রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ কারও বিরোধী নয়, দেশ সেবাই তাদের মূলমন্ত্র
অমিত কুমার চৌধুরী
‘রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ কি মুসলমান বিরোধী সংগঠন? এমন প্রশ্ন করেন ক্যান? শুনলে তো ঘোড়াতেও হাসব। এমন বোকা বোকা প্রশ্ন কেউ করে? এক দুগ্ধপোষ্য শিশুও জানে আরএসএস মুসলমান বিরোধী। দেশের অতি নগণ্য এক সাধারণ মানুষ থেকে বুদ্ধিজীবী সকলের কাছেই আরএসএস মুসলমানবিরোধী
বলে পরিচিত একটি সংগঠন।’রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্গেঘর শতবর্ষ পূর্তিতে এই সংগঠনটিকে নিয়ে এরকম বিভিন্ন আলোচনা দেশব্যাপী চলছে। এই
সংগঠনটির বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড়ো অভিযোগ এটি মুসলমানবিরোধী সংগঠন। একটু দেখা যাক, সত্যিই কি তাই?
যে কোনো সংগঠনের বৈশিষ্ট্য ফুটে উঠে তার আদর্শগত ভিত্তি ওকার্যকলাপ, তার তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক দিক কেমন, তার উপর। সঙ্ঘের তাত্ত্বিক বা আদর্শগত দিক হলো, এই সংগঠনটি বিশ্বাস করে-১.ভারতবর্ষহিন্দুরাষ্ট্র, ২.হিন্দুত্বই এদেশের রাষ্ট্রীয়ত্ব, ৩. এদেশের মূল সমাজ হিন্দু সমাজ, ৪. হিন্দু অনৈক্যের জন্য দেশ দুর্বল ও খণ্ডিত হয়েছে। ৫. দেশকে উন্নত ও শক্তিশালী করতে হলে হিন্দুদের মধ্যে ঐক্য ও স্বাভিমানবোধ জাগিয়ে তুলতে হবে।রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্রে প্রতিষ্ঠাতা ডাঃ হেডগেওয়ার এও বিশ্বাস করতেন যে এই সুপ্রাচীন দেশ এক সময়বিশ্বে শ্রেষ্ঠ দেশ ছিল। সেই দেশ ও সমাজের পতনের মূল কারণ হিন্দুরা, কোনো বিদেশি বা বিধর্মীরা দায়ী নয়। সুতরাং হিন্দুদেরকেই এগিয়ে আসতে হবে এদেশের উত্থানের জন্য। কারণ হিন্দুরাই এদেশকে পুণ্যভূমি বলে মনে করে।
এখন দেখা যাক উপরিউক্ত আদর্শগুলি কারও বিরোধী কি না। ১. আধুনিক গবেষণা অনুসারে প্রায় দশ হাজার বছরের এক প্রাচীন রাষ্ট্র,যা সুদূর অতীতকাল থেকে এক ঐতিহ্য পরম্পরাবয়েনিয়ে চলেছেআজ পর্যন্ত। কোনো বিদেশি গবেষক যদি রামায়ণ, মহাভারত, বেদ, উপনিষদ, রাম, কৃষ্ণ, দুর্গা,কালী প্রভৃতিনিয়ে গবেষণা করতে চায় তবে নিশ্চয় তিনি আমেরিকা, আফ্রিকা বা আরব দেশে যাবে না, নিশ্চিত রূপে ভারতেই আসবে। পশ্চিমবঙ্গে বাঙ্গালি ছাড়াও অন্যান্য ভাষাভাষী মানুষের বাস থাকা সত্ত্বেও পশ্চিমবঙ্গকে বাঙ্গালিস্থান, বঙ্গভূমি বলাটা যেমন অযৌক্তিক নয় ঠিক তেমনি ভারতের অধিকাংশ মানুষ হিন্দু সংস্কৃতি, ধর্ম মেনে চলায় ভারতকে হিন্দুরাষ্ট্র বলা কোনো অন্যায় বা অযৌক্তিক নয়। তাছাড়া ভারতে বসবাসকারী অহিন্দুরাযাদের পূর্বপুরুষ হিন্দু ছিল, যারা ধর্মান্তরিত হিন্দু, জাতিগতভাবে তারাও হিন্দু। ভারতের আর এক নাম হিন্দুস্থান।
২. কংপ্রেস সভানেত্রী, আইরিশ মহিলা, অ্যানি বেসান্তের মতে ভারতের মূল প্রোথিত রয়েছে হিন্দুত্বে। স্বামী বিবেকানন্দের মতে ভারতের আত্মা হচ্ছে ধর্ম (হিন্দুধর্ম) ঋষি অরবিন্দ ভারতের জাতীয়তাকে হিন্দুজাতীয়তা বলেছেন। দেশের সুপ্রিম কোর্ট হিন্দুত্বকে ভারতের হিন্দু জীবনধারা, জীবনদর্শন বলে স্বীকৃতি দিয়েছে। রবীন্দ্রনাথের মতে ভারতীয় সভ্যতার মূল আশ্রয়টি হলো সমাজ (হিন্দু) আর সেই সমাজ একান্তভাবে ধর্মের (হিন্দু) উপর প্রতিষ্ঠিত। এটি
