এগারো বছরে ঘটেছে বিকাশ, বেড়েছে সম্মান
ভারতীয় অর্থব্যবস্থা জাপানকে পিছনে ফেলে বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম অর্থব্যবস্থায় স্থান করে নিয়েছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা ভাণ্ডার (আইএমএফ)-এর রিপোর্ট অনুযায়ী ভারতের জিডিপি এখন ৪.১৮৭ ট্রিলিয়ন ডলার। এই আর্থিক বিকাশের কারণে ভারত বিশ্বস্তরে দ্রুত বর্ধনশীল প্রমুখ অর্থব্যবস্থার মধ্যে স্থান করে নিয়েছে। এই বিকাশের যাত্রাপথে বিভিন্ন বিশ্বজনীন সমস্যার দরুন ভারতীয় অর্থব্যবস্থা নমনীয়তা ও অনুকূলতার প্রদর্শন করে, যার মধ্যে কোভিড-১৯ মহামারী, সরবরাহ শৃঙ্খলে ব্যঘাত এবং ভূ-জনৈতিক উত্তেজনাও রয়েছে।
আর্থিক বিকাশে কৃষি ও উৎপাদনের মতো ঐতিহ্যবাহী ক্ষেত্র ছাড়াও ভারত পরিষেবা ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই ক্ষেত্রটি যে শুধু অর্থব্যবস্থাকে সৃজনশীল বৈচিত্র্য প্রদান করে তা নয়, বরং বিকাশের বাহক এবং ঝুঁকিপূর্ণ প্রশমন ব্যবস্থা প্রদানের সঙ্গে ভারতকে বিশ্বের উৎপাদন কেন্দ্র বানানোর স্বপ্নকেও সার্থকতা প্রদান করে।
অর্থব্যবস্থার স্তম্ভ
ভারতীয় অর্থব্যবস্থা গত কয়েক দশক ধরে দেশবাসীর সেবা অভিমুখী। এখন জিডিপিতে পরিষেবা ক্ষেত্রের যোগদান প্রায় ৫৪ শতাংশ, উদ্যোগে ১৭.৪ শতাংশ এবং বাকি ১৮.৮ শতাংশ যোগদান কৃষিক্ষেত্রের। পৃথিবীর উন্নত দেশের তুলনায় ভারতীয় অর্থব্যবস্থার বিকাশপথ কিছুটা ভিন্ন। উন্নত দেশের আর্থিক বিকাশে উৎপাদন ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। কিন্তু ভারতের অর্থব্যবস্থা কৃষিনির্ভর। এখানে মাথাপিছু আয় খুবই কম ছিল এবং উৎপাদন ক্ষেত্রেও ঠিকমতো অগ্রগতি হয়নি, তাই ভারতীয় অর্থব্যবস্থা উন্নত দেশের ‘ব্যাক-অফিস’ হয়ে পরিষেবা নির্ভর অর্থব্যবস্থা হয়েই থেকে যায়। একদিকে পরিষেবা ক্ষেত্র ভারতকে এগিয়ে নিয়ে যায়, আবার অপরদিকে এটাই তার সম্পূর্ণ ক্ষমতা প্রয়োগের সম্ভাবনাকে সীমিত করে দেয়। যদিও জিডিপিতে কৃষিক্ষেত্রে যোগদান কমেছে, কিন্তু এখনও এই উপার্জন, খাদ্য সুরক্ষা এবং গ্রামীণ জীবিকার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমানে ৪২ শতাংশ মানুষ কৃষির সঙ্গে যুক্ত, যার মধ্যে ফসল উৎপাদন, পশুপালন, মৎস্য চাষ এবং বনায়নও রয়েছে। ২০২৪-২৫ সালে ভারতের কৃষি ও কৃষিজাত দ্রব্যের রপ্তানি ৬.৪৭ শতাংশ বেড়ে ৫১.৯১ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছে যায়। এই বৃদ্ধিটা খুব গুরুত্বপূর্ণ, কেননা এই পর্যন্ত দেশের সার্বিক রপ্তানি প্রায় স্থির থাকে। যদিও তথ্য অনুসারে ২০২২-২৩ সালের রেকর্ড ৫৩.১ বিলিয়ন ডলারের কিছুটা কম, কিন্তু ২০২৩-২৪ সালের ৪৮.৮ বিলিয়ন ডলারের তুলনায় বেশি।
