মোদীজীর এগারো বনাম দিদির চোদ্দো
পিনাকপাণি ঘোষ
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর শাসনকাল মনে করলেই কয়েকটি বড়ো সাফল্যের কথা মনে পড়ে। অযোধ্যায় ভগবান রামলালার ভব্যমন্দির নির্মাণ থেকে পাকিস্তানি হামলার যোগ্য জবাব, কিংবা সফল চন্দ্রাভিযান থেকে তিন তালাক নিষিদ্ধ করা বা ৩৭০ ধারা বিলোপের কথা আলোচনায় আসে। কিন্তু এই ১১টা বছর ভারতকে এমন ছোটো ছোটো অনেক কিছু দিয়েছে যা আসলে অনেক বড়ো। এই সময়ে ভারতের সব সাবালক নাগরিকের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট হয়েছে। জন ধন যোজনার মাধ্যমে দেশের ৫৫ কোটি মানুষ ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলতে পেরেছেন, যা ইউরোপীয় ইউনিয়নের জনসংখ্যার চেয়েও বেশি। এই প্রকল্পের মাধ্যমে ভারতের একটি বড়ো অংশ প্রথমবার ব্যাংকিং সুবিধা পেয়েছে, যা তাদের আর্থিক সুরক্ষা ও স্বাচ্ছন্দ্য সুনিশ্চিত করেছে।
কোনো ছুটি ছাড়া ২৪ ঘণ্টার ডিজিটাল ব্যাংকিং জনপ্রিয় হয়ে গিয়েছে গোটা দেশে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মুদ্রা ঋণ প্রকল্প দেশের ছোটো ব্যবসায়ীদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা হয়ে উঠেছে। এই প্রকল্পের আওতায় ৫২ কোটি ঋণ দেওয়া হয়েছে, যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া ও অস্ট্রেলিয়ার মোট জনসংখ্যার চেয়েও বেশি। মুদ্রা ঋণের মাধ্যমে দেশের ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা সহজেই ব্যবসা করার সুযোগ পেয়েছেন এবং কর্মসংস্থানের সুযোগও সৃষ্টি হয়েছে। কেন্দ্রীয় অর্থ বাজেটের অঙ্গ হয়ে গিয়েছে রেল বাজেট। অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে এগিয়ে চলেছে ভারতীয় রেল। এই সময়কালেই জিএসটি-র মতো পরোক্ষ কর সংস্কার বা যোজনা কমিশনের পরিবর্তে নীতি আয়োগ গঠনের মতো কাজও সম্পন্ন হয়েছে। ‘আয়ুষ্মান ভারত’-এর মতো সরকারি স্বাস্থ্য বিমা প্রকল্প দেশজুড়ে বাস্তবায়িত হয়েছে। সফল চন্দ্রাভিযান করেছে ভারত। সবক’টি পদক্ষেপই যুগান্তকারী।
আবার এই সময়কালেই করোনাকাল এসেছে। দেশের ভিতরে তো বটেই, গোটা বিশ্বে ভারতের তৈরি টিকা সমাদৃত হয়েছে। এমন তালিকা লম্বা করে ফেলা যায়। বর্তমানে ১৫ কোটি পরিবার তাদের বাড়িতে পানীয় জলের সংযোগ পেয়েছে, যা রাশিয়ার মোট জনসংখ্যার সমান। এই প্রকল্পটি দেশের
