বাবুরাম শীল লেনের দত্ত পরিবারের রথযাত্রা
সপ্তর্ষি ঘোষ
‘রথের পাড়া’ হিসেবে মধ্য কলকাতার বউবাজার অঞ্চলের খ্যাতি সর্বজনবিদিত। রথকে কেন্দ্র করে এই অঞ্চলে যে আনন্দ ও উন্মাদনা পরিলক্ষিত হয়, কলকাতার অন্যত্র তা দেখা যায় না। বউবাজার অঞ্চলে বেশ কিছু বনেদি পরিবার আছে, যারা প্রাচীন ঐতিহ্য ও পরম্পরাকে অনুসরণ করে আজও রথযাত্রা উৎসব উদ্যাপন করেন। আর্থ- সামাজিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে আগের মতো আড়ম্বর না থাকলেও, আজও এলাকার কয়েকটি বনেদি বাড়িতে রথের দিন জগন্নাথদেব কোথাও একা বা অগ্রজ বলরাম এবং ভগিনী সুভদ্রা-সহ তিনজনে রথে আরোহণ করে পরিক্রমায় বের হন। এর মধ্যে সনাতন শীল লেনে ধরদের রথ, দেওয়া হয়। এরপর জগন্নাথদেবের ‘অনবসর’। অমাবস্যায় নবযৌবন প্রাপ্ত হয়ে জগন্নাথদেব পুনরায় মন্দিরে ফিরে আসেন। একদিন বাদেই রথযাত্রা। রথের দিন সকালে জগন্নাথদেবকে রথে বসিয়ে ঠাকুরবাড়ির উঠোনে পরিবারের সদস্যরা রথ টানেন। দ্বিপ্রহরে জগন্নাথদেবকে বিশেষ পূজা ও ভোগারতি। সন্ধ্যায় নারায়ণ ও জগন্নাথদেব সুসজ্জিত রথে আরোহণ করে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা সহকারে পরিক্রমায় বের হন। দত্ত পরিবারের শরিকদের বাড়িতে পূজা ও ভোগ গ্রহণ করে জগন্নাথদেব আবার ঠাকুরবাড়িতে ফিরে আসেন।
সোজা রথ থেকে উলটোরথ পর্যন্ত জগন্নাথদেব ঠাকুরবাড়ির একতলায় রুপোর সিংহাসনে অধিষ্ঠান করেন। এই ৮ দিন বিশ্বনাথ মতিলাল লেনে নরোত্তম দে’র রথ, বাবুরাম শীল লেনে যদুনাথ দত্ত’র ঠাকুরবাড়ির রথ, মদন দত্ত লেনে উমেশ শীলের রথ, রমানাথ কবিরাজ লেনে আঢ্যিদের রথ, পঞ্চাননতলায় শীলদের রথ, নীলমণি দে এবং রামকানাই অধিকারীর ঠাকুরবাড়ির রথ উল্লেখযোগ্য। সুদীর্ঘ ১৩০ বছরের ঐতিহ্যমণ্ডিত একটি পারিবারিক রথের কথা এই নিবন্ধে উল্লেখ করব।
৭ নম্বর বাবুরাম শীল লেনস্থ দত্ত পরিবারের ঠাকুরবাড়িতে রথযাত্রার রথযাত্রার সূচনা করেন দত্ত পরিবারের আদিপুরুষ যদুনাথ দত্ত। রথযাত্রা শুরুর নেপথ্যে এক কিংবদন্তীর কথা জানা যায়। এক রাত্রে জগন্নাথদেব তার স্বপ্নে আবির্ভূত হন এবং যদুনাথকে তাঁর মূর্তি প্রতিষ্ঠা করতে আদেশ করেন।
স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে তিনি বাড়িতেই শুরু করেন শ্রীশ্রী জগন্নাথদেবের পূজা। কিন্তু তার একান্ত বাসনা, ঠাকুরবাড়ি তৈরি করে জগন্নাথদেবকে সেখানে প্রতিষ্ঠা করা। অবশেষে ১৩০৩ বঙ্গাব্দে (ইংরেজি ১৮৯৬ সাল) বৈশাখ মাসের শুক্লাষ্টমী তিথিতে যদুনাথ দত্ত ঠাকুরবাড়ি দৈরি করে জগন্নাথদেবকে প্রতিষ্ঠা করেন। তদবধি দত্ত পরিবারের রথযাত্রা প্রতি বছর বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনা সহকারে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। এবারে এদের রথযাত্রা ১৩০তম বর্ষে পদার্পণ করলো। ঠাকুরবাড়ির দোতলায় কাষ্ঠনির্মিত সিংহাসনে জগন্নাথদেব অধিষ্ঠিত। এছাড়া জগন্নাথদেবের ডানদিকে রুপোর সিংহাসনে নারায়ণ, বামদিকে অন্য সিংহাসনে লক্ষ্মী ও মঙ্গলচণ্ডী আসীন। জগন্নাথদেবের নিত্যসেবা এবং বিভিন্ন উৎসবের ব্যয় নির্বাহের জন্য যদুনাথ দত্ত ১৯১১ সালে চারটি বাড়ি জগন্নাথদেবের নামে উৎসর্গ করেন।
স্নানযাত্রার দিন সকালে ঠাকুরবাড়ির দোতলার বারান্দায় আমপাতা ও কলাগাছ দিয়ে ঘর বানিয়ে সেখানে জগন্নাথদেবকে এনে বসানো হয়। নানাবিধ দ্রব্য দিয়ে জগন্নাথদেব মন্দিরে ফিরে যান। স্নানযাত্রার পরদিন অসুস্থতার জন্য জগন্নাথদেবকে আদা, খই, বাতাসা এবং দ্বিতীয় দিনে পাঁচন সন্ধ্যায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আসর বসে ঠাকুরবাড়িতে। সোজো রথের অব্যবহিত পরবর্তী শনিবার জগন্নাথদেব শ্বেতপদ্মবেশ এবং রবিবার লাল পদ্মবেশে সজ্জিত হন। উলটোরথের আগের দিন হয় জগন্নাথদেবের ‘রাজবেশ’। এই বেশ অত্যন্ত দৃষ্টিনন্দন। রথের ক’দিন জগন্নাথদেবকে দর্শন করতে বহু ভক্ত সমাগম হয় এবং প্রত্যেককে প্রসাদ দেওয়া হয়। সোজা রথ থেকে উলটোরথের মধ্যবর্তী এক মঙ্গলবার অনুষ্ঠিত হয় বিপত্তারিণী ব্রত। সেদিন দত্ত পরিবারের মহিলারা সমবেত হন ঠাকুরবাড়িতে। উলটোরথে আবার পরিক্রমায় বেরিয়ে কয়েকজন শরিকের বাড়ি ‘দ্বারভোগ’ খেয়ে জগন্নাথদেব ফিরে আসেন ঠাকুরবাড়ি। ঠাকুরবাড়ির প্রবেশ পথে লক্ষ্মী ও জগন্নাথদেবের মালা বদল এবং ‘যুগল মিলন’ হয়। তারপর দু’জনকে রুপোর সিংহাসনে বসানো হয়। মহিলারা এই সময় ‘যুগল মিলন’-এর গান করেন। এরপর ভোগারতি করে রথযাত্রা উৎসবের পরিসমাপ্তি ঘটে।