আমেরিকা ও চীনের দড়ি-টানাটানির মাঝে শক্তিধর ভারতের আত্মপ্রকাশ
মার্কিন মুলুকে একটি বিষয় জোর চর্চা চলে ডোনাল্ড ট্রাম্প যত না রাজনীতিবিদ তার থেকেব্যবসায়িক প্রবণতা তার বেশি। ট্রাম্পের নির্বাচনে আমেরিকার তেল কোম্পানিগুলি প্রচুর অর্থ বিনিয়োগ করেছিল। ট্রাম্প এখন তার প্রতিদান দিতে ব্যস্ত।
ড. পঙ্কজ কুমার রায়
ডোনাল্ড ট্রাম্প হুমকি দেন ভারত যদি রাশিয়া থেকে তেল কেনা বন্ধ না করে তবে আমেরিকা ভারতের ওপর কঠোর sanction বা আর্থিক নিষেধাজ্ঞা জারি করবে। ভারত আর রাশিয়ার কাছ থেকে তেল কিনছে কিনা তা আমেরিকা লক্ষ্য রাখছে। যার অর্থ ট্রাম্পের হুমকিতে ভারত ভয় পেয়েছে কিনা? বাস্তব
হলো রাশিয়ার সঙ্গে ভারতের তেল চুক্তি অনেক দিনের, যা রাতারাতি থামানো সম্ভবপর নয়।যা আমেরিকার কাছেবড়ো ধাকা। ‘New York Times’-এ প্রকাশিত তথ্য থেকেজানা যায়, নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দুই আধিকারিক জানিয়ে দেন ভারতের তেল নীতির কোনো পরিবর্তন ঘটবে না। এটা তেল কেনা বা না কেনা নয়, ভারতের সার্বভৌমত্বের সঙ্গে কোনো আপোশ করা হবে না। ভারতের Global Trade Policies-এর ক্ষেত্রে নতুন মাত্রা যুক্ত হয়েছেযার সারমর্ম হলো ‘No pressure no surrender’। মনে রাখতে হবে, এই ভারত ১৯৯০-এর ভারত নয়, ২০২৫-এর ভারত যাকে সারা পৃথিবী বিশ্বগুরুর মর্যাদা দিয়েছে।
প্রশ্ন হলো, ভারত কেন এত বড়ো একটা ঝুঁকিনিচ্ছে? পুরনো বন্ধু রাশিয়ার সঙ্গে বন্ধুত্ব চলে যেতে পারে ভেবেনা অন্য কোনো কারণ আছে? অর্থনৈতিক কারণ হলো, ভারত রাশিয়ার কাছ থেকে যে তেল পাচ্ছেতা ভালো মানের শুধু নয়। বাজার দামের থেকে অনেক কম দামে। পূর্বতন বৈঠকে জি-৭ ৬০ ডলার প্রতি ব্যারেলের দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে। রাশিয়া থেকে ভারত তার থেকেও কম দামে তেল কিনে আন্তর্জাতিক আইন-সহ তেলের গুণমান ও নিজস্ব স্বার্থও বজায় রাখল। এর ফলে ভারতের অয়েল পুল ঘাটতি নিয়ন্ত্রণের মধ্যে থাকছে, বাজার দাম নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভবপর হচ্ছে এবং মুদ্রাস্ফীতির লাগাম দেওয়া যাচ্ছে। বিদেশী মুদ্রাও সুরক্ষিত রাখা সম্ভবপর হচ্ছে। ভারতের বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয় ৩০৪ বিলিয়ন ডলার থেকে বেড়ে ৭০৪ বিলিয়ন ডলার হয়েছে ২০১৪ থেকে ২০২৫-এর মধ্যে। স্ট্যাটেজিক পেট্রোলিয়াম নীতি ভারত অনুসরণ করছে। প্রত্যেক দেশ যুদ্ধ বিগ্রহ ও অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা মাথায় রেখে তেল মঞ্জুত রাখে। ভারতেরকাছে মজুত তেল জীবনদায়ী অর্থনীতির হাতিয়ার হয়ে উঠতে পারে।
ভারত তার স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতির বার্তা বিশ্বের কাছেদিয়ে রেখেছে। ভারতস্পষ্ট করে দিয়েছে আমেরিকার সঙ্গে সম্পর্ক থাকবে কিন্তু রাশিয়ার সঙ্গে বন্ধুত্ব বিসর্জন দিয়ে নয় যা Multi Alignment Policies নামে পরিচিত। সবার সঙ্গে সম্পর্ক থাকবে কিন্তু নিজের দেশের স্বার্থ সবার আগে। ট্রাম্প ভারতকে শুধু হুমকিই দেননি শুল্ক এক লপ্তে২৫ শতাংশ এবং অনতিবিলম্বে ৫০ শতাংশ করার কথা ঘোষণা করেছেন। ভারতের সঙ্গে আমেরিকার যখন ঠাণ্ডা লড়াই চলছিল তখন অপ্রত্যাশিত ভাবে বৈরী একটি দেশ ভারতের পাশে এসে দাঁড়ায় যার নাম চীন। চীনের সরকারি মুখপাত্র গ্লোবাল টাইমস ভারতের পক্ষে দাঁড়ায়।ভারত এখন Dynamic Balancing এর পথে হাঁটছে।যা Independent Foreign Policy নামে বেশি পরিচিত। জাতীয় স্বার্থে এই নীতি অনুসরণকরা হচ্ছে।
এটা কোনো খবর নয়, এটা একটি Diplomatic Master Stroke.