গ্রামাঞ্চলে বিশুদ্ধ পানীয় জলপ্রবাহকে নিশ্চিত করেছে এবং এর ফলে কোটি কোটি মানুষ সুস্থ জীবনযাপন করছে। প্রায় ২৫ কোটি কৃষককে স্বাস্থ্য কার্ড দেওয়া হয়েছে, যা ব্রাজিলের জনসংখ্যার থেকেও বেশি। এই কার্ডের মাধ্যমে কৃষকরা তাদের জমির মাটি কেমন রয়েছে, তা সম্পর্কে প্রয়োজনীয় তথ্য পেয়ে উন্নত চাষাবাদ করতে সক্ষম হয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বাধীন ভারত সরকার প্রতি মাসে ৮১ কোটি মানুষের জন্য বিনামূল্যে রেশন বিতরণ করছে, যা আমেরিকা এবং দক্ষিণ আমেরিকার মোট জনসংখ্যার সমান। ভারতকে বিশ্বের বৃহত্তম স্মার্টফোন নির্মাতা দেশগুলির মধ্যে একটি করে তুলতে কেন্দ্রীয় সরকারের উদ্যোগে শুরু হওয়া ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ প্রকল্প গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। এখন প্রতি সপ্তাহে ৬৩ লক্ষ স্মার্টফোন তৈরি হচ্ছে ভারতে।
এই সময়টাকে ১৪ বছরের বনবাস বলেন তাতে এই প্রতিবেদকের আপত্তি রয়েছে। বনবাসেও রঘুপতি শ্রীরাম যা যা করেছেন, তা ইতিহাস হয়ে রয়েছে। দিদির ১৪ বছরেও অনেক ইতিহাস তৈরি হয়েছে, কিন্তু তাকে বনবাস বললে রামায়ণের প্রতি অশ্রদ্ধা করা হয়ে যাবে। মমতাদিদির প্রতিও। আমি বরং, এই সময়কালকে ‘দিদিকাল’ বলতেই ভালোবাসি।
পশ্চিমবঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ক্ষমতায় এলেন ২০১১ সালে। প্রায় সাড়ে তিন দশকের বাম শাসনের অবসান হলো। রাজ্যের মানুষ সেই পরিবর্তনের দিকে অনেক দিন ধরেই তাকিয়ে ছিল। দিদি যেদিন শপথ নিলেন, সেদিন উৎসবের মেজাজ ছিল এই রাজ্যে। তাঁর মুখে ‘বদলা নয় বদল চাই’ স্লোগান সবার কানে মধু ঢেলে দিয়েছিল। কিন্তু তারপরে রাজ্য জুড়ে বদলার রাজনীতি কেমন চেহারা নিয়েছে তা সব রাজ্যবাসী ভালোই জানে। তারপরে এক দিন দিদির মুখে নতুন স্লোগান- ‘যে গোরু দুধ দেয়…’। দিদির ক্ষমতায় আসার দু’বছরের মধ্যেই পশ্চিমবঙ্গের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছিল। ২০১৩ সালে প্রথমে সারদা কোম্পানি, পরে রোজভ্যালি-সহ একের পর এক চিটফান্ড দুর্নীতি সামনে এল। একের পর এক ধর্ষণ, বীরভূম থেকে অনুব্রতর হুংকার, খাগড়াগড় বিস্ফোরণ, শ্রীরামনবমীর শোভাযাত্রায় হিন্দুদের উপর আক্রমণ। অনেক ভয়ংকর ঘটনা এই রাজ্যে গত ১৪ বছরে ঘটেছে।তৃণমূলের নেতা-মন্ত্রীদের চটুল কথাবার্তা রাজ্যবাসীকে শুনতে হয়েছে।রাজ্যের কোণে কোণে তৈরি হয়েছে একাধিক শেখ শাজাহান। পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন প্রান্তে চলেছে গোরু-বালি- কয়লা পাচার। নাগরিকত্ব (সংশোধনী) আইন পাশের পর দুধেল গাইদের দৌরাত্ম্যে হাওড়া থেকে মুর্শিদাবাদ জ্বলেছে।