পরিষেবা ক্ষেত্র: বিকাশ ইঞ্জিন
বিগত তিন দশকে পরিষেবা ক্ষেত্র ভারতের প্রাথমিক আর্থিক চালক হিসেবে উঠে আসে। সমস্ত ঘরোয়া উৎপাদনে (জিডিপি) প্রায় ৫৪ শতাংশ যোগদান ছাড়াও এই ক্ষেত্র ৩০ শতাংশের বেশি শ্রমগোষ্ঠীকে রোজগার প্রদান করে। এই ক্ষেত্রে তথ্য প্রযুক্তি, আর্থিক পরিষেবা, দূরসঞ্চার, খুচরা ব্যবসা, স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং অন্য অনেক পেশার কাজ রয়েছে। আইটি ক্ষেত্র বার্ষিক ২৩ বিলিয়ন ডলারের বেশি রাজস্ব প্রদান করে, যার মধ্যে টিসিএস, ইনফোসিস, উইপ্রো এবং এইচসিএল-এর মতো কম্পানি বিশ্বস্তরে দ্রুত ঘটে চলা ডিজিটাল পরিবর্তন এবং নিত্যনতুন উদ্ভাবনে নেতৃত্ব দিচ্ছে। এই ক্ষেত্রটি সফ্টওয়ার উন্নয়ন থেকে শুরু করে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, মেশিন লার্নিং, ক্লাউড কম্পিউটারিং এবং সাইবার সুরক্ষা সমাধানের সঙ্গে আধুনিক পরিষেবাগুলিও উন্নত হয়। বর্তমান বৈশ্বিক আইটি আউটসোর্সিং বাজারে ভারতের অংশগ্রহণ ৫৫ শতাংশ। ভারতীয় কম্পানিগুলি ২০০-রও বেশি দেশে রপ্তানি করে থাকে। এই ক্ষেত্রটি ৫৫-৬০ লক্ষ লোকের জীবিকার ব্যবস্থা করে দেয়, যার মধ্যে ৪৫ লক্ষ লোক সরাসরি যুক্ত। এই বছর এই ক্ষেত্র ৪-৪.৫ লক্ষ লোককে কাজ দেয়।
আর্থিক পরিষেবা : ডিজিটাল বিপ্লব
আর্থিক ক্ষেত্রের আধুনিকীকরণ হয়েছে, যাতে ডিজিটাল লেন-দেন প্রণালী, আর্থিক প্রযুক্তির নতুন নিয়ম এবং ব্যাংকিং ক্ষেত্রে সংস্কার আর্থিক সমাবেশকে এগিয়ে নিয়ে চলেছে। জিডিপিতে এর যোগদান ৭.৪ শতাংশ। ভারতে ডিজিটাল বিপ্লব অত্যন্ত সফল। বিশেষ করে ইপিআই লেন-দেন প্রতি মাসে হাজার কোটি টাকারও বেশি হয়ে যায়। প্রধানমন্ত্রী জন-ধন যোজনা অনুযায়ী ৯ এপ্রিল, ২০২৫ পর্যন্ত ৫৫.২৮ কোটি মানুষ ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলে। এই যোজনা মানুষকে ব্যাংকিং পরিষেবার সঙ্গে যুক্ত করে, যার মধ্যে রুপে কার্ড, সুদ ও ডিবিটির মাধ্যমে সরকারি যোজনার প্রত্যক্ষ লাভ সম্মিলিত রয়েছে। বর্তমানে আর্থিক প্রযুক্তি গ্রহণের বিষয়ে ভারত অগ্রগণ্য। ফিনটেক স্টার্টআপ ফান্ডিং এবং ইউনিকর্নের বিষয়ে আমেরিকা ও চীনের পরই ভারত রয়েছে। আর্থিক প্রযুক্তি বিপ্লব ব্যাংকিং
ব্যবস্থাকে পাশে সরিয়ে মোবাইল ফর্স্ট বিত্তীয় ব্যবস্থা গ্রহণে সহযোগিতা করেছে, যার ফলে লক্ষ লক্ষ লোক ডিজিটাল ব্যাংকিং এবং লেনদেন পরিষেবার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। ভারতে ২৫০০-র বেশি ফিনটেক স্টার্টআপ রয়েছে, যা আমেরিকার ঠিক পরেই।
ম্যানুফ্যাকচারিং: শিল্পক্ষেত্রের মেরুদণ্ড
উৎপাদন ক্ষেত্র আর্থিক বিকাশে এক মুখ্য চালক রূপে উঠে এসেছে, যা জিডিপি, রোজগার ও রপ্তানিতে গুরুত্বপূর্ণ যোগদান দেয়। এতে কাপড়, ফার্মাস্যুটিকালস, বাহন, রসায়ন, ইস্পাত ও ইলেকট্রনিকসের মতো প্রমুখ উদ্যোগ রয়েছে। বিগত এক দশকে এই ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য বিকাশ ঘটেছে, যা নীতিগত সংস্কার, প্রযুক্তিগত বিকাশ এবং প্রমুখ ঔদ্যোগিক ক্ষেত্রে রণনীতিক নিবেশ দ্বারা প্রেরিত। বিশেষ করে ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ উৎপাদনের সঙ্গে যুক্ত উৎসাহমূলক যোজনা এবং পরিকাঠামোগত বিকাশের মতো সরকারি পদক্ষেপের কারণে এই ক্ষেত্রে গতি বেড়েছে। এই কারণে এই ক্ষেত্রটি আর্থিক পরিবর্তনের ভিত্তি রূপে দেখা দিয়েছে এবং ভারতকে চতুর্থ সর্ববৃহৎ অর্থব্যবস্থা রূপে তৈরি করার পিছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। গত ৫ বছরে এই ক্ষেত্রটি বার্ষিক গড় ১২.৫ শতাংশ হারে বৃদ্ধি হয়েছে, যা বৈশ্বিক উদ্যোগ বিকাশের হার থেকে অনেকটা আগে রয়েছে এবং ভারতকে আর্থিক নমনীয়তা প্রদান করে। ২০২৫ সালে উদ্যোগ ক্ষেত্র প্রায় ১ ট্রিলিয়ন ডলার বা ৮৩ লক্ষ কোটি টাকা উল্লেখযোগ্য স্তরে পৌঁছে গিয়েছে। জিডিপি-তে এর যোগদান প্রায় ১৭ শতাংশ এবং এটি দেশের আর্থিক বিকাশ, রপ্তানি ও রোজগার সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
বস্ত্র ও পরিধেয়:
ভারতের বস্ত্র শিল্প সবচেয়ে প্রাচীন এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগের মধ্যে একটি, যা দেশের মোট রপ্তানির করের প্রায় ১১ শতাংশ যোগদান করছে। এই ক্ষেত্রটিতে সুতি বস্ত্র, সিন্থেটিক, পাট, রেশম ও উলের উৎপাদন যুক্ত রয়েছে, যা প্রায় ৪.৫ কোটি মানুষ প্রত্যক্ষ এবং প্রায় ১০ কোটি মানুষ পরোক্ষভাবে এই রোজগারের সঙ্গে যুক্ত। ইনভেস্ট ইন্ডিয়া রিপোর্ট অনুসারে, ২০১৯ সালে এই ক্ষেত্রটির আকার ৫২.৭ বিলিয়ন ডলার ছিল, যা এই বছর প্রায় ৯২.৫ বিলিয়ন ডলার অর্থাৎ ৭.৭ লক্ষ কোটি টাকা হওয়ার অনুমান রয়েছে। ২০২৫-২৬ সালে বস্ত্র রপ্তানি ৬৫ বিলিয়ন ডলার পর্যন্ত পৌঁছতে পারে। ২০৩০ পর্যন্ত ঘরোয়া ও রপ্তানি, দু’টি মিলিয়ে ভারতীয় বস্ত্র উদ্যোগের পরিমান ৩৫০ বিলিয়ন ডলার পর্যন্ত পৌঁছতে পারে। কাঁচামালের জোগান, দক্ষ শ্রমিক, প্রতিস্পর্ধী মূল্য নির্ধারণ এবং সারা বিশ্বের প্রয়োজনীয়তা অনুসারে জোগান বস্ত্র ও পরিধেয় শিল্প ক্ষেত্রের শক্তি। এই উদ্যোগে প্রমুখ স্থানে তামিলনাড়ু, গুজরাট, মহারাষ্ট্র ও কর্ণাটক রয়েছে। যদিও বিগত কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশ, চীন, ভিয়েতনামের মতো কিছু দেশ পাল্লা দিচ্ছে। তবে বাংলাদেশের রেডিমেড কাপড়ের আমদানির বিষয়ে ভারত নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে, যার ফলে ছোটো খাটো উদ্যোগগুলি লাভান্বিত হচ্ছে।
