দিদি কি রাষ্ট্রপতি শাসন চান?
বদলেষু দিদি,
এই সম্বোধন আপনার ১৪ বছরের পুরনো একটা কথার জন্য। ক্ষমতায় এসেই সেই যে বলেছিলেন না, ‘বদলা নয়, বদল চাই’। কিন্তু দিদি পশ্চিমবঙ্গ কি সত্যিই বদলেছে? না, না গঙ্গার তলা দিয়ে মেট্রো রেল কিংবা বিশ্ব বাংলা গেটের বদলের কথা বলছি না, পশ্চিমবঙ্গের ভোট সংস্কৃতি কি বদলেছে দিদি?
এখন এই রাজ্যের মানুষের প্রশ্ন, রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করে কি বিধানসভা নির্বাচন হবে? আসলে দিদি, বাঙ্গালি হিসেবে লজ্জা লাগলেও একটা কথা আমাদের মেনে নিতেই হবে যে পশ্চিমবঙ্গ এখনও পশ্চিমবঙ্গেই রয়েছে। বামফ্রন্ট জমানায় এ রাজ্য যেভাবে সন্ত্রাস দেখেছে, তেমনটাই দেখে চলেছে এখনও। বেড়েছে বই কমেনি। তৃণমূল জমানার ১৪ বছরে এই রাজ্যে একটা নির্বাচনও হয়নি রক্তপাত ও মৃত্যু ছাড়া।
এমনটা দেশের অনেক রাজ্যেই এক সময়ে ছিল। বিহার, উত্তরপ্রদেশে তো ভোট মানেই ছিল ‘মৃত্যু’। কিন্তু টিএন সেশন জাতীয় নির্বাচন কমিশনার হওয়ার পরে ১৯৯১ সাল থেকে পরিস্থিতি বদলাতে শুরু করে। সব রাজ্যে নির্বাচন কমিশন শান্তিপূর্ণভাবে নির্বাচন করাতে সফল হলেও পশ্চিমবঙ্গে তা পারেনি। রাজ্য নির্বাচন কমিশনের নিয়ন্ত্রণে পঞ্চায়েত, পুরভোটে আদ্যিকালের ব্যালট ব্যবস্থা রেখে দিয়েছেন আপনি। বামফ্রন্ট জমানার ট্র্যাডিশন বজায় রেখে লুঠপাট, মারপিট, রক্ত, বোমা, হত্যা, এমনকী ব্যালট খেয়ে নেওয়াও দেখেছে এই রাজ্য। আর ভোেট পরবর্তী সন্ত্রাসে বাম জমানাকে বলে বলে গোল দেওয়া দেখিয়ে দিয়েছে তৃণমূল।
এটা মানতেই হবে যে, আপনি তথা আপনার প্রশাসন এবং দল কখনোই শান্তিপূর্ণ নির্বাচন করতে দিতে রাজি নয়। এর উপরে আবার কেন্দ্রীয় সরকার যখন দেশের খরচ কমাতে ‘এক দেশ, এক নির্বাচন’ চালু নিয়ে আলোচনা করছিল, তখনই আপনি বলেছিলেন আসলে রাষ্ট্রপতি শাসন চাইছে নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকার।
আসলে দিদি আপনি জানেন, রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করে ভোট হলে আপনি বেশি সুবিধা পাবেন। সেটা বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বও জানে। ‘নীতিগত ভাবেও বিজেপি কোনো নির্বাচিত সরকার ফেলে দেওয়ার বিপক্ষে। কারণ, তাতে যে দলের সরকার ফেলা হবে, তারা ‘শহিদ’-এর মর্যাদা পেয়ে যাবে এবং তার ফয়দা তোলার অবকাশ পাবে নির্বাচনে। বিশেষ প্রয়োজনে রাজ্য সরকার ফেলে দেওয়ার ধারা সংবিধানে দেওয়া থাকলেও এই পদক্ষেপকে মূলত ‘অগণতান্ত্রিক’ বলেই মনে করে বিজেপি। ফলে বিজেপি চাইবে না তৃণমূল তথা আপনি সেই সুযোগ পেয়ে যান।
