নির্বাচন কমিশনের সদর্থক ভূমিকা ভারতীয় গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করবে
খগেন্দ্রনাথ মণ্ডল
শ্রী জ্ঞানেশ কুমার ভারতের ২৬তম মুখ্য নির্বাচন কমিশনার নির্বাচিত হওয়ার পর থেকেই বিরোধী রাজনীতিকরা তার বিরুদ্ধে নানা অভিযোগে সরব হয়েছেন- বিশেষ করে নভেম্বর ২০২৪-এ মহারাষ্ট্রের বিধানসভা ভোটে কারচুপি করে বিজেপি জোট ক্ষমতায় এসেছে- এমন অভিযোগে বিদ্ধ নির্বাচন কমিশন। যদিও নভেম্বর ২০২৪-এ জ্ঞানেশ কুমার নির্বাচন কমিশনে যোগদানই করেননি, তিনি ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫-এ মুখ্য নির্বাচন কমিশনার হিসেবে কাজে
যোগ দেন। বিরোধীরা কোনো নির্বাচনে কোথাও জনসাধারণের দ্বারা প্রত্যাখ্যাত হলেই তাদের কোপে পড়ে নির্বাচন কমিশন। আবার পঞ্জাব, কর্ণাটক, তামিলনাড়ু, পশ্চিমবঙ্গ বা কেরালায় জিতলে, তখন জনতা- জনার্দনের রায়ে তারা আপ্লুত হন- নির্বাচন কমিশন বা নিষ্প্রাণ ভোটিং মেশিনের বিরুদ্ধে রা কাড়েন না। এধরনের অভিযোগ মূলত শোনা যায় প্রধান বিরোধী দলের দাপুটে নেতা-রাহুল গান্ধীর মুখে এবং তাঁকে আমল দিতে না চাওয়া নেত্রী মমতা ব্যানার্জির মুখে- এরা কথায় কথায় নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে মারেন, অথচ একটি অভিযোগও প্রমাণের দায় নেন না। যেহেতু, নির্বাচন কমিশনের মতো একটি স্বাধীন সংবিধানিক সংস্থার পক্ষে বিতর্কে নামা এবং প্রতিটি কুৎসার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ তাদের মর্যাদার পরিপূরক নয় বলেই বেপরোয়া রাজনীতিকদের অভিযোগ সীমাহীন।
ভারতবর্ষ পৃথিবীর সর্ববৃহৎ গণতন্ত্র-এ বিষয়ে আমাদের শ্লাঘার শেষ নেই- কথায় কথায় সর্বজনগ্রাহ্য গণতান্ত্রিক দেশ আমেরিকার প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম
লিঙ্কনের উদ্ধৃত দিয়ে থাকেন অনেকে- ‘Democracy is a Government of the people, by the people and for the people.’ এই সংজ্ঞাটির সর্বাপেক্ষা তাৎপর্যপূর্ণ অংশটি হচ্ছে ‘By the people’ অথচ যারা নির্বাচনে নির্বাচকমণ্ডলীর অংশগ্রহণ এবং তাদের মতামত প্রতিফলনে বাধাদানে নিয়ত
প্রয়াসী, তারাই গণতন্ত্রের বুলি বেশি আওড়ান। গণতন্ত্রের আকার-আয়তন দিয়ে উৎকর্ষ মাপা যায় না। প্রত্যেক নাগরিকের অবাধ এবং নিরপেক্ষ অংশগ্রহণ নিয়ে গণতন্ত্রের সফলতা প্রমাণিত হয়। দেখা যাক এর প্রতিফলন ভারতীয় নির্বাচনে কীভাবে ঘটছে।
প্রবীণদের অনেকেই মনে করতে পারবেন টিএন শেষন নামক ভারতের নির্বাচন কমিশনারের নাম– তিনি ভারতে সচিত্র পরিচয়পত্রের সূচনা করেন। তখনও কিন্তু আজকের SIR (Special Intensive Revision) এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদের মতোই পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থীরা (জ্যোতিবাবুর সরকার) কমিশনার শেষন সাহেবের বিরুদ্ধে (১৯৯০-১৯৯৬ সাল পর্যন্ত দায়িত্বে) অকথ্য গালিগালাজ করতেন, যেমনটি করছেন বর্তমানের লালু-ভুলুরা- বক্তব্য ছিল ভারতবর্ষের
মতো দেশে সচিত্র পরিচয়পত্র করিয়ে ভোট করা সম্ভব নয়, এ কাজে এগোলে কোটি কোটি প্রকৃত ভোটার বাদ পড়বে এবং গণতান্ত্রিক উপায়ে ভোট পর্ব ব্যাহত হবে। মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু টিএন শেষন সাহেবকে উন্মাদ বলে অভিহিত করলেও জ্যোতিবাবুরা তটস্থ থাকতেন পরের নির্বাচন পর্যন্ত শেষন ক্ষমতায় থাকলে বৈজ্ঞানিক রিগিং বাধাপ্রাপ্ত হওয়ার ভয়ে। কারণ তখন বিচার বিভাগের অতি সক্রিয়তা ছিল না, প্রত্যেকটি সাংবিধানিক সংস্থা নিজের এক্তিয়ার সম্পর্কে সতর্ক এবং অন্যের অধিকারে অনধিকার চর্চা থেকে বিরত থাকত, যাতে কোনো সাংবিধানিক সংকট তৈরি না হয়। শেষন জানতেন তিনি একটি
