শ্রীজগন্নাথ মাহাত্ম্য চির অমলিন
গোপাল চক্রবর্তী
চারধামের অন্যতম জগন্নাথ ধাম ভারতবর্ষের অন্যতম শ্রেষ্ঠ তীর্থ। শুধু তীর্থক্ষেত্র নয়, যুগ যুগ ধরে এর অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যও ভারতবাসী তথা বিশ্বের আধ্যাত্মিক ও সৌন্দর্যপিপাসু মানুষকে আকর্ষণ করে আসছে। জগন্নাথ ধামের প্রতিষ্ঠা ও জগন্নাথ মাহাত্ম্যের সঙ্গে যে পৌরাণিক কাহিনি যুক্ত তাও কম আকর্ষণীয় নয়।
পুরাকালে অবন্তীরাজ ইন্দ্রদ্যুম্ন ছিলেন ভগবান শ্রীবিষ্ণুর উপাসক, পরমধার্মিক ও প্রজাবৎসল। একদা তিনি এক পরিব্রাজকের কাছে শুনলেন দক্ষিণদেশে শ্রীপুরুষোত্তম নামে এক অতি উত্তম ক্ষেত্র আছে। সেখানে নীলগিরি নামে এক পর্বত আছে।
শ্রীবিষ্ণু সেখানে বিরাজিত। সেই দেবকে দর্শন করলেই চতুর্বর্গ ফল লাভ হয়। পরিব্রাজক ব্রাহ্মণের মুখে এমন অপূর্ব কথা শুনে নৃপতির মন বিচলিত হলো। তিনি অবন্তীনগর ত্যাগ করে পুরুষোত্তমে বসবাসের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন। রাজা যখন বসবাসের স্থান নির্ধারণের জন্য, সেই স্থান সম্পর্কে একজন অভিজ্ঞ পথপ্রদর্শকের সন্ধান করছিলেন তখন সেই পরিব্রাজক ব্রাহ্মণ বললেন যে, তাঁর ভাই বিদ্যাপতি সেই পথ জানেন। মহারাজ ইন্দ্রদ্যুম্ন তখন কয়েকজন বিশ্বস্ত অনুচর সঙ্গে দিয়ে বিদ্যাপতিকে পাঠালেন পুরুষোত্তম ক্ষেত্র সম্পর্কে সম্যক অবহিত হয়ে আসার জন্য। ভক্তপ্রবর বিদ্যাপতিও জগন্নাথ দর্শনের আনন্দে অধীর হয়ে সহযাত্রীদের নিয়ে চললেন পুরুষোত্তমের পথে। মহানদী পার হয়ে ক্রমে অগ্রসর হলেন নীলাচলের দিকে।
বিদ্যাপতি নীলাচলের তলদেশে এলেন কিন্তু পর্বতে আরোহণের পথ খুঁজে পেলেন না। এমন সময় সদ্য পূজা সমাপ্ত করে এক শবর সেখানে এলেন। দ্বাদশ তিলক-সহ তাঁর সর্বাঙ্গ চন্দনচর্চিত। এই বৈষ্ণবকে দেখে বিদ্যাপতি তাঁর কাছে এগিয়ে গিয়ে যথোচিত সম্মান প্রদর্শন করে বললেন- হে ভক্তপ্রবর, আমি অবন্তীরাজ ইন্দ্রদ্যুম্নের প্রতিনিধি। শ্রীবিষ্ণুর দর্শন অভিলাষে এখানে এসেছি। এক পরিব্রাজকের মুখে রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন বিষ্ণুর নীলমাধব রূপের কথা শুনেছেন। তাই তিনিই আমাকে প্রেরণ করেছেন। যতদিন পর্যন্ত আমি নীলমাধব সম্পর্কে অবগত হয়ে তাঁর কাছে না ফিরে যাব, তিনি চরম উৎকণ্ঠায় থাকবেন। আমার স্থির বিশ্বাস আপনি আমাকে নীলমাধব দর্শন করাতে সক্ষম।
