পূর্ববঙ্গের মুক্তিযুদ্ধ এবং বাঙ্গালি হিন্দু সমাজ
গোপাল চক্রবর্তী
দেশভাগের বীভৎস স্মৃতি নিয়ে পূর্বপাকিস্তানের হিন্দুরা দিন কাটাচ্ছিল আতঙ্ক আর ত্রাসের মধ্য দিয়ে। অনেকে পিতৃপুরুষের ভিটে, সাজানো সংসার, নিশ্চিত উপার্জন সব কিছু ছেড়ে শুধুমাত্র ধর্ম আর সম্ভ্রম রক্ষার জন্য পাড়ি দিয়েছিল পশ্চিমবঙ্গ, অসম কিংবা ত্রিপুরায় অনিশ্চিত আশ্রয়ের উদ্দেশ্যে। আবার অনেকেই জন্মভূমির মায়া কাটাতে না পেরে মাটি কামড়ে পড়ে ছিল। ১৯৬৫ সালে ভারত পাকিস্তান যুদ্ধের পর পূর্বপাকিস্তানের হিন্দুদের অবস্থা আরও সংকটাপন্ন হয়ে ওঠে। ভাবটা এমন, যেন এই যুদ্ধের সমস্ত দায় পূর্ব পাকিস্তানের হিন্দুদের। পঁয়ষট্টির পর থেকে শুরু হয় পাক সরকারের বিরুদ্ধে বিভিন্ন রাজনৈতিক এবং জনআন্দোলন। ফলে সরকার ও মোল্লাবাদী সংগঠনগুলি কিছুটা কোণঠাসা হয়। ১৯৬৯ সালে গণঅভ্যুস্থানে সামরিক শাসক আয়ুব খানকে গদিচ্যুত করে শুরু হয় আরেক সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খানের শাসন। অভূতপূর্ব রাজনৈতিক চাপে হলো ১৯৭০ সালে সাধারণ নির্বাচন। আর এই নির্বাচনে পূর্বপাকিস্তানে প্রায় সবকটি আসনে জয়ী হয়ে শেখ মুজিবুর রহমানের আওয়ামি লিগ, সমগ্র পাকিস্তানের সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। সংখ্যাগরিষ্ঠতায় দ্বিতীয় দল হয় জুলফিকার আলি ভুট্টোর পাকিস্তান পিপলস্ পার্টি। স্বাভাবিকভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের ফলে আওয়ামি লিগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানের প্রধানমন্ত্রিত্ব লাভ করার কথা। কিন্তু শুরু হয় ইয়াহিয়া খানের ষড়যন্ত্র, একজন বাঙ্গালি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হবে, এ পাকিস্তানের অপমান।
আবার পূর্বপাকিস্তানের প্রায় সব হিন্দুই আওয়ামি লিগের সমর্থক। আওয়ামি লিগের নেতারা আকারে প্রকারে বলছে ক্ষমতায় এলে তারা ভারতের সঙ্গে বন্ধ সীমান্ত খুলে দেবে, ভারতের সঙ্গে যাতায়াত এবং ব্যবসা বাণিজ্য শুরু করবে। ওদিকে ভুট্টোও প্রধানমন্ত্রিত্বের লোভে লালায়িত। ইয়াহিয়া খান শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করায় সারা পূর্বপাকিস্তানের বাঙ্গালি জনতা তখন ফুঁসছে, ক্ষুব্ধ সর্বস্তরের মানুষ। ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সাধারণ নির্বাচন হয়, জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি কেটে যায় কিন্তু ইয়াহিয়া খান অনড়। ৭ মার্চ ১৯৭১ ঢাকার রেসকোর্স ময়দান থেকে ঐতিহাসিক ভাষণে শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের পঠন পাঠন বন্ধ হয়ে যায়। অফিস আলাদলতে বাঙ্গালি কর্মচারীরা কর্মবিরতি পালন করে, পাকিস্তানের সামরিক সরকার বাঙ্গালিদের সমুচিত শিক্ষা দিতে বদ্ধপরিকর হয়। করাচি বন্দর থেকে যুদ্ধ জাহাজ ‘বাবর’কে নিয়ে আসা হলো চট্টগ্রাম বন্দরে। ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি বাহিনী আক্রমণ করে রাজারবাগ পুলিশ লাইন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাসগুলি আর আপামর বাঙ্গালি জনগণের উপর। শেখ মুজিবুর রহমানের ধানমণ্ডির বাড়ি থেকে তাঁকে গ্রেপ্তার করে বিমানে নিয়ে যাওয়া হয় পশ্চিম পাকিস্তানের গোপন কারাগারে।
