ভারত কেশরী ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ও বর্তমান ভারতবর্ষ : আদর্শ ও বাস্তব প্রেক্ষাপট
অরুণ কুমার চক্রবর্তী
ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের জন্ম ১৯০১ সালের ৬ জুলাই, এক বাঙ্গালি শিক্ষিত পরিবারে। তাঁর পিতা আশুতোষ মুখোপাধ্যায় ছিলেন কলকাতা
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ। এমন প্রজ্ঞাশীল পরিবেশে বড়ো হয়ে ওঠা শ্যামাপ্রসাদ খুব অল্প বয়সেই জ্ঞান, যুক্তি ও রাষ্ট্রচিন্তায় পারদর্শিতা অর্জন করেন। তিনি কেবলমাত্র একজন অধ্যাপক নন, তিনি ছিলেন জাতীয়তাবাদী নেতৃত্বের ধারক। হিন্দু সংস্কৃতির মৌলিক মূল্যবোধের উপর ভরসা রেখে, ড. শ্যামাপ্রসাদ চেয়েছিলেন এক যুক্তিবাদী, সর্বপন্থ সমভাব অথচ আত্মমর্যাদাসম্পন্ন রাষ্ট্রব্যবস্থা। তিনি বিশ্বাস করতেন, ভারতের জাতীয় চরিত্র কেবলমাত্র পশ্চিমি ভাবনার ছাঁচে ঢেলে তৈরি করা যাবে না; এর জন্য প্রয়োজন ভারতের নিজস্ব সভ্যতা, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির পুনর্মূল্যায়ন।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বকনিষ্ঠ উপাচার্য হিসেবে, ১৯৩৪ থেকে ১৯৩৮ সাল পর্যন্ত তিনি দায়িত্ব পালন করেন। মাত্র ৩৩ বছর বয়সে তিনি এই দায়িত্ব গ্রহণ করেন, যখন ভারতের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো ঔপনিবেশিক প্রভাবের অধীনে পরিচালিত হচ্ছিল এবং দেশীয় জ্ঞান ও সংস্কৃতির প্রায় উপেক্ষিত ছিল। ড. মুখোপাধ্যায় এই ভারসাম্যহীনতা লক্ষ্য করে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠক্রমকে আধুনিকীকরণ করার পাশাপাশি ভারতীয় ঐতিহ্যের প্রতি গর্ব ফিরিয়ে আনার প্রচেষ্টা করেন।
তাঁর অন্যতম বড়ো অবদান ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল পাঠক্রমে ভারতীয় ভাষা ও শাস্ত্রীয় বিষয়াবলীর অন্তর্ভুক্তি ও প্রসার। তাঁর বিশ্বাস ছিল, শিক্ষার শিকড় জাতির সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক চেতনার মধ্যে নিহিত থাকা উচিত। ইংরেজি ও পাশ্চাত্য বিজ্ঞানের পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের সংস্কৃত, বাংলা, ভারতীয় দর্শন, ইতিহাস ও সংস্কৃতির ওপরও সমান গুরুত্ব সহকারে শিক্ষা গ্রহণ করা উচিত।
একই সঙ্গে তিনি পাশ্চাত্য জ্ঞানের মূল্য অস্বীকার করেননি। বরং তিনি এমন একটি সমন্বিত শিক্ষা ব্যবস্থা কল্পনা করেছিলেন, যেখানে পাশ্চাত্যের বৈজ্ঞানিক যুক্তি ও অগ্রগতিশীল চিন্তা ভারতীয় আধ্যাত্মিকতা, নৈতিক মূল্যবোধ ও সাংস্কৃতিক ধারাবাহিকতার সঙ্গে মিশে যাবে। তাঁর মতে, এই সংমিশ্রণই এমন এক প্রজন্ম গড়ে তুলতে পারে, যারা আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে আধুনিকতা ও ঐতিহ্যের মধ্যবর্তী সেতুবন্ধন রচনা করতে পারবে। ড. মুখোপাধ্যায় ছিলেন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বায়ত্তশাসনের একজন দৃঢ় সমর্থক। তিনি শিক্ষা ব্যবস্থায় অপ্রয়োজনীয় রাজনৈতিক বা প্রশাসনিক হস্তক্ষেপের বিরোধিতা করেন এবং মনে করতেন বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা করা উচিত শিক্ষাবিদ ও বিদ্বজ্জনের মাধ্যমে; প্রশাসকদের মাধ্যমে নয়। তিনি যুক্তিসংগত বিতর্ক, বৌদ্ধিক স্বাধীনতা ও চিন্তার স্বাধীনতাকে উৎসাহিত করতেন। কারণ তাঁর বিশ্বাস ছিল, শিক্ষার মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত শুধুই পেশাগত দক্ষতা নয়, বরং দায়িত্ববান, সচেতন ও দেশপ্রেমিক নাগরিক গড়ে তোলা।
এই সংস্কার ও আদর্শের মাধ্যমে ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় এমন একটি শিক্ষা দর্শনের ভিত্তি গড়ে তোলেন, যা ছিল জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ, বিশ্বস্তরীয় দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন এবং ভারতীয় সভ্যতার মূল মূল্যবোধে গাঁথা। তাঁর এই শিক্ষাদর্শ আজও ভারতের শিক্ষাবিদ ও নীতিনির্ধারকদের অনুপ্রেরণা জোগায়।
আদর্শগত দিক থেকে শ্যামাপ্রসাদ ছিলেন সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবোধের প্রবক্তা— একটি এমন চিন্তাধারা যা ভারতের প্রাচীন সভ্যতা, আধ্যাত্মিক ঐতিহ্য এবং সাংস্কৃতিক পরিচয়কে জাতীয় জীবনের কেন্দ্রস্থলে স্থান দেয়। তাঁর বিশ্বাস ছিল, ভারত কেবলমাত্র একটি ভৌগোলিক সত্তা নয়, বরং হাজার হাজার বছরের অব্যাহত সাংস্কৃতিক চেতনার ধারক ও বাহক একটি জীবন্ত সভ্যতা। তাই তাঁর জাতীয়তাবোধ ছিল রাজনৈতিক সীমানার উপর নয়, বরং ধর্ম (ধর্মনীতি), বহুত্ব ও পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধে ভর করা একটি সভ্যতাগত ঐক্যের দর্শনে তিনি ছিলেন ব্যক্তিস্বাধীনতার দৃঢ় সমর্থক চিন্তা, মত প্রকাশ, ধর্মাচরণ ও রাজনৈতিক মতাদর্শে। তিনি কখনো কর্তৃত্ববোধে বিশ্বাসী ছিলেন না। তাঁর মতে, গণতন্ত্র রক্ষা করা অপরিহার্য এবং সকল নাগরিকের উচিত পূর্ণ স্বাধীনতার সঙ্গে মত প্রকাশ এবং রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করার অধিকার থাকা।
যা তাঁর ভাবনা ছিল একটি শক্তিশালী ভারসাম্যপূর্ণ শাসনব্যবস্থা কেন্দ্র ও রাজ্যের মধ্যে সুসমন্বয় সাধন করবে। তিনি অতিরিক্ত কেন্দ্রীকরণ যেমন সমর্থন করতেন না, তেমনি বিভাজনমূলক আঞ্চলিকতাকেও বিপজ্জনক মনে করতেন। তাঁর মতে, জাতীয় উদ্দেশ্যের আলোকে কেন্দ্র ও রাজ্যের মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্যপূর্ণ বণ্টনই ভারতের প্রকৃত শক্তির ভিত্তি।
১৯৫১ সালে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভা থেকে পদত্যাগ করে তিনি গঠন করেন ভারতীয় জনসঙ্ঘ যা আজকের ভারতীয় জনতা পার্টির পূর্বসূরি। এই রাজনৈতিক মঞ্চের মাধ্যমে তিনি ভারতের জন্য এক বিকল্প রাজনৈতিক দর্শন প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেন– যার ভিত্তি ছিল সাংস্কৃতিক গর্ব, জাতীয় অখণ্ডতা, আত্মনির্ভরতা এবং নৈতিক রাজনীতি। তাঁর রাজনৈতিক আদর্শ ছিল ভারতের একতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা এবং নীতিনির্ধারণ ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে দেশীয় মূল্যবোধ পুনঃস্থাপন করা।
ভারতবর্ষের আধুনিক ইতিহাসে ড. শ্যামাপ্রসাদের চিন্তা আজও বর্তমান ভারতের পরিপ্রেক্ষিতে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। তাঁর রাজনৈতিক দর্শন, সাংস্কৃতিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং রাষ্ট্রচিন্তা, আজকের ভারতবর্ষের নীতিনির্ধারণে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
ড. শ্যামাপ্রসাদ ভারতীয় রাজনীতিতে প্রবেশ করেন কঠিন এক সময়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, দেশভাগ, মুসলমানদের হিন্দুদের ওপর আক্রমণ– এই সবকিছুর মাঝে তাঁর রাজনৈতিক অভিমুখ ছিল সুস্পষ্ট। ১৯৪০-এর দশকে তিনি হিন্দু মহাসভার সভাপতি নির্বাচিত হন। যদিও তিনি হিন্দু সংস্কৃতির পক্ষে দৃঢ় ছিলেন, কিন্তু তাঁর অবস্থান ছিল সকল রকম গোঁড়ামির বিরুদ্ধে। তিনি বারবার বলেছিলেন– ‘আমি হিন্দু বলেই মানবতাবাদী’।