হলো দেবাশ্রয়ী ধর্ম যাকে ধারণ করে গড়ে উঠা জীবনচর্যাই হলো হিন্দুত্ব।ইংল্যান্ডেরইংরেজত্ব, জার্মানির জার্মানিত্ব, ফ্রান্সের ফরাসিত্ব ঠিক তেমন ভারতের রাষ্ট্রীয়ত্ব ভারতীয়ত্ব বা হিন্দুত্ব। ৩. প্রখ্যাত ঐতিহাসিক ড. রমেশ চন্দ্র মজুমদার বলেছেন ভারতের মূল সমাজ হলো হিন্দু সমাজ। বর্তমানে ভারতে হিন্দুর পাশাপাশি অহিন্দুরা বাস করা সত্ত্বেও আমাদের সকলের পরিচয় বৃহত্তর অর্থে হিন্দু, কারণ বৌদ্ধ, জৈন, শিখ প্রভৃতি সম্প্রদায়গুলো হিন্দু ধর্মেরই শাখা।
বৃহত্তর অর্থে এরা সকলেই হিন্দু। মুসলমান ও খ্রিস্টান জনগোষ্ঠীর মতবাদ ভারতে উদ্ভূত নয়, বিদেশে। কিন্তু ওঁরাবিদেশ থেকেআসাজনগোষ্ঠী নয়।ভারতের মুসলমান ও খ্রিস্টানদের পূর্বপুরুষ সবাইহিন্দু।তাইজাতিগত ভাবে সকলেই হিন্দু। বোম্বে হাইকোর্টের বিচারপতি, ভারতের শিক্ষামন্ত্রী করিমভাই চাগলা বলেছেন, ভারতে বসবাসকারী মুসলমানরা জাতিগতভাবে হিন্দু। দিল্লির জামা মসজিদের শাহি ইমাম আবদুল্লা বুথারি মক্কায় হজ করতে গেলে তাকে আরবেরমুসলমানেরা হিন্দু বলেডাকে। রবীন্দ্রনাথ তাই হিন্দু-মুসলমান, হিন্দু-খ্রিস্টান শব্দ ব্যবহার করেছেন।
৪. ভারতের ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে হিন্দুরা যেখানে দুর্বল হয়েছে সেখানে তারা পরাজিতহয়েছে এবং সেই অঞ্চলগুলি ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। হিন্দু জনসংখ্যাহ্রাসের কারণে, হিন্দুঅনৈক্যের জন্যই ভারত দুর্বল ও টুকরো হয়েছে।আফগানিস্তান, পাকিস্তান, বাংলাদেশ তার উদাহরণ।বর্তমান ভারতেও যেসব অঞ্চলে হিন্দুরা দুর্বল ও অসংগঠিত, সেখানে হিন্দুদের অবস্থা শোচনীয়।আর সেই সব অঞ্চলেই বিচ্ছিন্নতার আওয়াজ শোনা যায়।
৫. রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, প্রয়োজন না থাকলেও হিন্দু নিজেকেই মারে,আর প্রয়োজন থাকলেওহিন্দু অন্যকে মারতে পারে না।আরমুসলমান কোনোবিশেষ প্রয়োজন না ঘটলেও নিজেকে দৃঢ়ভাবে রক্ষা করে। আর প্রয়োজন ঘটলে অন্যকে বেদম মার দিতে পারে। তার কারণ এই নয় মুসলমানেরগায়ে জোর আছে, হিন্দুর নেই। তার আসল কারণ, তাদের সমাজের জোর আছে, হিন্দুর নেই।স্বামীজী বলেছেন, হিন্দু পৃথিবীর যে প্রান্তেই বসবাস করুক না কেন, যে ভাষাভাবীই হোক না কেন, যে নামধারীই হউক না কেন, নিজ সন্তান বিপদে পড়লে যেমন তুমি উদ্বিগ্ন হও তেমন যে কোনো হিন্দুর বিপদে তুমিও উদ্বিগ্ন হবে। হিন্দুদের মধ্যে এমন একটি সংগঠন গড়ে তোলা প্রয়োজন যাহিন্দুদের পরস্পরকে ভালোবাসতে শেখাবে ঐক্যবদ্ধ করতে শেখাবে।শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন,’হিন্দুর সমস্যা এই যে,কি করিয়া তাঁহারা সঙ্ঘবদ্ধ হইতে পারিবেন এবং হিন্দুধর্মাবলম্বী যে কোনোব্যক্তিকেই ছোটো জাতি বলিয়াঅপমান করিবার দুর্মতি তাঁহাদের কেমন করিয়া এবং কবেযাইবে।’চিকাগো বিশ্বধর্মসভায় স্বামীজী নিজেকে হিন্দু সন্ন্যাসী হিসেবে পরিচয় দিয়ে হিন্দু স্বাভিমানবোধজাগ্রত করেছিলেন যা সকল হিন্দুর মধ্যে জাগ্রত করা প্রয়োজন বলে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের বিশ্বাস। সঙ্ঘের আদর্শগুলো কি মুসলমান বিরোধী? আর হলে, রবীন্দ্রনাথ, স্বামীজী, শরৎচন্দ্রেরকথাগুলো কি মুসলমান বিরোধী হবে? না, তা কখনোই নয়।