কোনোশক্তি চাইলেই এই নতুন ভারতকে ঘিরে ফেলতে পারবে না। অনেক শক্তি আছে যারা আমেরিকার প্রতিপক্ষ যাদের চোখ এখন ভারতের দিকে। ভারত এখন এতটাই ভারসাম্য রক্ষা করতে পারবে। মনে রাখতে হবে, ভারত একটা বাজার নয় বরং বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী দেশ। এই দড়ি টানাটানির খেলা
যতটা শক্তিশালী এতটাই ঝুঁকিপূর্ণ। যতদিন ভারসাম্যের নীতি চালিয়ে যাওয়াযাবে, ততদিন ভারসাম্যেরনীতি চালিয়েযাওয়াযাবে, ততদিন লাভ পাওয়া সম্ভব। কিন্তু এটা যদি একপক্ষের ভরসা নষ্ট করে, তখন অন্য পক্ষ দ্বিধায় পড়ে যায়। এটা সূক্ষ্ম ভারসাম্যের খেলা, যেখানে একটাভুল সম্পূর্ণ ভারসাম্যের অবস্থান বদলে
দিতে পারে। এই মুহূর্তেভারত No Pressure no Surrrender নীতি সামনে আনছে যা অর্থনৈতিকভাবে শোষণের বিরুদ্ধে।অন্যদিকে রয়েছে সব পক্ষের সঙ্গে বিশ্বাস রাখার পরীক্ষা। প্রশ্ন হলো, এই জটিল ভারসাম্য ভারত ভবিষ্যতে ধরে রাখতে পারবে? ভবিষ্যৎ এর উত্তর দেবে। Rubix Data Sciences-এর
সমীক্ষা অনুসারে, ২০২৪ সালে আমেরিকার ভারতের সাপেক্ষে বাণিজ্য ঘাটতি ৪৯.৫ বিলিয়ন ডলার।অন্যদিকে, আমেরিকার মোট বাণিজ্য ঘাটতি ওই বছরে ১.১ ট্রিলিয়ন ডলার। ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন ২৫ শতাংশ শুল্ক চাপিয়েছিল ভারত তখন F-16 (এফ-১৬) যুদ্ধবিমান ক্রয় চুক্তি বাতিল করেছিল। এখানেই শেষ নয়,ট্রাম্প শুল্ক দ্বিগুণ করে ৫০ শতাংশ করার পর ভারতীয় নৌবাহিনী ৩.৬ বিলিয়ন ডলারের ছয়টি পসেইডন এয়ারক্রাফট্ কেনার চুক্তি স্থগিত রাখে।ভারত এই বলে সতর্ক করে দিয়েছে যে, আমেরিকা এই শর্ত না মানলে ভারত দেশীয় প্রযুক্তির দিকে ঝুঁকবে।শুধুভারত নয়, স্প্যানিশ সরকারও এফ-৩৫ ফাইটার জেট কেনার চুক্তি বাতিল করেছে। পরিবর্তে তারা ইউরোপীয় ইউনিয়নের কাছ থেকে বিকল্পের সন্ধান করছে। এর অর্থ হলো, ভারতের দেখাদেখি অন্যান্য দেশও আমেরিকার একতরফা বাণিজ্য নীতি মেনে নেবে না।