স্বাধীনতার আগে তিনি ব্রিটিশের বিরুদ্ধে সরাসরি অবস্থান নেন এবং বিভিন্ন প্রদেশে হিন্দু নিধনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সোচ্চার হন। দেশভাগের সময়ে পূর্ববঙ্গে হিন্দুদের উপর মুসলমানদের অত্যাচার দেখে তিনি চুপ থাকেননি। তাঁর অন্যতম বড়ো রাজনৈতিক অবদান হলো পাকিস্তানের কবল থেকে পশ্চিমবঙ্গকে ছিনিয়ে আনা। ১৯৪৭-এ পূর্ববঙ্গ থেকে উদ্বাস্তু হিন্দুদের পুনর্বাসন নিয়ে তিনি সোচ্চার হন। এই দৃষ্টান্ত আজও স্মরণীয়। তিনি জম্মু-কাশ্মীরের জন্য পৃথক সংবিধান এবং ৩৭০ অনুচ্ছেদের বিরোধিতা করে বলেছিলেন– ‘এক দেশ, এক পতাকা, এক সংবিধান।’ এই আদর্শকেই পরবর্তীকালে বর্তমান ভারত সরকার বাস্তবায়ন করেছে। ২০১৯ সালে ৩৭০ অনুচ্ছেদ বিলুপ্ত করে কেন্দ্র সরকার এক রাষ্ট্রনীতির পক্ষে শ্যামাপ্রসাদের ভাবনাকেই সম্মান জানিয়েছে। ভারতবর্ষ আজ এক বিশাল রূপান্তরের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। একদিকে অর্থনৈতিক বিকাশ, ডিজিটাল উন্নয়ন, জাতীয়তাবোধের উত্থান, অন্যদিকে অসাম্যের প্রাচীর, সাম্প্রদায়িক বিভাজন ও সামাজিক অসন্তোষ– এই দুই বাস্তবতাই আজ ভারতের সামনে।
এই বাস্তবতার আলোকে ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের আদর্শ পুনরায় মূল্যায়নের প্রয়োজন: ১. ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় বিশ্বাস করতেন ভারত একটি সাংস্কৃতিক রাষ্ট্র। আজকের ভারতে যেখানে জাতিগত, ধর্মীয় ও ভাষাগত বিভাজনের আশঙ্কা মাঝে মাঝে মাথা তোলে, সেখানে শ্যামাপ্রসাদের মূলমন্ত্র- ‘একতা ও বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য’- সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক।
২. তিনি সর্বপন্থ সমভাবের এমন এক রূপে বিশ্বাসী ছিলেন যা ধর্মকে অস্বীকার করে না, বরং সব ধর্মের সহাবস্থানে বিশ্বাস রাখে। তিনি ধর্মান্ধতার বিরোধিতা করলেও, ভারতের ঐতিহ্যগত ধর্মজ্ঞানকে সমাজগঠনের উপাদান মনে করতেন। বর্তমান ভারতের ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ বার বার রাজনৈতিক হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। এই খোলস থেকে সর্বপন্থ সমভাবের আদর্শকে উদ্ধার করতে ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের দৃষ্টিভঙ্গি এক বড়ো সহায়ক হতে পারে।
৩. যে দেশে শিক্ষানীতির সঙ্গে মূল্যবোধের যোগ কমে যাচ্ছে, সেখানে ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের শিক্ষা-দর্শন-জ্ঞান ও চরিত্রের সমন্বয়– পুনঃপ্রতিষ্ঠার দাবি রাখে। বর্তমান ‘নতুন শিক্ষানীতি’ অনেকাংশে তাঁর ভাবনার প্রতিফলন বহন করে, তবে এর বাস্তবায়ন এখনো অসম্পূর্ণ।
৪. কাশ্মীর ইস্যু থেকে শুরু করে মুসলমান, অনুপ্রবেশ, সীমান্ত রক্ষা– এই সমস্ত ক্ষেত্রেই তাঁর ভূমিকা ছিল দূরদর্শিতায় পূর্ণ। আজকের রাষ্ট্রনীতিতে এই চেতনার পরিরক্বতা দৃশ্যমান। চীনের আগ্রাসন, বাংলাদেশের সীমান্ত সমস্যা, পাকিস্তান প্রসঙ্গে তাঁর নির্ভীক অবস্থান আজও প্রাসঙ্গিক।
ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের চিন্তা কেবল একটি রাজনৈতিক মতবাদ নয়, এটি এক জাতীয় দৃষ্টিভঙ্গির বহিঃপ্রকাশ। আজকের ভারতবর্ষ তাঁর স্বপ্নের দিকে অনেকটা এগিয়ে গেলেও চূড়ান্ত রূপ পায়নি। তাঁর ভাবনা যদি দলীয় রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে সর্বজনীন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে আসে, তাহলে
ভারতের উন্নয়ন আরও মানবিক, যুক্তিনিষ্ঠ ও স্থায়ী হতে পারে।
দেশবাসী যদি বর্তমান বাস্তবতার মধ্যে ড. শ্যামাপ্রসাদের আদর্শকে খুঁজে নিতে পারে, তাহলে আজকের ভারত আরও নৈতিক, সাংস্কৃতিকভাবে সমৃদ্ধ ও আত্মবিশ্বাসী এক জাতিতে পরিণত হবে।
‘জীবনের ত্যাগ, চিন্তার গভীরতা এবং জাতির প্রতি নিঃস্বার্থ ভালোবাসা– এই তিনে গঠিত ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের ভারত চিন্তা। বর্তমান ভারত তাঁর ঋণ স্বীকার করুক এক শুধু আনুষ্ঠানিকভাবে নয়, নীতিগতভাবে।’