হাজার ভূতের রাজার দয়ায় বাম-তৃণমূলের উদয়
ভূতের রাজা দিল বর
নির্মাল্য মুখোপাধ্যায়
কথায় বলে বেল পাকলে কাকের কী? কাকের অনেক কিছু। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছে। সিঁদুরের মেঘ দেখছেন। বিহার নির্বাচনে বিশেষ ধরনের ভোটার তালিকা সংশোধন করছে কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশন। তাতেই বিপত্তি। এ রাজ্যে তা চালু হলে কয়েক কোটি ভুয়ো ভোটার বাদ পড়বে। সর্বশক্তি দিয়ে তা আড়াল করতে চাইছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সুপ্রিম আদালতের চড় খেয়ে তাকে ফিরে আসতে হয়েছে। লেজুড় কংগ্রেস দাবি করেছে কমিশনের অধিকার খর্ব নয়, স্পেশাল ইন্টেন্সিভ রিভিশনের সময় কোনো ন্যায্য ভোটার যাতে তালিকা থেকে বাদ না পড়ে, আদালতে সেই আবেদন তারা জানিয়েছিল। দলের এক নির্লজ্জ ও বেহায়া সাংসদকে দিয়ে আদালতে এই রিভিশনের বিরোধিতা করিয়েছিলেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ভোটার তালিকার বিশেষ সংশোধনের সঙ্গে অবান্তর প্রশ্নের সম্পর্ক তৈরি করতে মাঠে নেমেছে বালকবুদ্ধি রাহুল গান্ধী। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানেন যে, কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশনের কোনো কাজে হস্তক্ষেপ করা যায় না। এ বিষয়ে ভারতীয় সংবিধান কমিশনকে বিশেষ সুরক্ষা বা ‘ইমিউনিটি’ দিয়েছে। তাই এ নিয়ে জলঘোলা করা ভিত্তিহীন। ‘নির্বাচন কমিশন’ গঠনের ক্ষেত্রে অনেক ধরনের অদলবদলে জলঘোলা হয়েছে, কিন্তু তার কাজের আওতা নিয়ে প্রশ্ন
তোলা অর্বাচীন ব্যবহার।
নন্দীগ্রামে শুভেন্দু অধিকারীর কাছে ভোটে হেরে কলকাতা হাইকোর্টে ভোট জালিয়াতির মামলা করেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, যদিও জানতেন তাতে কোনো লাভ নেই। নন্দীগ্রাম থেকে পালিয়ে নিজের গড় ভবানীপুরে আসেন, যদিও ৯টি ওয়ার্ডের মধ্যে ৬টি হেরে যান। ৩টি মুসলমান-অধ্যুষিত ওয়ার্ড থেকে জেতার ভোট তুলে নেন। ২০২৬-এর পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনের দিকে তাকিয়েই বর্তমানে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশনের বিরোধিতা করছেন। এ রাজ্যের অধিকাংশ ভুয়ো ভোটার অনুপ্রবেশকারী ও মুসলমান সম্প্রদায়ের। তার সঙ্গে মিশেছে অন্যান্য রাজ্যের পরিযায়ী শ্রমিক। এদের ভোটেই বামেরা জিতত। এখন তৃণমূল জেতে। ভোটবাজারে এরাই সেই ভূতের রাজা যাদের বরে এতদিন ধরে বিদেশি বাম আর তৃণমূল জিতে চলেছে। ‘নকলি’ বা ভূতুড়ে ভোট কীভাবে আসে তা ধরতেই যেমন বিহারে জাল পেতেছে নির্বাচন কমিশন। মুখ্যমন্ত্রী মমতার আশঙ্কা এখানেও সে জাল পাতা হবে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে যে মুসলমানরা ভোট দিয়ে জেতায়, মমতা তাদের গোরু (দুধেল গাই) ইত্যাদি বলে থাকেন। দেনাপাওনার খেলায় তারাও মুখ বুজে থাকে।