দিদি, আপনি এটা ভালোই জানেন যে, অটলবিহারী বাজপেয়ী বা নরেন্দ্র মোদীর প্রধানমন্ত্রিত্ব কালে কোনো রাজ্যেই অবৈধ উপায়ে বা বিনা কারণে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করেনি। মণিপুরের ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলার প্রশ্ন ছিল। তাতে কোনো আপত্তিও ওঠেনি। তবে অনেক রাজ্যের সরকার ভেঙে দেওয়ার নজির দেখিয়েছে কংগ্রেস। ইন্দিরা গান্ধী তো বটেই, পিভি নরসিমা রাও প্রধানমন্ত্রী থাকার সময়ে অনেক রাজ্যেই বিজেপি সরকার ভেঙে দেওয়া হয়েছিল। তবে বিজেপি সে পথে কখনও হাঁটেনি।
ভারতের সংবিধান কী বলছে? সংবিধানের অষ্টাদশ অধ্যায়ে কোনো রাজ্যে ৩৫৬ বা ৩৫৫ ধারা বা অনুচ্ছেদ জারি সম্পর্কিত বিধান রয়েছে। দেশে বা দেশের কোনো প্রান্তে বিভিন্ন ধরনের জরুরি পরিস্থিতি মোকাবিলায় কেন্দ্রীয় সরকারকে বিশেষ ক্ষমতা দিয়েছে ভারতীয় সংবিধান। ৩৫৬ ধারায় বলা হয়েছে, কোনো রাজ্য সরকার সংবিধানসম্মতভাবে রাজ্য প্রশাসন পরিচালনা না করলে সেই মন্ত্রীসভাকে সরিয়ে রাজ্যে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করা যেতে পারে। আর ৩৫৫ ধারা বলছে, বাইরের আক্রমণ বা অভ্যন্তরীণ গোলযোগ থেকে রাজ্য সরকারগুলিকে রক্ষা করতে কেন্দ্র বাধ্য এবং সংবিধান অনুযায়ী রাজ্য চালাতে রাজ্য সরকারের যা যা সাহায্য প্রয়োজন, তা দিতে কেন্দ্রীয় সরকার দায়বদ্ধ। অর্থাৎ, একটি জোর করে এবং অপরটি রাজ্যকে সাহায্য করার জন্য। এক্ষেত্রে তাই রাজ্য চাইলে তবেই ৩৫৫ ধারা জারি করা যায়। কিন্তু ওই কাজ করলেই আপনি কান্নাকাটি শুরু করে বাঙ্গালির মন জিতে নিতে চাইবেন।
কিন্তু দিদি, এই দাবি ঠিকই যে, পশ্চিমবঙ্গে সাধারণ পরিস্থিতিতে অবাধ নির্বাচন সম্ভব নয়। অতীতে হয়নি। ২০২৬ সালে আরোই হবে না। কারণ এবারে আপনার দল তৃণমূল বেশি চাপে। একের পর এক ইস্যুতে কোণঠাসা তৃণমূল মরণকামড় দিতে চাইবে ভোটে। পুলিশকে কাজে লাগাবে আরও বেশি করে। কেন্দ্রীয় বাহিনী এলেও অতীতের মতোই ‘খেলা হবে’-র রিকল্পনা তৈরি। কিন্তু অতীতের মতো তৃণমূল খেলতে পারবে কিনা তা নিয়ে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে তৃণমূলের অন্দরে। হ্যাঁ দিদি, আপনার ভাইয়েরাই বলছেন, এবার অত সোজা হবে না। কারণ, মানুষ আর চাইছে না। একমাত্র মানুষই প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে।