রাক্ষস শাসনের অবসান অনিবার্য
স্মরণাতীত কাল হইতে ভারতবর্ষ আধ্যাত্মিক ভূমি। এই দেশ ব্রহ্মকে সত্য জ্ঞান করিয়াছে, জগৎকেও সত্য বলিয়া মানিয়াছে। এতদ্বারা ইহলৌকিক ও পারলৌকিক দুইদিকেই সিদ্ধিলাভ করিয়াছে। এই জ্ঞানের সন্ধান দিয়াছেন ব্রহ্মজ্ঞ মুনি ঋষিগণ। এই মুনি ঋষিদেরই একটি ধারা হইল সর্বত্যাগী সাধু
সন্ন্যাসীগণ। তাঁহারা নিজের মুক্তি কামনা করিয়াছেন জগতের হিতার্থে। বিত্ত হইতে চিত্ত শ্রেষ্ঠ এই শিক্ষা তাঁহারাই মানুষকে দিয়াছেন। তাই এই দেশ
সাধু সন্ন্যাসীদের শ্রেষ্ঠ স্থান দিয়াছে। সাধু সন্ন্যাসী রাজপ্রাসাদে প্রবেশ করিলে রাজা মহারাজা পর্যন্ত তৎক্ষণাৎ সিংহাসন হইতে অবতরণ করিয়া সাধু
সন্ন্যাসীর চরণ বন্দনা করিয়াছেন। তাঁহার আশীর্বাদ কামনা করিয়াছেন। ভারতবর্ষের প্রজাকল্যাণকামী নরপতিগণের পথপ্রদর্শক ছিলেন এই সন্ন্যাসীগণই। তাঁহারা রাজগুরু রূপে বন্দিত হইয়াছেন। তাঁহাদিগের পথপ্রদর্শনে এক-একটি রাজ্য হইয়াছিল সমৃদ্ধিশালী। এই সন্ন্যাসীদিগকে বড়ো ভয় করিত দানব, অসুর ও রাক্ষসেরা। লোকহিতার্থে সাধুদিগের যজ্ঞকর্মে বিঘ্ন সৃষ্টি করিত তাহারা। রামায়ণ-মহাভারত-পুরাণাদিতে ইহার ভুরি ভুরি উল্লেখ রহিয়াছে। সাধুদিগকে রক্ষা করিবার নিমিত্ত স্বয়ং ভগবান শ্রীরামচন্দ্র ও শ্রীকৃষ্ণকে যুদ্ধ করিতে হইয়াছে রাক্ষস ও অসুরদের সহিত। বর্তমান সময়েও ইহারা রহিয়াছে। সন্ন্যাসীদিগকে বড়ো ভয় পাইয়া থাকে ইহারা। বহিঃশত্রুর আক্রমণে অথবা অযোগ্য শাসকের কারণে দেশ, জাতি, সমাজ ও ধর্ম যখন বিপন্ন হইয়াছে, তখন এই সন্ন্যাসীরাই সমাজের নেতৃত্বদানকারী ব্যক্তি নির্মাণ করিয়া রাজ্যে শান্তি স্থাপন করিয়াছেন। আচার্য চাণক্য, স্বামী বিদ্যারণ্য, সমর্থ স্বামী রামদাস এই প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য। তাই সর্বযুগে সর্বকালেই রাক্ষসপ্রবৃত্তির মানুষ অথবা শাসকের বড়ো ভয় সাধু সন্ন্যাসীদিগকে।। স্বাধীনোত্তর ভারতেও দেশের শাসককে রাক্ষসের ভূমিকায় অবতীর্ণ হইয়া সন্ন্যাসীদিগের উপর আক্রমণ করিতে দেখা গিয়াছে। ১৯৬৬ সালে গোহত্যা নিবারণার্থে আইন প্রণয়নের দাবিতে দশলক্ষাধিক সাধু সন্ন্যাসী নূতন দিল্লিতে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনের নিকট জমায়েত হইলে পাঁচহাজার সন্ন্যাসীকে গুলি চালাইয়া হত্যা করিয়াছে স্বাধীন ভারতের পুলিশ প্রশাসন। গুজরাট ও আন্দামান নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের প্রত্যন্ত এলাকায় জনজাতিদের সেবা, শিক্ষা, স্বাবলম্বন ও সংস্কারের দীপ যিনি প্রজ্বলন করিবার কার্যে নিয়োজিত ছিলেন সেই সন্ন্যাসী স্বামী অসীমানন্দ মহারাজকে কংগ্রেস প্রশাসন কারাগারে রাখিয়া বহু বৎসর অকথ্য নির্যাতন করিয়াছে। সাধ্বী প্রজ্ঞা সিংহ ঠাকুর নাম্নী এক সন্ন্যাসিনীকেও একইভাবে কারাগারে রাখিয়া নির্যাতন করিয়া শারীরিকভাবে বিকলাঙ্গ করা হইয়াছে। পশ্চিমবঙ্গের কমিউনিস্ট শাসক তো প্রকাশ্য দিবালোকে কলকাতার রাজপথে আনন্দমার্গের কয়েকজন সন্ন্যাসী ও সন্ন্যাসিনীকে জীবন্ত দগ্ধ করিয়া হত্যা করিয়াছে। ওড়িশায় জনজাতি সমাজের সেবায় রত স্বামী লক্ষ্মণানন্দ সরস্বতী এবং তাঁহার চারজন শিষ্যকে ২০০৮ সালের ২৩ আগস্ট বিদেশি মদতপুষ্ট দুষ্কৃতীরা নির্মমভাবে হত্যা করিয়াছে। ২০২০ সালে মহারাষ্ট্রের পালঘরে হিন্দু বিরোধী রাজ্য সরকারের পুলিশের সম্মুখেই দুইজন সন্ন্যাসীকে দুষ্কৃতীরা হত্যা করিয়াছে। ইহা সত্ত্বেও সর্বত্যাগী সন্ন্যাসীদিগকে মানবসেবার ব্রত হইতে বিচ্যুত করিতে পারে নাই তথাকথিত রাক্ষসেরা। বরং যাহারা সন্ন্যাসীদিগকে হত্যা করিয়াছে, নির্যাতন করিয়াছে, তাহারাই নিশ্চিহ্ন হইয়াছে।
পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যটিতেও বহু বৎসর হইতেই রাক্ষসরাজ চলিতেছে। এই রাজ্যেও শাসক দলের পক্ষ হইতে অথবা পরিষ্কার করিয়া বলিলে মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে একজন সন্ন্যাসীর চরিত্রে কালিমা লেপনের চক্রান্ত শুরু হইয়াছে। সেই সন্ন্যাসীর অপরাধ যে তিনি হিন্দুদের হইয়া কথা বলেন, হিন্দুদের বিপদে সাহায্যের হস্ত প্রসারিত করিয়া থাকেন। এই রাজ্যে বিশেষ করিয়া মুর্শিদাবাদ জেলায় শাসক দলের মদতপুষ্ট জেহাদিদের আক্রমণে বিপন্ন হিন্দুদিগের পার্শ্বে দাঁড়াইয়া এই নৈরাজ্যের অবসানের নিমিত্ত হিন্দুদিগকে সংগঠিত হইবার কথা বলেন। তাই সেই তেজদীপ্ত সন্ন্যাসীর কণ্ঠ স্তব্ধ করিবার জন্য তাঁহার চরিত্রে কালিমা লেপন করা হইতেছে। এই কথা সত্য যে, স্বামী প্রদীপ্তানন্দজী মহারাজের ন্যায় সন্ন্যাসীর চরিত্রে কালিমা লেপন করিয়া এই রাজ্যের হিন্দু শক্তিকে অবদমিত করা যাইবে না। হিন্দু সমাজ সন্ন্যাসীর প্রতি এই অপমান সহ্য করিবে না। ইতিহাস সাক্ষী, সাধু সন্ন্যাসীর উপর যাহারা আক্রমণ করিয়াছে তাহারা সমূলে ধ্বংস হইয়াছে। সন্ন্যাসীর প্রতি অপমান এই রাক্ষস শাসনের পতনকে ত্বরান্বিত করিবে তাহার সমস্ত লক্ষণ পরিস্ফুট হইয়াছে।