বিদ্যাপতির মুখে এই কথা শুনে শবররাজ বিশ্বাবসু চিন্তিত হলেন। প্রকাশ্যে বললেন- হে দ্বিজবর, আপনার অভীষ্ট পূরণেরও চেষ্টা করব। এখন আমার প্রার্থনা শুনুন। আপনি ব্রাহ্মণ, অতিথি, নারায়ণস্বরূপ, তদুপরি পথশ্রমে ক্লান্ত। আপনি সবান্ধবে আমার কুটিরে পদার্পণ করুন। কিঞ্চিৎ ফলাহার করুন। বিদ্যাপতি বললেন- হে নরোত্তম, আপনার ব্যবহার ও আতিথেয়তায় আমরা মুগ্ধ, আহারাদি পরে হবে, আপনি অনুগ্রহ করে দিনমানে আমাকে প্রভুর দর্শন করান।
বিদ্যাপতির কাছে এরূপ কথা শুনে শবররাজ চিন্তান্বিত হলেন। নীলমাধবকে তিনি এতকাল সকলের অজ্ঞাতে একাকী পূজা করে আসছেন। ব্রাহ্মণকে নীলমাধবের দর্শন করালে তিনি প্রকাশ হয়ে পড়বেন। আর গোপন করলে অতিথি ব্রাহ্মণের সঙ্গে মিথ্যাচারের পাপ হবে। তখন শবররাজের মনে হলো এক প্রাচীন জনশ্রুতি। নীলমাধব এক সময়ে ভূমিতলে অন্তর্হিত হবেন এবং ইন্দ্রদ্যুম্ন নামে এক রাজা এখানে এক পুরী নির্মাণ করে বিষ্ণুকে দারুমূর্তিতে প্রতিষ্ঠা করবেন। সেই দিন কি সমাগত? এই ব্রাহ্মণ রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নের প্রতিনিধি হয়ে কি সেই বার্তাই বহন করে এনেছেন? শবররাজ ভাবলেন যা ভবিতব্য তা ঘটবেই। তারপর তিনি বিদ্যাপতিকে নীলমাধব দর্শনে নিয়ে গেলেন।
প্রস্তর আর কণ্টকে ভরা অতি সংকীর্ণ পথ। ক্রমে তাঁরা একে একে রৌহিন কুণ্ড, অক্ষয় বট পেরিয়ে কুঞ্জমধ্যে নীলমাধবকে দর্শন করলেন। শ্রীবিষ্ণুর এই রূপদর্শনে বিদ্যাপতি আনন্দসাগরে নিমজ্জিত হলেন। প্রণামান্তে নানা স্তবস্তুতি করলেন। প্রভুকে মুহূর্তের জন্য দৃষ্টির আড়াল করতে মন চাইছে না। তখন সূর্যদেব অস্তাচলে, বিদ্যাপতিকে ভাবাবিষ্ট দেখে বিশ্বাবসু বললেন- হে দ্বিজশ্রেষ্ঠ, প্রভুকে দর্শন করে তুমি ধন্য হয়েছ। এক্ষণে রজনী আগতপ্রায়, এই বন শ্বাপদসংকুল, এবার আমাদের কুটিরে ফিরতে হবে।