এদিকে বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও সীমান্তরক্ষী ইপি আর যৌথভাবে ব্যারাক ছেড়ে বেরিয়ে আসে এবং পাক বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ শুরু করে। ২৬ মার্চ চট্টগ্রামের বালুরঘাট বেতারকেন্দ্র থেকে চট্টগ্রাম সেনানিবাসের জি ও সি মেজর জিয়াউর রহমানকে দিয়ে আওয়ামি লিগের নেতৃবৃন্দ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করায়। শুরু হয় পাকবাহিনী এবং বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইপিআর আর আওয়ামি লিগের স্বেচ্ছাসেবকদের প্রচণ্ড লড়াই।
বাঙ্গালি জনতার মনে ত্রাসের সৃষ্টির জন্য ‘বাবর’ যুদ্ধ জাহাজ থেকে অনবরত গোলাবর্ষণ হতে থাকে। প্রথম দিকে বাঙ্গালি স্বাধীনতাকামীরা প্রতিরোধ করতে পারলেও ক্রমে তা ভেঙে পড়ে। পাকবাহিনী বোমাবর্ষণ করে বাঙ্গালিদের ঘাঁটিগুলি ভেঙে দিয়ে প্রথমে শহরগুলি দখল করে। এই সময়ে পাকিস্তানি বাহিনী বেছে বেছে হিন্দুদের হত্যা করতে থাকে, মুসলমানরা বহাল তবিয়তে থাকে। হিন্দুরা দলে দলে শহর ছেড়ে গ্রামে পালাতে থাকে। গ্রামগুলিতে তখনো বাঙ্গালি বাহিনীর আধিপত্য ছিল। এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে পাকবাহিনী মফস্সল শহরগুলিতে ঘাঁটি করে এবং গ্রামগুলির উপর আক্রমণ চালায়। তাদের লক্ষ্য ছিল হিন্দুপ্রধান গ্রামগুলি। বেছে বেছে হিন্দু বাড়িগুলিতে অগ্নিসংযোগ, লুটপাট, গণহত্যা, নারীধর্ষণ চলতে থাকে। এই সময়ে মুসলমানদের একাংশ পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে মিশে হিন্দু নিধনে মেতে ওঠে। তাদের মধ্যে মুসলিম লিগ, জামাতে ইসলামির সমর্থকরা যেমন আছে, তেমনই আছে যারা কদিন আগেও শেখ মুজিবুর রহমানের আওয়ামি লিগের সমর্থক ছিল। এইসব পাকিস্তান-পন্থীদের নিয়ে তৈরি হয় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সহযোগী আলবদর, রাজাকার, আল শামস প্রভৃতি বাহিনী।
নারকীয় হত্যালীলা, হিন্দু মেয়েদের ধর্ষণ, লুণ্ঠনে তারা নজির তৈরি করেছিল। হিন্দুরা তখন আত্মগোপন করে থাকে নিরাপদ অঞ্চলে। যদি কোনো কারণে কোনো হিন্দু পাকবাহিনী বা তাদের সহযোগীদের হাতে পড়ে, তাহলে তার মৃত্যু অনিবার্য। ট্রেন, বাস, নৌকা থেকে যাত্রীদের নামিয়ে বেছে বেছে হিন্দুদের গুলি করে মারা হয়। হিন্দু সন্দেহ হলে তাকে ঘাতকরা কলেমা পড়তে বলত, হিন্দুরা কলেমা জানে না, তাই ধরা পড়ে যেত। অনেক হিন্দু ভয়ে এই সময়ে কলেমা শিখে নিয়েছিল, অবিশ্বাস হলে তাদের কাপড় খুলে পুরুষাঙ্গ পরীক্ষা করে দেখা হতো সুন্নতের চিহ্ন আছে কিনা। হিন্দুরা তখন গোপনে দলে দলে ভারতের পথে। জীবন ও বিষয় সম্পত্তির রক্ষার জন্য অনেক হিন্দু তখন মুসলমানও হয়েছিল। অসংখ্য হিন্দু মেয়ে নির্যাতিতা হয়ে কিংবা নির্যাতিতা হবার ভয়ে আত্মহত্যা করেছে।