এক আত্মত্যাগের নাম মহাভারতের বর্বরীক
সমাপ্তি সামন্ত
পাণ্ডবদের অজ্ঞাতবাসের গল্প প্রায় সকলেই জানা। হিড়িম্বা রাক্ষসীর সঙ্গে মহাবলী ভীমের বিবাহের কাহিনিও আমাদের অজানা নয়। যে কাহিনি অজানা, তা হলো ঘটোৎকচের পুত্র বর্বরীক।
বর্বরীক অসীম ক্ষমতার অধিকারী। মহাভারতের যুদ্ধ তিনি কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই শেষ করে দেওয়ার ক্ষমতা রাখেন। শ্রীকৃষ্ণ সরাসরি বর্বরীককে জিজ্ঞেস
করলেন, কতটা সময় লাগবে এই যুদ্ধের পরিণতি আনতে। বর্বরীক শ্রীকৃষ্ণকে জোর হস্তে প্রণাম করে জানালেন, তিনটে তির চালাতে তার যতটা সময় লাগবে মহাভারতের যুদ্ধ শেষ করতে ঠিক ততটাই সময় লাগবে তার। সকলে আশ্চর্য হয়ে এ ওর মুখের দিকে দেখতে লাগলেন। বলে কী বর্বরীক! যে যুদ্ধের জন্য এত প্রস্তুতি, এতো ছলনা, এতো গোপনীয়তা সেই যুদ্ধ মাত্র তিনটে তিরের সাহায্যে সমাপ্ত করতে পারে বর্বরীক। শ্রীকৃষ্ণ প্রমাণ চাইলেন। সঙ্গে তিনি এটাও বললেন, যেন কোনো নিরীহ মানুষের প্রাণ না যায় সে বিষয়েও তাকে নিশ্চিত করতে হবে।
যুদ্ধক্ষেত্র ছাড়া বর্বরীক তার ক্ষমতা প্রদর্শন করবে কী করে। সামনে একটি বড়ো বৃক্ষ ছিল, নিজের যুদ্ধবিদ্যার কৌশল সেই বৃক্ষের মাধ্যমে দেখাতে সচেষ্ট হলেন বর্বরীক। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন, খেয়াল রেখো যেন এই গাছে বসা কোনো পাখি, ফল বা ফুলের ক্ষতি না হয়। মাত্র এই গাছের পাতাগুলি তুমি একটি তিরের সাহায্যে নষ্ট করতে পারবে।
বর্বরীক তার আরাধ্য শ্যামকে স্মরণ করে প্রথম তির নিক্ষেপ করলেন। সেখানে তিনি চিহ্নিত করলেন সেই গাছে থাকা ফুল, ফল ও পাখি যাতে নিশ্চিন্তে থাকতে পারে। তাদের যেন কোনো ক্ষতি না হয়। দ্বিতীয় তির দিয়ে তিনি চিহ্নিত করলেন এই গাছে যতগুলি পাতা আছে সেই পাতাগুলোর নষ্ট করতে। তৃতীয় তিরটা নিক্ষেপ করলেন সেই পাতাগুলিকে জ্বালিয়ে ভস্ম করে দেওয়ার জন্য। তখন শ্রীকৃষ্ণ ছলনা করে একটি পাতা তার পায়ের তলায় চেপে রেখেছিলেন।
বর্বরীক লক্ষ্য করলেন তার তির গাছের সব পাতা নষ্ট করেও ফিরে আসছে না কেন?