ফার্মাসিউটিক্যালস:
ভারতকে ‘বিশ্বের ফার্মেসি’ বলা হয়, কেননা বিশ্বের চাহিদার প্রায় ৬০ শতাংশ ভ্যাকসিনের জোগান দেয় এবং সারা বিশ্বে জেনেরিক ওষুধ উৎপাদনে ২০ শতাংশ যোগদান রয়েছে। এর জন্য সারা পৃথিবীতে সস্তা ও গুণমানসম্পন্ন ওষুধ পাওয়া যাচ্ছে। ভারত ইউনিসেফকে ৫০-৬০ শতাংশ ভ্যাকসিনের জোগানের পাশাপাশি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ডিপিটি ভ্যাকসিনের ৯৯ শতাংশ এবং বিসিজি ভ্যাক্সিনের ৫২ শতাংশ বৈশ্বিক চাহিদা পূরণকরে থাকে। ফার্মাসিউটিক্যাল ক্ষেত্রের বার্ষিক কারবার ২০২৩-২৪ এ ৫০ আরব ডলার অর্থাৎ ৪.১৭ লক্ষ কোটি ছিল। এই ক্ষেত্রটি বার্ষিক ৭-১০ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ভারত আমেরিকা ইউকে, বেলজিয়াম, দক্ষিণ আফ্রিকা, ব্রাজিল-সহ ২০০-র বেশি দেশে ওষুধ রপ্তানি করে। আমেরিকার জেনেরিক ওষুধ প্রয়োজনের প্রায় ৪০ শতাংশ এবং ইউকের ২৫ শতাংশ জোগান ভারত দেয়।
অটোমোটিভ ক্ষেত্র:
ভারতের অর্থব্যবস্থায় বাহন উদ্যোগ বড়ো উদ্যোগের মধ্যে একটি। আমেরিকা (৭৮ লক্ষ কোটি টাকা) ও চীনের (৪৭ লক্ষ কোটি টাকা) পরে ভারত পৃথিবীতে তৃতীয় সবচেয়ে বড়ো বাহনের বাজার। ২০১৪তে এর আকার ৭.৫ লক্ষ কোটি ছিল, যা বর্তমান সময়ে তিন গুণ বেড়ে প্রায় ২২ লক্ষ কোটি হয়ে গেছে। রোজগার প্রদানে এই ক্ষেত্রটি অগ্রণী রয়েছে। এখন প্রায় ৪.৫ কোটি লোক এর সঙ্গে যুক্ত। দেশে মধ্যম বর্গের বিকাশ, দ্রুততার সঙ্গে নগরায়ন, বৈদ্যুতিক বাহনের জন্য সরকারি সমর্থন এবং তামিলনাড়ু, মহারাষ্ট্র ও হরিয়ানার মতো রাজ্যে স্থাপিত উদ্যোগ পরিস্থিতির তন্ত্র ভারতকে আন্তর্জাতিক স্তরে প্রতিষ্ঠাদানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
রসায়ন ও পেট্রোকেমিক্যাল :
ভারতের পেট্রোকেমিক্যাল উদ্যোগ অর্থব্যবস্থাতে ৬ শতাংশ যোগদান করছে। ভারত বিশ্বের ষষ্ঠ সবচেয়ে বড়ো এবং এশিয়ার তৃতীয় রসায়ন উৎপাদক দেশ। রপ্তানিজাত দ্রব্যের মধ্যে এর অংশগ্রহণ ১৫ শতাংশ। বর্তমানে ভারত ১৭৫ টি দেশে রসায়ন রপ্তানি করে। ৫০ লক্ষ লোককে রোজগার দেওয়া এই ক্ষেত্রটি ২০২৪ সালে প্রায় ২২০ বিলিয়ন ডলারে থাকলেও আজ তা ৩০০ বিলিয়ন ডলারে (প্রায় ২৫ লক্ষ কোটি টাকা) পৌঁছেছে। সরকারের নীতি, বিনিয়োগ এবং ক্রমবর্ধমান আভ্যন্তরীণ চাহিদা অনুযায়ী ২০৪০ সালে ১ ট্রিলিয়ন ডলারে পৌঁছতে পারে।
আগামীর উদীয়মান ক্ষেত্র
ডিজিটাল অর্থব্যবস্থা এবং প্রযুক্তি :