তারপর হলো পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের বান্ধবীর ফ্ল্যাটে রাশি রাশি টাকা উদ্ধার। কোটি কোটি টাকার সঙ্গে মিলল সোনার গয়না, বিদেশি মুদ্রা। দিদির দলের মহাসচিব, রাজ্যের মন্ত্রী এই বিপুল পরিমাণ টাকা তুললেন, কিন্তু কিছুই জানতেন না মুখ্যমন্ত্রী। পার্থকে দল থেকে বহিষ্কার করে হাত ধুয়ে নিলেন। এরপর আরজি কর কাণ্ড। নতুন করে সেই সব দুঃখের কাহিনি বলতে চাই না। গোটা রাজ্য রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ জানিয়েছে। সেই প্রতিবাদে তৃণমূল কর্মী, সমর্থকদের পরিবারের মা, বোনেরাও ছিলেন। প্রতিবাদী পদযাত্রা থেকে সাধারণ মানুষকে চিৎকার করে বলতে শোনা গিয়েছে, মুখ্যমন্ত্রীর গ্রেপ্তারি চাই। তার ইস্তফা চাই। কিন্তু ‘চাই’ বললেই কি পাওয়া যায় নাকি? সবকিছু তো মামাবাড়ির মোয়া নয়। পিসির বাড়িরও নয়। এই তো সেদিন প্রায় ২৬ হাজার শিক্ষক-শিক্ষিকা- শিক্ষাকর্মীর চাকরি বাতিল হয়ে গেল। সে গেল তো গেল! তাতে কী হলো? এই দিদিকালেই তো পশ্চিমবঙ্গের ঘরে ঘরে লক্ষ্মীর ভাণ্ডার যাচ্ছে, ক্লাবে ক্লাবে দুর্গার ভাণ্ডার! জয় বাংলা!
এসব বলে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকারের ১১ বছরে যে কোনো দুর্নীতির অভিযোগ ওঠেনি তা বলা ভুল হবে। তুলনা টানা হলে এটা তো মেনে নিতে হয় যে, এ রাজ্যে দুর্নীতি হওয়ারই কথা ছিল। তৃণমূল আর দুর্নীতি সমার্থক। বরং, এটা বলা দরকার যে, এই রাজ্যের মানুষ দিদিকালে অন্য রাজ্যের বাসিন্দাদের মতো মোদীজীর সময়কালের অনেক সুবিধা থেকে বঞ্চিতই রয়ে গেল। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর উদ্যোগে চালু হওয়া আয়ুষ্মান প্রকল্পের মাধ্যমে প্রায় ৯০ কোটি মানুষ বিনামূল্যে চিকিৎসার সুবিধা পেয়েছেন। এই সংখ্যা কানাডার জনসংখ্যার দ্বিগুণেরও বেশি। আয়ুষ্মান ভারত স্বাস্থ্য পরিষেবার ক্ষেত্রে এক অভাবনীয় বিপ্লব সৃষ্টি করেছে, যেখানে দেশের দরিদ্র এবং গ্রামীণ জনগণের জন্য চিকিৎসা পরিষেবা পাওয়া সহজতর হয়েছে। না, পশ্চিমবঙ্গের মুকুটে নতুন পালকও লেগেছে। এই সময়কালে দেশের প্রথম রাজ্য পশ্চিমবঙ্গ, যেখানে কেন্দ্রীয় উদ্যোগে নদীর তলা দিয়ে চলছে মেট্রো রেল।
পশ্চিমবঙ্গে প্রায়শই শোনা যায়, কেন্দ্র বঞ্চনা করছে। বাম আমলের ভাঙা রেকর্ড। তৃণমূল জমানাতেও বলা হয়ে থাকে যে, পশ্চিমবঙ্গকে তার প্রাপ্য থেকে নাকি বঞ্চিত করা হচ্ছে। বিভিন্ন প্রকল্পে রাজ্যের প্রাপ্য টাকা আটকে রাখা হয়েছে। যদিও এখন আইনত সেই সুযোগই নেই। জিএসটি বাবদ আয়ের একটা অংশ রাজ্যে ফেরত আসে। মনমোহন সিংহ সরকারের আমলে রাজ্যকে ১.৩৪ লক্ষ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছিল ১০ বছরে। আর নরেন্দ্র মোদী প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন ১১ বছরে পশ্চিমবঙ্গ পেয়েছে ৫.২৪ লক্ষ কোটি টাকা। চার গুণ বেশি। ইউপিএ আমলে এই রাজ্য গ্র্যান্ট-ইন-এইড পেয়েছিল ৭৫ হাজার কোটি টাকা। নরেন্দ্র মোদীর সময়ে পশ্চিমবঙ্গ গ্র্যান্ট-ইন-এইড পেয়েছে ৩ লক্ষ কোটি টাকা।