এই কথা বলে বিশ্বাবসু বিদ্যাপতির হাত ধরে তাকে কুটিরে ফিরিয়ে এনে আহারে বসালেন। আহার্য বস্তু দেখে বিদ্যাপতি অবাক। এরূপ আহার্য রাজগৃহেও দুর্লভ। বিদ্যাপতির মনের অবস্থা বুঝে বিশ্বাবসু বললেন- হে ব্রাহ্মণ, এই আহার্য দেখে আপনি অবাক হচ্ছেন। যদিও এই রহস্য প্রকাশ করা উচিত নয়। তবুও আপনি ভক্তপ্রবর, আপনার কাছে এই রহস্য প্রকাশ করা যেতে পারে। প্রতিদিন ইন্দ্রাদি দেবগণ জগন্নাথের পূজার জন্য এই দিব্যবস্তুসমূহ নিয়ে আসেন। পূজা, স্তব, নৃত্য, গীতাদি-সহ প্রভু জগন্নাথকে তুষ্ট করে আবার স্বর্গে ফিরে যান। এই সবই হলো সেই প্রসাদ।
বিদ্যাপতির আর ইচ্ছে হলো না এই স্থান ত্যাগ করে অবন্তীনগরে ফিরে যেতে, কিন্তু রাজার কাছে তিনি দায়বদ্ধ, তাই অনিচ্ছা সত্ত্বেও ফিরে গেলেন অবন্তীনগরে। রাজা সম্যক অবগত হয়ে পুরুষোত্তমক্ষেত্রে আগমনের আয়োজনে মনোনিবেশ করলেন। তিনি সকল প্রজাকে অবন্তী ছেড়ে তাঁর সঙ্গে পুরুষোত্তম ক্ষেত্রে যাওয়ার আদেশ দিলেন। পুরুষোত্তম যাত্রার প্রস্তুতি যখন সমাপ্তপ্রায় তখন রাজসভায় এলেন দেবর্ষি নারদ। রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন পরম শ্রদ্ধাভরে অভ্যর্থনা করলেন তাঁকে এবং তাঁর সম্প্রতি পুরুষোত্তম যাত্রার অভিপ্রায় জানিয়ে নারদকে তাঁর সহযাত্রী হবার অনুরোধ জানালেন। প্রভু জগন্নাথের দর্শনাকাঙ্ক্ষায় নারদ এই প্রস্তাবে সম্মত হলেন। দেবর্ষি নারদ, পুরোহিত বিদ্যাপতির সঙ্গে রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন, রাজপরিবার, সাধারণ প্রজা এবং চতুরঙ্গ সেনাদল চলেছে পুরুষোত্তম ক্ষেত্রের পথে। যেতে যেতে বহু তীর্থ দর্শন করে অবশেষে নীলাচলে উপস্থিত হলেন। রাজা প্রভু নীলমাধবের দর্শনাভিলাষে যখন আনন্দধারায় নিমজ্জিত তখন তাঁর অঙ্গে নানা অমঙ্গল চিহ্ন অনুভব করলেন। যেমন- বাম চক্ষু এবং বাম বাহুর ঘনঘন কম্পন ইত্যাদি। তারপর বিদ্যাপতির নির্দেশ অনুযায়ী যথাস্থানে গিয়ে নীলমাধবের দর্শন পেলেন না। মর্মাহত রাজা মূর্ছিত হয়ে পড়েন। মূর্ছাভঙ্গের পর নারদ তাঁকে প্রবোধ দিয়ে বলেন-
-হে রাজন! যে নীলমাধবকে দেখার জন্য এত ক্লেশ সহ্য করে নীলাচলে এলে, সেই নীলমাধবরূপী শ্রীবিষ্ণু এখন অন্তর্ধান করেছেন। তোমার পুরোহিত বিদ্যাপতি যে মূর্তি দর্শন করেছেন তুমি আর তা দর্শন করতে পারবে না।
এই কথায় রাজা অত্যন্ত অধীর হয়ে বিলাপ করতে লাগলেন। তার বিলাপে দেবতাদের হৃদয় আর্দ্র হলো। তখন দৈববাণী হলো- ‘হে রাজন, মনস্থির করো। শ্রীবিষ্ণু পাষাণরূপ ছেড়ে দারুরূপে প্রকটিত হবেন, তুমি যাগযজ্ঞাদি করে সেই দারুব্রহ্মের আবির্ভাবের জন্য অপেক্ষা করো।’