কেন সে শ্রীকৃষ্ণের চরণের কাছে এসে অপেক্ষমান। বর্বরীক শ্রীকৃষ্ণের কাছে হাত জোড় করে প্রার্থনা করলেন, প্রভু, আমার এই তির তার কাঙ্ক্ষিত কার্য সমাপ্ত করতে পারছে না। আপনার চরণতলে একটি পাতা অবশিষ্ট থেকে গেছে। আপনি কৃপা করে আপনার পায়ের তলা থেকে ওই পাতাকে মুক্তি দিন। শ্রীকৃষ্ণ বর্বরীকের ক্ষমতা অনুমান করতে পারলেন। বিস্মিত হলেন স্বয়ং ভগবানও। অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী বর্বরীক। তবে শ্রীকৃষ্ণকে যে বিষয়টা ভাবিয়ে তুলছে তার হলো, বর্বরীকের মায়ের দেওয়া আদেশ। মাতৃ আদেশ বর্বরীক অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে প্রস্তুত। মা বর্বরীককে বলেছে, সব সময় পরাজিত দলের পাশে থাকতে, তাদের হয়ে লড়াই করতে। এহেন আদেশ ভাবিত করে তুলছে স্বয়ং ভগবানকে। প্রতিদিন যুদ্ধ শেষে যেকোনো একটা দল এগিয়ে থাকবে। অপর দল থাকবে পিছিয়ে। বর্বরীক পিছিয়ে পড়া দলের হয়ে লড়াই করবে। এভাবে তো যুদ্ধের পরিণতি কখনোই হবে না। অনন্তকাল ধরে চলবে এই ধর্মযুদ্ধ। শ্রীকৃষ্ণ বর্বরীককে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের ভয়াবহ রূপ
প্রত্যক্ষ করালেন। তার কারণে যুদ্ধে কোনোভাবেই সমতা আনা সম্ভব হচ্ছে না। স্বচক্ষে দেখা এই ভয়ংকর বাস্তবতা ভাবিয়ে তোলে বর্বরীককে। চিন্তায় বিচলিত হয়ে ওঠে তার মন। এই সমস্যার সমাধান কীভাবে সম্ভব? বারবার এই প্রশ্ন করতে থাকে নিজের মনকে।
শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং বর্বরীকের কাছে যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটানোর জন্য তার আত্মবলিদান প্রার্থনা করেন। হাসিমুখে শ্রীকৃষ্ণের এই প্রার্থনা মেনে নেয় বর্বরীক। বর্বরীক নিজে বাণ দিয়ে নিজ শিরশ্ছেদ করে শ্রীকৃষ্ণের চরণে নিজমস্তক নিবেদন করেন। তাঁর এই স্বেচ্ছামৃত্যু ভাবিয়ে তোলে সকলকে। পুত্র হারিয়ে শোকে বিহ্বল হয়ে বিলাপ শুরু করেন ঘটোৎকচ। মহাবলী ভীমও প্রপৌত্র হারিয়ে নিজেকে অসহায় মনে করেন।
মহাভারতের যুদ্ধে যোগ দিতে আসার একটাই উদ্দেশ্য ছিল বর্বরীকের। ইচ্ছা ছিল মহাভারতের যুদ্ধের প্রত্যক্ষদর্শী হয়ে থাকার। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তার সেই ইচ্ছা ব্যর্থ হতে দিতে চান না। যে আত্মবলিদান বর্বরীক দিয়েছে ভগবান তার অন্তিম ইচ্ছা পুরণ করতে বাধ্য হলেন। কুরুক্ষেত্রে এই ভয়াবহ যুদ্ধের একমাত্র প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে বর্বরীকের ছিন্নশির নিজ হস্তে পর্বতের শিখরে স্থাপন করলেন। তিনি কথা দিলেন পৃথিবীতে বর্বরীক খাটু শ্যাম নামে বেঁচে থাকবে। কোনো অসহায় ব্যক্তি যদি খাটু শ্যামের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করেন তা অবশ্যই পূরণ হবে। পঞ্চপাণ্ডবকে তিনি আশ্বস্ত করেন, এটা বর্বরীকের জীবনের শেষ
নয়, এই বলিদানের মধ্য দিয়েই বরং তার জীবনের শুরু। এই শিখরে বসেই মহাভারত যুদ্ধে প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে অমর হয়ে থাকবে বর্বরীক। যে স্বেচ্ছায় নিজমস্তক ঈশ্বরের চরণে অর্পণ করতে পারেন তার বলিদান বিফলে যাবে না। অমর হয়ে থাকবে সে চিরকাল। বর্বরীক খাটু শ্যাম নামে আজও বেঁচে আছেন। মহাভারতের যুদ্ধস্থল কুরুক্ষেত্রে আজও কোনো অসহায় মানুষ বর্বরীকের কাছে প্রার্থনা করলে তা পূরণ করেন বর্বরীক অর্থাৎ খাটু শ্যাম। এই
আশীর্বাদ স্বয়ং ভগবান শ্রীকৃষ্ণ দিয়েছেন তাঁকে।

