সাংবিধানিক পদে আছেন এবং একমাত্র ভারতের রাষ্ট্রপতির কাছে, তথা সংবিধানের কাজ দায়বদ্ধ। তাই তিনি সরবে ঘোষণা করেছিলেন- ‘I am the
Election Commissioner of India- not Government of India.’ শেষন সাহেব নির্বাচন কমিশনকে এক মর্যাদার অবস্থানে উন্নতি করেছেন। বর্তমানে নির্বাচন কমিশনার জ্ঞানেশ কুমারও যদি সংবিধান এবং কমিশনের নিরপেক্ষতা ও মর্যাদা রক্ষা করে ভোটার লিস্ট সংশোধন কঠোরতার সঙ্গে সম্পাদন করতে পারেন কোনো চাপের কাছে নতি স্বীকার না করে, তার পূর্বসূরী টিএন শেষন-এর মতো শিরদাঁড়া সোজা রাখতে পারেন, তাহলে ভারতীয় গণতন্ত্র সফল হতে পারবে। এই সফলতা শুধুমাত্র ভোটার লিস্ট পরিমার্জনের মাধ্যমেই হবে না- তবে নিঃসন্দেহ এটি প্রাথমিক পদক্ষেপ। যে কোনো রাজ্যে লক্ষ লক্ষ ভুয়ো ভোটারের অস্তিত্ব নির্বাচন ব্যবস্থাকে কলুষিত করবে নিঃসন্দেহে। কয়েক দশক ধরে পশ্চিমবঙ্গে সরকারি দল সমূহ ভোটার লিস্টে নাম থাকা
মৃত ভোটার, দেশত্যাগী বা রাজ্যত্যাগী ভোটার, একাধিক জায়গায় নাম থাকা ভোটারদের প্রক্সি ভোটের নিপুণ ব্যবহার করে থাকে। একথা দিনের আলোর মতো স্বচ্ছ পশ্চিমবঙ্গে বিরোধী এজেন্ট শূন্য বুথে বা বিরোধী এজেন্টদের মারধর করে বের করে দিয়ে ভোটার লিস্টে নাম থাকা প্রতিটি ভোটের সদ্ব্যবহার করে। ভোটের আগের দিন থেকে সরকারি দলের কর্তারা পুলিশকর্মী, নির্বাচন-কর্মীদের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা দেখভাল করেন– সেই দাপুটে নেতারা
নির্বাচনের দিন বেশ কয়েক ঘণ্টা পার হওয়ার পরে সদলবলে লিস্ট দেখে ভোটগুলি কাস্ট করালে কার সাধ্য তাদের বাধা দেয়। কেন্দ্রীয় বাহিনীর বুথে প্রবেশের অধিকার নেই, ক্যামেরা কাজ করে না, বিরোধী এজেন্ট শূন্য বুথে সরকারি দল ছাপ্পা মারলে তার রুখে দেওয়ার সাহস এবং সদিচ্ছা ভোট কর্মীদের
থাকার কথা নয়। তাছাড়া sleeping ভোটারদের ভোট নিয়ে হইচই হয় না, কারণ তাদের উপস্থিতি নেই। কোনো প্রকৃত ভোটার ভোট দিতে না পারলে এবং প্রতিবাদ করার সাহস থাকলে চিৎকার চেঁচামেচি হয়তো হয়, ভুতুড়ে ভোটারদের ক্ষেত্রে সবকিছু সম্পূর্ণ নিরাপদ। সুতরাং অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের পূর্বশর্ত হচ্ছে সঠিক ভোটার লিস্ট তৈরি, যাতে কোনো প্রকৃত ভারতীয় ভোটার বাদ না পড়ে এবং কোনো অনাগরিক বা অবৈধ ব্যক্তির নাম ভোটার লিস্টে না থাকে।
শুদ্ধ ভোটার লিস্টে নাম থাকা প্রত্যেক ব্যক্তি যাতে তার ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারে তা নিশ্চিত করাও অন্যতম কর্তব্য নির্বাচন কমিশনের। পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজ্যে যেখানে বাড়ি বাড়ি গিয়ে সরকার বিরোধী ভোটারদের বাড়ি থেকে না বেরোনোর হুমকি দেওয়ার অভিযোগ ওঠে প্রায়শই সেখানে ভোটের আগে ও পরে উপযুক্ত নিরাপত্তার ব্যবস্থা না থাকলে, অনেক ভোটার সাহস করে বাড়ির বাইরে বুথমুখী হবেন না। সেক্ষেত্রে, নির্বাচন কমিশনের নিরাপত্তা দানের ভূমিকা অতীতে সন্তোষজনক না হওয়ায় এবং ভোটের আগে-পরে প্রচুর মানুষের প্রাণহানি হওয়ার, সাধারণ মানুষ বুথমুখী হওয়ায় সংশয়ান্বিত, তাহলে কীভাবে অবাধ নির্বাচন সম্ভব? বিরোধীদের দাবি মতো কেন্দ্রীয় বাহিনী নিয়োগ করলেই চলবে না, তার প্রয়োগ যথাযথ না হলে কমিশনের প্রতি মানুষ আস্থা হারাবেন।