বাসস্থান না হলে যজ্ঞ করা অসম্ভব। মহারাজ ইন্দ্রদ্যুম্ন বিশ্বকর্মার পুত্রকে ডেকে দুই ক্রোশব্যাপী নগরের পত্তন করালেন। তারপর যজ্ঞে সুনিপুণ ব্রাহ্মণ-সহ ঋষি, রাজন্যবর্গ ও সকল বর্ণের লোকদের নিমন্ত্রণ করে অশ্বমেধ যজ্ঞের আয়োজন করলেন। মহাধুমধামে যজ্ঞ সম্পন্ন হলো। রাত্রিকালে শ্রীজগন্নাথ স্বপ্নযোগে রাজাকে দর্শন দিলেন, তাঁর শ্যামল সুন্দররূপ দেখে রাজা অভিভূত হলেন। পরদিন রাজার চরেরা সমুদ্রতীরে এক অত্যাশ্চর্য শ্বেত, নীল, পীত, রক্ত- এই চারবর্ণে শোভিত সুরভিত দ্যুতিময় ভাসমান দারুখণ্ড দেখতে পেল। এই সংবাদ রাজার গোচরীভূত হলে তিনি নারদের পরামর্শে এই দারুব্রহ্মকে মন্দির অভ্যন্তরে স্থাপন করলেন। এক শিল্পী এই দারুখণ্ডের নীল অংশ থেকে জগন্নাথ, শ্বেত অংশ থেকে বলরাম, পীত অংশ থেকে দেবী সুভদ্রা এবং লাল অংশ থেকে সুদর্শন মূর্তি নির্মাণ করলেন। দৈববাণী হলো- প্রতি বছর নতুন করে অঙ্গরাগ করতে হবে। শবররাজ বিশ্বাবসু আর রাজপুরোহিত বিদ্যাপতির বংশধররা প্রতি বছরই দারুমূর্তির অঙ্গরাগ করবে।
দেবর্ষি নারদ বললেন- ‘হে রাজন! তুমি মহাভাগ্যবান। এই মহৎকর্ম সম্পাদন করে তুমি নিজে মুক্ত হবে, আর নরলোককে মুক্ত করবে।’
নারদের পরামর্শে রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন জগন্নাথের মন্দির নির্মাণে উদ্যোগী হলেন। ব্রহ্মার আদেশে স্বয়ং বিশ্বকর্মা সপুত্রক এলেন শ্রীমন্দির নির্মাণের জন্য। হাজার হাজার মানুষ তাঁদের সাহায্য করতে এলেন। শ্রীমন্দির নির্মাণের আগে পাতাল-নৃসিংহদেবের অনুমতিগ্রহণ করা হয়। মাত্র তিনদিনে সুবিশাল, সুদৃশ্য শ্রীমন্দির নির্মাণ হলো। মনুষ্য শিল্পীর পক্ষে যা শতবর্ষের কাজ। শ্রীমন্দিরের পূর্বদিকে সিংহদ্বার আর গর্ভগৃহে রত্নবেদী তৈরি হলো। আবার সুবর্ণ নির্মিত তিন বিগ্রহের তিনখানা সুদৃশ্য রথও তৈরি করলেন বিশ্বকর্মা।
দারুমূর্তির অভিষেক পূজার জন্য ব্রহ্মলোকে যান মহারাজ ইন্দ্রদ্যুম্ন। ব্রহ্মলোকে প্রজাপতি ব্রহ্মা স্বয়ং দারুমূর্তির অভিষেক ও পূজা সমাপন করলেন। স্বর্গ থেকে দেবতারা এলেন মূর্তি দর্শনে। চারদিকে ধন্য ধন্য রব উঠল। এরপর মর্ত্যলোকে ফিরে এসে মহারাজ ইন্দ্রদ্যুম্ন শ্রীক্ষেত্র, পুরীধাম-স্থিত