এবার সঙ্ঘের কার্যকলাপ বা ব্যবহারিক দিক দেখা যাক। সঙ্রে বিরুদ্ধে অভিযোগ যে তারাদাঙ্গাবাজ। বাজপেয়ীজীর ছয় বছর, নরেন্দ্র মোদীর এগারোবছর কেন্দ্রে সঙ্রে আদর্শে অনুপ্রাণিতলোকেরাই দেশ শাসন করছে অথচ দেশে কোনো দাঙ্গা হয় না।ব্যতিক্রম শুধু গুজরাট, তবুও তার জন্য জেহাদি মুসলমানরাই দায়ী, কারণ নিরীহ, নিরস্ত্র হিন্দুদের মুসলমানরাই পুড়িয়ে মেরেছিল।এছাড়া কোনো রাজ্যে বিজেপির শাসনে কোনো দাঙ্গার ঘটনা ঘটেনি। আজ পর্যন্ত কোনো দাঙ্গায়সঙ্ঘের নাম জড়ায়নি বা দেশের কোনো আদালত দাঙ্গার জন্য সঙ্ঘকে দোষী সাব্যস্ত করেনি। যদিসঙ্দাঙ্গা করতো তাহলে কেন সঙ্বিরোধী দলগুলো যারা দেশে বেশিরভাগ সময় শাসন করেছে, দাঙ্গা করার জন্য সঙ্ঘকে নিবিদ্ধ করেনি বা তাদের কার্যকর্তাদের বিচারের আওতায় এনে শান্তিদেয়নি? কারও কোনো ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানে সঙ্বাধা সৃষ্টি করেনি বা তাদের প্রতি বৈষম্যমূলকআচরণ করেনি। দেশের যখন যখন বিপদ এসেছেজাতিধর্ম নির্বিশেষে স্বয়ংসেবকরা সব সম্প্রদায়েরমানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে। গুজরাটের মোর্ভিতে একবার বন্যায় মুসলমান ভাইদেরও স্বয়ংসেবকরাসাহায্যই শুধু করেনি তাদের নমাজ পড়ার ব্যবস্থা পর্যন্ত করেছিল। শাহবানু মামলায় সঙ্ ওই অসহায় মুসলমান নারীর আত্মমর্যাদাকে সম্মান জানিয়েছে। এপিজে আবদুল কালাম দেশের রাষ্ট্রপতি হলে তৎকালীন সঙ্ঘের সরসঙ্চালক কেএস সুদর্শন তাকে অভিনন্দন বার্তা পাঠিয়েছিলেন।নরেন্দ্র মোদীরশাসনকালে সবকা সাথ, সবকা বিকাশ নীতিতে সমস্ত সরকারি সুযোগ সুবিধা হিন্দুর সঙ্গে মুসলমানেরাওসমানভাবে উপকৃত হচ্ছে, কোনো বৈষম্য করা হয়নি মুলমানদের প্রতি। জন ধন যোজনা, আবাস যোজনা, আবুম্মান ভারত যোজনার সব সুযোগ মুসলমানেরাও পাচ্ছে। সিকান্দার বখ, আরিফবেগ, শাহ নওয়াজ হোসেন,মাফুজা খাতুন প্রমুখ নেতা-নেত্রীরা বিজেপি দলে সম্মানের সঙ্গেছিলেনও আছেন। রাষ্ট্রীয় মুসলিম মঞ্চ বলে সঙ্ অনুপ্রাণিত একটি সংগঠন আছে যার উদ্দেশ্য যত রাষ্ট্রভক্ত মুসলমান আছেন তাদেরকে জাতীয় জীবনের মূলস্রোতে নিয়ে আসা। কেউ বলতে পারেন সঙ্ঘে মুসলমান নেই কেন? সঙ্ঘে বহু রাষ্ট্রভক্ত মুসলমান আছেন। তাছাড়া হিন্দু সংগঠনে হিন্দুরাইথাকবে এটাই স্বাভাবিক। এটা মুসলমান বিরোধিতা নয়।কেউ বাণিজ্য বিভাগে পড়াশোনা করলেবিজ্ঞানের বিরোধী নয়। ব্যক্তির রুচি, প্রয়োজন অনুসারে তার পথ সে বেছে নেয়। কোনো ব্যক্তিব্যায়াম করে তার শরীর সুগঠিত করলে অন্যের আশঙ্কারকারণ হতে পারে না।হিন্দু সমাজ দুর্বলঅসংগঠিত,তাই হিন্দু সমাজের স্বার্থে হিন্দুদের সংগঠিত করা মুসলমান বিরোধিতা নয়।
তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক দৃষ্টিকোণ থেকে কোনোভাবেইসঙ্কে মুসলমান বিরোধী বলা যায় না।যারা দেশ বিরোধী, তারা হিন্দু বা মুসলমান হোক, কেবলমাত্র তাদের বিরোধী।