তৃতীয়ত, ভোটের কাজে দায়িত্বপ্রাপ্ত কোনো পদাধিকারীকে পক্ষপাতদুষ্টতার জন্য দায়িত্বে অব্যাহতি দেওয়া হলেও, ভোেট পরবর্তীকালে তার পদোন্নতি হয়, এমনকী পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনা হয়। এধরনের নির্বিষ শাস্তিতে কাজের কাজ কিছু হয় না, যদি না তা পরবর্তীতে পদোন্নতির অন্তরায় না হয়। অবাধ নির্বাচনের প্রয়োজনে কমিশনকে আরও বেশি কঠোর হতে হবে, প্রয়োজনে বিধি বদলাতে হবে। এছাড়াও ভোট গণনায় প্রত্যেক প্রার্থীর কাউন্টিং এজেন্ট উপস্থিত থাকা বাধ্যতামূলক করা প্রয়োজন।
এসআইআর বা বিশেষ নিবিড় সংশোধন করার সময় ভোটার তালিকাগুলির মধ্যে ২০০৩ সালের তালিকাকে ভিত্তি হিসেবে ধরলে বঞ্চিত হবে লক্ষ লক্ষ বাংলাদেশি হিন্দু যারা ২০১৪-এর ডিসেম্বরের মধ্যে ভারতে এসেছেন— যাদের ২০১৯ সালের সংশোধিত নাগরিক আইনে ইতিমধ্যেই De facto নাগরিক হিসেবে মেনে নেওয়া হয়েছে, যদিও তাদের মধ্যে বেশিরভাগ মানুষ এখনো প্রথাগত নাগরিক কার্ড বা Formal Citizenship Certificate এখনো নেননি,
কিন্তু তাদের কাছে ভোটার কার্ড, আধার কার্ড, রেশন কার্ড রয়েছে। যদি দেখা যায় ওই সমস্ত দলিল, কার্ড ২০১৪ সালের মধ্যে প্রাপ্ত হয়েছেন, সেক্ষেত্রে যেন তাদের ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করা না হয়, বিএলও-দের প্রশিক্ষণকালে এধরনের নির্দেশ দেওয়া প্রয়োজন।
জাতির সামনে বর্তমানে একটি গভীর সংকট এসে উপস্থিত হয়েছে। বেআইনি অনুপ্রবেশকারীদের প্রভাবে শুধুমাত্র সীমান্ত রাজ্যগুলিই নয়, ভারতের সবকটি মেট্রো শহরে বাংলাদেশি বে-আইনি অনুপ্রবেশকারী এবং বাংলাদেশ হয়ে ভারতে আসা লক্ষ লক্ষ রোহিঙ্গারা শুধু জন-ভারসাম্য পালটে দিচ্ছে তা নয়– আইন-শৃঙ্খলাজনিত সমস্যা, এমনকী দেশের অখণ্ডতা রক্ষার ক্ষেত্রেও বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে। অনুপ্রবেশকারীদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দেশ দেবে কিনা তা সরকার বা দেশের মানুষ ঠিক করবেন, তবে এরা যাতে দেশের নির্বাচন ব্যবস্থাকে কলুষিত বা প্রভাবিত করতে না পারে সে ব্যাপারে এসআইআর একটি বড়ো পদক্ষেপ। নির্বাচন কমিশন কোনো হুমকি বা প্রতিবাদে প্রভাবিত না হয়ে নিজেদের কর্তব্যে স্থির থাকবেন এটাই প্রত্যাশা, অন্যথায় গণতন্ত্র ভূলুণ্ঠিত
হবে। আর বাংলাদেশের অনুপ্রবেশের ফলে সীমান্ত রাজ্যগুলিতে জনসংখ্যার ভারসাম্য পালটে যাচ্ছে অর্থাৎ Demographic im- balance-এর জন্য সামাজিক এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং দাঙ্গা পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে তা কীভাবে সামলানো যাবে, তা নিয়ে সরকার এবং রাষ্ট্রবাদী রাজনৈতিক
দলগুলি আশু ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে, আমাদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। আমরা যেন ফরাসী দার্শনিক Auguste Comte-র সতর্ক বাণী ভুলে না যাই- ‘Demography is destiny’ অর্থাৎ জনবিন্যাসই একটি জাতির ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করে।