শ্রীমন্দিরের রত্নবেদীর উপর সেই দারুমূর্তি স্থাপন করলেন। প্রভুর নিত্য মহাপূজা আর মহাভোগের ব্যবস্থা করলেন। এইরূপে নীলাচলে দারুব্রহ্মরূপে ভগবান শ্রীবিষ্ণু অধিষ্ঠিত হলেন। কিন্তু ক্রমে কলির প্রভাব বাড়তে লাগল। তখন জগন্নাথদেব পুনরায় লীলা প্রকাশ করলেন। একদিন সকালে প্রধান পূজারি মন্দিরে প্রবেশ করে দেখলেন, দারুমূর্তি যেন জরাগ্রস্ত, বেশভূষা ছিন্নভিন্ন, অপরূপ মূর্তি প্রভাহীন, বিকৃত। পূজারি আর্তনাদ করে উঠলেন, পরিচারকেরা সব দেখে বিমূঢ় থেমে গেল ঙ্গলবাদ্য। সংবাদ গেল মহারাজ ইন্দ্রদ্যুম্নের কাছে। তিনি মন্দিরে এসে এই বিকৃত মূর্তি দর্শন করে মূর্জিত হয়ে পড়লেন। এই সময়ে দেবর্ষি নারদ এসে রাজাকে পূর্বকথা স্মরণ করালেন- স্বয়ং জগন্নাথ দৈববাণী করেছিলেন বিশ্বাবসুর বংশধরেরা প্রভুর অঙ্গরাগ করবেন আর বিদ্যাপতির বংশধরেরা প্রভুর পুনঃপ্রতিষ্ঠা করবেন, সন্ধান নাও সমুদ্রতীরে সেই দারুখণ্ড ভাসমান আছে। বিশ্বকর্মাকে স্মরণ করে মূর্তির পুনর্নির্মাণ করাও। কিন্তু বিশ্বকর্মা এসে দারুখণ্ড পরীক্ষা করে বললেন এই কঠিন দারুখণ্ড থেকে মূর্তি তৈরি করা তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়, ফিরে গেলেন বিশ্বকর্মা। রাজা পড়লেন মহাচিন্তায়, নারদ আশ্বস্ত করে বললেন- ধৈর্য ধর, ভগবান আপনি প্রকাশ হবেন।
এই সময়ে যন্ত্রাদি নিয়ে উপস্থিত হলেন এক বৃদ্ধ সূত্রধর। তিনি দারুখণ্ড পরীক্ষা করে বললেন- আমি এই দারুখণ্ড থেকে মূর্তি তৈরি করব তবে আমাকে তিনদিন তিনরাত্রি সময় দিতে হবে। এই তিনদিনে কেউ শ্রীমন্দিরের নির্মাণকক্ষে প্রবেশ করতে পারবে না। রাজা স্বয়ং দ্বার রক্ষা করবেন। এই নির্দেশ দিয়ে সেই বৃদ্ধ শিল্পী মন্দিরে প্রবেশ করে দ্বাররুদ্ধ করলেন। আর শুরু হলো অনবরত ঠুক্্যাক্ শব্দ। রাজা কিংবা অন্য কেউ বুঝতে পারলেন না যে এই বৃদ্ধ শিল্পী স্বয়ং ভগবান শ্রীবিষ্ণু। দুই দিন দুই রাত্রি অনবরত কাজ হলো তৃতীয় দিনে শ্রীবিষ্ণু ভাবলেন যে তিনি এবার অঙ্গহীন রূপে প্রকটিত হবেন। এই অঙ্গহীন মূর্তিকে যে অশ্রদ্ধা করবে সে নরকগামী হবে। আর যে এই অঙ্গহীন মূর্তিকে শ্রদ্ধাভরে ভজনা করবে সে বৈকুণ্ঠ প্রাপ্ত হবে। এই লীলা প্রকট করার জন্য শিল্পীরূপী শ্রীবিষ্ণু নির্মাণ কার্য স্থগিত রাখলেন। রাজা