আশির দশক থেকেই ব্যাকডোর রাজনীতি করেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাই সব ঘটনাতেই পিছনের রাস্তা খোঁজেন। এখন অবান্তর ভাবে ভোটার তালিকা সংশোধনের সঙ্গে জাতীয় নাগরিক পঞ্জীর সম্পর্ক জুড়েছেন। ‘এনআরসি জুজু’ দেখিয়ে মুসলমান ভোট নিজের কাছে রাখতে তিনি মরিয়া। রাজ্য বিজেপির নতুন সভাপতি শমীক ভট্টাচার্য তাদের কানে নতুন কথা ঢোকানোর চেষ্টা করছেন বটে, তবে মনে হয় না ‘সে বধির কভু জাগিবে এ অন্তরে’। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের কথায় ‘যার যেমন ভাব, তার তেমন লাভ’। রাজ্যকে অপশাসনমুক্ত করার লক্ষ্যে রাজ্যের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু
অধিকারী তাঁর পক্ষ থেকে সবরকম প্রয়াস জারি রেখেছেন। বিজেপি হিন্দু ভোটেই জিতবে। জাতীয় স্তরে বিরোধী দলগুলির ভাবনায় এতোটাই দৈন্য যে, তারা বোঝেন না সুষ্ঠু নির্বাচন করাতে কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশন যে ব্যবস্থা নেয় সেটাই শিরোধার্য। যে কোনো তদন্তের ক্ষেত্রে সিবিআই-এর যেমন কোনো বিকল্প নেই, নির্বাচন কমিশনের ক্ষেত্রেও তাই। ভারতীয় গণতন্ত্রকে বাঁচিয়ে রাখতে কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশনের কাঠামোর মধ্যে থেকেই তার বিরোধিতা বা প্রতিবাদ করতে হবে।
স্বাধীনতার পর থেকে কংগ্রেস সরকার নির্বাচন কমিশনকে নিজের মতো করে ব্যবহারের চেষ্টা করে গিয়েছে। জরুরি অবস্থা জারি করে ভারতের ইতিহাসের ‘কলঙ্কিত নেত্রী’র উদাহরণ হিসেবে থেকে গিয়েছেন ইন্দিরা গান্ধী। যেমন ১৯১৯-এ ব্রিটিশ সরকারের দ্বারা জালিয়ানওয়ালাবাগ নরহত্যা। চরম খারাপকে আজও ইন্দিরার ‘জরুরি অবস্থা’ আর ‘জালিয়ানওয়ালাবাগের নরহত্যা’র সঙ্গে তুলনা করা হয়। ২০১১ সালের পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনে সিপিএম হেরে যায়। কিন্তু ২০০৬-এ তার ঠিক আগের ভোটে তারা সর্বোচ্চ আসন পায়। কেন্দ্রীয় সরকারকে তা ভাবিয়েছিল। ২০১১-তে সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম আন্দোলনের সঙ্গে কেন্দ্রীয় সরকারের মনোভাবের ফয়দা তোলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সিপিএমের ভুয়ো ভোটার, চট-ভূত (সিপিএম ক্যাডাররা বুথে ঢুকে চটের আড়াল থেকে নজর রাখত কে কাকে ভোট দিচ্ছে) আর মৃত ভোটারদের সেযাত্রায় ছেঁটে দেয় নির্বাচন কমিশন। মুখ থুবড়ে পড়ে সিপিএম। ২৩৫ থেকে বিদেশি বামেরা ৬০-এ নেমে আসে, যার মধ্যে সিপিএমের আসন সংখ্যা ছিল ৪০। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বুঝেছেন ‘বিহারের নির্বাচনী মডেল’ এখানে চালু হলে ভুয়ো ভোটার নিয়ে তার ‘ভূতের রাজা’র খেলাও ফুরিয়ে যাবে। সিপিএমের দশা হবে। তাই দল বেঁধে ভূতের রাজার বরের আশায় আদালতে গিয়েছিল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতিনিধি। আপাতত সে গুড়ে বালি পড়েছে। বাকিটুকুর জন্য একটু অপেক্ষা করতে হবে।
(লেখকের মতামত ব্যক্তিগত)