২০২৯-৩০ পর্যন্ত শুধুমাত্র কৃষি ও উদ্যোগের মতো পারম্পরিক ক্ষেত্র থেকে আগে এগিয়ে যাবে, বরং জাতীয় আয়ে ২০ শতাংশ যোগদান করার অবস্থায় চলে যাবে। ২০২২-২৩এ জিডিপিতে ডিজিটাল অর্থব্যবস্থার যোগদান ১১.৭৪ শতাংশ থেকে বর্তমানে ১৩.৪২ শতাংশ হয়েছে। এতে ১.৪৭ শতাংশ লোক কার্যরত ছিল, যা দেশের মোট শ্রমশক্তির ২.৫৫ শতাংশ। এর মুখ্য বিকাশ ক্ষেত্রে এআই, ডিজিটাল প্লাটফর্ম, ক্লাউড, ইন্টারনেট, টেলিকমিউনিকেশন প্রভৃতির পাশাপাশি কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য প্রভৃতি ক্ষেত্রেও দ্রুততার সঙ্গে এগিয়ে চলেছে। এআই গবেষণার ক্ষেত্রে ভারত পৃথিবীতে১১তম এবং এআই পরিকাঠামোতে ১৬তম স্থানে রয়েছে।
নবায়নযোগ্য শক্তি:
ভারতের নবায়ন শক্তি ২০১৪ সালে ৭৫ গিগাওয়াট ছিল, বর্তমানে তা তিনগুণ বেড়ে ২৩২ গিগাওয়াট হয়েছে। ২০৩০ পর্যন্ত লক্ষ্য ৫০০ গিগাওয়াট নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ শক্তি এবং ২০৭০ পর্যন্ত শূন্য নির্গমন ঘটবে। স্বচ্ছ শক্তির ক্ষেত্রে সৌর, বায়ু, হাইড্রোজেন ও শক্তি উৎপাদনে ব্যাপক বৃদ্ধি ঘটেছে। সৌর ও বায়ু শক্তিতে ভারত তৃতীয় স্থান অধিকার করেছে। সৌর বিদ্যুৎ শক্তি উৎপাদন ২০১৪ সালে ২.৮ গিগাওয়াট থেকে ২০২৫ সালে ১০৮ গিগাওয়াটে পৌঁছেছে এবং ২০৩০ সাল পর্যন্ত ১৫০ গিগাওয়াটের লক্ষ্য রয়েছে। বায়ু বিদ্যুৎ শক্তি উৎপাদনে ২০১৪ সালে ২১ গিগাওয়াট ছিল যা বর্তমানে ৫১ গিগাওয়াটে পৌঁছেছে। নবায়নযোগ্য শক্তিকে উৎসাহ প্রদানের জন্য ৫৯ টি সৌরপার্ক নির্মাণে সবুজসংকেত আসার সঙ্গে সঙ্গে গুজরাটের ৩০ গিগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন হাইব্রিড সৌর-বায়ু পরিযোজনা বিশ্বের সবচেয়ে বড়ো প্রকল্প হিসেবে উঠে আসছে।
শিক্ষা প্রযুক্তি এবং দক্ষতা বিকাশ :
অ্যাড-টেক ক্ষেত্রে অনলাইন শিক্ষণ প্ল্যাটফর্ম, দক্ষতা বিকাশ কার্যক্রম এবং পেশাগত পাঠ্যক্রমের সঙ্গে প্রথাগত স্বীকৃতি লাভের বিষয়েও গতি এসেছে। এই ক্ষেত্রটি নতুন প্রযুক্তির মাধ্যমে ভারতের শিক্ষা ও দক্ষতা বিকাশের আবশ্যকতাও পূরণ করছে।
জনসংখ্যাগত লাভ এবং নগরায়ণ
ভারতের জনসংখ্যাগত লাভ ২৮ বছর গড় আয়ুর সঙ্গে আর্থিক বিস্তারের পর্যাপ্ত জনবল প্রদান করে। দ্রুততার সঙ্গে হওয়া নগরায়ণ, নতুন নতুন উপভোগের ধরন, মূল পরিকাঠামোর চাহিদা এবং পরিষেবা ক্ষেত্রে সুযোগ করে দিচ্ছে। ২০৩০ সাল পর্যন্ত নগরীয় ভারতের জিডিপিতে ৭৫ শতাংশ যোগদানের আশা রয়েছে, যদিও ৪০ শতাংশ জনগণ শহরেই বাস করে। নগরীয় ক্ষেত্রে জনসংখ্যা প্রতি বছর ২.৪ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। শ্রমবল হিসেবে ১৫-৬৪ বছর প্রায় ৭০ শতাংশ লোক দেশের বিকাশে অংশগ্রহণ করছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য যে তাদের অধিকাংশই ডিজিটাল প্রক্রিয়ার কাজে সক্ষম। এসবই ডিজিটাল ইন্ডিয়া এবং বিভিন্ন প্রশিক্ষণে হচ্ছে। যদি এই ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যাকে ভারতের কাজে লাগানো যায় তবে ২০৭৫ সালের পরে আসা যে কোনো বাধার সম্মুখীন হওয়ার জন্য দেশ তৈরি হয়ে যাবে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, আইওটি, ব্লকচেন, রোবোটিক্স এবং ৫জি প্রযুক্তির মাধ্যমে ভারত চতুর্থ ঔদ্যোগিক বিপ্লবের দিকে দ্রুততার সঙ্গে এগিয়ে চলেছে। উদ্যোগ স্মার্ট ফ্যাক্টরির ধারণাকে লাগু করছে, তবে পরিষেবা ক্ষেত্রে উৎপাদকতা এবং গ্রাহক অভিজ্ঞতা বৃদ্ধির জন্য স্বচালন এবং ডেটা এনালেটিক্সের লাভ তুলছে। ভারত ২০৪৭ পর্যন্ত বিকশিত দেশ হওয়ার জন্য সমাবেশক অর্থব্যবস্থা অত্যাবশ্যক। এর জন্য উপযুক্ত নির্দেশিকা এবং যোজনার প্রয়োজন হবে, যা এই প্রযুক্তির সমাবেশী প্রয়োগের জন্য আগ্রহ নির্মাণ করে। আজ ভারতে প্রাকৃতিক পরিবেশগত স্থিরতা, নিরন্তর বিকাশ এবং হরিৎ অর্থব্যবস্থা আর্থিক নিয়োজনের অভিন্ন অঙ্গ হয়ে উঠছে, যাতে হরিৎ বিত্ত, কার্বন বাজার এবং বৃত্তীয় অর্থব্যবস্থার ধারণার উন্নতি ঘটছে।
সরকারি পদক্ষেপ এবং নীতিগত পরিকাঠামো
সরকারের আর্থিক বিকাশ এবং ক্ষেত্রীয় বিকাশে গতি আনার জন্য সুপরিকল্পিত পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। আর্থিক বিকাশকে গতি দেওয়ার জন্য পরিবহন, বিদ্যুৎ, নগরীয় কাঠামো এবং ডিজিটাল কানেকটিভিটির বিকাশে ১.৪ ট্রিলিয়ন ডলার লগ্নির যোজনা রয়েছে। উৎপাদনের কাজে উৎসাহ প্রদানের পরিকল্পনার (পিএলআই) উদ্দেশ্য ২৬ আরব ডলারের সঙ্গে ১৪ টি ক্ষেত্রে উৎপাদনকে উৎসাহ প্রদান করা। ডিজিটাল ইন্ডিয়া মিশন প্রযুক্তি গ্রহণ করে সরকারি পরিষেবা পৌঁছানো এবং দক্ষতা বৃদ্ধি হয়েছে। আধার, ডিজিলকার, ই-হসপিটাল, ই-সঞ্জীবনী (টেলিমেডিসিন), উমঙ্গ অ্যাপ এবং অনলাইন পেনশনের মতো পরিষেবা ঘরে বসেই পেয়ে যাচ্ছে। এসবের কারণে ভ্রষ্টাচার, ভৌগলিক বাধা এবং কাজের শিথিলতা কমেছে। একইভাবে জিএসটি, দেউলিয়া ও দেউলিয়া নির্দেশিকা এবং ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে সুবিধার মতো নির্দেশাবলীতে সংস্কার লগ্নির পরিবেশকে উন্নত করে। মূল পরিকাঠামোগত বিকাশ, দক্ষতা বিকাশ ও নতুন উদ্যোগের পরিস্থিতি তন্ত্র নির্মাণে সরকারের নজর আর্থিক বিকাশের জন্য অনুকূল পরিস্থিতি নির্মাণ করছে।
সমস্যা ও সুযোগ