ও রানি বাইরে থেকে দীর্ঘ সময় শব্দ না শুনে উৎকণ্ঠিত হলেন। ভাবলেন শিল্পী হয়তো কোনোভাবে আক্রান্ত হয়েছেন বা মূর্তির কাজ হয়তো সমাপ্ত হয়েছে। রানির অনুরোধে মহারাজ দ্বার খুলে শ্রীমন্দিরে প্রবেশ করলেন। নির্মাণকক্ষ খুলে দেখলেন তিনটি অসমাপ্ত মূর্তি তাঁর সম্মুখে দণ্ডায়মান। সেই দারুশিল্পী অন্তর্হিত। হতাশায় ভেঙে পড়লেন মহারাজ। বুঝতে পারলেন এক মহা ভুল তিনি করে ফেলেছেন। অধৈর্য
হয়ে রুদ্ধদ্বার খোলা তাঁর উচিত হয়নি। কারণ তখনও আট প্রহরের কাজ বাকি। এই মূর্তি আর সম্পূর্ণ করা সম্ভব হবে না।
প্রচলিত কিংবদন্তী অনুসারে এরপর হয় দৈববাণী, মতান্তরে জনশ্রুতি রয়েছে যে মহারাজের স্বপ্নদর্শন হয়। শ্রীভগবান রাজাকে বললেন- কলিযুগে এই মূর্তিই আমার লীলাস্বরূপ। তুমি যদি মোক্ষলাভ করতে চাও, তবে এই অঙ্গহীন মূর্তিকেই পূজা করো। আর একটি গূঢ় কথা তোমাকে বলছি, আগের জীর্ণ মূর্তির নাভিদেশের গোপন রন্ধ্রে ব্রহ্ম-আত্মা স্থাপিত আছেন। সেই আত্মাকে নবনির্মিত মূর্তির নাভিদেশে স্থাপন করতে হবে। তবে সেই কর্মের একমাত্র অধিকারী বিশ্বাবসু শবরের পুত্র, চোখে সাতপাট কাপড় বেঁধে এই কাজ করতে হবে। সেই ব্রহ্ম-আত্মাকে দর্শন করলে মৃত্যু অনিবার্য। আর সেই ব্রহ্ম-আত্মাকে প্রতিষ্ঠা করবেন বিদ্যাপতি। প্রতি বারো বছর অন্তর এই অঙ্গহীন মূর্তি নবকলেবর ধারণ করবেন। বংশপরম্পরায় এই কাজ করবেন শবররাজ বিশ্বাবসু এবং বিদ্যাপতির বংশধররা। এই কথা শেষ করেই সেই বৃদ্ধশিল্পী অদৃশ্য হয়ে গেলেন। রাজা বুঝতে পারলেন ইনিই ছদ্মবেশী প্রভু জগন্নাথ। তখন রাজা বিশ্বাবসুর পুত্রকে এনে নবনির্মিত মূর্তিতে ব্রহ্ম-আত্মা স্থাপন করালেন এবং রত্নবেদীর উপর শ্রীজগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রার মূর্তি স্থাপন করে যথাবিধি পূজা-অর্চনা শুরু করলেন। ক্রমে মর্ত্যধামে ছড়িয়ে পড়ল শ্রীজগন্নাথ মাহাত্ম্য। অদ্যাবধি প্রতি বারো বছর অন্তে রথযাত্রার প্রাক্কালে শ্রীশ্রীজগন্নাথদেব নবকলেবর ধারণ করেন।
পুরাতন মূর্তির নাভিদেশ থেকে ‘আত্মা-ব্রহ্ম’ গ্রহণ করে নবকলেবরে স্থাপন করেন শবররাজ বিশ্বাবসুর বংশধরেরা। হাজার বছরের হাজার বৈদেশিক আক্রমণ, হাজার প্রাকৃতিক বিপর্যয় উপেক্ষা করে শ্রীজগন্নাথ মাহাত্ম্য আজও অমলিন।