে বিস্ময় প্রকাশ করে হাইকোর্ট। এই বিষয়ে একটি সঠিক, যথাযথ ও বিশদ সমীক্ষার উপরেও জোর দেন বিচারপতিরা। রাজ্যের তৈরি নতুন ওবিসি তালিকায় বিভিন্ন অনগ্রসর সম্প্রদায়ের নাম অন্তর্ভুক্তির উদ্দেশ্যে অনলাইনে জাতিগত শংসাপত্র (ওবিসি সার্টিফিকেট) জমা দেওয়ার জন্য সম্প্রতি একটি পোর্টাল খোলার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে পশ্চিমবঙ্গ সরকার। সেই পোর্টালের ক্ষেত্রেও এদিন স্থগিতাদেশ জারি করে কলকাতা হাইকোর্ট। এই রায়কে স্বাগত জানিয়েছেন রাজ্যের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী।
আদালতে একের পর এক মামলা হেরে যাওয়া রাজ্য সরকার বহু বছর ধরেই ওবিসি সংরক্ষণের ক্ষেত্রে মাহিষ্য, কৈবর্ত, সদগোপ, তিলি, বণিকদের বাদ দিচ্ছে। পরিকল্পনামাফিক প্রায় ৩৫ বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে তাঁদের বঞ্চিত করা চলছে।