দিদিকালে পশ্চিমবঙ্গ কি এগোয়নি? কে বলেছে ‘না’! কোনো এমন ছ’মাস যায় না যে, রাজ্যের কোথাও কোনো মহিলার উপর অত্যাচারের ঘটনা সামনে আসে না। যদি দিদিকালের ইতিহাস লেখা হয় তাহলে, কালো অক্ষরে লেখা হবে সন্দেশখালির ঘটনা। যে পশ্চিমবঙ্গ একদা উন্নতির শিখর ছুঁয়েছিল, সেই রাজ্যে আজ শিক্ষার কথা জিজ্ঞেস করলে দেখা যাবে তৃণমূলের আমলে এসএসসি ও প্রাইমারি স্কুলের চাকরিতে সবথেকে বড়ো দুর্নীতি হয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের সাম্প্রতিক রায়ে স্পষ্ট যে ২০১৬-র এসএসসি-তে ২৬ হাজার চাকরি চুরি হয়েছে। ক্যাগ রিপোর্টে প্রায় সব খাতের হিসাবেই গরমিল পাওয়া গিয়েছে। এই পরিমাণ টাকা কোথায় গেল? কারা লুটল? পশ্চিমবঙ্গে এখন সে প্রশ্ন করতেও সাহস লাগে। সংবাদমাধ্যম নিয়ন্ত্রণও তো দিদিকালের একটা প্রশাসনিক সাফল্য।
হিসাব করলে দেখা যাবে দিদিকালে সবথেকে বেশি ব্রেন ড্রেন হয়েছে পশ্চিমবঙ্গে। এখন বাংলাভাষা নিয়ে কাজ করতেও নয়ডা, গুরুগ্রাম, এমনকী দক্ষিণের বিভিন্ন রাজ্যে যেতে হয় এই রাজ্যের মেধাবীদের। তৃণমূলের মাফিয়ারাজ, রাজ্য সরকারের জমি নীতি এবং অ্যান্টি-বিজনেস মানসিকতা রাজ্যের শিল্প ভবিষ্যতের সঙ্গে কর্মসংস্থানের সম্ভাবনাকে শেষ করে দিয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকার শেষ ১১ বছরে দেশের আর্থিক অবস্থাকে মজবুত করেছে। ভারত বর্তমানে বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম অর্থনীতি। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ যেন দারিদ্র্য থিমের প্যান্ডেল। মোদীজীর প্রধানমন্ত্রিত্বের সময়কালকে বলা হচ্ছে, উন্নয়নশীল ভারত থেকে বিকশিত ভারতের পথে যাত্রা। তাতে পশ্চিমবঙ্গও রয়েছে। এই রাজ্যের বিকাশের জন্য একটি রোডম্যাপ তৈরি করেছে মোদীজীর নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকার। সেই রোডম্যাপকে বাস্তবায়িত করার জন্য রাজ্য সরকারের সদর্থক ভূমিকা গ্রহণ প্রয়োজন। কিন্তু সেটা করতে চাইলে রেল বা বিএসএফ-কে জমি দিয়ে দিলে, সংকীর্ণ রাজনীতি কে করবে? বাম-তৃণমূল জমানার পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক ঐতিহ্যই তো নষ্ট হয়ে যাবে! বিজেপি নেতৃত্ব বলেন, এই ১১ বছরে প্রমাণিত হয়েছে যে, ‘মোদী হ্যায় তো মুমকিন হ্যায়’।