ভারত ক্ষেপণাস্ত্র প্রযুক্তিতে এখন চীনের সমকক্ষ। আমেরিকার গণমাধ্যমগুলি ভারতের সামরিক ক্ষমতা দিয়ে আলোচনা করছে পুলওয়ামা পরবর্তী অপারেশন সিঁদুর নিয়ে। মার্কিন মুলুকে একটি বিষয় জোর চর্চা চলে ডোনাল্ডট্রাম্প যত না রাজনীতিবিদ তার থেকে ব্যবসায়িক প্রবণতা তার বেশি। ট্রাম্পের নির্বাচনে আমেরিকার তেল কোম্পানিগুলি প্রচুর অর্থবিনিয়োগকরেছিল।ট্রাম্প এখন তার প্রতিদান দিতে ব্যস্ত। ভারত তেলের বিরাট বাজার। আমেরিকার তেল সংস্থাগুলি মুনাফার জন্য সেই বাজার ধরতে চায়। ভারতের এত সাহস আমেরিকার কোম্পানিগুলি থেকে তেল না কিনে রাশিয়ার কাছ থেকে তেল কিনছে? আমেরিকার ব্যবসায়ীদের স্বার্থে লাগছে। এ ব্যাপারে আমেরিকার দোসর ন্যাটোও পিছিয়ে নেই। ন্যাটোর মহাসচিব মার্ক রুট ভারতকে এই বলে সতর্ক করেছে। ভারত যদি রাশিয়া থেকে তেল আমদানি বন্ধ না করে তবে ফল বিষময় হবে। ভারতও জানিয়ে দিয়েছে,ভারত অতীতেও কাউকে ভয় পায়নি, ভবিষ্যতেও কাউকে ভয় পায়না। অটলবিহারী বাজপেয়ীর প্রধানমন্ত্রিত্বে ভারত আমেরিকার রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে রাজস্থানের পোখরানে পরীক্ষামূলক পরমাণু বিস্ফোরণ ঘটিয়েছিল।ভারতের পক্ষ থেকে এই বিবৃতির পরন্যাটোরমহাসচিব মার্করুটের পায়ের তলার মাটি কেঁপেগিয়েছে।
জাতীয়নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল ও বিদেশমন্ত্রী ড. এস. জয়শঙ্কর চীন সফর শেষে রাশিয়ায় গেছেন। অন্যদিকে, প্রধানমন্ত্রীনরেন্দ্র মোদী চীন সফরে। আন্তর্জাতিকবাণিজ্যের তত্ত্ব অনুসারে দক্ষতাবৃদ্ধি ও শ্রমবিভাজনের কারণে মুক্ত বাণিজ্য সর্বদালাভজনক। বিগত শতকের শেষ লগ্নে অর্থনীতিবিদ জেমস ব্র্যাণ্ডার ও বারবারা স্পেনসারের গবেষণায় উঠে এসেছে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের বিষয়ে তাঁরা ব্যাখ্যা করেছিলেন একটি অর্থনৈতিক তত্ত্ব,যারনাম- ‘ইকোনমিক মডেল ইন ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড’।এই তত্ত্ব অনুযায়ী, বাণিজ্যিকভাবে শক্তিশালীদেশগুলি বিশ্ব-বাজারকে প্রভাবিত করতে পারে যা অর্থনীতির পরিভাষায় অলিগোপলি (oligopoly) রূপে খ্যাত। এই অবস্থায় প্রতিযোগিতা অল্প কয়েকজন বিক্রেতার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। এই ক্ষেত্রে মার্কেট স্ট্রাকচারবা বাজার অর্থনীতি নিয়ন্ত্রিত হয় কখনও শুল্ক বাড়িয়ে বা কমিয়ে।আবার কখনও ভরতুকিরমাধ্যমে। আমেরিকা ও চীন এই খেলাই খেলে চলেছে।বিশ্বগুরু ভারত এর অন্তর্বর্তী অবস্থায় দাঁড়িয়ে ভারসাম্যের খেলার সর্বোচ্চ সুবিধাগ্রহণ করছে।