উল্লেখযোগ্য প্রগতি সত্ত্বেও ভারতে আয় বৈষম্য, বেকারত্ব, পরিকাঠামোর অভাব, পরিবেশ সংক্রান্ত চিন্তা এবং নিয়মিত প্রযুক্তির উন্নতির আবশ্যকতার সঙ্গে বহু আর্থিক বাধারও সম্মুখীন হতে হচ্ছে। এছাড়া কৃষিকাজে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব, প্রয়োজনীয় সামগ্রীর ঘাটতি এবং বৈশ্বিক আর্থিক অনিশ্চয়তা সমস্যা হিসেবে রয়েছে। ভারতকে বুঝতে হবে যে, আমেরিকা ও ইউরোেপ ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা এবং বেকারত্বের কারণে তাদেরনীতি খুব দ্রুত পরিবর্তন করছে। অতএব ভারতকেও একথা মাথায় রেখে পরিকল্পনা করতে হবে।
পিএলআই এবং স্টার্টআপ পরিকল্পনার মাধ্যমে শিল্প ও পরিষেবা ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন তো হয়েছে, কিন্তু সরকারকে এটাও বুঝতে হবে যে উদ্যোগ ও পরিষেবাক্ষেত্রের জন্য ভিন্ন পরিকল্পনার প্রয়োজন রয়েছে। পরিষেবাক্ষেত্রের প্রয়োগের লাভ পেতে ৫ বছর সময় পর্যাপ্ত, কিন্তু শিল্পের ক্ষেত্রে তা অনেকটাই কম। তার সঙ্গে, পিএলআই যোজনার সাফল্যকে অ্যাসেম্বলি লাইন হওয়ার বিষয় না দেখে ভারতীয় কম্পানিগুলির গবেষণা ও উন্নতির মাদ্যমে স্বদেশি দ্রব্য নির্মাণ করে তাকে দেশে ও বিদেশে বিক্রি করে। বর্তমানে মার্কিন রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্প ধমকি দিচ্ছেন যে, অ্যাপল আমেরিকাতে নিজস্ব ফোন তৈরি করুক। অ্যাপল যদিও ভারতে কিছু লোককে রোজগার দিচ্ছে, কিন্তু ভারত তা থেকে প্রত্যক্ষ আর্থিক লাভ পাচ্ছে না। মাত্র ২ শতাংশই ভারত পাচ্ছে, যা অন্য দিক দিয়ে পিএলআই রূপে ঘুরে অ্যাপল ও আমেরিকার কাছেই চলে যাচ্ছে। ভারতের বাজার, দক্ষ শ্রমবল, প্রযুক্তিগত ক্ষমতা এবং ভৌগোলিক স্থিতি গুরুত্বপূর্ণ লাভ প্রদান করে।
বড়ো লক্ষ্যের দিকে
ভারতের লক্ষ্য ২০৩০ পর্যন্ত ১০ ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থব্যবস্থা নির্মাণ,যার জন্য ৮-৯ শতাংশ নিয়মিত জিডিপি বৃদ্ধি প্রয়োজন। এই লক্ষ্য পূর্তি সমস্ত ক্ষেত্রে গঠনমূলক পরিবর্তন, পরিকাঠামোর বিকাশ, মানব পুঁজি বৃদ্ধি এবং প্রযুক্তিতে নবায়নযোগ্য সফল উপযোগিতার উপর নির্ভর করছে। পরিষেবা ক্ষেত্র থেকে আশা রয়েছে কিন্তু ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ অনুযায়ী উৎপাদন বৃদ্ধি জরুরি যাতে জিডিপিতে এর অংশগ্রহণ ২৫ শতাংশ হয়। নবীকরণীয় বিদ্যুৎ শক্তি, জৈব প্রযুক্তি, মহাকাশ প্রযুক্তি এবং উন্নত শিল্পের মতো উদীয়মান ক্ষেত্রগুলিকে এতে খুব বেশি করে অংশগ্রহণ করতে হবে। আইএমএফ অনুসারে ভারত ৫.৫ ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থব্যবস্থার সঙ্গে ২০২৮ সালের মধ্যে বিশ্বের তৃতীয় সবচেয়ে বড়ো অর্থব্যবস্থা হয়ে যাবে। এই কারণে বিশ্বে একটা মনোবৈজ্ঞানিক প্রভাব পড়বে যা ভারতকে বিশ্বস্তরে কূটনৈতিক অগ্রগতি প্রদান করবে এবং আন্তর্জাতিক মঞ্চে তার প্রভাবসম্পন্ন হবে।